কানাইকাকুর মেঘ, পাগলাদাদুর নীল, নিতাইকাকুর আনন্দ…
বেবী সাউ
জীবন যতটুকু দেয়, কেড়ে নেয় তারও কিছু বেশি। আর সামান্য পথের সেই পাওয়াটুকু নিয়ে এগোতে এগোতে নিজেকে মানুষ ভালোবেসে ফেলে। এগিয়ে যায়। তৈরি হয় আবার কিছু পাওয়ার, নিজেকে প্রস্তুত করে দেওয়ার জন্যও। এভাবে একটা একটা ক্যালেন্ডার পালটায়… নতুন সংখ্যা যুক্ত হয়। বয়স বাড়ে। বর্তমানকে কেউ কখনও ভালোবাসতে পারেনি। তাকে নিয়ে ভাবেও কম। হয় অতীত নিয়ে তার স্মৃতিচারণ, মনখারাপ, আফসোস, মুগ্ধতা। না হয় ভবিষ্যতের আলোয় নিজেকে উজ্জ্বল দেখানোর চাহিদা — এই অতীত এবং বর্তমানের রেষারেষি থেকে আর রেহাই নেই। এদিকে জীবন গড়িয়ে যায়, বয়স এগিয়ে যায়…ভালোভাবে বাঁচাটুকু হয় না আর! গুমরে গুমরে মরে যায় একটা অসফল জীবন– না-পাওয়া একটা দীর্ঘ সময়!
এসব সময়ের কাছে আজকাল বড্ড অসফল লাগে। এসব ভাবনা যেন আরও বিক্ষত করে তোলে। মৌন এবং মৌলিক করে তোলে বিক্ষিপ্ত কারণ। কিন্তু কিছুতেই আর স্থিরতায় পৌঁছাতে পারি না। কিছুতেই ভেঙে দিতে পারিনা আমার অসফল অতীত এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে। শুধু একের পর এক যুদ্ধক্ষেত্র সাজাই, কেটে আনি তালপাতার তলোয়ার, ধারালো কথার ছুরি এবং অনেকগুলো অসফল কবিতার লাইন। তারপর তলিয়ে যাই, মিলিয়ে দিতে চাই বিরাট এক কালো গহ্বরে।
অবচেতন মনের এই উদভ্রান্ত একটা সময় যেন আমাকে দাঁড় করার একেকটা লাইনের কাছে। অক্ষরের কাছে। আর আমি বোধি হয়ে উঠি। আলো হয়ে উঠি। দৌড়ে যাই সেসব কালো কালো অক্ষরের কাছে। আমার অক্ষমতাকে প্রকাশ করার রাস্তা পেয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠি। নিজেকে প্রকাশের আনন্দ, নিজেকে আবিষ্কারের আনন্দ, ডানা এনে দেয় আমাকে। দিগন্তের দিকে আমার কখনও তেমন ঝোঁক ছিল না কখনও, বরং একটা বলয়ের মধ্যে খুঁজে ফেরা প্রেম, ভালোবাসা, চাতুরি, ছলনা আমাকে বারবার বিধ্বস্ত করেছে, বারবার আমাকে মৃত ভেবে তুলে দিয়েছে রজনীগন্ধার মালা। আমিও কতবছরের বুভুক্ষু মানুষের মতো তাকেই সত্য ভেবে বারবার ঠকেছি। নিজেকে মৃত জাহির করেছি আর তারপর বিরাট এক শূন্যতার কাছে হাত পাততে পাততে বলেছি, অতীতের মতো সত্য কিছু নেই, ভবিষ্যতের মতো ভঙ্গুর! আমাকে বর্তমানে নাও।
আর ঠিক তখনই বিরাট একটা অংশ, স্বভাব হয়ে ওঠে, ডালপালা ছড়ায় আর প্রতিবিম্বিত স্বরে চেয়ে বসে এক বাস্তব দুনিয়া… যেখানে কোনও মায়া নেই, স্মৃতি নেই, নাকি স্বপ্ন!
২
জ্বরের জোরালো সাপ, হিসহিসিয়ে সারা শরীর হেঁটে বেড়াচ্ছে। হলুদ হয়ে আসা এই দেহলতা, তার চারপাশের আবহাওয়া, গাছ-গাছালি কেমন যেন উদ্ভ্রান্তের মতো চেয়ে আছে তোমার দিকে। তুমি আজ শীতলতম সরীসৃপ, চেরা জিভ আর ঘোলাটে চোখ নিয়ে জ্বরের শরীরে উপুড় হয়ে আছ। লালা ঝরছে। ফেনাময় এই সমুদ্র মন্থন, তার বাসুকী নাগ সমস্ত বাসর ভেঙে ডেকে আনছে প্রলয়ঙ্কর সৃষ্টিকে। তারপাশে বসে কে যে আজ বিদ্রোহ পড়ছে! কে যে শোনাচ্ছে এক ব্যর্থ কবির ইতিহাস, তাঁর আত্মহত্যা! মুখ চেনা কিন্তু কিছুতেই নাম মনে আনতে পারছি না…কিছুতেই মেলানো যাচ্ছে না এই কথা এবং শব্দের বন্ধনকে। প্রতিহিংসাপরায়নণ এই সময় আমাকে কি আরেকবার বশ্যতা শিকার করাবে?
আর তখনই পাল্টে পালটে যাচ্ছে দৃশ্য… তারপাশে ধূ ধূ হয়ে আছে মাঠ। নদী নেই। স্রোত নেই। চরার ওপরে আজ ছুটুপিসি হাঁটছে। ছুটছে। মুখে তার অসুখের দুর্গন্ধ, গায়ে তার বিকলাঙ্গের অলংকার… হাঁটতে হাঁটতে ছুটুপিসি হাততালি দিয়ে উঠল। তালিতে তালিতে ঝরে পড়ছে সরষের ভাঙা টুকরো, হলুদের হাসি। তার পুতুলঘরের বেনারসি পতপত করে উড়ছে সুপ্রিম কোর্টের ছাদে। আর সেই শব্দে আমি চিৎকার করে উঠছি। মায়ের হাত খেলে বেড়াচ্ছে সমস্ত শরীরে। আহ! কী গরম! কী উত্তপ্ত এই পৃথিবী। দলমার মাঠঘাট। দামাল হাতি শুঁড় উঁচিয়ে তাড়া করছে। কাকে?
দেখছি, ছুটুপিসি হাসতে হাসতে হাসতে হাসতে উঠে গেল আকাশবাণী গাছের শীর্ষে। পাখিরা ঠুকরে খাচ্ছে তার মন, দেহ। আজন্ম কুমারী অঙ্গ নিয়ে ছুটুপিসি শান্তটি বসে। বেশ মজা পেয়ে খিলখিল করে হাসছে… মুখের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে সারা গাঁয়ে। এমন দৃশ্য ফেলনার নয় ভেবে, সমস্ত গ্রাম ছি ছি করার জন্য ছুটে ছুটে আসছে… ততক্ষণে ছুটুপিসি মেঘ… নীল নীল… তারপর সাদা…আর সাদা আর সাদা…
কেউ তাকে ধরতে পারছে না জেনে, আমার শরীরের সাপ লজ্জায় কুঁকড়ে মরে পড়ে আছে… গরম দুধ তাকে কিছুতেই বীণ বাজানোর উপযোগী করে তুলতে পারছে না! আর এই শীতল অঙ্গ তোমাকেই প্রভু মেনে, পথ মেনে, রসকলি এঁকে পথেঘাটে ঘুরে মরছে…
গোঁসাই ওগো! সময় পেলে দু’টো জলবাতাসা দিও তাকে!
৩
কাকে যে খোঁজে এই পোড়া মন! কোনদিনে মন নেই তার, ফলত আলোও কমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে– অস্পষ্ট গোধূলির দিকে উড়ে যাওয়া পাখিদের ডাক; বাঁশবন ভরাট করে তুলেছে। মন মাঝে মাঝে এত বিবশ হয়ে পড়ে! এত আনমনা! যেন কতকিছু বলার ছিল তার, কতকিছু শোনার। সময় বয়ে গেছে, দিনও বৃদ্ধ — অবসর নেই বলে এখনও পর্যন্ত না-কথা সব গুমরে গুমরে মরছে… আর সেই অভিমানী চোখ আর একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন অথচ রহস্যময় দৃশ্য তাকে হাতছানি দিচ্ছে বারবার… সেই হাতছানি যার কাছে তুমি নির্লিপ্ত মাত্র…
আমাদের পাগলাদাদু, সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে একদিন কথা বলছিলেন। আমিও আনমনা সেই মনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পৃথিবীর একটা দৃশ্য হয়ে উঠেছিলাম। বুঝেছিলাম, মন-ই সেই মনোহারী দোকান; যাকে শুধু খুচরো পয়সার দিয়ে কেনা যায় না! তার পেছনে ছুটতে ছুটতে দেখি, টুঙটুঙি বাজিয়ে চলে গেছে বহুদূর। সাইকেলের চাকার দাগে ভরে আছে মোরামের রঙ। ক্ষত। রক্তাক্ত। চমকে ওঠে তাকাই, ধূলিধূসরিত অঙ্গ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছ তুমি! দু’হাত খোলা, কীর্তন গাইছে কানাইকাকু। আজ তার রাধাবেশ। দু’চোখ ভরে উপচে পড়ছে জল। নিতাইকাকু নাচছে। মাদল ভেঙে যাবে না তো! আর সরলা-ঠাকুমা হলুদমেশা জল এনে ধুইয়ে দিচ্ছেন পা… কে যে সন্তান কে যে কার জন্মদাত্রী…মন শুধু কাঁদছে আর কাঁদছে…
আনন্দের সন্ধান পেতে গিয়ে সেই যে দুঃখের বাতাস এসে ঢুকলো ঘরে, তাকে আজ কিছুতেই সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। অবাধ্য শিশুর মতো, তার জন্মলগ্নে এঁকে দেওয়া হচ্ছে বিরহের নামডাক… অভিমান… অভিযোগ নিয়ে তুমি এসে বসেছ চৌকাঠে। আর ঠিক তখনই অশুভ লক্ষণ রেখা ভেদ করে সেতার বাজছে ঘরে। ঝরে ঝরে পড়ছে মেঘ। কানাইকাকুর মেঘ, পাগলাদাদুর মেঘ, নিতাইকাকুর আনন্দ…
তাল মেলাতে গিয়ে বুঝছ, এটা আসলে ইমন… যার কল্যাণ অনুভবে ভাসে…
মন ভরাট করা একটা গদ্য। অসাধারণ। মুগ্ধতা! চরম মুগ্ধতা!
ভীষন সুন্দর একটি লেখা। আরো চাই….
অসাধারণ লেখা! জাস্ট অসাধারণ। তিনটি অংশ পৃথক লেগেছে। যদিও সমন্বয় আছেই। দুই এর শুরুটা মুগ্ধ করেছে। অনেক ভালোবাসা দিদিকে।। ❤️❤️❤️