
নতুন ধারাবাহিক
ভাবের ঘর প্রথম পর্ব
সপ্তর্ষি বিশ্বাস
বাড়ি কথা
আগা নাই, মাথা নাই
যার
সে’ই ভাবনা।
কোন পাখি কোন-খান থেকে কোন-খানে উড়ে যেতে যেতে ফেলে যায় একটি বীজ, একটি পালক আর আরো কোন পাখির ডানা-হাওয়া কিংবা ঝড়ো-বাতাস তাদের নিয়ে পাড়ি দেয় কার মনের ঠিক কোন চক্রবালের দিকে। এক পাখির এক রকমের পালক হয়ে ওঠে অন্য অনেক অচেনা অজানা পাখিদের পালক, একটি বীজ থেকে গজায় আর-গাছ, আর-লতা, আর-পাতা। ভাবনার এই অবলীল যাতায়াত প্রকৃতই কি একেবারে ‘আগা নাই, মাথা নাই’? হয়তো নাই। হয়তো আছে। যদি থাকে তবে তা আছে মন-খাদের এতোটাই অতলে কিংবা মন-পুকুরের আঘাটা ছেড়ে নেমে যাওয়া এবড়োখেবড়ো মাটি যেখানে সিঁড়ি হয়ে চলে গেছে পাতালে – সেখানে। তাকে ‘স্ট্রিম অফ কন্শাসনেস’ ইত্যাদি লুটিশে শনাক্তিকরনের আবডালে, আদতে, মনগড়া গড় ঠিকানাই পাওয়া যায় শুধু। আমার অন্তত এরকমই অনুভব। আমার? সম্ভবতঃ সম্পূর্ণ সত্য নয় কথাটি। আরো অনেকেই, অন্তত এ দেশে, এমত ভেবেছে বলেই, এই দেশে এক রকমের নাটকের, নাট্য শৈলীর নামই হয়েছে ‘ভাওনা’ বা ‘ভাবনা’। হয়তো তাঁদেরই নিহিত প্রেরণায় আমিও আর খুঁজতে যাইনা ভাবনার আঁতুড়ঘর। আমি বরং ভাবনার হাতে ছেড়ে দিই নিজেকে। ভেসে যেতে চাই। কিন্তু অভিকেন্দ্রিক টান ছাড়া ভাসবার, নিতান্ত শূন্যে, ভাগ্য আমার নেই। কোনো পাতাল-টান, তারও ‘আগা নাই, মাথা নাই’, নামিয়ে আনে। নামিয়ে আনে, কোথায়? আজ যেমন হলো। দেখলাম দক্ষিণের এই ‘সিলিকন নগর’, তার আকাশেও শরতের চিহ্ন। এই যে নগর, তার আকাশে ‘বাণিজ্য’ লুটিশ হয়ে ঝুলে আছে অনেক বছর। বাণিজ্য আর তার বিস্তার। সর্বত্র। বিদেশী বণিক টাকা আর ডলারের ফারাকের মূল্যে এখানে গড়েছে ‘আইটি কলোনী’। ঝোপ বুঝে তাদেরই ভাই-ভাতিজা’রা তুলছে মস্ত সব চোখ ঝলসে দেওয়া বস্তি। “মাত্র কোটি টাকায় কিনে নিন’ বিজ্ঞাপন অনুরণিত মন, মগজ, চোখ, কান। … এই ঘটনা সর্বত্র। ঘটছিল। নিও লিবারেলি কালাযাদুতে তা অধুনা দুর্নিবার। মফস্বল, গঞ্জ, গ্রামও বাদ যাচ্ছেনা এই মুদ্রা-রাক্ষসের হাঁ থেকে। তবু দেখলাম, এর আকাশেও আজ শরতের চিহ্ন। দেখলাম, ভাবনা বল্লো, ‘ যা দেখলে, তা কি আছে সত্যই? না’কি তোমার মনের কোনো কুঠুরীতে যে শরৎ এখনো টিঁকে আছে, কোনো মতে, তাই ছায়া ফেল্লো বাইরের আকাশে?” এই বাণিজ্য-ধর্ষিত সময়েরই একজন কবির পংক্তি মনে এলো। কেন? কারন – কারন নেই। কারন ভাবনার, মনেপড়ার ‘আগা নাই মাথা নাই’। লিখেছেন ‘শরৎ, আনন্দের বাড়ি ফেরা’। আনন্দের? কোন আনন্দ? কিসের আনন্দ এই নগরে? না’কি সমস্ত নগর, শহর, বন্দর, বাজার থেকে সব পরবাসীর বাড়ি ফিরবার আনন্দিত ইচ্ছার কথাই লিখেছেন কবি? এবার ভাবনার ভিতরে ‘বাড়ি’ আর ‘ফেরা’ এই দুটি শব্দ হয়ে উঠলো নাবিক। ‘চকা নিকোবর’। হারিয়ে গেলাম ‘বাড়ি’ শব্দের সন্ধানে, বিস্তারে।
আমার মর্মে ‘বাড়ি’ আর ‘বাসা’ এখনো ভিন্ন। আমার মনে হয়েছে সব ‘বাসা’ হয়ে উঠতে পারেনা, ‘বাড়ি’, একজনের জীবনে। আবার কখন যে একটি নিতান্ত ‘বাসা’ই হয়েওঠে বাড়ি …একটা ‘বাজার’কেও মনে হয় ‘নিজের’। আশ্চর্য হতে হয় নিজেরই অন্দরে তাকিয়ে। এই বেঙ্গালোর শহর, আমার কাছে এখনো ‘বাজার’। এমন এক বাজার যার দেহে গ্রামের নাহোক অন্ততঃ করিমগঞ্জের মতো মফস্বল-বাজারের মায়াটুকুও নেই। তবু এবং আশ্চর্য …বেঙ্গালোরের এমজি রোডে একটি দোকানদারিচত্বর আছে। অনেক অনেক দোকানচত্বরেরই একটি। তবু একদিন, এমজি রোডে গিয়ে দেখি ওই একটি চত্বরে ‘অচিরেই বিক্রি হচ্ছে’ ঘোষনা আঁটা দেওয়ালে দেওয়ালে এবং কিনারে কিনারে কারা যেন ‘এমনটা হতে দেবোনা’ আন্দোলনের পোস্টারও রেখেছে লাগিয়ে। ওই বিশেষ চত্বরে ওই লুটিস দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো। কেন? সচেতনে, আমার কাছে,এই বেঙ্গালোর শহর এক ‘বাজার’। বড়লোকের বাজার।’আপস্টার্ট’দের স্বর্গ। আমার কাছে নরক। নিতান্তই পেটের ধান্দায় থাকা। তবু কেন মনটা খারাপ লাগলো? কেন বিদ্রোহী হয়ে উঠলো এই ‘বিক্রি লুটিস’ দেখে? কেননা এই চত্বরের বই-দোকানগুলোতে কাটিয়েছি অনেক ছুটিদুপুর, অনেক সন্ধ্যা — যখন এমজি রোডের কাছাকাছি বাস করতাম। পরেও, সুলতানপালিয়াবাস-কালেও এসেছি এই চত্বরে। বোর্ড-বাঁধাই ‘ডিভাইন কমেডি’, জিম করবেট অমনিবাস … বেশ কয়েকটি বোর্ড বাঁধাই গ্রন্থই আমার এখানের পাশাপাশি চারটি বইদোকানের থেকে কেনা। একটি দোকানের ছোকরাদের সঙ্গেতো এমনই ভাব হয়ে গেলো, যে, অন্য খদ্দের না থাকলে, দোকানের ভেতরেও সিগারেট ধরাতে দিতো। শুধু স্মিত হেসে সাবধান করে যেতো, প্রতিবারঃ ‘দেখবেন আগুন-পানির কান্ড না ঘটে যায় …’ … এই চত্বরেই সেই টিফিন-দোকান যাতে আছে সৈয়দ কিরমানির ফোটো। লেখা আছে এখানে সৈয়দ কিরমানি আসতেন, সকালে, প্র্যাকটিস শেষে, ব্রেকফাস্ট করতে। … আমি ক্রিকেটপ্রেমী… থুড়ি ক্রীড়া জগতের সঙ্গে সংশ্রবহীন। তবু ‘সৈয়দ কিরমানি’ আমার স্মৃতির টুকরো, বাবার রেডিওতে খেলাশোনার, রিলে ধরার জন্য এরিয়েল টাঙ্গানোর আর দেখাদেখি আমারো বাজারের দিকে গেলেই বায়না সোমেশস্যারের দোকান,’সংবাদ বিচিত্রা’, থেকে ‘খেলার আসর’ কিনে দেওয়ার আর ওই সব ‘খেলার আসর’ মানেই, তখনো,বেদী-প্রসন্ন-চন্দ্রশেখর, সৈয়দ কিরমানি …। ওই টিফিনদোকান’টিতে বসে, আদতে, আমি ছুঁতে চাইতাম ওই দিনগুলি, রাতগুলি …
এই কিরমানিধন্য টিফিনদোকান থাকবেনা? থাকবেনা এই বইদোকানগুলি? এই ‘জুস্’ওয়ালারা? এই পানসিগ্রেট বিক্রেতারা? সাইকেলে করে চা-কফি বেচে বেঁচেথাকা মানুষগুলির সংস্থান? এখানেও উঠে যাবে, ওই “নীলবর্ণ আইটি শৃগাল”দিগের মতো আপস্টার্ট ‘মল্’? … মনখারাপের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম আরেক সাবেক স্থানে “কোশি’স্ বার্ এন্ড রেস্টোরেন্ট”এ মাতাল হতে। সে আরেক কাহিনী … হয়তো একদিন দেখবো এই শহরের সবচেয়ে পুরাতন “কোশি’স্ বার্ এন্ড রেস্টোরেন্ট’ অ গিয়েছে মুছে। সেখানে খুলেগেছে ‘বাবা রামদেব জড়িবুটি কর্পোরেট শপ্’ নতুবা ‘মল’ নতুবা ফলাট…
মোদ্দা কথা এই, যে, ওই দোকানচত্বরের থাকা না থাকা, ওই বৃদ্ধ “কোশি’স্ বার্ এন্ড রেস্টোরেন্ট”এর থাকা না থাকা আমাকে স্পর্শ করলো। অর্থাৎ সচেতনে যা’ই বলিনা কেন অবচেতনে, গত ১৭-১৮ বছরে, মর্মে, অবচেতনে এই ‘ভংগা-লুরু বাজার’ হয়ে গিয়েছে আমার একটি অংশ অথবা আমিই হয়ে গেছি তার একটি অংশ।
পার হয়ে আসা বাড়িগুলি ঘিরে থাকে আমাকে। আমি নানা সময়ে আমার ‘থেকে আসা’, রেখে আসা নানান বাসার, বাড়ির ছবি এঁকেছি পেন্সিলে, তুলিতে।
১।
এই যে বাড়িটা, এটা আমার ‘বাড়ি’। আমার করিমগঞ্জের বাড়ি।
কিন্তু এই ছবিটির মতো আর নেই সে অনেক বছর। দিনগত, যাপনগত প্রয়োজনে তার স্থাপত্য, চেহারা গিয়েছে পাল্টে। আর্থ সামাজিক বাস্তবতা ছায়া ফেলেছে তার আবহে। তবু আমি এখনো বাস করি ওই বাড়িটিতেই। সেখান থেকেই রোজ সকালে যাই ইস্কুলে, ফিরে আসি ক্লাস শেষে, আড্ডা শেষে।
২।
এবারে সেই ‘বাড়ি’ যা আমার মনে থাকা প্রথম ‘বাড়ি’।
গোপীনাথ সিনেমা হল্ কে হাতের বাঁদিকে রেখে সোজা হাঁটতে থাকলে প্রথমে আসে পাব্লিক ইস্কুল। হাতের ডান দিকে। ইস্কুলের পরেই গলী। গলীর মাঝামাঝি তরজার নীচু বেড়া ঘেরা বাড়ি। মুখোমুখি জলা। কচুরী পানায় ঢাকা। জলার ঐ পারে ‘প্রফেসর পাড়া’। বাড়ির উঠানের এক পাশে নিম গাছ। অন্যপাশে ভিতর বাড়িতে যাওয়ার পথ। ভিতর বাড়ির উঠানের পাকঘর অন্য পাশে পুকুর। সেই জল থই থই পুকুর। অন্তহীন পুষ্করিণী। তারি অন্য পারে ভয়। গা ছম্ ছম্। কলা গাছের সাড়। বড় বড় কচু গাছের শিবির। কুয়াশা। অন্ধকার। ঐ অথৈ জলেই কতোবার ডুবে গেলো নৌকা, রাজা-রাজরার ময়ূরপঙ্খী, চাঁদ সওদাগরের মধুকর। ঐ পারাপারহীন পুকুরেই কতো বুদ্ধু-ভুতুম পাড়ি দিলো রাজকন্যার সন্ধানে …
ঐ পুকুরই সীমা। বাড়িটির। সীমানার তরজার বেড়ার কিনারে কিনারে আমগাছ। দক্ষিণের সীমানার ঐ পারে ইস্কুল। পাব্লিক ইস্কুল। ‘জেঠু’ ঐ ইস্কুলে পড়ান। এই ‘জেঠু’ যে বাড়িমালিক আর আমরা যে ‘ভাড়াটিয়া’, এই কদর্যতা আজো আসেনা মনে। ঐ পাব্লিক ইস্কুলেই একবার নাটক হয়েছিল। সেই চল্লিশ চোরের গল্প। সেই ‘আলিবাবা-মর্জিনা’। সেই ‘চিচিং ফাঁক-চিচিং বন্ধ্’।
সেই থেকেই মর্জিনা’কে মনে ধরে গেলো আমার। দিদিভাই, জেঠিমণি, সুধাপিসীদের কিনারে বসে আমি যখন বিভোর নাটকে তখনি কে যেন বলেছিল ‘ তোর সঙ্গে মর্জিনা’র বিয়া দিমু’। আহা, ‘বিয়া’ কি মধুর, কি রহস্যময় একটি উচ্চারণ! সেই তখনি শব্দটি তার মতো করে একটা জায়গা করে নিয়েছিল অতলে …
৩।
এর পরে চলে আসা করিমগঞ্জে। করিমগঞ্জে তিনটি ‘ভাড়াটিয়া’ বাসায় আমরা ছিলাম। ‘বাসা’ই কেননা অনেক ছবি, অনেক স্মৃতি সত্ত্বেও তারা আমাকে দেয়না তেমন আশ্রয় যেমন আশ্রয় “ছিনু মোরা সুলোচনে গোদাবরী তীরে …” তে। তবে ছবি আসে। উঠে আসে মাঝে মাঝেই। দেওয়াল ঢাকা এক বিরাট অঞ্চল। বিরাট গেট। রীতিমতো ফটক। ‘ফাটক’ও বলা যায়। মালিক মহাশয়ের চা-পাতা’র ব্যবসা। নিজেদের তেতলা। তখন বোধহয় চারতলার কাজ চলছে। আগে গরু-ঘর। আছে মস্ত পুকুর। আছে ‘গুদামঘর’। আর আছে আরো তিনটে মাঝারি সাইজের বাড়ি। প্রথমটি, সেই বিরাট, কালো, টিনের ফটক পার হয়েই। সেখানে যাঁরা থাকতেন সেই মহিলাকে ডাকতাম ‘পিসীমনি’। তাঁর নাম ছিল ‘সীমা’ যা আমার ছোটো পিসীরও নাম। হয়তো ওই নামের মিলেই দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতা। হয়তো পূর্ব পরিচয় ছিল। কেজানে। তবে পিসীমনি ছিলেন অপরূপা সুন্দরী। অন্ততঃ স্মৃতিতে তেমনই আঁকা আছে। ছিলেন স্নেহময়ী। বাগান করেছিলেন সামনে। ছোট্ট কিন্তু কল্পনাকে উস্কে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
পিসীমনিদের বাড়ির কিনার ধরে লম্বা পথ। ইঁটপাতা। নারকোল গাছের ছায়া। প্রান্তে আরো দুটি বাড়ি। আদতে একটিই বাড়ি। দুই ভাগে ভাগ করে ভাড়া দিয়েছেন ‘মালিক মশাই’।
বাড়িটির সমান্তরালেই পুকুর। তবে বেড়া দেওয়া। অন্য ভাগটিতে যারা ‘ভাড়াটিয়া’ তাদেরো আছে দুটি ছেলে। আমি আর মার ভাই’এর থেকে সামান্য বড়। সেই পুকুর থেকেই উঠে গিয়েছে জলের পাইপ। পাম্প দিয়ে জলতোলা। পুকুরটি ঘিরে সুপুরীর গাছ। ছায়া। পার হয়ে দেখা যায় ধুধু ধানমাঠের ইঙ্গিত। ওই বাড়িটির আবহে এখনো মিশে আছে গরু-ঘরের গোবর-গন্ধ আর চা-পাতা ঘ্রাণ।
৪।
এরপরে ‘******’এর বাড়ি। তাঁকে ডাকতাম ‘দাদু’ বলে। তখন নির্মীত হচ্ছে ‘আমাদের বাড়ি’। ‘নিজের বাড়ি’।
এই সেই বাড়ি, এই সেই গৃহ, যা চাঁদরাম মুন্সীর,যা, দিদিভাইকথিত গল্পের প্রতিটি শব্দে, যতিতে, ক্রমে নির্মীত হয়ে উঠছিল আমার মর্মে। সেই গৃহটির পিছনে নদী। খোয়াই। গৃহ আর নদীকে ঘিরে আছে আশ্চর্য নামগুলি – হবিগঞ্জ, বানিয়াচং, সিলেট … ঈশ্বরমাস্টর, কানকাটা গোপাল, কানা আজিজ, আলিমপীর, বাচ্চু ওস্তাগর, সরল খান …। সেই গৃহে, নদীর ধারে, আছে এক মন্দির, যা শূন্য। যা শিবের। যা চাঁদরাম মুন্সী নির্মাণ করেছিলেন কন্যা সন্তানের পিতা হওয়ার মানসে। যে বাসনা, চেষ্টা অসম্পূর্ণ রেখেই মঞ্চ থেকে ফেরার হয়েছিলেন মুন্সী… মন্দিরের আবডালে, নদীর ঘাটে, হরিমুদ্দি মাঝির হুঁকায় টান দিয়ে ধূমপানের স্বাদ, প্রথমবার, পেয়েছিলেন আমার তখনকিশোর ঠাকুর্দা। এই গৃহের মুখামুখি যে ধূধূ মাঠ, যা বর্ষায় সমুদ্র, সেখানেই, এক শীতদুপুরে হরেন্ড’র বিড়িতে টান দিয়েছিলেন আমার তখনবালক বাবা। বাবু, শিবেন্দ্র চক্রবর্তী, দেখেফেলেছিলেন সেই দৃশ্য। আমি জানতাম, একদিন, ওই মাঠেই, হাডু ডুডু খেলব আমিও, জানতাম ওই হরিমুদ্দির হুঁকায় টান দিয়ে তামাক খাওয়া শিখবার কথা আমারও।
সেই গৃহের বারান্দা খুব উঁচু। তাই বর্ষায় যদিবা উঠানে আসতো জল, বারান্দায় উঠতে পারতোনা। উঠানের সীমানা সূচিত সুপারী আর নারকোলের কাছে। বাইরের যে কোঠায় লোক এলে বসতে দেওয়া তার জানালার ধারে পাতাবাহারের পাহারা। বড়কোঠার পাশাপাশি কোঠায় দুটো ছোটো চৌকি জুড়ে দিয়ে বড় বিছানা। বাবা আর দিদিভাই ঘুমায়। যদিও চৌকি দুটি গায়ে গায়ে লাগানো তবু মাঝখানে ছোটো একটা ফাঁক। একটি চৌকিকে ‘হিন্দুস্থান’ আর অন্যটিকে ‘পাকিস্তান’ কল্পনা করে নিয়ে লাফ দিয়ে ‘স্তান’ থেকে ‘স্থানে’ আসা যাওয়ার খেলা খেলতে খেলতে ওই দুয়ের মাঝখানে হঠাৎই পা গলে গেলো আমার তখনবালক বাবার। চৌকির কোনায় লেগে মাথা ফাটল। অতঃপর, যথারীতি ডাক্তারবদ্যিহাসপাতাল। কপালে সেলাইব্যান্ডেজ। প্রায় বিঘৎগভীর সেই কাটা দাগ এখনো বাবার কপালে সুস্পষ্ট। – আমি জানতাম ওই দুই চৌকির বিছানাতে আমারো খেলা, আমারো মাথাফাটা – সমস্তই পুনরাভিনীত হবে। মনেহতো এই যে বাসা, ভাড়াবাড়ি, এই যে শহর – শিলচর, করিমগঞ্জ – সমস্তই সাময়িক। সমস্তই অবাস্তব। অলীক। মনেহতো একদিন না একদিন – এই ভাড়াবাড়ির পুকুরপাড়ের ঝোপঝাড় থেকে নয়তো পুকুরের ওই ধারে, বেড়া পারহয়ে, যে ধূধূ মাঠ, সেই মাঠ থেকে নয়তো পড়শীবাড়ির বাঁশঝাড়ের রহস্যময় আব্ছায়া থেকে একজন আসবেই। এসেই বলবেঃ “ …এইবার চলো তোমার আসল বাড়িতে, নিজের বাড়িতে। চলো তোমার আপন রাজ্যে, রাজত্বে, যে রাজ্যের তুমি রাজকুমার। শেষ হয়েছে তোমার অজ্ঞাতবাস পর্ব …” –সুতরাং বাবা যেদিন বাড়ি ফিরে বল্লো ‘কোর্টের কাজ হয়েগেছে, এই দেখ কাগজ”, যেদিন সব্বার মর্মের আনন্দটুকু টের পেলো নেহাৎ শিশুরাও অথচ দেখল সবারই চোখে জলের রেখা, সব্বার কথায় বার্তায় বোঝাগেলো বাবা জায়গা কিনেছে, সেখানে আমাদের ‘বাড়ি’ হবে তখুনি আমি, আমার মর্মের ময়দানবকে হুকুম দিলাম সেই গৃহের বারান্দা খুব উঁচু করে দিতে যাতে বর্ষায় যদিবা উঠানে আসে জল, বারান্দায় যেন উঠতে পারেনা। হুকুম দিলাম উঠানের সীমানা সূচিত করেদিতে সুপারী আর নারকোলের কাছে। বাইরের যে কোঠায় লোক এলে বসতে দেওয়া হবে তার জানালার ধারে বসাতে বললাম পাতাবাহারের পাহারা। মর্ম-ময়দানবকে এ’ও হুকুম দিলাম যে বড়কোঠার পাশাপাশি কোঠায় দুটো ছোটো চৌকি জুড়ে দিয়ে বড় বিছানা করে রাখতে …
অবশেষে একদিন সূচিত হল যাত্রালগ্ন আমার নিজস্ব ইন্দ্রপ্রস্থে গমনের। এসে দেখলাম, আশ্চর্য হয়ে, যে, খোয়াই নদি নাহোক্, একটি বহতা খাল সত্যই আমার মর্ম-ময়দানব এনে রেখেছে আমার গৃহের আবহে। দেখলাম নারকোল গাছ না হোক সুপুরীর সাড়ির প্রহরা রয়েছে সীমানায়। রয়েছে অর্জুনবৃক্ষেরা, রয়েছে বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড়ের হুহু বাতাস। এ’ও আশ্চর্য, যে, আমাদের বাড়ির সীমানায় না হলেও মুখোমুখি, বড় রাস্তার ওই ধারে, প্রমেশ ভট্টাচার্যের বিরাট পুকুরের পাড়ে একটি শিব মন্দির। সেও, হায়, হয় শিবহীন। আমার স্বপ্নের সেই গৃহেও, এক শিব মন্দির, যা শূন্য। যা শিবের। যা চাঁদরাম মুন্সী নির্মাণ করেছিলেন কন্যা সন্তানের পিতা হওয়ার মানসে আর প্রমেশ ভট্টাচার্যের মন্দিরে শিব ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মর্মে ছিল, দুইটি কন্যার পরে, পুত্র সন্তানের পিতা হওয়ার সাধ।
অবশ্যই কৃতজ্ঞ বোধ করেছিলাম মর্ম-ময়দানবের প্রতি করিমগঞ্জ কলেজ কো-অপারেটিভ থেকে ‘লোন’ নিয়ে কেনা জমির উপরে তৈয়ার হওয়া এই গৃহটির জন্য। তথাপি কেন যেন এ’ও মনে হয়েছিল এখনো সময় হয়নি আমার আত্মপ্রকাশের। শেষ হয়নি আমার অজ্ঞাতবাস পর্ব। এ শুধু বনবাস পর্বের সমাপ্তি। হ্যাঁ, এইভাবেই, বাপ-ঠাকুর্দা’র মর্মগত আকাশকুসুমের বীজ উড়ে এসে পড়েছিল আমাদের, আমাহেন কিছু অতীতবিলাসীর, শোণিতে। বীজ, শোণিতে, এইভাবেই, ক্রমে হয়ে উঠেছিল বিরাট মহীরুহ।
৫।
আরেকটি দিনের কথা মনেপড়ে। সে’ও সেই বয়ঃসন্ধির সময়েরি। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েগেছে। সঙ্গীসাথী যারা ছিল সবাই মিলে গিয়েছে বেড়াতে। আমার অনুমতি মেলেনি। ফলে আমি বাড়িতে। একা। যেন আমি এই শহরেই একা। রাজাদারো কিযেন পরীক্ষা সামনে। তাই বাড়িআসা হয়না তারো। আমার সঙ্গী বলতে বই আর গান। মাঝে মাঝে বেড়িয়ে যাই। সাইকেলে চেপে চক্কড় লাগিয়ে আসি শহরে। সেই চক্কড়ে একাকীত্ব বাড়ে বৈ কমেনা …
এরিমধ্যে এসেগেলো বর্ষাকাল। তুমুল বৃষ্টিবাদল। সেদিন সকাল থেকেই মন ভালো লাগছিল না। তখন কি আর জানতাম যে ঐ অকারণ মনখারাপ বয়ঃসন্ধিরই আরেক লক্ষণ? বিভূতি রচনাবলী নিলাম। মন বসলোনা। নিলাম পরশুরাম। ভাল্লাগলোনা।আগাথা ক্রিস্টিতেও তাই …ভাবলাম সাইকেলে চেপে একটা চক্কড় মেরেএলে … কোনো গলীঘুঁজিতে লুকিয়ে একটা দুটো সিগারেট টেনেএলে হয়তো ঠিক হবে মন মেজাজ … তখনি তোড়ে নামলো বৃষ্টি …
দুপুরের দিক। বৃষ্টি ধরেছে ঠিক। তবে থামেনি। এদিকে চলেগেছে কারেন্ট। নাহলে টেপ রেকর্ডারটা চালিয়ে গান শোনাযেতো আর নাহলে টিভিটা খুলে অন্ততঃ দেখাযেতো কি চলছে … অগত্যা সেই প্রায় ভুলেযাওয়া ব্যাটারী চালিত রেডিওর শরণ নিতে হলো … সেটাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বসলাম আমাদের বসবার ঘরে। সারাবাড়িতে ঐ কোঠাটিতেই শুধু দুটো কাঁচের জানালা আছে … বাকী সমস্ত কোঠার জানালা দরজা বন্ধ। বৃষ্টির ছাঁট ঢোকে …
বাইরের কোঠার কাঁচের জানালার পর্দা সড়িয়ে গিয়ে বসলাম একটা চেয়ারে। বাইরে তখনো বৃষ্টি। জানালার কাছে ছোটো ছোটো ফুলগাছের বৃষ্টিভেজা মাথা … আকাশে মেঘ … ব্যাটারী চালিত সেই রেডিওর নব ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে খুঁজছি যদি পাওয়া যায় শোনার মতন কিছু … এই ষ্টেশনে যদি চলছে অতি খেজুড়ে আধুনিক গান তো অন্যটাতে কোন অচেনা ভাষায় খবর …ভাবছি এটাও বন্ধকরে এবার গিয়ে শুয়েই পরবো … ঠিক তখন … হ্যাঁ ঠিক তখনি শুনলাম … কোন ষ্টেশন বোঝাগেলোনা তবে শুনলাম … আসরের শেষ শিল্পী সুচিত্রা মিত্র … অনুরোধ আপনাদের আজিমগঞ্জ থেকে শেফালী, গীতালি … ইত্যাদি ইত্যাদি … টেপ রেকর্ডার আসার পরথেকে রেডিওর সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় ছিলোনা বললেই চলে তাই ঠিক ধরতে পারলাম না কোন ষ্টেশন … আর তখনি বেজে উঠলো গানটি … পরে ঐ গান শুনেছি বহুবার দেবব্রত বিশ্বাসের কন্ঠে … ভালোও লেগেছে খুব … তথাপি ঐ দিনের ঐ শোনাটি আমার চির কৃতজ্ঞ হয়েআছে সুচিত্রা মিত্র’র কাছেই …
যেন আমার সেই বাদলা দিনের মনখারাপই সুরের অবয়ব পেলো তাঁর সেদিনের সেই কন্ঠে, সেই গানেঃ
‘এই শ্রাবণ-বেলা বাদলঝরা যূথীবনের গন্ধে ভরা …’
একটু দ্রুতলয়ে দেবব্রত গেয়েছেন গানটা। সুচিত্রা গেয়েছেন অতি ধীরলয়ে … হায় সেদিন আমার মন ঐ গানের ঐ ধীর লয়টিতেই পেয়েছিল আশ্রয়, পেয়েগেলো আশ্রয় … অন্তরায় এসে সুচিত্রা গাইলেনঃ
‘হঠাৎ কখন অজানা সে আসবে আমার দ্বারের পাশে
বাদল সাঁঝের আঁধার মাঝে গান গাবে প্রাণ পাগল করা
এই শ্রাবণ-বেলা বাদলঝরা যূথীবনের গন্ধে ভরা …’
গান থামলো। শেষহলো অনুরোধের আসর। কোন ষ্টেশন জানার ইচ্ছা হলোনা। বন্ধ করেদিলাম রেডিও কারন তখন আমার মনেপ্রাণে বেজেউঠেছে সেই অন্তহীন প্রতীক্ষা যার শেষে ‘হঠাৎ কখন অজানা সে আসবে আমার দ্বারের পাশে … বাদল সাঁঝের আঁধার মাঝে গান গাবে প্রাণ পাগল করা …’
তারপর জীবনে এসেছে গেছে আরো আরো বর্ষার দিন, বর্ষার রাত … শুনেছি রবীন্দ্রনাথের আরো আরো বর্ষার গান … শুনেছি অনেকের কন্ঠে … শুনেছি সুচিত্রার কন্ঠেও তথাপি ঐ একটি বর্ষার দুপুর, তার আনন্দ ও বিষাদ ঘিরে আজো বেজে চলেছেন সুচিত্রা মিত্র। সুচিত্রা মিত্র’ই শুধু ….
৬।
নিজের মতো নিজের ভিটেটিকেও অচেনা মনেহয় কছুদিনের অসাক্ষাতে যেমন হয়েছিল সেবার বড়মামা এসেছিল যে বছর আর বাবুর স্ট্রোক হওয়ার খবর এসেছিল দুপুরে তন্দ্রাদিদিদের বাড়িতে ১১৮ ফোন নাম্বার নাম্বার প্লিজ কল বুকিং এর যুগ। পাড়ায় প্রায় একমাত্র । টেলিফোন আশ্চর্য রহস্যময় ফেলুদার কাছে ফোন আসে ক্রিং ক্রিং বেজে ওঠে দীপক চ্যাটার্জি র টেলিফোন ধূমায়িত চায়ের কাপে চুমুক দেয় দীপক আর রিসিভারে কান রেখে দীপকের সহকারী রতনলাল শোনে ফোনের অন্যপ্রান্তে লালবাজার থানার ওসি মিস্টার গুপ্ত খুন বিভৎস খুন মুখার্জি ভিলাতে ছোট কাকু জানায় গতকাল রাতেই ঘটেছে ঘটনা। বাবু ফিরছিলেন গান শেখানোর কাজ সেড়ে ঘরে ফিরেই ‘মাস্টারবাবু আপনাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন শীতের রাত্রেও ঘামছেন ভাবে’ ‘ও কিছুনা টায়ার্ড লাগছে’ বলতে বলতেই …সকালে মেডিকেল কলেজে আনার পরে ফোন ছোটকাকুর । বাবা সঙ্গে সঙ্গে রওয়ানা দিয়েছিল । ক্লাস থ্রি ফোরের কথা বাবা বাড়ি থাকবেনা অতি মস্তি সংবাদ আমদের দুই ভাইয়ের ।
বাবু বাবার জন্মদাতা পিতা নন তখনো ঠিক বুঝতাম না তবে বিয়ে না করলে ছেলেমেয়ে হয়না জানতাম আর বাবু চিরকুমার এই খটকা। উত্তর আদতে বাবু বাবার বাবার মামা । গান পাগল । ‘ পরের জায়গা পরের জমি ‘ কানে বাজে । কানে বাজে ‘এপারে মুখর হল কেকা ওই’, ‘একা মোর গানের তরী’ … তখন মেডিকেল কলেজের জেনারেল ওয়ার্ডে বাবা আর ছোটকাকু রাত জাগছে পালা করে । আমার বাবার ক্যামোথেরাপির সময় মাত্র একরাতই আমি জেগেছি। হাসপাতালে মা আর ভাই জেগেছে।
মা থম ধরেগেছে। অতশত না বুঝে বাবু সেড়ে উঠবেন তবে সময় লাগবে বাবার থাকতে হবে আরো কিছুদিন ৫৬ কিমি দূরের আরেক শহরে তদ্দিন আনন্দ আমাদের আর বড়মামা বিলাত থাকেন এসেছেন অনেক বছর পরে তাই ঘরে তালা দিয়ে মার সঙ্গে দুইভাই সেই ৫৬ কিমি রেলে পাড়ি দিয়ে ইস্টিশন তারাপুর থেকে রিক্সায় মামাবাড়ি মামাদের বাড়ি যদিও নয় লম্বা গলীর প্রান্তে পাতকুয়ার ডানদিকে লম্বা গলী ধরে যেতে যেতে মার একপায়ের চটি কিকরে হারাল কেজানে মেডিকেল কলেজে মাকে নিয়ে বড়মামা দেখে এল বাবুকে বাবার সঙ্গে দেখা আমাদেরো মেডিকেল কলেজে অন্যরকম বাবাকে দেখলাম না কামানো দাড়ি রোগা ছোটকাকুর চাকরি মেডিকেল কলেজেই ছোটকাকুর সঙ্গে পলস রেস্টুরেন্টে আমরা দুইভাই একটা ড্রাম বাজানো চাবিপুতুল বায়না ধরে আমার বড়মামা ক্রিকেটের স্টাম্প, বল, ব্যাট আর সব মাসীদের মধ্যে ফুলমাসীই শুধু বই নীহার রঞ্জন গুপ্তর কিশোর অমনিবাস রাজকুমার আর একটা গল্প নিঝুমপুর নিঝুমপুর দিয়ে আরম্ভ আর সুমথনাথ ঘোষেরও কিশোর রচনা… ‘আইভ্যান হো’, বাংলায়, তাই ফুলমাসিকে এরপরে আর না দেখলেও আমার ফেভারিট…
মা ধরে পড়লো বড়মামাকে বাড়ি আমার তোমাকে দেখে যেতে হবেই,দাদা, অনেকপরে বুঝেছি পূর্ব বাঙলা থেকে তাড়া খাওয়া আসামে আসামীদের হাতে খেদা খাওয়া বাঙালবাঙালীদের বাড়ি মানে ঠিক কি অবসেশন বাসে চেপে আসা হল কিমি ৫৬ পারহয়ে মা বমি করলো বাসে করলো আমিরাও নেমে রিক্সা নিয়ে বাপীদের বাড়ি থেকে চাবি বাপীও আছে ওই ফোটোতে বড়মামার তোলা নিজেই ওয়াশ করে পাঠাত বড়মামা কেরোসিন স্টোভে রান্না নেই কেরোসিন প্লাস্টিকের ঝাড়িকেন হাতে মা বড়মামা আবার বাপীদের বাড়ি এই বাড়ি আমাদের দখলে প্রায় দশদিনের অনুপস্থিতির অসাক্ষাতের পর আহা এই বাড়ি এই আমাদের তবু কেমন যেন অচেনা অচেনা অভিমানী অভিমানী লাজুক লাজুক ধুলোর আস্তরণ এখানে ওখানে পড়ার টেবিলে ইন্দ্রজাল কমিক্সে পুজা সংখ্যা আনন্দমেলায় ঘাস গজিয়েছে সিঁড়ি ঘিরে আগে গজানো ঘাস লম্বা হয়েছে মাথায় বেড়ায় বেড়ায় রিফুজি লতা হাতে দা নিয়ে বাবা সাফ করত ধূলার আস্তর রিফুজি লতার পাতাতেও শেফালীর রোগা ডালপালাতে পাতাতেও লাগিয়েছিলেন দিদিভাই এই শেফালী চারা গৃহপ্রবেশ হওয়ামাত্র নিজের হাতে এমনই শেফালিগাছ ছিল সেখানে বাবা খুব ভালবাসতেন শেফালী মানে আদিবাড়িতে বাংলাদেশে বাবা মানে ঠাকুর্দা আমার বাবার। গাছগুলি তখন অবশ্য নিতান্ত শিশু নাহলেও কিশোর বড়জোর যুবক অর্জুনগাছেরা পেছনের দিকে চারজন নদীর পারে দুইজন দাঁড়িয়ে যে দুইজন ঝুঁকেগেছে নদীর দিকে তারা আমার গাছবাড়ি অরণ্যদেব আমি তাদের পাতা গজিয়ে আমার বৃক্ষাসনটি ঢাকা পরেছে তবু যাওয়ার উপায় নেই ঘাস বেড়ে জংলা গমনপথে অরণ্যদেরবের পাকঘরের কিনার ঘেঁষে চিলতে বারান্দা ইঁট বসানো সিমেন্ট তখনো পড়েনি গায়ে পাকঘরেও বাঁশের বেড়া কোঠার দেওয়াল আর মাথার উপরের চালটুকু হলেই উঠে আসব বাবা বলতো রোজউ প্র্য বাড়ি যখন তৈরি হচ্ছে যা হোক একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই বাবু বলতেন আসলেই কাজ দেখতে লম্বা চশমা পরনে পাকা চুল ব্যাক ব্রাশ ক্যাপস্টেন সিগারেট কামানো মুখ এখন হাসপাতালে আমাদের চিনতে পেরেছেন কিনা কেজানে ভাবি নাহলে দু চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল কেন অবিরাম এখন ভেবে মনেহয় চিনেছিলেন হয়তো পাকঘরের কিনার ধরে পিছবাড়িতে বাঁশঝাড়ের তলা থেকে আমার নদী আমার গাছবাড়ি শীত শীত আদতে ছিল হেমন্ত পরে টের পেয়েছি তাই আরো ধূসর আরো শূন্য মনে হচ্ছিল সব মড়ে আসা রোদে পড়ে আসা বেলায় কারেন্টের লাইনও কাটা দেখেছিল মা আলো জ্বালাতে গিয়ে সন্ধ্যাবেলা মনে এলো অনেক বছর পরে ভারিকিনোতে নিজগৃহে ফিরে আসা সন্ধ্যাবেলা লারার সঙ্গে জিভাগোর পড়তে পড়তে আবার লন্ঠনের আলোতে রাত্রি আগেও তবু সেদিন অন্যরকম বড়মামা আর মা গল্পে মত্ত আর আমাদের স্বাধীনতা অন্ধকারে যদিও ছোট বাড়ি এখন বুঝি তখন মনে হতো বিপুল, যেন ভারিকিনোই, তবু এখনো অত রহস্য আর নেই কোথাও যা ছোটোবাড়ির আনাচে কানাচে।
রোদ পড়ে আসছে বড়মামা দাঁড় করালো মাকে মাকে ঘিরে আমরা বাপীও আছে ওই ফোটোতে গেটের পাশে রাস্তায় বাড়িটাও যাতে আসে ফোটোতে সামনের বারান্দায় দুটি রোগা সিমেন্ট খুঁটি চূনকাম হয়েছিল অনেক পরে দুই ধাপ সিঁড়ি শেফালীগাছ ফোটোটাতে যেন উঠে এসেছিল হেমন্তের হাহার সঙে অনেকদিন পর খালি বাড়িতে ফেরার অভিমান অপরিচয়।
বাড়িটা কেন আজো রইলোনা ওই রকম?
আমি ওই বাড়িটি ফিরে চাই।
৭।
এটি বাড়ি নয়। বাসা নয়। অন্য এক বাড়ির এক জানালা। তিনচারজন যুবতী, প্রায় যুবতী হয়েওঠা বোনেদের বাড়ির জানালা এটা। এই জানালায় ঝুলন্ত অন্তর্বাসগুলি চোখ টেনে নিতে আরম্ভ করেছিল ছয়ের কেলাসে পা দেওয়ার সময় থেকেই। ক্রমে, ওই ‘বোন’দের কারোর মুখোমুখি হলে নিজের সমস্ত অস্তত্বটিকেই যেন ‘চোখ’ করে নিয়ে মিলিয়ে দেখতে চাওয়া কোন অন্তর্বাসটি সে পরে আছে আজ কিংবা ওই ‘বোন’দের কে কোন অন্তর্বাসের মালকিন …
৮।
আরেকটি বাড়ি শক্তিকাকুর বাড়ি।
আমার নিজের বাড়ির পরেই কিংবা বহু ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশী অধিকার আমার ছিল যে বাড়ির আলোয়, বাতাসে, সে বাড়ি শক্তিকাকুর বাড়ি। বাবা আর শক্তিকাকু যে ‘মার পেটের ভাই’ নয় এই ‘বায়োলজিক্যাল’ অঘটনটি আজো পারিনি মানতে। বিবেকানন্দ রোডের পিচ সড়ক ছেড়ে বাঁধের পথ ধরে ফেরা, শহরময় আড্ডা সেড়ে, জ্যোৎস্নায়, কোনোদিন একা, কোনোদিন শক্তিকাকুর সঙ্গে গল্প করতে করতে …।
৯।
প্রতিটি ‘বাড়ি’ একেকটি ‘অডিও-ভিসুয়াল’ … আজএর ভাষার VLOG । আরো বাড়ি, আরো ছবি রয়েগেলো না লেখা, এখনো। তবে লিখবো। তবে আঁকবো তাদেরো। … হ্যাঁ, হোস্টেলও একটা ‘বাড়ি’। আমার প্রিয়তম বাড়িগুলির একটি। হোস্টেলে ঢোকার মুখেই ছিল এক কালীবাড়ি …
আর হোস্টেল চত্বরের অন্দরে ছিল দোকান ‘শীতেনের’। মধ্যরাতেই সেখানে বসতো মেলা। ছবিগুলি এইভাবেই মনে রেখেছে মন …
১০।
… বাড়ি। বাড়ি-ভাবনা এবার মোড় নিলো ‘ফেরা’ শব্দের টানে। এই সমস্ত বাড়ির, বাসার কাছে ফিরে যেতে চাই আমি। … ফিরে যেতে চাই? কিন্তু তা কি সম্ভব? ভাবনা বল্লো “আদৌ চাও কি ফিরে যেতে? তুমি পরবাসী। সত্য। কিন্তু তোমার আছে কি সত্যই কোনো ‘বাড়ি’? কোনো ‘ফেরা’? ‘ফেরা’ মানে যদি হয় একটি বিন্দুর থেকে একটি যাত্রার আরম্ভ আর তারপরে এই একই যাত্রা কিংবা একই যাত্রার অন্দরে, আরব-রাতের কাহিনীর মতন, আরো অনেক পথ, অনেক কাহিনী ঘুরে, চলে আসা সেই আরম্ভ-বিন্দুটিতে, তাহলে কোন বিন্দুটিতে ফিরতে চাও তুমি?’ … এইবার ভাবনা চল্লো ‘ফেরা’ শব্দকে নাবিক করে।
আদিলেখনঃ ১১/০৬/২০২১
ফিরে লেখাঃ ১৬/০৯/২০২৩