
কোন হোমে, কী যজ্ঞেই বা
অনির্বাণ ভট্টাচার্য
একটা চৌহদ্দি আমার৷ আমার বাড়ি, নাম৷ সেখানে দীর্ঘ দিনের বসত, বা অল্প ক্ষণের স্থায়ীরূপও, আমায় একটা অভ্যাস উপহার দেয়, একটা সাংঘাতিক অধিকার বোধও৷ যে ওই চৌহদ্দি, আমার৷ অতএব আমি যদি সেখেনে নিজ মর্জির আয়তন রচি, কারই বা কী বলার৷ যদি আদৌ কিছু না-ও রচি, এক রাশ ব্ল্যাঙ্কই সই, তাতেই বা কীসের কী? প্রচলন তো এমনতরো-ই৷ সে পরিসর, মেয়াদ নির্বিশষেই, নিজ, ব্যক্তিগত৷ আত্মপরিচয়ের উৎসভূম হয়ে ওঠে তা৷ বদলে যেতে পারেও হয়তো, ওই চারণক্ষেত্র, ঘনঘন, তবুও সে অবস্থার, সে ক্ষেত্রের, মহিমা এমনই, যে এক প্রকার কর্তৃত্ববোধ গড়ে ওঠে বাসিন্দার৷ যেমন মুখিয়ার গড়ে ওঠে, নিজ সম্প্রদায়ের উপর৷ বেড়া-খচিত নিজ ভূমিখণ্ডের উপর৷
নিজ গৃহ, হোক না তা ভাড়ারও, তাও থাকছি যেখানে, উৎখাতহীন, উপদ্রব ছাড়া, আমাদের এক আরামস্থল দেয়, যেমনই ক্ষুদ্র হোক, কিঞ্চিৎ অভাবীও হোক না, তবু তা আরামের স্থল৷ আমরা ভেবে নিই, ওটা আমাদের পাওনা৷ হকের৷ যেমন ইচ্ছে, তাই তো আমরা গুছিয়ে নিই বা অ-গুছিয়ে দিই, সে অঞ্চল৷ আরে নিজেরই তো আফটার অল৷
কী ফরক পয়েন্দা, একটু হিমশিম খাওয়া অবস্থা হলেই বা৷ আমি যেমন, আমার অন্দরমহলও হুবহু যে৷ যদি না, একেবারে বিপরীত মেরুর সঙ্গিনীর (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেমনটা বাঙালির কপালে, ভাগ্যিস!) হাতে রাজদণ্ড থাকে (অবধারিত ভাবেই, যাহা বাস্তবও বটে)৷ ফলে ঘর, গৃহ, যাই বলা হোক না কেন, এক স্থিতির চিহ্নক৷ হোটেল ঠিক যা নয়৷ যতই সে ঘিরে রাখুক আপনাকে অখণ্ড মোলায়েমে৷ এ ক্ষেত্রে বলে নেওয়া ভালো, সে সব হোটেলেরই কথা বলছি, যা পাতে দেওয়া যায়৷ অবশ্য, কার কাছে কী পাতে দেওয়ার যোগ্য, তাও তো ভাবনার বিষয়৷ সে যাক, এখানে হোটেল বলতে তারা সমস্ত, যেখানে দু’দণ্ড শান্তি আছে, মিনিমাম৷ শান্তি আছে, হ্যাঁ, থইথই যত্নও নিশ্চিৎ, ঢুকেই বাথরুম চেক করে, তাকে সাজিয়ে রাখা শ্যাম্পু, সাবান, ফেসওয়াশ, টুথপেস্ট ইত্যাদি, আর পর ক্ষণই লাল স্যুটকেস থেকে পাজামা, ঘরে পরার সালওয়ার, ফ্রক, ঘরে পরার চটি ইত্যাদিও, মোট কথা, চেক-ইন করার মিনিট দশের মধ্যেই, সে হোটলঘর, ছড়িয়েছিটিয়ে, যেন পাক্কা নিজের সুখীগৃহকোণ৷ রাত পোহানোর আগেই বৈধ ভাবে অধিকৃত সে হোটেলঘরের অবস্থা দেখে এমনকী হোটেলকর্মীই নির্ঘাৎ ভিরমি খেয়ে, সরি ম্যাডাম, আই অ্যাম দ্য গিল্টি ট্রেসপাসার বলে নতমস্তক বেরিয়ে যাবে! দিনকতকের যাপনক্ষেত্র, এই হোটেলঘর, তবুও, বিশেষত বাঙালির ট্যালেন্টে সে হোটেলঘরের স্পিরিটে ইনট্রুড করে বসে, চিরপরিচিত গৃহকোণের আদল৷ ব্যবহারের কায়দায়, টেম্পোরারি, তখন পার্মানেন্টের প্রতিচ্ছবি৷ রেপ্লিকা৷
ওই রেপ্লিকা মাত্রই৷ নিজগৃহের সম্পূর্ণতা কখনও তার হকের হয় না৷ সে হোটেলঘরের বাসিন্দাও তো চায় না, দুই তীর সমানতালের হোক৷ ঘরের যে আইডেন্টিটি আমার, তাকে কিছু ক্ষণের আড়ালে পাঠিয়ে, সম্পূর্ণ অন্য এক পরিস্থিতি, এক পরিচয়েই হয়তো, নিজেকে দেখার, ভিন্ন এক নিজের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতা জমানোর সুযোগ দেয় আমার এই হোটেলঘর৷ অর্থাৎ, এই হোটেলঘর, এক অর্থে আমার কাছে এক স্বপ্নক্ষেত্র৷ যা অনন্ত নয়, বেঁধে দেওয়া এক সময়সীমা যার, তবুও সেখানে আমি দাপিয়ে বেড়াতে পারি, হয়তোবা এক ‘আইডিয়াল’, কাঙ্খিতের চেয়েও বাড়তি কিছুর স্বাদের আহ্লাদে৷ ভাঙবে এ স্বপ্নসম আবহ, নিশ্চিত, অচিরেই, ফিরে যেতে হবে তখন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তেই, ভবঘুরের টাইমলাইন ভেস্তে দিয়ে, তবু যে ক’দিন সম্ভব, নিজেকে পুনরাবিষ্কার করার এ প্রচেষ্টা, নিজেকে ঠিক নিজের নয়, বরং অন্যের কল্পিত এক আদর্শ পরিস্থিতির অংশগ্রহণকারী রূপে ভেবে নিয়ে, বেঁচে নেওয়ার যে গোটা প্রক্রিয়া, তা-ই হোটেলঘর আমায় দেয়৷
এখানেই হোটেলঘরকে, নিজ গৃহসম গুছিয়ে নেওয়া সত্ত্বেও, সে কখনওই আমার বাসা হয়ে উঠতে পারে না৷ বাসায় আমার যে বাঁধন থাকে, যে বাঁধনে আমি সেখানে বেঁধে যাই, তা থেকে তো হোটেলঘরে আমি মুক্ত, মুক্ত হতে চেয়েছিই তো আমি, আর ওই মুক্তিই এ ক্ষেত্রে আমায় ঘরের সঙ্গে বেঁধে দিচ্ছে৷ যে ঘর আমার, আমায় প্রকৃত অর্থে লুকোতে দেয় না, কারণ সে জেনে যায় আমার প্রথম সব কিছু, আমার অন্তরের যা কিছু, কিন্তু হোটেলঘর, যে হেতু সে স্বাধীনতা বিলোয় এন্তার, ক্ষণিকের অতিথি জেনে আমায়, আড়াল দেয় অজস্র, হয়তো লু্কিয়ে রাখতে চাওয়া আমার ইচ্ছেসকল, কীর্তিগুচ্ছ, মুখ বুজে রেখে দেয় অন্তরালেই, তাই সে হোটেলঘর আমার গৃহ হয়ে ওঠে না৷
কারণ, সারা জীবন যে লুকিয়ে কাটায়, সে তো ফিউজিটিভ৷ আমি তো তা না৷ হলেও বা, আমি তো ইচ্ছা-পলাতক৷ সবচেয়ে জরুরি, আমার তো ঘর আছে৷ ফিরে যেতে পারি আমি যেখানে, আলবাৎ, ফিরে যাবই নিশ্চিত সেখানে আমি৷ ক’দিনের মায়া, ক’দিনের অন্যের হাতে বোনা ফেব্রিকে নিজেকে মিলিয়ে দিয়ে, মিশিয়ে দিয়ে, আমার এ কল কাটল যেই না, এ বার আমার ফেরার পালা৷ আমি তো দৈনন্দিনের থেকে খানিক নিস্তার চাওয়া এক জীবমাত্র৷ তা দেয় আমায়, হোটেলঘর৷ ঘর নয়৷
দিনের শেষে স্থিতিতে ফিরে যাওয়া ছাড়া, এই বাঙালির কাছে অন্য বিপ্লব আর কবেই বা এসেছে?