‘যেটুকু ঈশ্বর থাকবে সেটুকুই পর্যাপ্ত ঈশ্বর’
: রণজিৎ অধিকারী
ভাবছি, ভেবেই চলেছি… একজন কবির মৃত্যু হলে, একজন প্রাবন্ধিকের চিন্তকের মৃত্যু হলে, তাৎক্ষণিকভাবে কী লেখা যায়! এই কি যথাযথ সময় তাঁর যা-কিছু সৃষ্টি রচনা শিল্পিত ভাবনা, তা-র মূল্যায়ন করতে বসার! আমরা যা পড়েছি তাঁকে, যতটুকু জেনেছি বুঝেছি সেই মানুষটিকে, তা-র বোঝাপড়া করার এ-ই কি সময়? যে স্থির পরিপ্রেক্ষিতের কথা জীবনানন্দ বলেছিলেন, আমরা ততদূর পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করিই না! বরং সমীচীন এখন একটু বিমূঢ় হয়ে থাকা যেন যে মানুষটা যখন তখন বসতবাড়ি থেকে বেরিয়ে যান আর অনিয়মিত ফিরতে থাকেন … একটু খোঁজ নিয়ে দেখা যায় না কি, মানুষটা ফেরেন কি না!
“ঐ যে আমার বসতবাড়ি নিকষ কালো
শ্লেটের ওপর আলতো আঁকা যখন-তখন
বেরিয়ে গিয়ে অনিয়মিত ফিরতে থাকা ”
এই দেখুন, আমরা যখন কবির মৃত্যুসংবাদ পেলাম,
সত্যি সত্যিই “এখন শুধুই অগ্রহায়ণ, শীত আসেনি… ”
শীতের কাপড়জামা নিয়ে হয়তো আড়ালে কোথাও দাঁড়িয়ে আছেন ঈশ্বর, যারা নিঃস্ব তাদের জন্য!
এখন এই অগ্রহায়ণে সেই স্রষ্টা মানুষটাই নেই, আমরা জানিনা, কেউ-ই জানিনা, তাঁর মুখে কোনো ছায়া পড়েছিল কিনা —মৃত্যুর? বেরিয়ে গিয়ে না-ফেরার?
কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে থেকে কেবল তাঁর কিছু কবিতা, কিংবা অন্যমনস্ক ভাবে দু’একটা পঙক্তি, হয়তো বা প্রয়োজনের তাগিদে নিরেট পাথরের মতো সুঠাম কোনো প্রবন্ধ পড়ে কি জানা যায় একজন শিল্পিত স্বভাবের বিশুদ্ধ ভাবনার এক মানুষকে?
যখন চতুরতা চতুরতা আর চতুরতা দিয়ে ঘেরা একটা বানানো জগতে আমরা বাস করা অভ্যাস করে ফেলেছি আমরা, যখন ভাষা কেবল আক্রমণের কুৎসিত হাতিয়ারে পর্যবসিত, কলুষিত … সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে নিজেদের আহাম্মকি বিজ্ঞাপিত করতে করতে ভাবিনি কতদূরে নিক্ষেপিত হয়েছি নিজেদেরই দোষে!
সেই স্বরচিত দূরত্ব থেকে কীভাবেই বা বুঝে নিতে পারব তাঁর মুখে মৃত্যুর ছায়া পড়েছিল কিনা?
কিংবা “মৃত্যু কি নিজেই নচিকেতা হয়ে তাঁকে জীবন বিষয়ে কিছু প্রশ্ন” করেছিল?
আমরা তার বিন্দুবিসর্গও জানিনা, কেননা তিনি দূরে থেকেও আমাদের কাছে ছিলেন, “পুরোনো বটের সদ্য পাতার মতন ফুটে” ওঠা, যেন তাঁর “চোখ চিরন্তন আপীড়িত শান্ত” — কবি অলোকরঞ্জন।
আমরা কি আজও পড়তে পারলাম তাঁকে, কবিতার চেয়েও যা জরুরি কবিকে পড়া? সেই কবে আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতাকে ধাক্কা দিয়ে লিখেছেন,
“… আমি বুঝতে পারি না অদ্যাবধি
মানুষ নিজেরই মধ্যে থাকতে চায় কেন, দুর্নিবার
আত্মকেন্দ্রিকতার ঘোরে…!”
পড়েছি কি, এই কবি কবেই না কাঠুরের কাছ থেকে দ্রুত অতর্কিতে করাত ছিনিয়ে নিয়েছিলেন, যে করাতের দাঁত বড়ো মরমি , আহা! বড়ো সুরেলা।
তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন,
নিজেকে না ফেড়ে, না ফালাফালা করে সংগীত বাজানো যায়নি কখনো।
আর ভাবি, আমাদের হাতে উঠে আসা করাত কী ধারালো!
কেন তা বিশুদ্ধ মরমি হতে পারল না!
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর কবিতা গদ্য পড়তে পড়তে মনে হয়, যেন ধ্যানস্থ সন্ন্যাসীর উচ্চারণ, কিন্তু যদি একটু নিবিড়ভাবে খেয়াল করি দেখব ধ্যানের মগ্নতার আড়ালে
আছে বিদ্রোহের সুর। তাই বুদ্ধিজীবী শব্দের আগে বসিয়ে দেন ‘ধুরন্ধর’ শব্দ, সন্ন্যাসী শব্দের আগে ‘ভুল’ শব্দ।
আসলে তাঁর কবিতা পড়ার জন্য পাঠকেরও চাই ধ্যান, বিশেষ মগ্নতা।
মনে পড়ছে, যখন ধর্ম অধর্ম বিষয়ে সংখ্যার পরিকল্পনা করেছি, তখন তাঁর সঙ্গে নিয়মিত কথা হত, প্রায় প্রতি সপ্তাহে সন্ধেতে ফোন করতাম। তার আগে ফ্যাক্স করে সংখ্যায় লেখার আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম, উনি চিঠিটি পড়ে খুবই খুশি হয়েছিলেন এবং আমাকে গ্রহণ করেছিলেন। ধর্ম বিষয়ে কত কথাই যে হত, আমাদের দেশ, সারা পৃথিবী… অসহিষ্ণুতা, মানুষের পাশবিকতা, কত কত প্রসঙ্গ! আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন,… দেখুন না, দেশের এই অসহিষ্ণুতা নিয়ে,, ধর্মধ্বজীদের তাণ্ডব নিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের কোনো সন্ন্যাসীর কী বক্তব্য… যদি একটা সাক্ষাৎকার অন্তত নেওয়া যায়!… তাঁর কথা রাখতে পারিনি।
প্রত্যেক বার ফোন করার আগে ভয়ে ভয়ে কাঁপতাম, তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলেই মনে হত, বাংলা ভাষার কিচ্ছু জানি না আমি। একটা সুরে, (স্নেহ আর ভালোবাসার সুরের ছলাৎছল এতদূরেও বুকে এসে লাগত) নিপুণ ভাবে শব্দ গেঁথে গেঁথে কথা বলতেন, যেন যা কিছু বলছেন আমাকে, সব পূর্ব-নির্ধারিত, আমার বাংলা ভাষা এত ঐশ্বর্যবতী! এত সম্ভাবনাময়! দূর থেকে প্রণাম করতে ইচ্ছে হত।
আজও দুঃখ পাই ভেবে যে, ধর্ম অধর্ম সংখ্যায় তাঁর লেখা ছাপতে পারিনি ভিন্ন একটা কারণে।
দুঃখ আরো যে, খড়্গপুর আইআইটি-র এক অধ্যাপক গবেষণার কাজে জার্মানি গেলে তাঁর হাতে ‘পূর্ব’-র কয়েকটি সংখ্যা পাঠাই, কিন্তু সেইসময় কবি অলোকরঞ্জন অসুস্থ থাকায় ফোন ধরতেই পারেননি, তাই আমার ‘পূর্ব’ আবার পূর্বে ফিরে এসেছিল ।
এখনো তাঁর সঙ্গে কথোপকথনের স্মৃতি মনে পড়লে শিহরিত হই, তাঁর অনুবাদে গুন্টার গ্রাস-এর কবিতা পড়তে পড়তে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। গ্রাস-এর কবিতা অনুবাদে যে ভূমিকা অংশটি তিনি লিখেছিলেন, ভাবি,
ঐ লেখা লিখবার মতো আর কেউ থাকলেন না, কেউ-ই না।
তিনি চললেন, হয়তো অনারোহ নক্ষত্রপুঞ্জের চারণেরা এভাবেই সাক্ষ্য রেখে যায় আর আমাদের বোবা ও বধির করে যায় … কেননা সত্যিই এখন শুধুই অগ্রহায়ণ, শীত আসেনি!
অথচ আমরা দাঁড়িয়ে আছি প্রলয়ের সম্ভাবনার ওপর, কী করব আমরা? তিনি লিখেছিলেন,
“এখন মতান্তর বড়োই জরুরি তা না হলে
আর কোনোদিনই আমরা
পরস্পরের মধ্যে নিজেদের খুঁজে পাব না।”