
ধারাবাহিক উপন্যাস কেদার – দশ
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
“অথাহমংশভাগেন দেবক্যাঃ পুত্রতাং শুভে/ প্রাপ্স্যামি ত্বং যশোদায়াং নন্দপত্ন্যাং ভবিষ্যসি //শ্রীমদ্ভাগবতম// স্কন্ধ ১০/ অধ্যায়/ শ্লোক ৯//
(হে যোগমায়া। আমি আমার পূর্ণ ষড়ৈশ্বর্য নিয়ে দেবকীর ছেলে হয়ে জন্ম নিচ্ছি। তুমিও নন্দ মহারাজের মহারাণী মা যশোদার কন্যারূপে জন্ম নাও।)
মহেশ সিংহানিয়া তলব করেছিল শহরে। সেদিন আর রণজয় সেন আসেনি। তলব করেছিল একটা কোট টাই পরা শহুরে বাবু দিয়ে। অতোগুলো মুরগির ক্ষতিপূরণ দিতে হবে অলোকানন্দাকে। অলোকানন্দা না করল না। বরং হিসেবনিকেশ বুঝে নিল। হাতে দেড় মাস সময়। পঞ্চান্ন হাজার টাকা। কোট টাই পরা লোকটা কালির প্যাড এনেছিল। অলোকানন্দা সবকিছু বুঝে নিয়ে টিপছাপ দিয়ে দিল কাগজে। শাশুড়ির কাশিটা দুদিন হলো বেড়েছে। অলোকানন্দা লোকটিকে বিদায় করে ঘরে গিয়ে শাশুড়ির কপালে হাত দিয়ে দেখল ধুম জ্বর। এদিকে ঘরে কৃষ্ণেন্দু নেই কদিন। শহরে ওদের সেমিস্টার পরীক্ষা চলছে। শাশুড়ির নেতিয়ে পড়া শরীরে বিয়ের প্রথম দিককার ঝাঁঝ এতোটুকু নেই। যেন কন্যাসন্তানের মতো তার কোলে সমর্পণ করে দিয়েছে সে। চারপাশে কানাঘুষো শোনে অলোকানন্দা। ভাইরাস জ্বর হচ্ছে। ডেঙ্গু হলো কি! হলে তো হাসপাতালে দেওয়া দরকার। কী করা যায়। সুকুমারীও যে মাসদুয়েক বেপাত্তা। ভাবতে ভাবতে দরজার সামনে দাঁড়াল অলোকানন্দা। তার দাদু তার এমন বাহারিয়া নাম রেখেছিল যখন, তখন নিশ্চিত ভেবেছিল, সে সহজে হেরে যাবে না। না। অলোকানন্দা হারবে না। প্রফুল্র শিকদারদের ছেলে। সদ্য টোটো কিনেছে। পাশে কয়েকটা বাড়ি পরেই থাকে। ওকে একবার বললে হয়। তাকে ‘কাকিমা কাকিমা’ করে। ছেলেটা ভালো মনে হয়।
অলোকানন্দা শিকদারদের বাড়ির সামনে গিয়ে ইতস্তত করছিল। শিকদারের বৌটা শয়তান। কথায় কথায় কৃষ্ণেন্দুর নাম তুলে খোঁটা শোনায়। কিন্তু অলোকানন্দা আবার চোয়াল শক্ত করল। সে হারবে না। উঠোন দাওয়া ধানের মড়াই পেরিয়ে গ্রিলের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে সে বেল দিতেই প্রফুল্ল বেরিয়ে এল।
-একি কাকিমা। তুমি? এসো। ভিতরে এসো।
-একটা বিপদে পড়েছি ভাই। খুব বিপদ।তোর ঠাম্মার শরীরটা একদম ভালো নেই। এদিকে বাড়িতে কৃষ্ণেন্দু নেই। আমি একদম একা।
-দাঁড়াও। শার্ট গলিয়ে আসছি।
প্রফুল্ল খুব সাহায্য করে দিল অলোকানন্দাকে।টোটো করেও গোকুলঘরিয়ার পথটুকু অলোকানন্দার মনে হল শেষ যেন আর হচ্ছে না। এলিয়ে পড়া শাশুড়ির গায়ে অরিন্দমের চেনা গন্ধ। আজ অরিন্দম বেঁচে থাকলে এতো ঝড়ঝাপ্টা তাকে সইতে হতো! হাসপাতালের অবস্থা ভালো নয়। গোকুলঘরিয়া রাজনগর সূতারহাটি, সব জায়গা থেকেই পিলপিল করে ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষ ভীড় করেছে হাসপাতালে। পুরনো ডাক্তার পালটে এখন নতুন ডাক্তাররা এসেছে। তারা সিস্টারদিদিমণিরা ওয়ার্ডভাইয়েরা সবাই হিমহিম খাচ্ছে যেন।অলোকানন্দার মনে হলো এও যেন এক মুরগির খাঁচা। সেখানে গিজগিজ করছে পাখি। এক একটি বেডে তিন চারজন। মেঝেতে চলার পথ নেই। প্রফুল্ল একজন ডাক্তারকে চিনত। টৈতন্য দেবনাথ।রোগীকে দেখামাত্র ভর্তি করে নিল। শাশুড়ি জায়গা পেল বারান্দা লাগোয় বাথরুম যাবার রাস্তার একপাশে রাখা পিসবোর্ডের ওপর। তাই সই। একটা স্যালাইন তো পাবে। জানলা দিয়ে বাইরেটা একুশ বাইশ বছর আগে যেমন দেখেছিল অলোকানন্দা, আজ আর তেমন দেখতে পেল না। সইসাবুদ করার পর তাকে ছেড়ে দিল ডাক্তার দেবনাথ। বেরোবার পথে বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তার। বিষ্ণুপ্রিয়ার আঠারোমাসের মেয়েটা জ্বরে ভুগছে। হাসপাতালে ভর্তি। বিষ্ণুপ্রিয়ার বাড়ি সুকুমারীর বাড়ির কাছেই। কিন্তু এ অবস্থায় তাকে কি ওর কথা জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে? একটু ‘কিন্তু কিন্তু ‘ করেই কথার এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করে ফেলল অলোকানন্দা। বিষ্ণুপ্রিয়া ভেবে বলল,”কানাঘুষো একডা শোনা যাইস্সে। তর সুকুমারী বেনারস গ্যাসে!”
হাসপাতালের ফিরতি পথ প্রফুল্লকে সঙ্গে নিল না অলোকানন্দা। আকাশে রোদ ফুটেছে। তা ফুটুক। হরিসভার তেমাথা থেকে বামদিকে হেঁটে গেলেই চৌধুরীদের আমবাগান। সেই আমবাগানের ভিতর দিয়ে একটা পায়ে হাঁটা পথ দিয়ে খানিক গেলেই অদ্বৈত গোঁসাইয়ের আশ্রম। কতোদিন সেদিকে যায়না অলোকানন্দা। শাশুড়িমাকে হাসপাতালের মেঝেতে শুইয়ে দেবার সময় এক আশ্চর্য অনুভূতি হয়েছে তার। শাশুড়ির শ্বাসের ভিতর লুকনো অরিন্দমের শ্বাস যেন তার ভিতরেও প্রবেশ করেছে। অরিন্দম আজ নেই। সেকথা মেনে নিতে হয়েছে তার মনকে।কিন্তু শরীর! তার শরীর সেকথা মানে না কেন? সেই শ্বাসকণা তার ফুসফুস দিয়ে নাড়িতন্ত্র দিয়ে যেন ছড়িয়ে পড়ছে তার প্রতিটি রোমকূপে।অরিন্দম, কোথায় তুমি? এসো। এসো হে পুরুষ শরীর। রণজয় সেন তো এসেছিল। কেন কেঁপে গেল অলোকানন্দা! ভাবতে ভাবতে শিউড়ে উঠল সে। এসব কী ভাবনা আসছে তার মনের ভিতর। আর তাছাড়া রণজয় সেন, তো পুরুষ নয়। সে দানব। সে অন্ধকার। সে শুধু গ্রাস করতে জানে।
চৌধুরীদের আমবাগানের ভিতর মেঠো হাঁটাপথ। সেখানে শুকনো আম্রপল্লব বিছানো। এই বাগানের ইতিউতি রোদ ঢুকে এক আলোআঁধারি জোনাকি তৈরি করেছে যেন। পুরুষালি গাছগুলি যেন অলোকানন্দাকে ডাকছে। ‘আয়। আয়।কাছে আয়।’ এই ডাকে সাড়া দিয়েই বুঝি সেইদিন স্কুলফেরতা মেয়েটা নিজেকে সঁপে দিয়েছিল! ছমছম নুপূরের মতো অলোকানন্দা বুক চেপে হেঁটে যাচ্ছে বাগানের ভিতর দিয়ে। সিংহানিয়ার ক্ষতিপূরণের হুমকি, শাশুড়িমায়ের রোগাকীর্ণ অস্তিত্ব তাকে স্পর্শ করছে না। আর কৃষ্ণেন্দু! সে যে আজ কতোদিন মাকে দেখতেও আসে না।ওই মেয়েটি তাকে বশ করল বুঝি! ভাবতে ভাবতে ভিতর থেকে এক দুর্মেয় গরম ওমভাব উঠে আসে অলোকানন্দার শরীরে। চারপাশে নাচের মূদ্রার মতো ছেয়ে থাকা আম্রবনের ডালপালা যেন তার শরীরে শিহরণ তুলছে। সে যেন এখনই তার পরণের সব আভরণ খুলে ফেলে ছুটে যাবে বৃক্ষপুরুষদের দিকে। নিজেকে অর্পণ করে দেবে ওই স্কুলফেরতা মেয়েটির মতো। দুইকান দুহাতে চেপে কোনও মতে উন্মাদিনীর মতো দৌড়ে আমবাগান পেরিয়ে ছুটে চলে অলোকানন্দা। বাগান পার হতেই গোঁসাইয়ের আশ্রম। গোঁসাই শচীমাতা ফেরেনি এখনও। আশ্রমে মাধব কীর্ত্তণ করছিল। অলোকানন্দা যেন তার সুন্দর মূর্তির ভিতর দেখতে পেল ময়ূরপুচ্ছ ভূষণ। কানে যেন কর্ণিকার ফুল। গলায় বৈজয়ন্তীমালা। উঠোনে এক কোণে গুটিকয়েক ভক্তবৃন্দর ভিতর রণজয়পত্নী সুলোচনাকেও দেখতে নেল সে।মাধব গাইছে,”বঁধুর লাগিয়া সব তেয়াগিঁলু, লোকে অপযশ কয়। এ ধন আমার লয় অন্যজন, ইহা কি পরাণে সয়।”বাঁধনদার গেয়ে ওঠে,”সই কত না রাখিব হিয়া।আমার বঁধূয়া আন বাড়ি যায় আমারি আঙ্গিনা দিয়া।”শীতল হয়ে আসে সবটুকু ভিতর থেকে। অলোকানন্দার মনে হয় সে ভাসমান। পালকের মতো বাতাসে ভেসে ভেসে চলেছে।
কীর্তন শেষ হতে হতে বেলা গড়িয়ে গেল। খই প্রসাদ দিতে দিতে আশ্রমের আরেক সেবক সুদাম ঘোষণা করল, “আগামী সপ্তাহে রাধাষ্টমী গো। সকলে এসো। অষ্টপ্রহর কীর্তন হবে। নামগান হবে। শহরের সেরা কীর্তনীয়ারা আসবে। এসো গো।”সকলে উঠে পড়লেও সুলোচনা গেল না। অলোকানন্দা উঠে পড়ল। ঘর খোলা পড়ে আছে। ছেলেডা তো ফিরবে না। ফিরতে হবে তাকেই। আশ্রমের বাইরে টোটো ধরল সে। টোটোয় সে ছাড়াও অন্য ভক্তরা ছিল। সকলেরই বাড়ি গোকুলঘেরিয়ার আশপাশ গ্রামে। তাদের একজন মধ্যবয়সী মহিলা বলছিল, “আমাদের গেরামে বটতলায় একটা নেংটি পাগলী আইসে গো। কাসে যাইতে দেয় না কারোকে। খালি বলে, আমার ছেলেরে কেড়ে লিবে।”অলোকানন্দা যেতে যেতে শুনছিল সব। ও মহিলার বাড়ি রতনপুর। গোকুলঘেরিয়া রেলস্টেশনের উত্তরের গ্রাম রতনপুর। সেই গ্রাম ঘিরে মস্ত বাঁওড়। সেখানে বটতলার পাশেই ডাকাতে কালীমন্দিরে বিয়ের পরপর অরিন্দম মানত করতে নিয়ে গিয়েছিল তাকে। মহিলাটি বলে চলে।”সে আর কী বলি বলো। ঘরে উঠতিবয়সের পোলা। দেখা যাইসে না গো।মাগী উদোম হয়ে বসি আসে।”
-পুলিশে দাও নাই?
-পুলিশ ঘেঁষে না। বলে গেলেই তেড়ে আইতাসে। বলে ছেলেরে লইয়া যাইবে।বোঝো কাইণ্ড।
অলোকানন্দার কৌতূহল হল। ঘরে শাশুড়ি নেই আজ।তার উপর মন চঞ্চল। একটু দেখে এলেই তো হয়।
-আপনের বাড়ি বুঝি উখানে?
মহিলাটি উৎসাহ পেয়ে বলল,”তয় আর কৈসি কী। ছেলে কেন, আমার বরটাও হাঁ করি তাকায় থাকে। কী যে করি।”
-একবার নে যাবেন আমারে?
মহিলাটি অন্যদের দিকে তাকায়। তারপর কী মনে হয়। বলে,”তয় চলেন।”
স্টেশন পেরিয়ে রতনপুর বাঁওড়ের দিকে চলতে থাকে টোটো। বাকি যাত্রীরা নেমে গেছে স্টেশনে। একলা পেয়ে মহিলাটি অলোকানন্দাকে জিজ্ঞেস করে।
-আপনের ঘর কুথায়?
-গোকুলঘেরিয়া।
-অ।তা ঘরের লোক কী করে?
-নাই।
-চলি গেছে?গলার স্বর নামিয়ে নেয় মহিলা।’মেয়েছেলের চক্কর?’
-না মরি গেছে।আপনের?
-চাষবাস গো…
মুখ ঘুরিয়ে নিল অলোকানন্দা। এই মহিলার সঙ্গে তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।কিন্তু উপায় নেই। কেন যাচ্ছে সে কে জানে?কোথায় যাচ্ছে তাও কি জানে? এটুকু জানে এই মুক্ত বাতাসটুকু তার দরকার ছিল। আমবাগানের অস্থিরতা কাটাতে তার শরীরের ভিতরের গরমটা ঠাণ্ডা হওয়ার দরকার।
চারমাথা মোড়ে নেমে পায়ে হেঁটে যেতে হবে খানিকটা।চারপাশে কতো চা দোকান।রাস্তার দুইপাশে ডুমো করে পাটকাঠি রাখা রয়েছে। যেন অজস্র মন্দিরচুড়োর ভিতর দিয়ে সে হেঁটে চলেছে। বিয়ের পরপর অরিন্দম যখন তাকে এই ডাকাতেকালীমন্দিরে এনেছিল, সে জিজ্ঞেস করেছিল,”কার জন্যি মানত করলে?”অরিন্দম হেসেছিল শুধু। মুখে বলেছিল,”যার জন্যি করিছি, তারে বলা বারণ।” ফেরার পথে মটরভাজা খেয়েছিল দুইজনে। তখনকার চারপাশ কতো বদলে গেছে আজ। জীবন্ত পথঘাটগুলো ফলক আর পার্টির পতাকার বেষ্টনীতে কেমন ম্যাদামারা অঙ্কখাতার মতো বনে গেছে। চারপাশে গিজগিজ করছে লোক। চা দোকান। পান দোকান।তারা যখন এসেছিল, তখন লোকে এখানে আসতে ভয় পেত। চারপাশে বাবলা আর তল্লা বাঁশবনে ভরা ছিল।বটতলার কাছে এসে মহিলাটি আঙুল দিয়ে একটা জটলার দিকে দেখালো। কিছু ভ্যানরিক্সাওলা, দোকানদার, আর পথচলতি ছেলেবুড়োর জটলা। অলোকানন্দা সেদিকে হেঁটে গেল একা।তার ভিতর থেকে সেই আমবাগানে শোনা অদ্ভুত স্বরটি ‘হিহি’ করে হেসে উঠছে বারবার। বলছে ‘আয় আয়। কাছে আয়’। উন্মুক্ত নারীশরীর পেয়ে মাছির মতো মানুষগুলো ভনভন করছিল। অলোকানন্দা তাদের সরিয়ে ভিতরে গিয়ে দেখল ধুলোকালি মাখা একটি মহিলা তার স্তন দুই হাতে ঢেকে মাথা গুঁজে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। মাথার চুলে জট ধরেছে। মাথা নড়ে উঠছে মাঝেমাঝে। বোঝা যাচ্ছে মহিলাটি আপনমনে বিড়বিড় করে কিছু বলছে। পাগলীমহিলার উন্মুক্ত পিঠ ও অনাবৃত নিতম্ব দেখে মাছিমানুষগুলোর লালা ঝরে পড়ছে। অলোকানন্দা কাছে যেতে তারা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। অলোকানন্দা এগিয়ে গেল কাছে। ভীড়ের ভিতর কে যেন বলে উঠল, “কাছে যেওনি। কামড় দিবে।”অলোকানন্দা শুনল না। এগিয়ে গিয়ে পাগলীর কাঁধ স্পর্শ করল। পাগলীটি সে স্পর্শ পেয়ে মুখ তুলে তাকাতেই সে বিদ্যুতের ঝটকা খাবার মতোই ছিটকে গেল খানিক দূরে। বিস্ফারিত চোখে নিজের অজান্তেই ভিতর থেকে আকুল আবেগঘন স্বরে সে বলে উঠল,”এ কী।সুকুমারী! তুই?!!”