ঊর্ণনাভ চট্টোপাধ্যায়-এর কবিতা
আখরজন্ম
অনেক ক্ষতির পরে সেই তো সুদিন আমাদের
মুগ্ধ যেখানে চিরঅভিনব আতিথ্যফলক
ধ্বংসে যেখানে উঠে আসে প্রিয় আত্মলীন নাচ
কি অমেয় মুক্তি দেখি তার মাঝে উপস্থিতিকালে
অন্বয়বিচলিত আমাদেরই আরব্ধ ভুবন,
বিহঙ্গশরীর আনে এখন এ মনোপ্রেরণায়।
অাসলে ছলনা নেই, মুক্তিপ্রসঙ্গ সকাতর
সকাতর ভালোবাসা, সকাতর জড়েরও ভূমিকা
তাছাড়া সীমিত নয় জীবনের অলক্ষ্য আকাশ
অথচ প্রায়শ ঢেউয়ে ভেসে আসে বিষপানজ্বালা
সেই দোষ গায়ে মেখে ঘরে ফিরি নিয়তিবিহীন।
যদিও এখন জানি কোথাও রয়েছে সেই নিরাময়লোক
বাক জেগে আছে তার অনাহত ছন্দগভীরে
এবার সময় তবে, নিয়ত আখরজন্ম দাও।
ঘটনাবহুল
এই যে অনর্গল মাদকতা ছড়িয়ে রেখেছো যেন অভিলাষ
সকল ক্ষতের নিরাময় হয়ে তোমার দু’হাতে ফুটে আছে ফুল,
নিরবকাশের চেয়ে অপলক তবু সেই পরমোৎসবে
মাথার ওপরে যদি নিভৃত অপার শামিয়ানা, নীচে সাময়িক
অপূর্ণতার মাঝে গোপনীয় কথোপকথনটুকু চেনা যায়
কত তুমি কথা বলো, মৃদুল আশ্বাস তার জমে থাকে প্রতিটি পরতে।
এখানে হৃদয় শুধু নির্ভুল যন্ত্র নয় আর, স্বেচ্ছাবসরের মাঝে
জেগে থাকা তৃণাঙ্কুর নয়,
কখনও সম্বিৎজুড়ে যা বেড়ে ওঠে অসহনিবিড় প্রায় সমস্ত উদ্ভাসে।
আসলে কোথাও কোন স্বগতগভীরে এই দৃশ্যত সবুজ
অপরিজ্ঞাত তবু নৈকট্যের বিনম্র আভাস নিয়ে ত্রাণ আবিষ্কার
নক্ষত্রের মুক্তালোক গায়ে মেখে আজও বেঁচে থাকা অপ্রকাশিত
যেন করপুটে সামান্য আশ্রয় ভেবে ভুল, মুঠো খুললেই
তুলনাবিহীন তুমি কথা বলো অকৃপণ, ঘটনাবহুল।
বিনিময়ে কতটুকু চাই
অসহিষ্ণু নও, গাছেদের সব প্রত্যুত্তরে যেমন নির্যাস
গ্রহাণুপুঞ্জের মতো মানুষের মনে সাময়িক
বিরামহীন সুখ হয়ে বাজে
ঠিক তারই অনুরূপ প্রতিটি আখ্যান লেখা হয়,
চোখের দর্পণে যত উপচিত আলো ছিল সেসব কোথাও
তখন স্থিরতা পায় – আমাদের আকাশ কি একা!
মানুষ ভালোবাসে মৃত্যুর মত ঢেউয়ে ঢেউয়ে বেঁচে থাকা
প্রতিটি স্রোতের পরে সন্নিধির মুখোমুখি দাঁড়ানো কেবল,
অভিন্ন শৈশবে তারা নিজেদের কাহিনী জেনেছে।
যদিও ভবিষ্যৎ ত্রুটিপূর্ণ আবিষ্কারে যত ধরা দেয়
অস্তিত্বের শর্তগুলি বিগত রাতের স্বপ্নে ঘর ফিরে পাওয়া
তেমন সৌভাগ্যের মতো মনে হয়,
এভাবে অতীত আর সাম্প্রতিক এক হয়ে থাকে।
অথচ কতটা বলি, বিনিময়ে কতটুকু চাই
সে আলাপ নয় আজ, নিমীলিত চোখের সংবাদ শোনা ছাড়া
স্থপতির সবকটি প্রাচীন ইঁটের মতো দামী
এই নিষ্কলুষ জল, এখানে শায়িত থাক অসতর্ক লিপি।
ভাষা
ভালোবাসা লুব্ধপথ, অথচ কি সামান্য আয়াস
দু’চোখে সাড়ার মতো পিছুটান, সাম্প্রতিক মায়া
নিহিত রোদ্দুর ছুঁয়ে মুখে এসে জেগে থাকে সাধ
ফুরোয় না পৃথিবীর সহজিয়া, মধুর বিধান।
আসলে সামুদ্রিক ব্যাকুলতা কোথাও কখনও
প্রবাল ফুলের মতো বাসনায় ফিরে যেতে চেয়ে
যোগ্যতম প্রণয়ীর সন্তরণে ডানা মেলে দেয়,
শরীরে জলের দাগে ফুটে ওঠে অসংখ্য হতাশা।
জানি এই সংক্রমণ কাউকেই রেহাই দেবে না
বুকের ভিতরে কোন বিরলতা সহজে ঘনাবে,
অন্ধকারে প্রহরায় ডুবে যাবে নেহাতই পাথর।
তবুও এখানে কত ভার বয়ে সুদীক্ষায় আসা বলো
সে প্রিয় সহিষ্ণুতা ধ্বনি তোলে শুধু উচ্চারণে।
জন্মদাগ
আসলে নিবিষ্ট, গূঢ় সংরাগ স্বগতবন্ধনে বাঁধে কখনও এমন
যেন ভালোবাসি বললেই আর্ত হবে বিপন্ন সফর, সয়ে যাবে
সকল কথার শেষে আপোসের ম্রিয়মান ফুল, অন্তঃপীড়া,
পরে তারা মুক্ত হবে অদৃশ্য সোপানে, বারান্দায় টেনে রাখা
নাইলন দড়িতে, শূন্য ছাদে, শেষকথা ফুরোবার অভিজ্ঞ স্খলনে,
প্রতিবার বন্দী হয়ে নিহিত ছায়ায় কাটবে এক ঋতুকাল
বিরাগের চিঠি আসবে অনেক পরে, দাক্ষিণ্যের, ক্ষমার ভাষায়।
সহায় হবেনা কিছু, তারপর অতর্কিতে সাড়াও পাবোনা আর
লোকারণ্য দেখে বেলা যাবে, বয়স বেড়ে সতর্ক ভঙ্গিতে
অবশেষে দাঁড়াবে কোথাও, কোন নীরবতম সন্ধের জঠরে,
বাঁশি বাজবে, জন্মদাগ রেখে যাবে আলোকিত প্রতিটি কবিতা।
জিভের নীচে ব্লেড
জিভের নীচে ব্লেড, নিজের ভিতরে খাত কেটে আমি
যদি যমুনা বহাই, পূর্বজন্মের থেকে সাড়া পাবো ঠিক
এমত আশ্চর্য সংবাদ বুকের নীচেই গোপন রেখেছি
আমাদের ভালোবাসা, ভালো থাকা, অত্যুক্তি সকলই
তাই স্পঞ্জের বলের মত নরম, নরমতর ছোঁয়া নিয়ে
এল, অবসাদ ভুলি যদি সকালদুপুর রত থাকি সেই
বল নিয়ে, খেলুড়ে শিশুর মত রত থাকি, বাল্যজর্জর
মানুষের স্বপ্নকরোটির দরজা খুলে যায় মুহূর্তে তখন
শিশুর আনন্দচিত্ত, উচ্ছ্বাস অবিরত ঠোঁট স্পর্শ করে
জামা ভিজে যায় জিভের প্রতিটি স্বাদকোরকেই জ্বর
ছাড়ার অনির্বচনীয় সুখ, রাত্রিদিন বাঁধনহারা খেলার
সাথে আশনাই, মাগো এমন জ্বরজ্বালা রোজই হোক
নিজের ভিতরে খাত কেটে আমি যমুনা বহাই, দারুণ
আশ্চর্য সব খিল খুলে সিংহদরজার কাছে এসে পড়ি
আর তারই গায়ে কান পেতে শুনি কত অপূর্ব ব্যালাড
মানুষের উপাসনা পূর্ণ করে, ভূমিকাও পূর্ণতর করে।
মহাত্মাসম্বাদ
কখনও ঘুমের মাঝে ধ্রুব হয়ে ওঠে সেই দুখী মহাত্মারা
যাদের পাহাড়জীবন আমাদের ক্ষণকম্পাস, ব্যাপৃত ভয়
অভিন্ন বহুস্বর থেকে যারা ভিন্ন ভিন্ন স্বরে উপনীত হয়ে
আমাদের করতলে সাবলীল সূর্য এঁকে যান, অথচ সত্য
এই বিলম্বসফর গন্তব্য নয় আমাদের, আমরা বরং সেই
চিরন্তন কার্পাস তুলোর মাঠ খুঁজে পেলে বল্গাহীন খুশি,
তবু নির্ভার গহন দুপুরে পথে-বিপথে ডাক দিয়ে ফেরার
আকুতি আমাদের কোন এক স্বপ্নের শিয়রে নিয়ে যায়।
তখনই তাকিয়ে দেখি পূর্ণিমা, দিগ্বিগিকে অপার্থিব চাঁদ
তবু উদাসীন পান্থ, রাত্রি এক সখেদ মঞ্জিল, গণিকাসমাজ
শ্রান্ত, যদিও সেখানে অস্ফুটে ধ্বনিত হচ্ছে আরও কিছু
কেচ্ছাসংবাদ, সেইসব মহাত্মার যারা গত জমানার থেকে
মানুষের নিকটবর্তী হতে চেয়ে অথচ কি সঙ্গীহীন, একা!
এই এক প্রশ্নে সর্বদাই লৌকিকতার ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ে,
অন্দরবাহিরে ক্ষয় শুরু হয়, ভেঙে পড়ে স্বপ্নলব্ধ প্রকাণ্ড
জাহাজ-মাস্তুল, সমুদ্রযাত্রার আগে যদিও সে রোজকার
জ্বরের উত্তাপ নেমে যায়।
যাজকের কবিতা
পীড়া দাও মর্মসখী, আকস্মিক মরণের সাধ
ভ্রূবঙ্কিম ছেনালিতে পূর্ণ কর ফলদ্যোতনায়
গলায় জড়িয়ে দাও পীতকুসুম, আনন্দমালা
অশনি ছুঁইয়ে ভালে, অরক্ষিত শিব ও সুন্দর
উদ্ধার কর, চিবুক ডিঙিয়ে জল গড়াক আপনি।
না না, অযথা কেঁদে কিই বা হবে, যেতে যেতে
বলো এই উদাসীন পালা লিখে রাখিগে এখন
আমি কার ঠেঁইয়ে? তার কানে ভবরূপ বলিয়া
ঈষৎ চুপি চুপি মরে যাওয়া যদি অন্ধকলস্বর?
ফলত গলায় আজ রুদ্রাক্ষ হেনেছি অভিনব
হাতের উল্টোপিঠে কাগজমুখর গতিবিধি ও
পরিচিত তেরচা ঠিকানা আমাদের গাণিতিক
সম্পর্কগুলিই বলে দেয়, একাধিক উজ্জ্বলতা
নিয়ে নির্বিশেষ মুখ গড়ে ওঠে, তার মন্দ, তার
ভালো সাক্ষাৎ করুণা জেনে মৃত্যুশীত কবলিত
আমি প্রসন্ন মনে তার স্তব করে যাব, ইচ্ছা এই।
পড়ে ভালো লাগল। আরো পড়বার ইচ্ছে রইলো।