
ফয়েজ় পরিক্রমা
নীলাঞ্জন হাজরা
প্রথম পর্ব
১।
এই যে আঁধার, প্রথম ভোরের গালে এই তো আবির
সেই সন্ধেটার কথা কখনও ভুলব না। দিনক্ষণতারিখের কিচ্ছু মনে নেই। তবে শীতকাল ছিল নিশ্চয়ই, জানালা সব বন্ধ ছিল, মোমবাতি জ্বলেছিল প্রায় নিষ্কম্প শিখায়। কমলা অন্ধকারে কিছু দূর থেকেই যেন ভেসে আসছিল একটা স্বর। একেবারে নাটকীয়তাহীন, সম্পূর্ণ আটপৌরে চালে কবিতাটা বলে চলা সত্ত্বেও শব্দ থেকে শব্দে যাওয়ার নিরুচ্চার মুহূর্তের ফাঁক দিয়ে ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছিল সযত্নে আড়াল করা আঘাত — ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়।
ফের কেউ এল বুঝি, আহত হৃদয়? না কেউ নয়
পথিক কোনও, চলে যাবে, কে জানে কোথায়
রাত অতিক্রান্তপ্রায়, তারাদের ঝড় ফিকে হয়ে যায়
মহলে মহলে কামরায় টলমলে প্রদীপের স্বপ্নাতুর শিখা তন্দ্রায়
পথ চেয়ে চেয়ে শেষে হরেক পথিকজন এখন ঘুমায়
পায়ের চিহ্নগুলো অজানা অচেনা ধুলো আবছা করে যায়
এইবার প্রদীপ নিভাও, ঢেলে দাও মদ পেয়ালায়
এবার শিকল দাও স্বপ্নহীন নিজস্ব সব দরজায়
কেউ, কেউ আর আসবে না এই ঠিকানায়
(একাকিত্ব। মূল কবিতা ‘তনহায়ি’। পৃ ৭১। নক্শ-ই-ফরিয়াদি। নুসখাহা-এ-বফা, এজুকেশনাল পাবলিশিং হাউস, দিল্লি, ১৯৮৬।)
যে কবিতাটা আমরা সেদিন মৃদু দুলতে থাকা কমলা অন্ধকারে শুনেছিলাম তিনজনে বসে, তার বাংলা তরজমা এমনই হতে পারত। তিনজন — আমি, আমার বাল্যবন্ধু পার্থপ্রতিম এবং সে সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির কিংবদন্তি অধ্যাপক জ্যোতি ভট্টাচার্য। কিন্তু তরজমাটা সেদিন এ রকম হয়নি। আর হয়নি বলেই সেই সন্ধ্যায়, হয়তো বাইশ বছর বয়সে বড়ো জোর, ফয়েজ়ের স্বর নিজের অস্তিত্বে শুষে নেওয়ার প্রথম সুযোগ ঘটে গেল। সালটা সম্ভবত ১৯৮৯। সবে কিছু উর্দু শিখেছি। কলকাতা বুক ফেয়ারে ময়দানে স্টলের পর স্টলে খুঁজতে খুঁজতে খুঁজতে খুঁজতে হাতে একটা বই চলে এসেছিল তার ক’বছর আগেই — The Unicorn and the Dancing Girl. Poems of Faiz Ahmed Faiz With Original Text. তরজমা দাউদ কামাল, সম্পাদনা ও সঞ্চয়ন খালিদ হাসান।
বই কেনার এমন রুদ্ধশ্বাস অভিজ্ঞতা আমার এ পর্যন্ত আর হয়নি। তখন আমি প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র, হিন্দু হস্টেলের বাসিন্দা। ছুটতে ছুটতে হস্টেলে ফিরে নাওয়া-খাওয়া ভুলে সেই কবিতায় ডুবে গেলাম। আর পড়তে পড়তে যতই বুঝতে থাকলাম এ তরজমা একেবারে যাকে বলে কবিতার দফারফা, ততই মনের মধ্যে ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকল এক ভয়ঙ্কর বেয়াদব বাসনা — বাংলায় ফয়েজ় তরজমা করতেই হবে। ঘোরের মধ্যে কাটল কয়েক বছর। থার্ড ইয়ারে আমি একটি ক্লাস করেছিলাম। কলেজের বড়বাবু দিলিপদা বললেন, তোমাকে ভাই পরীক্ষায় বসতে গেলে রজতের কাছ থেকে পারমিশন লিখিয়ে নিয়ে আসতে হবে। প্রণম্য রজতকান্ত রায়, আমাদের ইতিহাস বিভাগের প্রধান, কার্পণ্য করেননি।
একটা খয়েরি ডায়েরি ছিল। তার প্রথম পাতায় ইন্ডিয়া টুডে থেকে কেটে লাগান অমিতাভ বচ্চনের এক দুরন্ত ছবি। সেই ডায়েরি ফয়েজ়ের কবিতায় ভরে উঠতে লাগল। সেই না দেখে একদিন পার্থ বলল, এগুলো তো এবারে ছাপাতে হয়। হয় তো। আমি তখন ফুটছি। ঠিক মনে নেই কী ভাবে, কিন্তু কোনও ভাবে অনুষ্টুপের সম্পাদক অনিল আচার্য-র দপ্তরের ঠিকানা যোগাড় করে তাঁর দেওয়া সময়মতো হাজির হলাম। হাতে ফুল্স-ক্যাপ সাদা কাগজে খান দশ-পনের কবিতার তরজমা পরিপাটি করে টোকা। আমি প্রায় নিশ্চিত যে, পত্রিকার পরের সংখ্যার সিংহভাগ জুড়েই থাকবে আমার পরমাশ্চর্য কাণ্ড। কিছু কাজ করছিলেন সম্পাদক। খানিক্ষণ দাঁড়ানোর পর জিজ্ঞাসা করলেন — তুমি প্রেসিডেন্সির ছেলে? হ্যাঁ। কারও একটা নাম করে বললেন, হ্যাঁ, ও বলছিল তুমি যেন কী অনুবাদ করেছ? কী? ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়ের অনেকগুলো কবিতা। ওঃ! ফয়েজ়! ফয়েজ় তো আমরা ওঁর মৃত্যুর পরেই করে দিয়েছি। বছর চার-পাঁচ আগেই। বলেই ফের কাগজের তাড়ায় ফিরে গেলেন। আমি অ্যাবাউট টার্ন করে চলে এলাম। এই আমার অনিল আচার্যর সঙ্গে প্রথম ও পরবর্তী এক দশকের জন্য শেষ মোলাকাত। এরপর ফের পরিচয় হলো যখন ২০০০ সালের আশেপাশে, প্রথম সাক্ষাতেই সে গপ্পো শুনিয়েছিলাম অনিলদাকে। সেই থেকে আজও আমার বয়োজ্যেষ্ঠ অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় বন্ধুদের মধ্যে একজন অনিলদা। অনেকে অনেক কথা বলে। দুটো কান দেওয়ার জন্য প্রকৃতিকে ধন্যবাদ দিয়ে এখনও মুখিয়ে থাকি অনুষ্টুপে বড়ো লেখা প্রকাশের জন্য। সৌভাগ্য, অনিলদা আর কোনও দিন হতাশ করেননি।
কিন্তু হিন্দু হস্টেলীয় বাছাই বাছাই গালির সঙ্গে সেদিনের সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা আমার কাছে শুনে পার্থ বলল, ধুর, এ ভাবে তোকে কেউ পাত্তা দেবে না। চল আগে জাঁদরেল কারও কাছ থেকে একটা রেকমেন্ডেশন নিয়ে আসি। অরণ্য পরিবৃত লাল ধুলোর দেশ সুদূর বিষ্ণুপুর থেকে এ শহরে জীবন-হাতড়াতে আসা আমাদের কাছে সে এক মহাচ্যালেঞ্জ। কে পড়বে এ সব লেখা? কারও সঙ্গে তো কোনও পরিচয়ই নেই বাংলাসাহিত্য দুনিয়ার, জাঁদরেল তো দূরস্ত্। কেবল কফি হাউসের দিন-নেই-রাত-নেই আড্ডার সময় সোমক দাসকে দেখতাম টেবিলে টেবিলে গিয়ে তাঁর উপন্যাস ‘ঘন শ্যামবাজার’ কেনার অনুরোধ করতে। আমি এক কপি কিনেছিলাম। অনেক অনেক বছর পরে সোমক-দার সঙ্গে বেশ হৃদ্যতা হয়েছিল। কিন্তু সেদিন পরিচয় হয়নি।
শেষে পার্থ একদিন বলল, শোন জ্যোতি ভট্টাচার্যর কাছে যাবি? আমাদের মাস্টার মশাই। বলে দেখতে পারি। ওঁর বিষয়ে আমি জানতাম। লাফিয়ে উঠলাম। ওরেব্বাস, সে তো বিরাট ব্যাপার — ফয়েজ়ের বন্ধুস্থানীয় ছিলেন শুনেছি। কয়েকদিন পরেই শুনলাম উনি রাজি। সেই খান দশ-পনের কবিতা নিয়েই হাজির হয়ে গেলাম গোলপার্কের বাড়িতে। পাক্কা সাহেব জ্যোতি বাবু ধবধবে পায়জামা আর গাউন পরে, পায়ের ওপর পা তুলে, চোখ বন্ধ করে একের পর এক আমার তরজমা শুনতে লাগলেন। কিছু কিছু যায়গায় টুকটাক শুধরোতে বললেন। প্রক্রিয়াটা আটকে গেল ‘তনহাই’ কবিতায় এসে। ‘গুল করো শম্মেঁ, বঢ়া দো ময়-ও-মিনা-ও-অয়াঘ’-এর তরজমায় যেমনি বলেছি ‘ছুড়ে ফেল প্রদীপ সব’, তড়াক করে চনমনিয়ে উঠলেন। কী বললে? আবার বললাম। বললেন, ফয়েজ়ে কোনও ছুড়ে-ফেলা-ফেলি নেই ভাই। কিন্তু আমার তখন বাইশ বছরের স্পর্ধা!— সটান বলে দিলাম, ওখানে আমি একটু লিবার্টি নিয়েছি, উনি তো কমিউনিস্ট, এটা আসলে একটা ফিউডাল ব্যবস্থার রিজেকশন… ইত্যাকার সদ্য-পড়া হজম-না-হওয়া নানা থিওরির আগডুম-বাগডুম। জ্যোতিবাবু মৃদু হেসে উঠে চলে গেলেন। আমরা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছি, পার্থর মুখে প্রমাদ গোণার ছায়া, কারণ ওর মাস্টারমশাই। অনতিবিলম্বে দেখি হাতে একটা টেপরেকর্ডার নিয়ে জ্যোতিবাবু ফের হাজির। আর ঠিক তখনই লোডশেডিং। মোম-গড়ান এবড়ো খেবড়ো একটা মোটা মোমবাতি জ্বালান হল টেবিলে। বললেন, অসুবিধা নেই, ব্যাটারিতেই চলবে। তারপর একটু ক্যাঁচ-কোঁচ রিওয়াইন্ড-ফরোয়ার্ড করে সেটা চালিয়ে দিলেন। তনহায়ি। ফয়েজ়ের নিজের কণ্ঠে।
এখানে কবিকণ্ঠে শুনে নিন সেই কবিতা — https://www.youtube.com/watch?v=WHeafC0BeoU
একটা অমোঘ শিক্ষা হয়ে গেল। নিমেষে বুঝতে পারলাম কোথায় আমার অনুবাদ মুখথুবড়ে পড়েছে। এরপর দরজা অবধি আমাদের এগিয়ে দিতে এসে, আমার পিঠে একটা চাপ্পড় মেরে বললেন, ইয়াং ম্যান, কোনও কবিকে ট্র্যান্সলেট করতে হলে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘকাল বসবাস করতে হয়।
কিন্তু মানলাম না। তার কয়েক বছর পরেই যখন কলেজ স্ট্রিটের একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত পাবলিশার বললেন, ‘মূল থেকে ফয়েজ় করেছো? আমি ছাপব।’ লোভ সামলাতে পারিনি। ১৯৯২ সালের জানুয়ারিতে বইটা বেরিয়ে গেল — উতলা হোস্নে প্রাণ, ধীরে— নামটা ফয়েজ়েরই একটা কবিতা থেকে সরাসরি নেওয়া — অ্যায় দিল-এ-বেতাব, ঠ্যাহর।
নিকষ অন্ধকার — এ যে আসতেই থাকে দমকে দমকে
রক্তের ফিনকি যেন রাত্রির প্রতি শিরা থেকে
এমনই চলেছে বুঝি জীবনের নাড়ি-স্পন্দন
নেশার কুয়াশা কেটে সম্বিৎ পাচ্ছে দুই বিশ্বভূবন
বয়ে যাক, আরও বয়ে যাক ঊষ্ণ রুধির রাত্রির
এই যে অন্ধকার, প্রথমভোরের গালে এই তো আবির
সেই ভোর এই হলো বলে, উতলা হোস্নে প্রাণ, ধীরে
শৃঙ্খল ঝঙ্কার এখনও সঙ্গীতের পর্দা ঘিরে ঘিরে
হওয়া-না-হাওয়ার সুতো এখনও নিরঙ্কুশ ক্ষমতার হাতে
চোখের জলের ফোঁটা ঝরে পড়ে টলটলে ভরা পেয়ালাতে
টলমলে পা, প্রথার বেড়ির পাকে কষে বাঁধা তাও
প্রেমিক পাগলদের এবার পাগল হতে দাও
আমাদের যত পানশালা, সত্যিই পানশালা হোক এইবার
নিশ্চল পরম্পরার দাপট যত হবে চুরমার
সরে যাবে জগদ্দল প্রথার যত ভার
শিকল ঝনঝনাক, ঝনঝনাক ঝনঝনাতে চায় যত বার
(উতলা হোস্নে প্রাণ, ধীরে। মূল কবিতা ‘অ্যায় দিল-এ-বেতাব, ঠ্যাহর’। পৃ ১২। দস্ত-এ-সবা। নুসখাহা-এ-বফা, এজুকেশনাল পাবলিশিং হাউস, দিল্লি, ১৯৮৬।)
এ বই বহুকাল আউট অফ প্রিন্ট। এতে ছিল ফয়েজ়ের তিরিশটি কবিতা এবং পঁচিশটি বাছাই শে’র-এর বাংলা তরজমা। আমার তরজমাগুলোর মধ্যে থেকে নিজেই অনেক ঝাড়াই বাছাই করে এগুলো প্রকাশের যোগ্য মনে করেছিলাম। কিন্তু এতগুলো কবিতা আমি পেলাম কোথা থেকে? কলকাতায় কোথায় উর্দু কেতাব মেলে কোনও ধারণাই নেই। রেকমেন্ডেশন না দিলেও জ্যোতি বাবু সেদিন আমায় একটা হদিশ দিয়ে ছিলেন — হিন্দু হস্টেলে থাকো তো! পিছনেই তো মহম্মদ আলি স্কোয়্যার। ঠিক উল্টো দিকের রাস্তা দিয়ে ঢুকে পড়ে সোজা হাঁটা লাগাবে। যতক্ষণ না চিৎপুর রোডে ধাক্কা খাচ্ছ। রাইট টার্ন। তোমার ডান দিকে পড়বে নাখোদা মসজিদ। ঠিক তার উল্টোদিকে, একটু খুঁজে নিয়ো একটা ঘুপচি দোকান — উসমানিয়া বুক ডিপো। সব পাবে।
লাগালাম হাঁটা। কলকাতার মধ্যে এক আশ্চর্য কলকাতার সঙ্গে আমার পরিচয় হল, এই ৩০ বছর পরেও যার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক আজও অটুট— ঠাসাঠাসি ট্রাকের সারিতে যন্ত্রবৎ পাটাতন বেয়ে উঠ মাল বোঝাই করতে থাকা ছেঁড়া-গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা বিহারী কুলিদের চিৎকার, গুঁতোগুঁতি ভিড়ের মধ্যেই ঠেলা-গাড়ির চালকের হুঙ্কার, শো-কেসের পর শো-কেসে বাটিতে বাটিতে সাজান ঝলমলে রঙিন পাথরের পিছনে ধবধবে কুর্তা-পাজামা-ফেজ টুপি আর মেহদি-করা-কমলা দাড়িওয়ালা জওহরি, শ্রীজবরেশ্বর মহাদেব মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি, ধূপ-ধুনো-চরণামৃতর গন্ধে ধীরে ধীরে মিশে যাওয়া নেহারি, ডাল-গোশ্ত, বোটি কাবাব, সদ্য সেঁকা তন্দুরির গরম ধুমায়িত নোনতা সুবাস, ঘি-চবচবে মুঘলাই মেঠাইয়ের হালুইকর, ১৯৩৬-এর মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় জেল খেটে আসা কমিউনিস্টদের ডেরার অগোছাল বাড়িটা, বাহারে পাঞ্জাবি, টুপি, কড়া-মাড়-দেওয়া চেক কাটা লুঙ্গি, আত্তরদান থেকে আলবোলা সাজান পিতল-কাঁসার দোকান, লাল দাপুটে নাখোদা মসজিদ, কুরান শরিফ আর হরেক কিসিমের উগ্র রঙিন প্রচ্ছদের ইসলামি কেতাবের দোকান।
কিন্তু সেই সব কোনও দোকানে নেই ফয়েজ়ের একটিও বই। অনেক খুঁজেপেতে শেষে মিলে গেল একরত্তি উসমানিয়া বুক ডিপো। কলকাতার উর্দু-সাহিত্য গ্রন্থের সেরা ঠিকানা। আজও আছে সে দোকান, তবে নাখোদার উল্টো দিকে নয়, উঠে এসেছে জ়াকারিয়া স্ট্রিটে। সেই উসমানিয়া বুক ডিপোতে মিলল ফয়েজ়, কিন্তু মাত্র খান দুয়েক। তা হলে বাকি কবিতা? সে এক দীর্ঘ প্রতীক্ষা। সহপাঠী বন্ধু শুভজ্যোতি এমএ পড়তে চলে গেল দিল্লি — জে.এন.ইউ। তার কয়েক মাস পরেই এল নীল ইনল্যান্ড লেটার — শোন, তোর ফয়েজ়ের কমপ্লিট কালেকশন এখানে লাইব্রেরিতে আছে। আমি তো পড়তে-ফড়তে পারি না। তোকে এসে দেখেশুনে জেরক্স করে নিতে হবে! পাগলের মতো ছুটলাম হাওড়া। রাজধানী এক্সপ্রেসে টিকিটের রেস্তো তখন স্বপ্নাতীত। পূর্বা এক্সপ্রেসের থ্রি-টিয়ারে নয়ি দিল্লি — জীবনের দীর্ঘতম ২৪ ঘণ্টা।
‘হাঁ-হাঁ। কালেকশন হ্যায়। নুসখাহা-এ-বফা।’ ফয়েজ়-এর সব কটা কাগ্যগ্রন্থ দু’ মলাটের মধ্যে — নক্শ-এ-ফরিয়াদি (অভিযোগী হৃদয়ের ছাপ), দস্ত-এ-সবা (ভোরের হাওয়ার হাত), জ়িন্দাঁ-নামা (কারাগারের হালখাতা), দস্ত-এ-তহ-এ-সঙ্গ্ (পাথর চাপা হাত),সর-এ-ওয়াদি-এ-সিনা (সিনা উপত্যকার মাঝে), শাম-এ-শহর-এ-ইয়ারাঁ (সুহৃদের শহরে সন্ধ্যা), মেরে দিল মেরে মুসাফির (প্রাণ আমার পথিক আমার), ঘুবার-এ-অইয়াম (সময়ের ধুলোঝড়)। এই হলো ফয়েজ় আহমদ ফয়েজ়ের সারা জীবনের নুসখাহা-এ-বফা, বিশ্বাসবিধি। দু’ হাতে ভালো করে ধরি, আঁকড়ে ধরি। বাজটা পড়ল তার পরেই।
‘পুরোটা জেরক্স করে নিতে কত লাগবেরে?’ শুভোর কাছে জানতে চাই। শুভো প্রশ্ন চালান করে দেয় কাউন্টারে বসা ভদ্রলোকের কাছে।
‘পুরি কিতাব?’
‘হাঁ-জি।’
‘পুরি কিতাব কেয়সে হোগি?’
‘কাহে?’
‘না। তিরিশ পাতার বেশি একসঙ্গে দেওয়ার নিয়ম নেই!’
চোখের সামনে দুনিয়াটা দপ করে নিভে গেল। আরও দুবার গিয়েছিল, বহু বহু বছর পরে। একবার তেহরানে — একগুচ্ছ সাদা গোলাপ হাতে বত্রিশ বছর বয়সে অকাল প্রয়াত ফার্সি কবি ফুরুঘ ফারোখজ়াদের সমাধির ভাঙাচোরা গোরস্তানে ঢোকার গেটে।
আমি রাত্রির গভীর থেকে কথা বলি
কথা বলি অন্ধকারের গভীর থেকে
আর রাত্রির গভীর থেকে বলি
যদি আমার বাড়িতে তুমি আসো, মেহেরবান, আমার জন্যে এনো প্রদীপ একটা
আর একটা জানালাও এনো
যাতে আমি দেখতে পাই
আনন্দে ভরপুর রাস্তার কলকলে ভিড়।
(উপহার। মূল কবিতা ‘হাদিয়েহ্’)
ফুরুঘের এহেন কবিতা আমার রক্তে ঢুকে পড়ার পর ঠিক করেছিলাম তেহরানে গিয়ে কবির সমাধিতে একগোছা সাদা গোলাপ আমায় রাখতেই হবে। সে জন্যই আমার ইরান সফর। সেই সফরের শেষ দিনে হাজির হয়ে গেলাম তেহরানের বিশাল পাঁচিল ঘেরা জ়হিরোদ্দোল্লে গোরস্তানের গেটে। হবে না। আজ শুধু মহিলাদের প্রবেশের অনুমতি, পুরুষদের নয়। কাল আসতে হবে। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমার দিল্লি ফেরার ফ্লাইট। গোলাপ রেখেছিলাম। কিন্তু সে কাহিনি এখানে নয়, অন্যত্র বলেছি সে সফরের কথা বিস্তারে (ইরানে। প্রকাশক: গুরুচণ্ডা৯)। আবার একবার, লাহোরে। ফয়েজ়ের গোর যেখানে সেই পাড়াতেই। সে কিস্সাও শুনব এই দাস্তানগোয়িতেই কোনও এক সময়ে, কিন্তু এখন নয়।
এখন মাথায় হাত। তা হলে? পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকি আমরা দু’ জন। শুভো শেষ চেষ্টা করে — ইয়ে বান্দা কলকত্তাসে আয়া হুয়া হ্যায়। ও শহরে পাওয়া যায় না ফয়েজ়। কিছুতেই কি সম্ভব নয়? দীর্ঘ নিরবতা — ‘শাম কো আ যাও। লাইব্রেরি বন্ধ্ হোনে সে ঠিক পহলে।’ সেই সন্ধ্যায় ভদ্রলোকের শেষ কথাটা এখনও কানে লেগে আছে — ‘কিসিকো বাতানা নেহি।’ বেআইনি ফয়েজ় পাচার হয়ে গেল। সেই থেকে আজ অবধি এমন খুব কম দিনই গিয়েছে, যেদিন বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও একবার না একবার সেই মোটকা লম্বাটে বইটা উল্টাইনি। বিশ্বাসের বিধি।
কিন্তু সেই কেতাব বগল দাবা করে ফিরে এসে ‘অ্যায় দিল-এ-বেতাব, ঠ্যাহর’ কবিতাটার যে অনুবাদ করেছিলাম, সে তরজমার পোশাক সম্পূর্ণ আলাদা। ভূল করেছিলাম বলে এখনও মনে হয় না। কিছু স্বাধীনতা নিয়েছিলাম। আর সে ছিল গদ্যানুবাদ। পোশাকের এই তারতম্য এই কারণেই হয়েছিল যে, তার অনেক, অনেক পরে উপলব্ধি করেছি ফয়েজ়-এর কবিতার প্রাণভোমরা হল ‘তগজ়্জ়ুল’। যার কোনও বাংলা তরজমা হতে পারবে না। যার বোধ গজ়ল নামক উর্দু-ফার্সি কবিতা-আঙ্গিকের গভীর বোধ ছাড়া অসম্ভব। তাই ফয়েজ়ে পৌঁছতে গেলে বহুদূর পেছিয়ে গজ়লের খাসমহলে প্রবেশ করতে হবে সবার আগে।
আজকের এই পাঠ তবে শেষ করি মালকা-এ-তরন্নুম নূর জাহানের কণ্ঠে একটা গান শুনে, খালি গলায় এ গান ফয়েজকে গেয়ে শুনিয়ে ছিলেন নূর, যা আসলে নজম, কবিতা, কিন্তু যার শিরায় শিরায় তগজ্জুল…
শুনুন ও দেখুন নূরজাহানের কণ্ঠে ফয়েজ
দ্বিতীয় পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন ফয়েজ পরিক্রমা -দ্বিতীয় পর্ব
পড়লাম লেখাটা খুব ভালো লাগলো একটা নতুন কিছু মনে হল।
শ্রী নীলঞ্জন হাজরার লেখা প্রথম প্রথম পর্বটি পড়ে ভারী ভাল লাগলো। বইয়ের সন্ধানে কলকাতা থেকে দিল্লী পর্যন্ত যাওয়া, তারপর সেখানে যা অভিজ্ঞতা —রোমাঞ্চ মেশান আগ্রহ নিয়ে পড়ে ফেললাম পুরোটা। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
পড়লাম , ভালো লাগলো – নস্টালজিয়ার ছোয়াঁ রয়েছে।
চিৎপুর এলাকার বিবরণ টা বেশ নস্টালজিক লাগলো। কলেজে পড়া কালিন আমরা মাঝে মধ্যে সেখানে যেতাম রুটি আর ভুনা খাবার জন্য- পাঁচ টাকা প্লেট।
যে কোনো লেখা, প্রবন্ধ, গল্প বা কবিতা কে গভীর ভাবে অনুধাবন করার জন্যে সেই লেখা ও লেখকের স্থান, কাল, সংস্কৃতির প্রেক্ষাপট সম্মদ্ধে ওয়াক-ই-বহাল হওয়া অনিবার্য। ফয়েজ এর ক্ষেত্রে আরো বেশি। উর্দু ভাসি মুসলিম সংস্কৃতি ও তার ঐতিহাসিক পটভূমিকার সাথে পৰিচিত না থাকলে এবং যেই ভাষায় কবি লিখেছেন তার সেমান্টিক্স আর সেমিওটিক্স কে রপ্ত না করলে অনুবাদ এর কাজ টা সফল হয় না। এই সমস্ত দিক বিচার করার পরেও বলা যেতে পারে যে ফয়েজ কে অনুবাদ করার সাহসী প্রকল্পে শ্রী হাজরা উত্তীর্ণ হয়েছেন।
পড়লাম , ভালো লাগলো – নস্টালজিয়ার ছোয়াঁ রয়েছে।
চিৎপুর এলাকার বিবরণ টা বেশ নস্টালজিক লাগলো। কলেজে পড়া কালিন আমরা মাঝে মধ্যে সেখানে যেতাম রুটি আর ভুনা খাবার জন্য- পাঁচ টাকা প্লেট।
যে কোনো লেখা, প্রবন্ধ, গল্প বা কবিতা কে গভীর ভাবে অনুধাবন করার জন্যে সেই লেখা ও লেখকের স্থান, কাল, সংস্কৃতির প্রেক্ষাপট সম্মদ্ধে ওয়াক-ই-বহাল হওয়া অনিবার্য। ফয়েজ এর ক্ষেত্রে আরো বেশি। উর্দু ভাসি মুসলিম সংস্কৃতি ও তার ঐতিহাসিক পটভূমিকার সাথে পৰিচিত না থাকলে এবং যেই ভাষায় কবি লিখেছেন তার সেমান্টিক্স আর সেমিওটিক্স কে রপ্ত না করলে অনুবাদ এর কাজ টা সফল হয় না। এই সমস্ত দিক বিচার করার পরেও বলা যেতে পারে যে ফয়েজ কে অনুবাদ করার সাহসী প্রকল্পে শ্রী হাজরা উত্তীর্ণ হয়েছেন।