
ভবানী বিশ্বাস-এর কবিতাগুচ্ছ
উন্মোচন
এই যে গভীর রাত
হ্যারিকেনের আলোয় একা
ভাবছি কেবল–
ভাবনা একপ্রকার উন্মোচন
পৃথিবীতে গুপ্ত আসলে কিছুই নেই
নিজেই অজান্তে প্রকাশ করি
স্নান আসলে ধুয়ে যাওয়া
গোপন গুপ্তচিহ্ন…
শ্যাম আমার
কে ডাকে! কে বাজায় সুরেলা বাঁশি?
তুমি! প্রিয় শ্যাম আমার…
হাওয়া বয়,
ভেসে আসে কাতর ডাক–
স্থির,শান্ত হয়ে বসে থাকি
চেতন থাকে না
শূন্য হয়ে যায়
তীব্র কান্না পায়–
মা কাঁদে ঠাকুরঘরে
প্রিয় শ্যাম আমার,
কাকে ডাকো তুমি!
সবার বুক ভেসে যায়
কিছু স্বপ্ন আসলে থেকে যায়
পাথরে লেখা
স্বপ্নও আজ মুছে গেছে!
ঢেউয়ে ভেসে গেছে সংসার
আর ছোটাছুটি হবে না,
কথাগুলোও ধীরে ধীরে
মুছে যাবে…
গ্রামও একদিন নগর হবে–
বহুদিন পর যখন একা হবে
হাতে থাকবে কবিতা!
তখন একবার বলো,
কিছু স্বপ্ন আসলে মোছা যায় না…
অকারণ
তীব্র রোদে সেগুন তলায়
কাকে খুঁজি!
পাখির মতো চিৎকার করি
নিজের আর্তনাদ
নিজেই গিলে ফেলি
অন্ধের মতো গাই
জমির এ আল থেকে
ওই আলে দৌড়াই–
খুঁজি,
যাকে পাওয়া যায় না–
স্নেহ
পুকুরে এখন ছায়া নেই
বিকেলে ওইপাশে চলে যায় সূর্য…
পাড়ে বসে জলে আকাশ দেখি
অপেক্ষা করি–
তারপর কাছে যাই,
তীব্র জ্বর নিয়ে তুমি তাকাও–
কপালে হাত রাখি
ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দিই শরীর
আমি তখন মা হই
সন্তান স্নেহে সেবা করি
সংসার কথা
মাটির ঘরের যুদ্ধ বলতে
পানের বাটা আর বিড়ির প্যাকেট।
ঘুম থেকে ওঠে সূর্যোদয়ের মতো
কে দেখে পানের বাটা!
কাশতে কাশতে কে ধোঁয়া ওড়ায়?
ধোঁয়া আর পানের বাটার সংঘর্ষ
ঠান্ডা যুদ্ধের মতো,
সারাদিন চুপচাপ অথচ
ভিতরে ভিতরে যুদ্ধ–
এভাবে চলতে চলতে শ্মশান থেকেও
শোনা যায় যাঁতির আওয়াজ
অথবা ধোঁয়ার দৃশ্য–
পাষাণ
আমার লাইগ্যা ভাইব্ব না
ভাবলে মানুষ মৌন হয়
আমি চাই না তুমি ঋষি হও
তুমি বরং পাখি হইয়ো
উইড়া আইয়ো আমার কাছে
আদর কইরা জল দিমু
হাত দিয়া মুইচ্ছা দিমু সারা গাও।
তুমি থাইক্ক আমার কাছে।
আমার কথা ভাইব্বা কষ্ট পাইও না।
তুমি কষ্ট পাইলে ভাইঙ্গা যায় আমার বুক।
বুক ভাঙ্গলে মানুষ পাষাণ হয়—
বিলীন
তোমার মৃতদেহ পুষি বুকের ভেতর
কেউ দেখে না
বোঝে না
আগুন জ্বলে,
দেহ হয়ে ওঠে পঞ্চভূত
ছাড়তে পারি না
রাখতেও না
কান্না আর মৃতদেহ নিয়ে
বিলীন হয়ে যাই পঞ্চভূতে…
কাছে থাকা
যখন একা থাকি তখন
আসলে একা থাকি না
মনের ভিতর থাকে ঘরের মানুষ
সে আগলাইয়া ধরে চাদরের মতন
তার সাথে বইয়া থাকি
হয়তো শুইয়া পড়ি তার কোলে
কোনো এক নির্জন পূর্ণিমা রাইতে
চাঁপা গাছের নিচে বইয়া থাকি–
যেমন থাকি ঠাকুরঘরে
অথবা মন্দিরে…
বাঁধন
মনে পবিত্রতা থাকলে
ভালোবাসা ঝইরা পড়ে কৃষ্ণচূড়ার মতো
সেদিন যেমন পড়ছিল!
দু’জন তাকাইয়া ছিলাম ফুলের দিকে..
তোমারে বাঁধতে দড়ি লাগে না
শতপ্যাঁচে আটকাইয়া আছো আমার ভিতরে
মানুষ রাখতে চাইলে কেউর সাধ্য নাই
তারে ছুটাওনের।
তুমি থাইক্যা যাইও
যেমন আছে পরান পাখি!
ভিন্ন ও সরল লেখা। ভারি সুন্দর।
স্বতন্ত্র অনুভব ও তার প্রকাশ। গভীর পর্যবেক্ষণের অনুভবী উপস্থিতি ভবানী বিশ্বাসের প্রতিটি কবিতায়।