
ফয়েজ় পরিক্রমা – ১১
নীলাঞ্জন হাজরা
বহুদিন পর আবার শুরু হল ফয়েজ পরিক্রমা। এটি একাদশতম পরিক্রমা। এর আগে ফয়েজ পরিক্রমার দশটি পর্বই পাবেন আমাদের ওয়েবসাইটে।
কোনখানে ছিল যেন ঠিকানা আমার
(বিশেষ অনুরোধ — এই লেখা লিখছি আবহমান পত্রিকার ইন্টারনেট সংস্করণের জন্য। ইন্টারনেট আমাদের সামনে এনে দিয়েছে একাধারে পড়া দেখা শোনার অভিজ্ঞতার অভূতপূর্ব সুযোগ। সেই ভাবেই এ লেখার বয়ন। তাই সঙ্গের লিঙ্কগুলি অতিরিক্ত মনে করে উপেক্ষা করবেন না)
কহুঁ কিস-সে ম্যায়ঁ কি কেয়া হ্যায় শব-এ-গম বুরি বলা হ্যায়
মুঝে কেয়া বুরা থা মরনা আগর একবার হোতা।।
(কাকেই বা কব আর বিচ্ছেদ-রাত্রি সে কী যে যাতনার
খুব কি খারাপ হতো, মৃত্যুও যদি হতো, শুধু যদি হতো একবার।।)
- মির্জ়া গালিব
এই যে পরিক্রমা, এ একেবারেই আমার এক ব্যক্তিগত সফর ফয়েজ়কে ঘিরে। সূর্যকে গ্রহ প্রদক্ষীণ করে যে অমোঘ টানে, এ লেখা আমার সেই সফরের সেই টানের কথা। সেই টানের রসায়নের কথা।
বিগত কয়েক পর্ব ধরে আমি ফিরে দেখছি এই টানের রসায়নে মির্জ়ার ভরপুর উপস্থিতি। মির্জ়ার কবিতার ঘন সবুজ গাছের নানা শাখা থেকে ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ় নিজের কাব্যিক আকাশে পরমাশ্চর্য কেমন সব উড়ান নিচ্ছেন তাতেই মশগুল আছি আমরা । আর সেই সূত্রেই আমরা গত পর্বে শুনেছিলাম ওপরে উদ্ধৃত শে’রটি যে গজ়ল থেকে নেওয়া তারই মতলা — প্রথম শে’র:
ইয়ে না থি হামারি কিসমত কি বিসাল-এ-ইয়ার হোতা
আগর অওর জিতে রহতে ইয়েহি ইন্তজ়ার হোতা।।
(আমার কপালে ছিল না প্রিয়ার সঙ্গে মিলন
বাঁচতাম যদি আর কিছু কাল এ প্রতিক্ষাই চলত সারাক্ষণ।।)
এ শে’র অনন্ত প্রতীক্ষার। গোড়ায় উদ্ধৃত শে’রটিও তাই। সন্দেহ নেই, প্রিয়ার বিরহে প্রতীক্ষার। আপাতত শুধু এটুকু মাথায় রেখেই ফয়েজ়ের পথে রওয়ানা দিই।
ফয়েজ়ের কক্ষপথে যে টানে আমার প্রদক্ষীণ তার রসায়নের নানা উপাদানের একটার নাম — নির্বাসন।
প্রশ্ন হল নির্বাসন বলে কাকে? প্রণম্য হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘নির্ব্বাসন’ শব্দের অর্থ দিচ্ছেন, ১। ‘পুরাদি হইতে বহিষ্করণ; প্রব্রাজন’, ২। ‘বধ, মারণ’, ৩। ‘বিসর্জ্জন’। আধুনিক চলতি অর্থে আমরা প্রথমটিই বুঝিয়ে থাকি। ‘পুর’ শব্দের একাধিক অর্থের মধ্যে রয়েছে ‘নগর’ এবং ‘গৃহ’। কাজেই বলতে পারি নগর বা গৃহ থেকে বহিষ্কৃত হওয়াই নির্বাসন। তার মধ্যে একটা সুস্পষ্ট অনিচ্ছা, একটা বাধ্য হওয়ার ভাব রয়েছে। কিন্তু শুধু অনিচ্ছায় স্বস্থান ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হওয়াই নির্বাসনের সবটুকু নয়। নির্বাসনের মর্মে রয়েছে যা ফেলে আসতে হয়েছে সেখানে ফিরে যাওয়ার এক অদম্য টান।
এখানে এই বাধ্য হওয়া এবং ফেরার টান দুটো অবিচ্ছেদ্য, কাজেই তা একাধারে দৈহিক ও মানসিক। এবং এখানেই তা ভারতীয় অধ্যাত্মবাদী দর্শনে যা ‘মায়া’ তা থেকে পৃথক। কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে ‘নেতি নেতি’ করে — এটা নয়, এটা নয় করে — এগোন যায়, তা হলে আর একটু স্পষ্ট হতে পারে কী বোঝাতে চাইছি।
বিবেকানন্দর এই আশ্চর্য গান ‘মায়া’-মুক্তির, নির্বাসনের নয়।—
‘‘মন চলো নিজ নিকেতনে
সংসার বিদেশে বিদেশীর বেশে
ভ্রম কেন অকারণে
মন চলো নিজ নিকেতনে।
বিষয়-পঞ্চক আর ভূতগণ
সব তোর পর কেহ নয় আপন
পরপ্রেমে কেন হয়ে অচেতন
ভুলিছ আপনজনে
মন চলো নিজ নিকেতনে।…’’
এখানে যিনি ভ্রমিছেন তিনি প্রপঞ্চময় মায়ায় অচেতন। নির্বাসন, এক অর্থে, ঠিক এর উলটো। শিকড় বিচ্যুত নির্বাসিত যে জন সে সতত দারুণ সচেতন। সে সচেতনে ফিরে যেতে চায়। কোন নিকেতন তার ‘নিজ’ তাই নিয়ে তার মনে কোনো সংশয় বা অচেতনতা নেই— বিন্দু মাত্র না। কিন্তু সেটুকুও— পরবাসে থাকা ও নিজ নিকেতনে ফিরে যেতে চাওয়াটাই, সে বিষয়ে সচেতনতাই, সচেতনতাও নির্বাসনের সবটুকু নয়। রবীন্দ্রনাথের এই গানও নির্বাসনের গান নয়—
E Parobase Rabe Ke ? – Kanchanjungha 1962 movie’s Rabindrasangeet – YouTube
‘‘এ পরবাসে রবে কে হায়!
কে রবে এ সংশয়ে সন্তাপে শোকে॥
হেথা কে রাখিবে দুখভয়সঙ্কটে–
তেমন আপন কেহ নাহি এ প্রান্তরে হায় রে॥’’
নির্বাসন, আমার মনে হয়েছে, অনেক বেশি আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক। রাষ্ট্র আইনি শক্তি প্রয়োগ করে মানুষকে নির্বাসিত করে। দেশান্তরী করে, কারারুদ্ধ করে — দুটিই নির্বাসন। রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের ধারণা মানুষকে — হাজারে হাজারে মানুষকে— নিজবাস থেকে পরবাসে যেতে বাধ্য করতে পারে— নির্বাসন। যুদ্ধ মানুষকে নির্বাসিত করে। যে কোনো রকমের জাতপাত-ধর্ম-বর্ণ-ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক আস্ফালন মানুষকে নির্বাসিত করতে পারে। রাজনৈতিক দর্শন মানুষের নির্বাসিত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। আরো নানা কারণে বলপ্রয়োগ করে মানুষকে নির্বাসিত করা হয় — আর সে বলপ্রয়োগ কেবল শারীরিক নির্যাতনই নয়, প্রবল মানসিক চাপ তৈরি করেও সেটা করা হয়।
নির্বাসন নিয়ে তাত্ত্বিকদের অজস্র আলোচনা রয়েছে, যার মধ্যে আমরা সচেতন কারণেই সংক্ষেপে ঢুকব একটির মধ্যে। এডোয়ার্ড সয়ীদ। নির্বাসন নিয়ে তাঁর একটি অনবদ্য প্রবন্ধ আছে— Reflections on Exile (Reflections on Exile and Other Literary and Cultural Essays. Granta. 2000)। তরজমা করছি না, কারণ সয়ীদের লেখা বহুমাত্রিক এবং তরজমায়, অন্তত আমার সাধ্যের তরজমায়, তার কিছুটা হারিয়ে যেতে বাধ্য— ‘‘Exile is strangely compelling to think about but terrible to experience. It is the unhealable rift forced between a human being and a native place, between the self and its true home: its essential sadness can never be surmounted. And while it is true that literature and history contain heroic, romantic, glorious, even triumphant episodes in an exile’s life, these are no more than efforts meant to overcome the crippling sorrow of estrangement. The achievements of exile are permanently undermined by the loss of something left behind for ever.” আমি সয়ীদের এই প্রবন্ধে বারবার ফিরব।
বিষয়টা কি জটিল হয়ে যাচ্ছে? সহজ করে নেওয়া যাক। কবিতায় ফিরি— ফয়েজ়ের নিজের কবিতায়:
প্রাণ আমার পথিক আমার
প্রাণ আমার, পথিক আমার
হুকুম যে হয়েছে আবার
দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে, তোমায় আমায়
অলি-গলি ডেকে ডেকে ফিরি
শহরে শহর থেকে ঘুরি
কোনওখানে তাকে যদি খুঁজে পাওয়া যায়
আনবে যে চিঠি কোনও, কোনও বার্তা প্রিয়তমার
অচেনা অপরিচিত, সকলকে কেবলই শুধাই
কোনখানে ছিল যেন ঠিকানা আমার
কোন মোড়ে নিস্পৃহ কোন রাস্তার
দিনকে রাত্রি করে তোলা
এর সাথে কিছু কথা বলা
ওর সাথে কিছু কথা বলা
কী আর বলব তোমায়
রাত্রি কাটাতে হবে কোন যাতনায়
তাও বড়ো প্রিয় মনে হতো
শেষ যদি কোনওখানে হতো
খুব কি খারাপ হতো, মৃত্যুও যদি হতো
শুধু যদি হতো একবার।
—
(লন্ডন। ১৯৭৮। উর্দু থেকে তরজমা নীলাঞ্জন হাজরা)
জলের মতো সহজ। জলের মতো গভীর। আর, কী আশ্চর্য, মির্জ়ার পঙক্তি হুবহু তুলে নিয়েও এক সম্পূর্ণ অন্য দুনিয়ায় হাজির করে দিলেন ফয়েজ় আমাদের। ভালোবাসার বিচ্ছেদ-রাত্রির পর রাত্রিতে বার বার মির্জ়ার তিলে তিলে মৃত্যুর যাতনা থেকে রাষ্ট্রীয় হুকুমে নির্বাসিত কবির হৃদয়ের আকাশে ফয়েজ়ের পরমাশ্চর্য উড়ান! মধ্যযুগীয় কাব্যধারা এক সম্পূর্ণ ভিন্ন হাহাকারে অত্যাধুনিক হয়ে উঠল। সয়ীদ নির্বাসন বিষয়ে যা লিখছেন, এ কবিতা কী তার ধ্রুপদী কাব্যিক সংজ্ঞা নয়? ‘The crippling sorrow of estrangement’— বিচ্ছিন্নতাবোধের একেবারে পঙ্গু করে দেওয়া বিষাদ। একটু ভেঙে যদি দেখি কী ভাবে সহজতম সম্ভাব্য শব্দে ফয়েজ় গড়ে তুলেছেন এই ‘বিচ্ছিন্নতাবোধ’, এই ‘পঙ্গুত্ব’, এই ‘বিষাদ’— মন দিয়ে বারবার পড়তে হবে— ‘অচেনা অপরিচিত, সকলকে কেবলই শুধাই / কোনখানে ছিল যেন ঠিকানা আমার /
কোন মোড়ে নিস্পৃহ কোন রাস্তার’। প্রথম পাঠে এ ভ্রান্তি হতেই পারে— ‘কোনখানে ছিল যেন ঠিকানা আমার’, এ তো স্মৃতিমেদুর মাখোমাখো নস্টালজিয়া! তিষ্ঠ ক্ষণকাল। না। এ স্বদেশের পথের ঠিকানার কথা নয়। সে তো ‘কু-এ-য়ার’ — যদি আমরা চট করে ফিরে যাই এই পরিক্রমারই একেবারে দ্বিতীয় পর্বে উল্লিখিত এক গজ়ল ‘গুলোঁমে রঙ্গ্ ভরে’-র ‘মকতা’-য়, শেষ শে’র-এ: যো কু-এ-ইয়ার সে নিকলে তো সু-এ-দার চলে।। (কোনও কিছু পথে আর প্রাণেই যে ধরেনি ফয়েজ় / ছেড়েছি যে প্রিয়তমার পথ, যেদিকে চলেছি সেইখানে ঘাতক রয়েছে তৈয়ার।।)
‘অচেনা অপরিচিত’ তো নির্বাসিত দেশের মানুষ। তাঁদের কেন শুধাবেন নিজের দেশের নিজ ‘গৃহ’ ছিল কোন ঠিকানায়? তাঁদের তো জানার কথা নয়। কেনই বা নিজের দেশের পথ হবে ‘নিস্পৃহ’? ফয়েজ় মূলে ‘সর-এ-কু-এ-না-শনাইয়া’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন। হুবহু তরজমা— ‘নিস্পৃহ মানুষে ভরা পথের মোড়’। নিজের দেশের পথ তো ‘কু-এ-ইয়ার’, ‘প্রিয়তমার পথ’। তা হলে? তা হলে ওই ‘পঙ্গু’ করা বিষাদই এ উচ্চারণের চাবিকাঠি— তার মাথা কাজ করে না, যে গৃহে তার আপাত-বাস তা থেকে সে এতটাই বিচ্ছিন্ন যে অচেনা অপরিচিতকে শুধাতে হয় সে ঠিকানা কোথায় হতে পারে।
আরও সহজ উচ্চারণ— ‘দিনকে রাত্রি করে তোলা / এর সাথে কিছু কথা বলা / ওর সাথে কিছু কথা বলা’— একটা বিষণ্ণতার ঘোরের সম্পূর্ণ অসংলগ্নতা, অর্থহীন, খেইহীন সব কথপোকথন। কী সহজ, তাই নয় কী?! শুধু মনে করতেই হবে, আমাদের আর এক কবির অমোঘ উচ্চারণ: ‘কিন্তু কে না জানে সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়’। (এ আমার চিরকালীন, অপূরণীয় আক্ষেপ যে স্যারের সঙ্গে আমার আরও তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে পরিচয় হলো না। হলে একটা কাজ করিয়েই ছাড়তাম: আমাদের সমসময়ের এই মানুষটাই কেবল পারতেন ওই মানুষটার কবিতাকে বাংলায় তরজমা করতে। সহজ নয়। হলো না।)
এক্ষণে এই হৃদয়-চুরমার-করা নির্বাসনের কবিতার বিষয়ে কয়েকটা তথ্য জেনে নেওয়াও যেতে পারে। কবিতার শেষে বন্ধনীতে দেওয়া স্থান ও কাল: লন্ডন ১৯৭৮। পাকিস্তানের নির্বাচিত সমাজবাদী প্রধানমন্ত্রী জ়ুলফিকার আলি ভুট্টো ১৯৭৬ সালে দেশের সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন মহম্মদ জ়িয়া-উল-হক-কে। ১৯৭৬-এর শেষ থেকেই ভুট্টোর সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভ সংগঠিত হতে থাকে। তৈর হয় বিরোধী রাজনৈতিক মঞ্চ Pakistan National Alliance। ১৯৭৭-এর জানুয়ারিতে ভুট্টো নির্বাচন ডাকেন। ভুট্টোর Pakistan Peoples’ Party জিতে যায়। বিরোধীরা এককাট্টা হয়ে ভুট্টো-সরকারে অবৈধ ঘোষণা করেন। ১৯৭৭-এর এপ্রিলে ভুট্টো করাচি, হায়দরাবাদ, লাহোরে সেনা শাসন কায়েম করেন। বেগতিক দেখে কয়েক মাস পরেই বিরোধীরা ভুট্টোর সঙ্গে একটা রফায় আসতে রাজি হন। ঠিক সেই মুহূর্তে ঝোপ বুঝে কোপ মারেন সেনাপ্রধান জ়িয়া। ১৯৭৭-এর ৫ জুলাই ভোর রাতে সেনা অভ্যুত্থান সংগঠিত করেন জ়িয়া। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান মুক্তকণ্ঠে অভ্যুত্থান সমর্থন করেন, কমিউনিস্টদের বাড়বাড়ন্ত রুখতে। মার্কিন সমর্থন ছাড়া জ়িয়ার অভ্যুত্থান টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হতো। ১৯৭৮-এর ১৮ মার্চ ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয় । পাকিস্তানে পরবর্তী দশ বছর ধরে চলতে থাকে জ়িয়ার কট্টর মৌলবাদী, ভয়াবহ সামরিক শাসন।
ভুট্টোর দীর্ঘকালীন বন্ধু ছিলেন ফয়েজ়। ১৯৭১-এ ‘প্রেসিডেন্ট’ পদে আসীন হওয়ার (পরে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন নির্বাচন জিতে) বছরখানেকের মধ্যেই তিনি ফয়েজ়কে কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্কৃতিমন্ত্রক ও শিক্ষামন্ত্রকের উদেষ্টা পদে নিযুক্ত করেন। ১৯৭৪-এ ফয়েজ় সব সরকারি পদ থেকে অবসর নেন, কিন্তু সম্পর্ক অটুট ছিল। কাজেই ১৯৭৮-এর পর তাঁর পক্ষে আর কিছুতেই পাকিস্তানে থাকা সম্ভব ছিল না। তিনি কিছু দিনের জন্য লন্ডন চলে যান। ফেরেন। স্বদেশ ছেড়ে থাকতে পারতেন না। ভুট্টোর ফাঁসি হলো ১৯৭৯-র ৪ এপ্রিল। ফের দেশ ছাড়তে হল ফয়েজ়কে। এবার ফিলিস্তিনের বইরুত। আফ্রো-এশীয় সাহিত্যিকদের বিখ্যাত জার্নাল ‘লোটাস’-এর সম্পাদক নিযুক্ত হলেন (পরে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও এই সম্মানিত পদে ছিলেন)। হলে কী হবে, ওই যে— The achievements of exile are permanently undermined by the loss of something left behind for ever, যেমনটা লিখেছেন সয়ীদ।
‘নির্বাসন’ নিয়ে আরও অনেক সাহিত্য-তাত্ত্বিকের লেখাই আমরা দেখে নিতে পারি, কিন্তু সয়ীদের এই প্রবন্ধে বারবার ফিরছি যে, তার একটা সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। কারণ ফয়েজ়ের এই ‘loss’ সয়ীদ প্রত্যক্ষ করেছিলেন এক আশ্চর্য পরিস্থিতিতে। ফের তরজমা করার পরিবর্ত এই প্রবন্ধেরই আর একটি অংশ তুলে দিই— ‘‘Several years ago I spent some time with Faiz Ahmed Faiz, the greatest of contemporary Urdu poets. He was exiled from his native Pakistan by Zia’s military regime, and found a welcome of sorts in strife-torn Beirut. Naturally his closest friends were Palestinian, but I sensed that, although there was an affinity of spirit between them, nothing quite matched – language, poetic convention, or life-history. Only once, when Eqbal Ahmed, a Pakistani friend and a fellow-exile, came to Beirut, did Faiz seem to overcome his sense of constant estrangement. The three of us sat in a dingy Beirut restaurant late one night, while Faiz recited poems. After a time, he and Eqbal stopped translating his verses for my benefit, but as the night wore on it did not matter. What I watched required no translation: it was an enactment of homecoming expressed through defiance and loss, as if to say, ‘Zia, we are here’.”
ফয়েজ়ের কবিতার প্রতি, ফয়েজ়ের প্রতি, এত মর্মস্পর্শী সম্মান আর কেউ জানিয়েছেন বলে আমি কখনও পড়িনি। অথচ কী মর্মন্তুদ, মর্মান্তিক। গভীর রাত গড়িয়ে চলেছে। বিভুঁইয়ের এক ঘুপচি রেস্তোরাঁর এক টেবিলে এক হিমালয়প্রতিম নির্বাসিত কবি, তাঁর আর এক নির্বাসিত বন্ধু এবং বিশ্বের প্রথম সারির, সম্পূর্ণ ভিন্ভাষী এক সমাজ-সংস্কৃতি-সাহিত্য-তাত্ত্বিক। কবিতা বয়ে চলেছে। এক সময়ে এসে ভাষার প্রাচীর ভেসে যায়। কথিত শব্দই শুধু আর মনের দূত নয়, দরকার নেই। লিখছেন সয়ীদ, “To see a poet in exile – as opposed to reading the poetry of exile – is to see exile’s antimonies embodied and endured with unique intensity.” কবির সারাটা অস্তিত্ব উপচে ঝরা এক অনির্বচনীয় ‘অ্যান্টিমনি’, ‘বিরোধাভাস’— ‘defiance and loss’, ‘মানছি না’ এবং ‘সব হারানোর’-র বিরোধাভাসী ধারার ঘূর্ণী — ফয়েজ়ের কবিতা, ফয়েজ়ের জীবন।
যে কবিতা আমরা পড়লাম — ‘প্রাণ আমার পথিক আমার’ (দিল-এ-মন মুসাফির-এ-মন), তা যে বই থেকে নেওয়া তারও নাম ‘প্রাণ আমার পথিক আমার’ (মেরে দিল মেরে মুসাফির), প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। আমি মনে করি ফয়েজ়ের কবিতার একটা বড় অংশই নির্বাসনের কবিতা। কিন্তু বিশেষ করে এই কাব্যগ্রন্থ যেন তার দলিল। কাজেই ফিরতে আমাদের হবেই এর পৃষ্ঠায়। পরের পর্বে।
যেতে যেতে এই কাব্যগ্রন্থের একটি গজ়ল। কার গলা জানি না। কিন্তু ভালো লাগল এই যে, কোনও কালোয়াতির চেষ্টা না করে জলের প্রবাহের মতো সহজ সুরে গাওয়া —
তরজমা খুব কঠিন, তবু—
‘‘আপনার কথা মনে আসতেই থাকল রাতভর’’
জ্যোৎস্না এ হৃদয় ব্যথায় ভরে দিতেই থাকল রাতভর।।
কখনও বা জ্বলে উঠে, কখনও বা নিভে গিয়ে
ব্যথার প্রদীপ ঝিলমিল করতেই থাকল রাতভর।।
কোনও সুগন্ধ বদলাতে থাকল পোশাক
কোনও ছবি গাইতেই থাকল রাতভর।।
বাতাস ফের ফুলের শাখের নীচে
কোনও কাহিনি শোনাতেই থাকল রাতভর।।
যে আসেনি তাকে কোনও শিকল দরজার
শব্দ তুলে ডেকে ডেকে যেতেই থাকল রাতভর।।
কী এক আশা প্রাণকে দিতে থাকল সান্ত্বনা।
কী বাসনা জ্বালাতন করতেই থাকল রাতভর।।
(মস্কো। সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮। পঞ্চম শে’রটি গানে নেই। প্রথম শে’র-এ ফয়েজ় কেন উদ্ধৃতি চিহ্ন দিয়েছেন আমি বুঝিনি। অন্য কোনও কবির গজ়ল থেকে এই পঙক্তিটি নেওয়া কি? জানিনা।)
(ক্রমশ…)
পূর্বের দশটি পরিক্রমা– https://abahaman.com/abahaman/?s=%E0%A6%AB%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%9C+%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AE%E0%A6%BE