
চিন্তার চিহ্নমালা ১০
সন্মাত্রানন্দ
"এই বিশাল ভুবন, এর মাটি-আকাশ-গাছ-মানুষ সবই আসলে একটা লেখা। খাতায় লিখিত শব্দের মতো এরাও শব্দই। এইসব শব্দের আড়ালে যে চিন্ময় নৈঃশব্দ্য থমকে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে আবিষ্কার না করতে পারলে এই বিশ্বরচনার লেখককে খুঁজে পাওয়া যাবে না।" চিন্তার চিহ্নমালা। দশম পর্ব। লিখলেন সন্মাত্রানন্দ।
পূর্বের পর্বগুলি — (১), (২), (৩), (৪), (৫), (৬), (৭),
(৮),
((৯)
দশম পর্ব
লেখক কোথায়?
লেখক যে কে আর লেখক যে কোথায়, আমি তো বাবু, খুঁজে পেলাম না!
কথাটা শুনেই আপনি হেসে উঠবেন। এমন কথায় পরিহাসের উপাদান কম তো কিছু নেই! আপনি বলবেন, ধুর মশাই! আপনি যখন লিখছেন এ লেখা, তখন আপনিই এর লেখক। নিজেকে খুঁজে পাচ্ছেন না?
এই বলে আপনার সে কী আকাশ-বাতাস-কাঁপানো উচ্চরোলে হাসি! আপনার হাসির সঙ্গে আমিও যোগ না দিয়ে পারব না। সত্যি কথা বলতে কী, এমন আকালে বিশুদ্ধ হাস্যপরিহাসের খোরাক বেশি তো পাওয়া যায় না। এমন একটা সুযোগ যখন পেয়েছি আজ, তখন প্রাণভরে একটু হেসেই নিই না হয়!
হাসি শেষ হলে আসুন, দুজনেই একটু ভাবতে বসি। এই যে এই লেখাটা আমি লিখব বলে বসেছি, এই মুহূর্তে আমার মস্তিষ্কে কতগুলো চিন্তা ভিড় জমাচ্ছে। কতগুলো ছবি, ছবির পেছনে ভাব, কোনোটা নির্বস্তুক বা বিমূর্ত, কোনোটা বা সবস্তুক বা মূর্ত। এবার যদি বুদ্ধিকে খুব শান্ত করে নিয়ে এর একটি একটি চিন্তাকে নিয়ে পরীক্ষা করি, তাহলে দেখব, এর প্রত্যেকটা চিন্তা অন্য কোথাও থেকে এসেছে। হয় আমি কোথাও কিছু দেখেছি, নয় কোথাও শুনেছি, নয় পড়েছি। মোট কথা আমারই জীবনের সব বিচিত্র অভিজ্ঞতা, তা ব্যাবহারিকই হোক বা সাংবেদনিকই হোক, অন্য কোথাও থেকে এসেছে এসব। মানে এক কথায়, একটি চিন্তাও আমি উৎপন্ন করিনি বা অশিষ্ট ভাষায় ‘পয়দা করিনি’। ওই চিন্তাগুলো জগতে ছিলই, জগতের সঙ্গে বোঝাপড়ার ফলে ওগুলো আমার মনে ঢুকেছে। এখন লিখতে বসে ওগুলো ফুলের চারিপাশে মৌমাছির মতো আমার চেতনার কেন্দ্রের চারপাশে ভিড় জমাচ্ছে।
তা ভিড় জমালেই তো আর হল না! ওই ভিড়ের মধ্যে থেকে আমি কতগুলো চিন্তাকে নগদ-বিদায় দিচ্ছি, কতগুলোকে বামাল-সমেত গ্রেপ্তার করছি। তারপর সেগুলোকে মনের মধ্যে সাজাচ্ছি। এইভাবে চিন্তাসমূহের যে এক নতুন ধরনের বিন্যাস দাঁড়াচ্ছে, সেই বিন্যাসটাই এই সম্ভাব্য লেখার সূক্ষ্মশরীর। তা এই যে চিন্তাগুলোর নির্বাচন, তারপর তার একটা নতুন ধরনের বিন্যাস, সমবায় তৈরি করা—এটা তো আমার কীর্তি, নাকি?
বেশ। সেটুকু মেনে নিতে আমার অসুবিধে নেই। কিন্তু ওই বিন্যাস-সমবায় করার কাজটার জন্যেই আমাকে লেখক বলতে হবে? বা, যে কেউ লেখেন, তাঁকে লেখক বলতে হবে? আমরা যখন ‘লেখক’ কথাটা ব্যবহার করি, তখন তার পেছনে তিনিই রচনাটির স্রষ্টা এমন ভাবনা থাকে নাকি? সৃজনশীলতা না থাকলে স্রষ্টা হন কী করে কেউ?
এই চিন্তাগুলো কি আমি সাক্ষাৎ সৃজন করেছি? করিনি তো! কারণ, ওগুলো চিরকাল ছিল। আমি ওগুলো চয়ন করে নিয়ে একটা বিশেষ প্রকার বিন্যাস-সমবায় করেছি মাত্র। বিউটি-পার্লারে চুল বাঁধেন যাঁরা, যাঁরা কেশবিন্যাস করেন, তাঁরা কি মাথার চুলগুলো সৃষ্টি করেছেন? না, ওগুলো তাঁরা শুধু একভাবে আজ সাজিয়েছেন, কালকে হয়তো অন্যভাবে সাজাবেন। তাই যদি হল, তাহলে আমাকে ‘লেখক’ না বলে হেয়ার-ড্রেসারের মতো ‘থট-ড্রেসার’ জাতীয় কিছু বলা হোক।
এখানে যেটা আমাকে বলে নিতে হবে, তা হল আমি কিন্তু হেয়ার-ড্রেসার প্রভৃতি পেশায় যুক্ত মানুষদের ছোটো করছি না বা চুল-বাঁধার কাজটাকে লেখার কাজের থেকে ছোটো কিছু একেবারেই বলছি না। বরং আমি বলছি, ‘লেখক’ অভিধায় যাঁকে ধরা হচ্ছে, তাঁকে আমি কেশবিন্যাসকারীর থেকে অন্যতর বা উচ্চতর বলে ভাবতে পারছি না। তাঁদের উভয়ের কাজের মধ্যে সাদৃশ্যটুকুই খুঁজে পাচ্ছি।
যাকগে যাক! আপাতত, ওই লেখক-খোঁজার কথাটাই চলুক। পরিপার্শ্বের সঙ্গে ব্যক্তির মিথস্ক্রিয়ায় যেসব চিন্তা ও অভিজ্ঞতার অভিঘাত জমা হয়, লিখতে বসে তাদের এক প্রকার বিন্যাস আমরা ভাষায় অনুবাদ করি। এই যে-বিন্যাস একজন তৈরি করলেন, সেই বিন্যাসটিই ওই লেখকের ব্যক্তিত্ব বা চরিত্র বা স্টাইল। কিন্তু শুধু এই কারণেই তাঁকে ‘লেখক’ বলতে আমার বাধছে। বিন্যাসকারী বা অনুবাদক বললে আপত্তি ছিল না।
তাহলে যে-মনের মধ্যে এই চিন্তাগুলো জমছে, যেখানে এগুলো প্রসেসড হচ্ছে, একটা অন্য ধরনের বিন্যাসে বিন্যস্ত রূপ পাচ্ছে, সেই মনটাকেই যদি লেখক বলা যায়?
তাতে সমস্যা হচ্ছে অনেক। প্রথমত, মন একটা ধারণা। মনকে চিন্তার সমষ্টি ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। ওই সমষ্টি কল্পিত একটা ব্যাপার। যেমন অরণ্য বলে কিছু দেখানো যায় না। কতগুলো গাছ দেখানো যায়। গাছেদের সমষ্টি বলে কিছু বাইরে দেখানো যায় না। সমষ্টি বা ব্যষ্টি মনের ধারণা। বাইরে যা আছে, তা ওই গাছগুলোই।
সেরকমই চিন্তাগুলোকেই আমরা অনুভব করি। আর সেই চিন্তাগুলোকে কল্পনায় আঁটি বেঁধে আঁটিটার নাম দিই ‘মন’। কেউ বলতেই পারেন, ‘লেখক’ কথাটাও একটা ধারণাকেই নির্দেশ করে। বাইরের গাছ বা অন্তরের চিন্তার মতো লেখককেও সাক্ষাৎ অনুভব করা যায় না। কাজেই অননুভূত এই ‘লেখক’ আর ওই অননুভূত ‘মন’ অদ্বয় বা এক হোক, তাতে আর আপত্তি কীসের?
এই যুক্তি বেশ জোরালো। এবং এর ভিত্তিতে মনকে ‘লেখক’ বলতে আপত্তি থাকত না, যদি জানতে পারতাম, এ মন কার? কে এই মনের হকদার? ব্যক্তিমন যেহেতু বহু মানুষের চিন্তার যোগফল, এবং সেই যোগফলটি আবার প্রতি সেকেন্ডে পালটাচ্ছে, তাই একটা কোনো বাঁশের বা লোহার বা ওই জাতীয় কিছুর বেড়া দিয়ে কোনো ব্যক্তির মনকে আর সবার থেকে পৃথক করা অসম্ভব। দার্শনিক ভাষায়, এখানে ভেদকের অভাব আছে। অভাব আছে সেই সব বৈশিষ্ট্যের বা ডিস্টিংগুইশিং মার্কের যা দিয়ে আমি আমার মনকে অন্যের মনের থেকে আলাদা করে দেখাব।
তাহলে একটিই অন্তহীন চিন্তার সমুদ্র আছে, যার একটা ক্ষণভঙ্গুর ঢেউ আমার মগজের ভিতর এই মুহূর্তে উথলে উঠেছে। ঢেউকে যেমন করে মার্কার দিয়ে চিহ্নিত করে সমুদ্রের থেকে আলাদা করা যায় না, তেমনই সেই অন্তহীন চিন্তার সমুদ্র থেকে ব্যক্তিমনকে ছিঁড়ে দেখানো যাবে না।
বেশ। তাহলে ওই অন্তহীন চিন্তার সমুদ্র বা বিশ্বমনকেই তবে ‘লেখক’ বলা হোক বা রচনার ‘স্রষ্টা’ বলা হোক। সেকথা বলতে গেলে সমস্যা হচ্ছে এই যে, ওই বিশ্বমন বা কসমিক মাইন্ড নৈর্ব্যক্তিক বা ইমপারসোনাল। তাকে ‘লেখক’ বলা আর ‘লেখক খুঁজে পাইনি’ বলা একই কথা। কারণ ‘লেখক’ কিংবা ‘স্রষ্টা’ বললে আমরা কোনো ব্যক্তিকেই বুঝি। একটা বিমূর্ত ব্যক্তিনিরপেক্ষ স্রোতকে বুঝি না।
ওই রাস্তায় কাউকে খুঁজে না পেয়ে বিরক্ত হয়ে মনের মধ্যে পরপর ওঠা দুটো চিন্তার মাঝখানের ফাঁকের দিকে নজর করার চেষ্টা করি। দুটি চিন্তার মাঝখানের ওই সূক্ষ্ম ব্যবধান কেমন নীরব! ওখানে কোনো শব্দ নেই, কোনো চিন্তা নেই। যখন আপনি একটা বই পড়েন, তখন পাতার পর পাতা শব্দরাশির দিকেই তো আপনার নজর থাকে। এখন যদি তা না করে দুটো শব্দের মধ্যেকার সাদা অংশের দিকে খেয়াল করতে শুরু করেন, তাহলে দেখবেন, গোটা বই জুড়ে আসলে এক অখণ্ড স্পেসই আছে, যাকে শব্দ দিয়ে কেটে কেটে একটা বই বানানো হয়েছে। শব্দগুলো আসলে ওই স্পেসটাকে চেরাই করে চলেছে। অন্ধকারকে যেন সেলাই করে চলেছে অগুনতি জোনাকি।
পরপর উত্থিত দুটি চিন্তার মাঝে যে নিশ্চিন্ত নীরবতা আছে, তাকেই চিন্তাগুলো কেটে কেটে একটা রূপ তৈরি করছে। তাহলে লেখার উপাদান ওই অখণ্ড নীরবতা। কিন্তু তা উপাদান-কারণ হলেও, নিমিত্ত কারণও কি? সেটা না জানা হলে ওই নীরবতা বা চিন্তাশূন্যতাকেও ‘লেখক’ অভিধায় অভিহিত করা যাচ্ছে না। কে ওই পরম নীরবতাকে বা চিন্তাশূন্যতাকে কেটে কেটে একটা অবয়ব তৈরি করছে? নীরবতা নিজেই?
এখানে এসে আর যুক্তি দেওয়া যাচ্ছে না। কেন যাচ্ছে না? কারণ, যুক্তিও একপ্রকার চিন্তাপ্রণালী, যাকে ওই পরম নিশ্চিন্ত নীরবতা থেকে কেটে বের করে আনা হয়েছে। যদি চিজেল করার বা কেটে বের করে আনার কাজটা কেউ করছে এমন হয়, তবে তাকে যুক্তি দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যাবে না। কেননা যুক্তি নিজেই খোদিত বস্তু। পাথরের মূর্তি কেমন করে দেখাবে ভাস্করকে?
যুক্তি এই পর্যন্ত আমার হাত ধরে এসেছে। চিন্তার অনেক গ্রাম, পথ, শহর, মরুভূমি পেরিয়ে, নদী পার হয়ে যুক্তি আমাকে নিয়ে এসেছে হাতে ধরে এই খাদের কাছ অবধি। এখন সে আমার হাত ছেড়ে দিয়েছে। অন্ধকার খাদের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বলছে, ‘যাও! যদি সাহস থাকে ওই অন্ধকারের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়ো। ওখানে আমি যেতে পারব না। আমার যতটুকু সাধ্য ছিল, আমি করেছি।’
ঝাঁপ কি আমি দিতে পারি? যদি মনে করি, আমি বা আমার অস্তিত্ব শুধু এক আঁটি চিন্তার সমষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়, তাহলে ওই খাদের অন্ধকার আমার কাছে অধরাই থেকে যাবে। আমি বলব, লেখক কে, তা অজ্ঞাত এবং অজ্ঞেয়।
আর নিজেকে যদি যুক্তির আঁটি বলে অপমান না করি, যদি মানি যে, চিন্তা-অতিরিক্ত আমার একটা সত্তা আছে, যে সত্তার আধারে বা যে সত্তার মধ্য দিয়েই আমি সবকিছু জানি, তাহলে ওই অন্ধকার খাদ আমাকে আর ভয় দেখাতে পারে না। যুক্তির হাত ছেড়ে দিয়ে তাতে ঝাঁপ দিতে আমার বাধা নেই, ভয়ও নেই।
এই বিশাল ভুবন, এর মাটি-আকাশ-গাছ-মানুষ সবই আসলে একটা লেখা। খাতায় লিখিত শব্দের মতো এরাও শব্দই। এইসব শব্দের আড়ালে যে চিন্ময় নৈঃশব্দ্য থমকে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে আবিষ্কার না করতে পারলে এই বিশ্বরচনার লেখককে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আর যতক্ষণ তা না পাওয়া যাবে, ততক্ষণ এই লেখাটিরও লেখক কে বা লেখক কোথায়, তা খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
আপনি কি এখনও হাসছেন?
অসাধারণ! গোটা বই জুড়ে এক অখন্ড স্পেস….অনেক দিন মনে থাকবে
ধন্যবাদ। সেই কথাটাই মূল কথা।
এমনটি কখনও ভেবে দেখিনি এই গাছপালা, ঘরবাড়ি, পথ, নদী, পাহাড় সবই এক একটি অক্ষর… নিরবচ্ছিন্ন একটা শূন্যতাকে ছিন্ন করছে অক্ষরমালা… অসাধারণ লাগলো পড়ে।
আমি কিন্তু এই ধারণা আমার দুটি উপন্যাসে দুই জায়গায় ব্যবহার করেছি।
নমস্কার নেবেন।
হ্যাঁ পড়েছি।এমনকি সেই দীনেশ গুপ্তের রিভলভার ধারাবাহিকটিতে ছোট্ট ডালি চরিত্রটি অক্ষরমালার মধ্যে কেমন ভাবে হেঁটে চলে… একটা স্বপ্নের পথচলা।সেটিও পড়েছি। তবে প্রবন্ধে এই প্রথম ব্যাপারটি পরিষ্কার করলেন। আশা রাখি এই লেখাগুলি একত্রে একটি বই হিসেবে বেরোবে।
আপনি আমার প্রমাণ নেবেন।😁🙏
আপনার লেখা সব সময়েই নতুন করে ভাবার উপাদান দেয়।ভালো লাগল।
আপনার লেখা বারবার আলোড়িত করে চিন্তার প্রবাহকে। শেষদিকের লাইনগুলি অনবদ্য কাব্যিক সুষমামণ্ডিত।