অযান্ত্রিকঃ ঋত্বিকের সিনেমায় ডিটেলিং ও শিশ্নকেন্দ্রিকতার তত্ত্ব  <br /> মৌমিতা ঘোষ

অযান্ত্রিকঃ ঋত্বিকের সিনেমায় ডিটেলিং ও শিশ্নকেন্দ্রিকতার তত্ত্ব
মৌমিতা ঘোষ

ঋত্বিক ঘটক। আজকের প্রজন্মের কাছে এই নামটি মানে সেই দেশভাগ-উদ্বাস্তু-ভিটেহারার নস্টালজিয়া—সেই প্রজন্মের কাহিনী যে প্রজন্ম একদিন পূর্ববাংলা থেকে ভিটেমাটি খুইয়ে এপারবাংলায় আসে যেন এক অচিনদেশে তার জন্মভূমির সংস্কৃতিকে বুকে লুকিয়ে। সেই প্রজন্মের সেন্টিমেন্টকে খাদ্য জুগিয়েছে ঋত্বিকের মেঘে ঢাকা তারা- কোমল গান্ধার-সুবর্ণরেখার মতো ছায়াছবিগুলি। আজকের প্রজন্ম সেই ভিটেহারারদের অধঃস্তন তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্ম হলেও দেশভাগ তাদের কাছে প্রজন্মবাহিত মিথের মতো হয়ে গেছে। তাদের কাছে ঋত্বিকের ছায়াছবিগুলি তাই এ যুগের নিডের(need) ক্ষেত্রে অবসোলিট। কিন্তু তারা ভুলে যান ঋত্বিক কেবলমাত্র এই একটি টপিক নিয়েই অবসেশড ছিলেন না। টপিকের বিভিন্নতায় তিনি নিজেকে নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তেমনই একটি নির্মাণ হল কালী ব্যানার্জী অভিনীত ছবি অযান্ত্রিক। এই প্রসঙ্গেই এই লেখার অবতারণা।

বাংলা সাহিত্যে সুবোধ ঘোষের অনবদ্য কাজ হল “অযান্ত্রিক”। শরৎচন্দ্র “মহেশ” গল্পে মানবেতর জীবকে মানবসত্তা দান করান নায়ক গফুরের স্নেহশীল সম্বোধনে—“তুই আমার ছেলে মহেশ, তুই আমাদের আট বছর পিতিপালন করে বুড়ো হয়েছিস”। আর সব কৃষকদের মতো মহেশকে, অকেজো বুড়ো ষাঁড়কে, যে সংসারে কেবল ব্যয় বাড়ায়—তবুও গফুর গো-হাটায় তাকে বেচে দিয়ে সাংসারিক আপদ বিদায় করতে চায় না। বৃদ্ধপুত্রকে গফুর তার অভাবের সংসারেও আশ্রয় দিতে চায়, মহেশই তার মনের কথা বলার স্থল।
একইভাবে রুশ কোচম্যানের মনের কথা বলার একমাত্র স্থান হয়ে ওঠে তার ছ্যাকড়াগাড়ির মাদী ঘোড়াটা। মানব মনের আকুতির নিরিখে আন্তন চেকভের “মিজারি” ছোটগল্প অনবদ্য হয়ে ওঠে যখন নির্বাক জীব মানুষের একাকীত্বের সঙ্গী হয়ে যায়। দরিদ্র বৃদ্ধ কোচম্যান, যার উপার্জনক্ষম পুত্রের মৃত্যু হয়েছে, সেই পিতা এই প্রাণহীন নিষ্ঠুর নগর সভ্যতাকে তার কান্না হতাশা শোক শোনাতে পারে না। আবার মার্কেজের “কর্নেলকে কেউ চিঠি না” লেখায় তার সেই চরম আশ্রয়হীনতা ও অর্থকষ্টে তার মৃত পুত্রের পরিবর্ত হয়ে আসে একটি যুদ্ধ-মোরগ, যে মোরগের লড়াইয়ে জিতে পুত্র-কৃত্য পালন করে। আত্মজের মৃত্যু আত্ম-মৃত্যুর থেকেও বেদনাদায়ক।
এইচ.ই.বেট্স-র “দ্য অক্স” ছোটগল্পে নিম্ন মধ্যবিত্ত মিসেস থার্লো-র একমাত্র সহায় হয়ে ওঠে তার পুরোনো সাইকেলটি। কোনোদিকে না চেয়ে নির্লজ্জের মতো তিনি অর্থ সাশ্রয় করেন আর দিবস রজনী অগাধ পরিশ্রম করে চলেন। শেষপর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায় সাইকেলটি। বৃথা হয়ে যায় তার সকল আশা, ধ্বংস হয়ে যায় তার পারিবারিক জীবন। ক্লান্ত শরীরটাকে আর অকেজো সাইকেলটিকে তিনি টেনে নিয়ে চলেন পাহাড়ি চরাই উৎরাই বেয়ে।
সুবোধ ঘোষের “অযান্ত্রিক” ছোটগল্পে পুরোনো জিপগাড়িটি শুধু বিমলের অন্নসংস্থানের যন্ত্র নয়। তা বিমলের সাথী, কখনও বা পিতাসম আশ্রয়স্থল, কখনও ভ্রাতাসম ভরসাস্থল, কখনও বা পুত্রসম স্নেহের স্থল। বিমল জিপের নাম দিয়েছে “জগদ্দল”। যেন জগতের সকল শক্তি তার “জগদ্দল”-এর মধ্যে নিহিত আছে। যে শক্তির একমাত্র চালক বিমল নিজে—এটাই বিমলের পৌরুষ। তাই অকেজো জগদ্দল যেন বিমলের পৌরুষের পরাজয়। জগদ্দলকে ভাঙা বা জগদ্দলের মৃত্যু যেন বিমলের আত্মজের অকালে চলে যাওয়া। জগদ্দলকে হারানো বিমল হয়ে ওঠে যেন ঘরহারা উদ্বাস্তু। যন্ত্রকে এইভাবে মানবচেতনায় অযান্ত্রিক করে তোলেন সুবোধ ঘোষ। “অযান্ত্রিক” বাংলা সাহিত্যে একপ্রকার বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়।
আরে এতক্ষণ তো খেয়ালই করিনি, পুনর্বার অযান্ত্রিক ছায়াছবিটি দেখতে দেখতে চোখ আটকে গেল জগদ্দলের নাম্বার প্লেটে—BRO 117। গাড়িটির উপর রেড ক্রশের একটি পুরোনো লোগো আছে, হয়তো গাড়িটি বহু হাতফেরতা। বাতিল গাড়িটি “মক্ষীচুষ” বিমল কম দরে কিনে নিয়েছে। তারপর পাকা মেকানিক বিমল গাড়িটি মেরামত করে নিয়ে নিজের কাজে চালাতে চালাতে এক অন্যমাত্রার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে তার দাসরূপী জগদ্দলের সঙ্গে। BRO কথাটি পাশ্চাত্যে ভাই বা বন্ধু সম্বোধনে ব্যবহৃত হয়। নাম্বার প্লেটের মাধ্যমে ঋত্বিক বুঝিয়ে দিলেন যে এখন দাস-প্রভু সম্পর্কের বিপ্রতীপে জগদ্দল বিমলের ভাই-বন্ধু। তার নির্ভরস্থল। পাঠক হয়তো বলবেন BR বিহারের গাড়ির কোড। হ্যাঁ, অবশ্যই বিহারের প্রেক্ষাপটেই অযান্ত্রিক নির্মিত। পাশেই সর্দারজীর নাম্বার প্লেট BRN। কিন্তু বিমলের গাড়ির কোড BRO-ই হতে হয়, BRN বা BRM নয়। ঋত্বিক এইভাবেই আমাদের বারবার চিহ্নকের ডিটেলিং-এর মাধ্যমে বিমল ও জগদ্দলের সম্পর্কের পরম গভীরতায় নিয়ে যান।
অযান্ত্রিকের ডিটেলিং তুখোড়। পাঠক মনে করুন সেই দৃশ্যটার কথা, যেখানে রাতের বেলা ১০জন আরোহী চাপিয়ে ওভারলোডেড জগদ্দলকে নিয়ে বিমল মেলায় আসে আর পরেরদিন সকালে আমরা বিমলের ঘুম ভাঙতে দেখি পরম নিশ্চিন্তির জগদ্দলের আশ্রয়ে। ঋত্বিক এইভাবে দেখিয়ে দেন যে জগদ্দলই বিমলের আসল ঘর, তার বাসা।
বাসা কথাটা লিখতে লিখতেই অরনিথোলজিস্ট বা পক্ষীবিদদের দ্বারা চর্চিত বাবুই পাখির বাসার বিষয়টি মনে পরল। বর্ষাকালে পুরুষ বাবুইগুলো সুন্দর করে বাসা বানায়। স্ত্রী বাবুইয়ের যে বাসাটি মনে ধরে তাতে এসে বসবাস করা শুরু করে। কালক্রমে সেই স্ত্রী-পাখিটিই বাসা নির্মাণকারী পুরুষ বাবুইটি সন্তানের জননী হয়।
পাঠক মনে করুন যে দৃশ্যে কাজল গুপ্ত জগদ্দলে প্রবেশ করল (প্রবেশ বলছি এই কারণে জগদ্দল এখন বিমলের গৃহ) সেই দৃশ্যটি মনে করুন। প্রবেশ করেই কাজল গুপ্ত জগদ্দলের ছাদের ছিন্ন কাপড় নিয়ে ব্যঙ্গোক্তি করে বসল। তারপরেই সেই মোক্ষম দৃশ্য। কাজল গুপ্তের বিমলের কাঁধ ধরে গাড়ি থামানোর নির্দেশ। বিমলের জীবনে প্রথম নারীস্পর্শ—জায়ারূপী নারীস্পর্শ। পাল্টে গেল বিমলের জীবনের চলন। মক্ষীচুষ বিমল সারিয়ে নেয় জগদ্দলের ছাদ। জগদ্দলের ভগ্নদশা নিয়ে আগেও আমরা বহু ব্যক্তিকে ব্যঙ্গ করতে দেখেছি। বিমল তাদের তেড়ে মারতে গেছে। কিন্তু জগদ্দলকে মেরামত করার চিন্তা তার মাথায় আসেনি। এবার কাজল গুপ্তের সঙ্গে দ্বিতীয়বারের সাক্ষাতের দৃশ্যে বিমলকে দেখি লাজুক কণ্ঠে বলতে—‘ওটা সেলাই করে দিয়েছি, পুরোনো হুডের কাপড়টা’। পুরুষরাই তো বাসা তৈরি করে মেরামত করে আর নারী সেখানে এসে ঘর বাঁধে।
পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, বিমল কি আদৌ সংসারী হতে চায়? মিতব্যয়ীতার স্বভাব যার প্রায় মানসিক অসুস্থতার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তার তো অকৃতদার থাকাই স্বাভাবিক। ঋত্বিক বিমলের এই মেটামরফোসিস বা পূর্ণ চারিত্রিক পরিবর্তনটাকেই দেখাতে চেয়েছেন। এই ট্রান্সফরমেশনটি পূর্বনির্দিষ্ট। জীবন রসিক পরিচালক আবার চলে যান ডিটেলিং-এ। যখন কাজল গুপ্ত প্রথমবার জগদ্দলে পা রাখে তখন দেখি বিমলের প্রায় বরবেশ। পাঠক হয়তো বলবেন, বিমল শখ করে ছবি তোলাতে এসেছে প্রায় ফুলবাবু জামাইয়ের মতো সেজেগুজে। কিংবা আরো বলতে পারেন ছবিটির প্রথমদিকে প্রায় উন্মাদ বর সতীন্দ্রকে তার পরম কাঙ্ক্ষিত বিবাহবাসরে পৌঁছে দেবার পরও বিমলের নিজের বিয়ে করবার প্রতি কোনও আগ্রহ নেই। কিন্তু পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন যখন কাজল গুপ্ত জগদ্দলে প্রথমবার পদার্পণ করল তখন আড়াল থেকে একটি ট্যাক্সি মোটরযান দেখা যাচ্ছে যেটিকে বরের গাড়ির মতো সাজানো হয়েছে। তারপর জগদ্দল স্টার্ট নিলো, পিছিয়ে আসলো, এসে পৌঁছোলো ওই পুষ্পসজ্জিত ট্যাক্সির ঠিক পাশটিতেই; তারপর চূড়ান্ত গতিতে ছোটা আরম্ভ করল। চিহ্নকের মাধ্যমে ঋত্বিক দেখালেন বিমলের বরযাত্রা। সে আজ নিপাট বাবু। সে গাড়ির স্টার্টারে তাই হাত লাগায় না যেমন সে এযাবতকাল করে এসেছে। সুলতানকে নির্দেশ দেয় হ্যাণ্ডেল ধরে গাড়িতে স্টার্ট দিতে।
বিমলের হয়তো কোনোদিনই ঘর বাঁধার আগ্রহ হত না যদি না কাজল গুপ্তের সঙ্গে তার দেখা হত। ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে তেলেভাজা বিক্রেতা রমণী বুলাকি বহুবার বিমলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে তার অশালীন হাসির মাধ্যমে, কিন্তু বিমলের মনে তা রেখাপাত অবধি করে না। ঐ নারীর সামনে অনায়াসে বিমল লোকজনকে শাসায়, গালি দেয়, তাদের গায়ে হাত তোলে। বিপ্রতীপে কাজল গুপ্তের সম্মুখে বিমল সংযত হয়ে যায়; যে ভদ্রলোক জগদ্দলের প্রচণ্ড আওয়াজ সহ্য করতে না পেরে উলটে পথের একদিকে পড়ে যায় ও জগদ্দলকে দোষারোপ করতে থাকে, তাকে বিমল ক্রুদ্ধ স্বরে প্রতিআক্রমণ করে, বলে—“মশায় কী নেত্য কম্মটম্ম কিছু করেন না, যত দোষ আমার এই গাড়ির…”। তারপর বিমল লাজুকভাবে নিজেকে সামলে নেয় কারন পিছনের আসনে বিমলের আচরণ দেখে কাজল গুপ্ত হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়ে, সরে যায় তার অবগুণ্ঠন, গাড়ির আয়নায় এই দৃশ্যের প্রতিবিম্ব অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে বিমল। নিজেকে হারিয়ে ফেলার মুহূর্ত তার জীবনে এসে গেছে।
ঋত্বিক বরাবরই বিমল-জগদ্দলের মধ্যে পিতা-পুত্রের সম্বন্ধকে বজায় রেখে চলেছেন। বিমলের চেতনায় এখনও জগদ্দল পুত্রসম যদিও অবচেতনে শুরু হয়েছে অন্য খেলা। কাজল গুপ্ত ও অনিল চ্যাটার্জীকে হোরাব পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময় ঘাটপ্রারম্ভের পাহাড়ের উপরে গাড়ি থামায় বিমল। সুলতানকে বলে—“বেড়ে কাটছে না দিনগুলো”। রগচটা বিমলকে আজ বড় খুশি খুশি ভাবুক লাগছে। যে অভূতপূর্ব অনুভূতি পুরুষের মনে পূর্বরাগের রঙ লাগায় সেই রঙ আজ লেগেছে বিমলের মনে। “মাস্টার তোমার কেউ নেই?” সুলতানের প্রশ্ন আয়নার মতো ধরে বোঝানো হয় যে বিমলের সেই একক মন এখন কোনো সঙ্গী কামনা করছে। সে বলে ১৫ বছর আগে যখন তার মা চলে গেল তখন থেকে জগদ্দলই তার সব। যেন তার পুত্র জগদ্দল রোজ তার অন্নসংস্থান করে নিজ কর্তব্য পালন করে চলেছে। বৃদ্ধ আরোহীকে কলকাতার ট্রেন ধরিয়ে দেওয়ার পর তার আত্মবিশ্বাস বা আরও স্পষ্টভাবে দেখলে পুত্রের উপর পিতার আত্মবিশ্বাস যেন অনেক বেড়ে যায়। সে জগদ্দলকে পিতৃস্নেহে আদর করতে থাকে, প্রশংসা করতে থাকে। বিমলের পুত্রের প্রতি আস্থা দিন কে দিন বেড়ে চলে। সে দশজন যাত্রীকে নিয়ে জগদ্দলকে ওভারলোড করে মেলায় যায়। সেই মেলাতেই মন্দিরে যায় বিমল—যদিও ঈশ্বরে ভক্তি তার নেই বললেই চলে। পূজা দেবার প্রস্তাব সে প্রত্যাখ্যান করে মুখ ফিরিয়ে চলে আসতে চায়। কিন্তু তাকে যখন বলা হয়— “বাবা, বাল বাচ্চা আচ্ছা রহেগা”, সে নিয়ে নেয় প্রসাদী ফুল তার জগদ্দলের জন্য। তারপর তার নজরে আসে যে একদল দুষ্টু বালক বালিকা জগদ্দলের উপর অত্যাচার করছে। উন্মাদের মত সে তেড়ে যায় তাদের দিকে। তারা তাকে “পাগলা পাগলা” বলে মজা করতে থাকে (এরকম বীভৎস মজা করার সিন ঋত্বিকনাট্যে প্রায়ই দেখা যায়; মানুষের শিল্পী ঋত্বিক কখনও মাস সাইকোলজিকে অবজ্ঞা করতে পারেন না তা সে যতই না বীভৎস হোক)। তারা কাদা ছুঁড়তে থাকে জগদ্দলকে লক্ষ্য করে। বিমল বুক দিয়ে রক্ষা করার চেষ্টা করে ঠিক যেমন পিতা তার কমজোরি পুত্রকে দামাল সমবয়সীদের বুলিং থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। তারপর বড় জলাশয়ের তীরে নিয়ে গিয়ে জগদ্দলকে পরম মমতায় সাফ সুতরো করে বিমল; বলে “তুই আছিস, আর আমি আছি” ঠিক যেমন অবলা পুত্রকে ভরসা যোগায় তার পিতা।

পিতা পুত্রের এই পবিত্র সম্পর্কটাই পৌঁছোতে থাকে প্রায় স্কিৎজোফ্রেনিয়ার স্তরে। তথাকথিত মানসিকভাবে সুস্থ মানুষের জগতে বিমল তাই অন্য মানুষ। বেঙ্গলি ক্লাব বিমলকে মেশিন বলে। বিমল তা উড়িয়ে দেয় ফুঁৎকারে। সুলতানকে ফিসফিস করে বলে যে জগদ্দলও মানুষ। যে ব্যক্তি যন্ত্রকে মানুষ ভাবে মানুষের সমাজ তাকে স্বাভাবিকভাবেই মেশিন ভাবে। জগদ্দলকে ঘিরে বিমল যে স্কিৎজোফ্রেনিক জগৎ গড়েছে তাতে তার একান্ত বিশ্বস্ত সুলতান ছাড়া আর কারও প্রবেশাধিকার নেই। তিস্তায় পৌঁছে বিমল খুশি মনে জগদ্দলকে আদুরে গলায় ডাকে “বুড়ো…”। বৃদ্ধ আরোহী ফিরে তাকালে বিমল চমকে ওঠে। তার চোখে মুখে ফুটে ওঠে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। আর সব স্কিৎজোফ্রেনিক এইভাবেই নিজের কম্ফোর্ট জোন জগতের থেকে লুকিয়ে রাখতে চায়। মুহূর্তে সামলে নেয় বিমল। কল্পনার জগতের সঙ্গে সে বাস্তবের সঙ্গেও সমান্তরাল সম্পর্ক রেখে চলে। বড় সাবধান সে এ ব্যাপারে। বাস্তবে সে আবার ফিরে আসে। অনবদ্য দৃশ্য সৃষ্টি করে ঋত্বিক বিমলের চেতন-অবচেতন মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দেন।
এরপর থেকেই ঋত্বিক অবচেতনকে চেতন স্তরে তুলে আনতে থাকেন। দর্শকেরই অজান্তে তাদের অবচেতনে ঋত্বিক এতক্ষণ যে স্রোত ফল্গুধারার মতো বইয়ে দিয়েছিলেন বিমল-জগদ্দল পিতা-পুত্র সম্পর্কের প্রাধান্যের আড়াল করে এবার সেই স্রোত চেতনে প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। সিনেমার মূলধারা পিতা-পুত্র থেকে ঋত্বিকের ক্যামেরা সরে এসে এবার অন্য অ্যাঙ্গেলগুলিতে নিবদ্ধ হয়। ক্যামেরার গতিপথের ব্যবহারে এবার দর্শকের অবচেতনকে স্বচ্ছ আয়নার মতো তারই সামনে মেলে ধরেন ঋত্বিক। বিমলের মুখের উপর ফোকাস আর জগদ্দলের চলন-গমন এবার ক্যামেরার মূল প্রতিপাদ্য হয়ে ওঠে। কাজল গুপ্তের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই অবচেতনের চেতনের স্তরে উঠে আসা শুরু হয়। শুরু হয় পিতা-অপত্যের সম্পর্কের ক্রমাবসান ও এক নতুন ধরণের সম্পর্কের নির্মাণ যেখানে জগদ্দল সেই বিশেষ সম্পর্ক বা পরিচিতির চিহ্নক হয়ে ওঠে।
হেঁয়ালি ছেড়ে এবার সেই ক্রমে ক্রমে উপরে উঠে আসতে থাকা চিহ্নকের কথাই বলব যা অনেক দর্শকের চোখ এড়িয়ে যায় অথচ ঋত্বিক সেটিকেই সবচেয়ে বেশি নজরে আনতে চেয়েছেন। বিষয়ের গভীরে যাওয়ার আগে পরপর কয়েকটি দৃশ্যের কথা পাঠককে স্মরণ করতে বলব। প্রথম দৃশ্যেই বরবেশী সতীন্দ্র ও তার মামা গঙ্গাপদ বসুর আবির্ভাব। উন্মাদনায় কেউ কারোর থেকে কম যান না। কেষ্ট মুখার্জী অভিনীত পাগলের আবির্ভাবও প্রথম দৃশ্য থেকেই। সুলতান তার মার বয়সী বুলাকী তেলেভাজাওয়ালিকে ঠাট্টার সুরে প্যাঁক দেয়—“এই বুলাকী আমায় বিয়ে করবি!” বুলাকীও প্রকটভাবে হেসে উঠে তাদের স্ব স্ব পাগলামিকে প্রকাশ করে একেবারে প্রথম দৃশ্য থেকেই। ইনস্যানিটি ও অবসেশনের এই সেলিব্রেশন থেকে বোঝা যায় মনোরাজ্যের কোনো গভীরের দিকে দর্শককে নিয়ে যাওয়াই পরিচালকের প্রথম থেকেই প্রধান উদ্দেশ্য। এবার সেই দৃশ্যগুলি ভাবুন যেখানে গহিন পাহাড়ি অরণ্যের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে বিমলের শেভরোলেট গাড়িটি বা গভীর নিশীথে গাঢ় অন্ধকার ভেদ করে ছুটে আসছে জগদ্দলের হেড-লাইট (গাড়ি ওভারলোড করে মেলায় যাওয়ার দৃশ্য)।
প্রথম দৃশ্য থেকেই দেখি বিবাহ নিয়ে ঠাট্টা-হাসি-বরযাত্রা ইত্যাদি বা এককথায় বিবাহ নিয়ে অবসেশন। মানবজীবনে উপযুক্ত সঙ্গী খুঁজে পাওয়ার (যৌনতা বা আধ্যাত্মিকতা উভয় দিক থেকেই) সাফল্যকে সেলিব্রেট করা হয় বিবাহের মাধ্যমে। চলচ্চিত্রটিতে ঋত্বিক চরিত্রগুলির সাফল্য বা ব্যর্থতা মেপেছেন বিবাহে সাফল্য-ব্যর্থতার মাপকাঠিতে। তেলেভাজা বিক্রেতা বুলাকী স্বনির্ভর অন্তত অর্থনৈতিক দিক থেকে। তবুও তার বর জোটেনি। সে তার স্খলিত হাসির দ্বারা পুরুষদের (বিমলেরও) দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। ব্যর্থ হয় তার এই সিডাকশন। শেষের দিকের দৃশ্যে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া জগদ্দলকে ঠেলে আনে বিমল। বুলাকীই প্রথম হেসে ওঠে। কী অদ্ভুত প্রতিস্পৃহ সেই হাসির দৃশ্য! জগদ্দলকে চালাতে বিমল এখন অক্ষম। এই দৃশ্য বুলাকির প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করে। তাই সে হেসে ওঠে সবার আগে। সমগ্র সমাজের হাসির অগ্রদূতী সেই প্রেতিনী।

শেষপর্যন্ত বিবাহবাসরে যেতে সমর্থ হয় সতীন্দ্র। তাও বিমলের সহায়তায়। এখানেই ঋত্বিকের নিষ্ঠুর পরিহাস যে উন্মাদেরও জীবনসঙ্গী জুটে যায় কিন্তু বিমল ব্যর্থ হয় কাজল গুপ্তকে লাভ করতে। আপাতদৃষ্টিতে বাস্তবের কাছাকাছি থাকা বিমল সুস্থ ও স্বাভাবিক। তবুও কাজল গুপ্ত বিমলের হাত ধরল না। কেন? বারবার ঋত্বিকের সিনেমায় এই না-পাওয়া বিয়োগান্তক ফিরে ফিরে এসেছে। সিম্বলিক দৃশ্যগুলি সেই ঘটনার সম্ভাবনা আগে থেকেই ব্যক্ত করেছে। অবচেতন এতে মাস্টার! অযান্ত্রিকের সেই ট্রিক দৃশ্যটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত হলে ঋত্বিকের ডিটেলিংয়ে মাথা ঘুরে যায়। বিদ্যুৎচালিত কয়লাবাহী ট্রেগুলির আনাগোনা। ট্রেগুলি একে অপরের কাছে এসেও কেউ কাউকে স্পর্শ করতে পারছে না উপরন্তু আরও আরও দূরে সরে যাচ্ছে। বিমলের জীবনে কাজল গুপ্তের আবির্ভাবও এই একইপ্রকারের পরিণতির দিকে যায়। তাই পূর্ব হতেই এই দৃশ্য দেখিয়ে জানিয়ে রাখা যে অতিরিক্ত কিছু প্রত্যাশা করবেন না দর্শক! পরিচালকের ক্যামেরা তাক্ করল ৫৭৯নং ট্রেটিতে। সংখ্যাগুলি বিজোড় অর্থাৎ বিমলের জীবনে যুগ্মতা আসার সম্ভাবনা নেই। এবং সংখ্যাগুলি ক্রমবর্ধমান। অর্থাৎ বিমলের একাকীত্বও ক্রমাগত বাড়বে। একে একে তার জীবন থেকে চলে গেল কাজল গুপ্ত, জগদ্দল ও সুলতান। সুলতানকে সমাজ অপহরণ করে নিল বিমলের কাছ থেকে। বিমল একা ছিল কিন্তু একাকীত্ব ছিল না। কাজল গুপ্তের চলে যাওয়া বিমলের মতো যন্ত্রকে শেখালো একাকীত্ব কীরকমের অনুভূতি! এই ক্রমবর্ধমান একাকীত্ব বোঝাতেই ব্যবহৃত হল ৫৭৯ সংখ্যাটি। সাহিত্যের কনসিটকে এইভাবেই চিত্রকল্পে ব্যবহার করলেন ঋত্বিক।
জগদ্দলের সঙ্গে কথোপকথন—বিমলের স্কিৎজোফ্রেনিক ট্রেইট—সকলের অলক্ষ্যে থেকে যায়। কাজল গুপ্তের সঙ্গে সাক্ষাতের পর সে তার কৃপণতার গূঢ় ব্যারাম থেকে একপ্রকার বেরিয়ে আসে। গাড়ির হুড সারাই থেকে শুরু করে কাজল গুপ্তের জন্য ট্রেনের টিকিট কেটে দেওয়া এবং টিকিট ফেরত দিতে গিয়েও না দেওয়া—এগুলি তারই উদাহরণ। বিমলের ট্রেইটগুলি হয়তো সেরে উঠতো ঈপ্সিত নারীর প্রেমময়ী সান্নিধ্যে। কিন্তু তা হল না। কেন হল না তাই এবার দেখতে গিয়ে আমরা ঋত্বিকের অবচেতনের গভীরতর স্তরের দিকে ঘুরে যাওয়া বা অ্যাসোসিয়েটিভ সিনগুলি নির্মাণের কারণের দিকে চোখ ফেলব।
বর্তমান মানব সংস্কৃতি পুরুষতান্ত্রিক বা আরও স্পষ্ট করে বললে ফ্যালোসেন্ট্রিক বা শিশ্নকেন্দ্রিক (উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিকদের ভাষায় ফ্যালাগোসেন্ট্রিক)। মেল ডোমিন্যান্ট জগতে নারী হল জমি/সম্পদ যাকে অধিকার করে পুরুষত্ব চরিতার্থ হয়। ফার্টিলিটি মিথ বা উর্বরতা কল্পগুলিতে মাটিকে গর্ভবতী করে লাঙ্গল ধনুক শাবল ইত্যাদি কৃষিযন্ত্র যার সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠে শিশ্ন (বস্তুত আদিপ্রস্তর যুগে মানব নির্মিত সকল অস্ত্রই শিশ্ন আকৃতির। সর্বপ্রথম পূজনীয় মূর্তি যোনি বা ত্রিভুজ আর লিঙ্গ আকৃতির।)। পুরুষের স্বার্থে সন্তান বা শস্য জন্ম দিতে পারে তাই এবং একমাত্র সেই কারণেই নারী মহীয়সী মাতারূপে পূজনীয়। ‘অযান্ত্রিক’-এ পিতা-পুত্র সম্বন্ধের আড়ালে বিমল-জগদ্দলের শৈশ্নিক একাত্মতা সমান্তরালভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ঋত্বিক। এই শৈশ্নিক একাত্মতা লক্ষ্য করতে থাকে আমাদের অবচেতন মন। তারপর বিবিধ প্রতীকের মাধ্যমে পরিচালক আমাদের চেতনার কাছে এই বিষয়টি নিয়ে আবেদন রাখেন।
শিশ্ন যন্ত্রটির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রত্যেক পুরুষের কাছে একটি চ্যালেঞ্জের মতো। কৈশোর থেকে এই নিয়ন্ত্রণের পাঠ নেওয়া শুরু হয়। চলচ্চিত্র যত এগোতে থাকে জগদ্দল ততই বিমলের শিশ্ন-প্রতিভু হয়ে উঠতে থাকে। হোরাব-এ পৌঁছে বিমল জগদ্দলকে স্টার্টে রেখেই অনিল চ্যাটার্জীর ডাক আসাতে চলে যায়। সুলতান গাড়িতে উঠে বসে চালিয়ে দেয় জগদ্দলকে। একটু পরেই তার আর্ত চিৎকারঃ “গাড়ি থামাতে পারছি না”। পুরো দৃশ্যটিই সিম্বলিক। সদ্য কিশোর সুলতান এখনও শিশ্নের উপর প্রভুত্ব করার পাঠ পায়নি; সে অস্ত্র প্রয়োগ করতে শিখেছে কিন্তু সম্বরণ করতে শেখেনি। এবং এই শিশ্নের বালখিল্যতার প্রেক্ষিতে বিপরীত লিঙ্গ কাজল গুপ্তের বোধ-চিত্ত হারানো হাসি। বিমল লাফিয়ে উঠে থামিয়ে দেয় গাড়ি। নয়তো মুহূর্তে উত্তেজিত নিয়ন্ত্রণহীন শিশ্ন নারীকে (কাজল গুপ্ত) পিষে পিণ্ডে পরিণত করে চলে যেত। বিমল তার যন্ত্রকে সঠিক জায়গায় থামাতে জানে।
জগদ্দলকে ঋত্বিক যে ফ্যালাগোসেন্ট্রিজমের দিক দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন তার অন্যতম প্রমাণ ঘাট প্রারম্ভের সাঁওতালি বাঁশির দৃশ্য। উত্থানরত লিঙ্গের মতো দৃশ্য ফুঁড়ে বাঁশির উত্থান ঘটে। চলচ্চিত্রের চারটি দৃশ্যে একটি বালক শিশুর কনটিনিউয়িটি নির্মিত হয় যার একটি দৃশ্যে তাকে সামনের দিক থেকে নগ্ন দেখা যায়। খুব সচেতনভাবে নির্মিত দৃশ্য যার নির্মাণ হয় পরিচালকের ফ্যালাগোসেন্ট্রিক ইন্টারপ্রিটেশনকে আরো জোরদার করে দর্শকের সামনে উপস্থাপিত করার জন্য।

বিমল গর্বিত তার পুরোনো গাড়িটি নিয়ে। এ যেন মধ্যবয়স্ক যুবকের নিজের শিশ্ন যন্ত্রের উপর আস্থা, আত্মবিশ্বাস যার নামান্তর! বিমল জগদ্দলকে ওভারলোড করায়। মধ্যবয়স্ক আত্মবিশ্বাসী পুরুষ যেমন সংসারের সব ভার বহন করে। সমগ্র সমাজকে উচ্চগ্রামে (জগদ্দলের হর্ন, সাউণ্ড ডিজাইন) জানিয়ে বুক চিতিয়ে দায়িত্ব-জগদ্দলকে বহন লালন করে বিমল। নিজের পুরুষত্বের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস।
পাঠক, এপর্যন্ত আমরা দেখেছি যে বিমলের পৌরুষ সংযত, ভব্য। নাহলে বুলাকীর সিডাকশনে বিমল মজে যেত বা কাজল গুপ্তকে পিষে দিয়ে চলে যেত জগদ্দল। কিন্তু এবার বিমলের মধ্যে শুরু হয়েছে পরিবর্তন। তারই আগাম বার্তারূপে ঋত্বিক মেলায় নিয়ে আসলেন ছৌ নৃত্য—প্রচণ্ড পুরুষালি নৃত্যের একটি ফর্ম। দেবতাদের বদলে ঋত্বিক আলো ফেললেন ছৌ-এর অসুরের মুখে। পশুশক্তির পেশিশক্তির অসংযমের প্রতীক। এর ঠিক আগের দৃশ্যেই দেখি বিমল বৃদ্ধদের মতোই কিছুটা কমফর্টার জড়িয়ে ঘুম থেকে উঠল; সে জগদ্দলের মধ্যেই রাতে শুয়ে ছিল। ঋত্বিক যেন দেখাতে চাইলেন যে এবার বৃদ্ধ বিমলের বশে আর তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি থাকবে না। ক্রমশ জাগছে তাই বিমলের মধ্যে ব্যর্থতা বোধ/অবসাদবোধ। যা থেকে সে অসংযমকে আশ্রয় করতে চাইবে। দৃশ্যে দেখা যাবে বাচ্চারা জগদ্দলে কাদা ছুঁড়ছে আর বিমলকে “পাগলা পাগলা” বলে ক্ষেপাচ্ছে। বিমলের ট্রেটগুলি এবার সর্বসমক্ষে ধরা পড়ে যাচ্ছে। বিমল আর তা লুকিয়ে রাখতে পারছে না। এখান থেকেই শুরু হয়ে যায় বিমলের সক্ষমতা হারানোর বিয়োগান্তক পালা।
এর পরের দৃশ্যেই দেখি কাজল গুপ্তের সঙ্গে বিমলের দ্বিতীয়বার বা শেষবারের সাক্ষাৎকার। জগদ্দলের কাদা ধুয়ে ফেরার পথে বিমলের নজরে পরে টিলার উপর একাকিনী কাজল গুপ্ত। সাক্ষাতের প্রথম দৃশ্যে জগদ্দলের উপর বসে থাকা কাজল গুপ্তের হাতের দিকে ঋত্বিক ক্যামেরা তাগ্ করেছিলেন। এখনও তাই করলেন। পূর্বে হাত ভর্তি, গা ভর্তি স্বর্ণালঙ্কার ছিল। এখন তা আর নেই। কাজল গুপ্ত এখন নিঃস্ব। ইতিমধ্যে পুলিশের তদন্তের কল্যাণে বিমল জেনে গেছে কাজল গুপ্ত অন্যের স্ত্রী। প্রেমিক অনিল চ্যাটার্জীর সঙ্গে তিনি পালিয়ে এসেছেন। আর বর্তমানে বিমল বুঝল মেয়েটিকে নিঃস্ব করে দিয়ে তার প্রেমিক পালিয়েছে। এখন বিমল অনায়াসে কাজল গুপ্তকে অধিকার করতে পারে—এ সেই নারী বিমল যাকে অবচেতনে কামনা করে।
কিন্তু নারীটির দিকে এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তেই বিমল আক্ষরিক অর্থেই হোঁচট খায়। কাজল গুপ্তের একমাত্র সম্বল কাপড়ের পুঁটুলিটা সে গাড়িতে তুলে নেয়। কাজল গুপ্তও গাড়িতে উঠে বসে। লাজুক কন্ঠে বিমল গাড়ির হুডের কাপড় সারিয়ে নেবার খবর দেয়। কাজল গুপ্তের মুখে হাসি দেখা দেয়। বিমল যে বাসা নির্মাণ করতে পারে, তাতে যে একটি নারীকে আশ্রয় দিতে পারে এ যেন তারই স্বীকৃতি। আবার দেখি শুকনো খড়ের গাদার পিছন থেকে ক্যামেরার ফোকাস করেন ঋত্বিক – জগদ্দল সেই খড়ের গাদার পাশ দিয়ে যাচ্ছে। খড় ঘর নির্মাণে ব্যবহৃত হয় – এ যেন বিমলের ঘর বাঁধার স্বপ্নের প্রতীক – তার অবচেতন মনের চাহিদা। খড় আবার ফসলহীনতার প্রতীক, বার্ধক্যের প্রতীক – বিমল যে দিনে দিনে নিষ্ফলা হয়ে উঠছে, বার্ধক্য যে তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে খড়ের গাদা যেন তারই দ্যোতক।
কাজল গুপ্তকে নিয়ে বিমল এসে পৌঁছায় রেল স্টেশনে। বিমল কাজল গুপ্তের জন্য টিকিট ক্রয় করে। এবার কাজল গুপ্তকে দেখি উদাসী আনমনা। বিমল অনেকটা দূরে বেঞ্চে এসে বসে। পাঠক খেয়াল করুন কাজল গুপ্তের উদ্দেশ্যে বিমলের কথাগুলি ও তা বলার ধরণ:
“মরবে মরবে। ঘরও নেই শ্বশুরবাড়িও নেই”। কোথায় জন্মেছিল?
না বিমলের আর সংযত ভাব নেই। সে এখন আক্রমণাত্মক। যেন সে নারীকে অধিকার করে নিতে চাইছে। তার অবচেতন মনে এখন লীলা করছে পাশবিক প্রবৃত্তি। যেন সে নারীকে ভয় দেখিয়ে তাকে নিজের ইচ্ছামত চালিয়ে নিতে চাইছে। তারপর সে এগিয়ে যায় কাজল গুপ্তের দিকে। জানতে চায়…
“এখন কোথায় যাবে?”
কাজল গুপ্ত বলে ওঠে : “জানি না”।
এই “জানি না” বলার ভঙ্গির মধ্যেই কাজল গুপ্ত ফুটিয়ে তোলে বিমলের প্রতি তার প্রত্যাখ্যান।
আশ্রয়হীনা কাজল গুপ্ত তো পারতো বিমলকে আশ্রয় করতে। কিন্তু কেন করল না? পাঠক এই বিষয়টিকে দেখা যাক ফ্যালাগোসেন্ট্রিজমের আলোকে। শিশ্নকেন্দ্রিক পুরুষালি অহং কেবলমাত্র শারীরিক সক্ষমতার জোরে নারীকে অধিকার করতে চায়, তাকে দমিয়ে রাখতে চায়। এই পাশবিকতার কাছে মননের কোনো স্থান নেই। সে বোঝেনা নারীমন। সে ভাবে অন্ন, বস্ত্র আর বাসস্থান দিয়েই একটি নারীকে একটি পুরুষ আমৃত্যু বেঁধে রাখতে পারে। শিশ্ন দৌর্বল্য এজাতীয় পুরুষের কাছে তাই নিঃস্ব হয়ে যাবার শামিল। বিমলও আজ এই পথের পথিক। তাই কাজল গুপ্ত বিমলকে আশ্রয় করতে আর ভরসা পান না। টিকিটের অপেক্ষা না করেই তিনি ট্রেনে উঠে পরেন।
ট্রেন স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্যে দেখি বিমল ছুটে গিয়ে টিকিটটা কাজল গুপ্তকে দিচ্ছে। সে জানতে চায় কোথায় যাচ্ছে কাজল গুপ্ত। ট্রেনের ধাতব শব্দের মধ্যে সম্ভবত সে শুনতে পায় গন্তব্যস্থলের নাম। ট্রেন চলে যাবার পর বিমল হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে ফিরে আসে জগদ্দলের কাছে। সে দেখে পুঁটুলিটা আর সাধের চাকুটি ফেলে রেখে গেছেন কাজল গুপ্ত। মুহূর্তে কর্তব্য স্থির করে নেয় বিমল। সে জানে জগদ্দলের ক্ষমতা – একদিন ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে জগদ্দল বৃদ্ধকে কলকাতার ট্রেন ধরিয়ে দিয়েছিল। আজ জগদ্দলকে বিমল ট্রেনের আগে ছোটাতে চায়। আজ এই ছোটার উপর, গতিবেগের উপর নির্ভর করে আছে বিমলের পরম কাঙ্ক্ষিত নারীকে পাওয়া বা না পাওয়া। বিমলের পুরুষত্বের পরীক্ষা, তার পৌরুষদণ্ডের শক্তির পরীক্ষা।
না, জগদ্দল আর আগের মত দ্রুত স্টার্ট নিল না। উন্মাদের মতো বিমল জগদ্দলকে স্টার্ট করতে চাইল প্রচন্ড ক্ষিপ্রতায়। স্টার্ট নিয়েও স্টার্ট ফেল করল জগদ্দল। প্রচণ্ড ক্রোধে বিমল লাথি মারলো জগদ্দলকে। সশব্দে অবনত হয়ে যায় জগদ্দলের হেডলাইট। দর্শকের এবার নিশ্চয়ই মনে পড়ছে হেডলাইট উঁচিয়ে জগদ্দলের ছুটে যাবার কথা। বার্ধক্যগ্রস্ত পুরুষের শিশ্ন যেমন জেগে উঠেও নত হয়ে যায় ঠিক সেভাবেই জগদ্দলের হেডলাইট একবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েও আবার স্খলিত হয়। জগদ্দলের বিমলের পৌরুষত্বের এইভাবে বার্ধক্য গ্রস্ত হয়ে ওঠা অসীম নৈপুণ্যে দেখিয়ে চলেন ঋত্বিক। বিমলকে আমরা এবার প্রায় প্রতিটি দৃশ্যেই কম্ফর্টার জড়িয়ে নিতে দেখি। ছায়াছবির প্রথম দৃশ্য গুলিতে আমরা বিমলের এই রূপ কম্ফর্টার জড়ানো চেহারা দেখতে পাই না। পাঠক বলতেই পারেন ক্রমায়মান শীতে কম্ফর্টার বিমল জড়াতেই পারে। তবে পাঠককে একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, শীত ঋতু জরা – বার্ধক্যের প্রতীক। যুবক অনায়াসে পারে শৈত্যের সঙ্গে লড়াই করতে। বৃদ্ধই শীতকালে অতিমাত্রায় সচেতন হয়ে আগাম সতর্কতা অবলম্বন করে।
যাইহোক জগদ্দলকে লাথি মারার পরেই দেখি বিমল হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর দেখি প্রবল চেষ্টায় জগদ্দলকে স্টার্ট করালো বিমল। ঝড়ের গতিতে ছোটাতে লাগলো জগদ্দলকে। কিন্তু বিপদ ঘটলো ঘাটপ্রারম্ভের পাহাড় চূড়ায় এসে। একেবারে থেমে গেল জগদ্দল। তারপর পিছু হটা শুরু করলো পাহাড়ের নিম্নমুখী ঢাল বেয়ে – যেন পতনের দিকে যাত্রা করল বিমলের যৌবন। অনেক চেষ্টা করেও বিমল পতন আটকাতে পারল না। শেষে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে জগদ্দলকে পাহাড়েই ছেড়ে রেখে বিমল পাথুরে ঢাল বেয়ে নামতে লাগলো জঙ্গলে – আদিবাসী জীবনের উৎসব মুখরতায় – সেদিন আদিবাসীদের জমি উর্বরতা উৎসব। ভেসে আসছে পরবের গান, মাদল, বাঁশির আওয়াজ। এই দৃশ্যের শুরুতেই ক্যামেরা পরে উত্থিত লিঙ্গের মতো আদিবাসী বাঁশিতে। সারারাত জুড়ে চলে যৌবনের মাতন। বিমল এখানে ব্রাত্য থেকে যায় – ব্রাত্য আদিবাসী বৃদ্ধের একমাত্র সঙ্গী হয় সে। ফ্রাস্ট্রেটেড বিমল হাঁড়িয়ার নেশায় ডুবে যায়। এরপরই বিমলের নজরে আসে আদিবাসী তরুণীর ক্রোধান্বিত কথোপকথন তার মরদের সঙ্গে। তরুণী বেইমান বলে গালি দেয় তার প্রেমিককে। তার সেই ব্যর্থ মরদকে প্রত্যাখ্যান করে চলে যায় তরুণী…
পরদিন বিমলকে দেখা যায় জগদ্দলকে ঠেলে নিয়ে যেতে। জগদ্দলের উপর চড়ে বসে আছে আদিবাসী তরুণী আর তার নতুন মরদ জগদ্দলকে বলতে গেলে একা হাতে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে হাসিমুখে প্রেমিকার সাথে কথা বলতে বলতে। কী সাবলীল পৌরুষ ঐ আদিবাসী তরুণের যার উপর নিশ্চিন্তে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে যুবতীর উর্বরতা উদ্‌যাপনকারী লাবণ্য। এই বৈপরীত্য থেকেই আরও নিঃস্ব লাগে ক্রমক্ষীয়মান পৌরুষে আক্রান্ত বিমলকে।
ছবির প্রথম দিক থেকেই আরও মারাত্মক আর পৌরুষকেন্দ্রিক-শিশ্নকেন্দ্রিক বৈপরীত্য নির্মাণ করে গেছেন ঋত্বিক কেষ্ট মুখার্জি অভিনীত পাগল চরিত্রটির মধ্য দিয়ে। প্রথম দৃশ্যেই পাগলকে হেঁটে যেতে দেখি বর্ষোন্মুখ মেঘাচ্ছন্ন সন্ধ্যা আকাশের নীচ দিয়ে। বলতে শুনি: “ছাতাটা পাওয়া গেছে, গামলাটা আর ভিজবে না”।
এরপর আবার যে দৃশ্যে পাগলকে দেখা যায় সেটা কাজল গুপ্ত, অনিল চ্যাটার্জী আর সুলতানকে নিয়ে বিমল তীব্র গতিতে জগদ্দলকে চালিয়ে আসছে আর পাগল শশব্যস্ত হয়ে উঠেছে তার ছাতা আর গামলা বাঁচাতে। ভীতু এবং ক্ষুব্ধ হয়ে সে বলছে: “এই! এই! ওরে আমায় মেরে ফেলবে…”
আর্ত, ত্রাহি চিৎকার তার। জগদ্দল আসার মুহূর্তে আমরা পাগলকে দেখছি গামলাটা দিয়ে মাথা বাঁচাতে বাঁচাতে একদম তার ছাতার দিকে সরে গুটিয়ে যেতে।
এরপর যে দৃশ্যে আমরা পাগলকে যেখানে দেখি সেখানে রাস্তার মাঝখানে গামলা উপুড় করে রেখে পাগলকে আপন মনে পাগলামো করতে‌ দেখি। ইতিমধ্যে একটি মোটর গাড়িকে আসতে দেখে পাগল খিঁচিয়ে ওঠে: এই! এই! যেন সারা রাস্তাটাই ওর!
যাইহোক গাড়িটি গামলাটির পাশ দিয়েই চলে যায়। এরপর আবার একটি গাড়ি আসতে দেখা যায়। কিন্তু এবার গামলাটিকে দুমড়ে-মুচড়ে পিষ্ট করে দিয়ে চলে যায় গাড়িটি। বেদনাহত পাগল ব্যথিত মুখে শুয়ে পড়ে তোবড়ানো গামলাটিকে বুকে জড়িয়ে নেয়। এরপরই দেখা যায় জগদ্দলের চাকা। বিমল জগদ্দলকে ঠেলে নিয়ে আসে রেলশহরে।
পাঠক খেয়াল করেছেন যে পাগলের অবসেশন (বিশেষ বস্তুর প্রতি তীব্র আকর্ষণবশত ঐ বস্তুকে নিয়েই অনবরত চিন্তন যা আর অন্য কোনো বস্তুতে মনোনিবেশে বাধা দেয়) তার গামলা নিয়ে আর বিমলের অবসেশন জগদ্দলকে নিয়ে। দুটিই প্রাণহীন বস্তু। অবসেশন যদি মানসিক রোগ হয় তবে পাগল, বিমল দুজনেই একই রোগের রোগী। দুজনেরই ট্রেটের ধরন তাই এক প্রকার। পাগল যেমন গামলায় আঁচড় লাগতে দিতে চায়না, ছাতা দিয়ে গামলা টিকে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া থেকে বাঁচায় বিমলও ক্ষেপে ওঠে জগদ্দলকে নিন্দা করলে, তাকে আঘাত করলে। দুজনেই তাদের অবসেশন এর বস্তুটির রক্ষণের বিষয়ে নিজেদের অসহায় বোধ করতে থাকে। এই অবশেসন তাদের দুজনেরই আর তাই তাদের সমাজ বিচ্ছিন্ন করে তোলে।
পাঠক ভাবছেন পাগল ও বিমলের বৈপরীত্য দেখাতে গিয়ে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে মিল দেখিয়ে দিলাম। বেশ এবার বৈপরীত্যের দিকে তাকাই চলুন। আমরা দেখলাম পাগল ও বিমল দুজনেরই অবসেশনের বস্তুটি নষ্ট হয়ে গেল। বিমল আপ্রাণ চেষ্টা চালালো অসুস্থ জগদ্দলকে সারিয়ে তুলতে। প্রাথমিকভাবে সফল হলো সে। পরীক্ষা করতে জগদ্দলকে চালিয়ে নিয়ে গেল সে ঘাটপ্রারম্ভের পাহাড়ের চূড়ায়। আবার স্টার্ট বন্ধ করে দিল জগদ্দল। যেন স্খলিত অতি শীঘ্র বীর্য পতন। যে বিমল অসুস্থ জগদ্দলকে গিয়ে সান্ত্বনা দিত—
“আমি আছি জগদ্দল… ”
আজ সে ক্ষিপ্ত হয়ে জগদ্দলকে গাল দেয়:
লোহা
বিমল জগদ্দলকে বলে :- “সর্বস্ব দিয়েও তোর মন পেলুম না… ”
তারপর শাস্তি দিতে জগদ্দলের উপর ভারী ভারী শিলাখণ্ড চাপায় সে। যেন অনেকটা অবাধ্য পুত্রকে পিতার সাজা দেবার মত। তারপর সে চালাতে শুরু করলো জগদ্দলকে। খানিক এগিয়ে গিয়ে দেখা গেল জগদ্দলের ক্লাচ ফেল করে ঝর ঝর করে পেট্রোল পড়ে গেল। ইঞ্জিনের শব্দ সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।
বরাবরের জন্য বাতিল হয়ে গেল জগদ্দল।
এরই বিপরীতে ঋত্বিক দেখান একটি নতুন গামলা জোগাড় করেছে পাগল। সে সারা সমাজকে এই গামলা দেখাতে ব্যস্ত- ও সুলতান,ও বৌ ঠাকরুন এই দেখো আমার নতুন গামলা! সুলতান বলে ওঠে আগের পুরানো গামলাটাই ভালো ছিল। পাগল প্রতিবাদ করে বলে যে আগের গামলাটার কী কী খুঁত ছিল। কিন্তু বর্তমানের, নতুনটা, পাগলের ভাষায়, “কেমন যেন চকচক চকচক করছে! কেমন যেন চকচক চকচক করছে।”
পাগল ভীষণ খুশি গামলা পেয়ে।
এবার গামলা যদি হয় পাগলের শিশ্ন ক্ষমতার জ্ঞাপক তবে পাগলও সফল হলো তার পুরুষত্ব অটুট রাখতে। তাই বুলাকিকে দেখি হাসি মুখে পাগলের মতন গামলা প্রত্যক্ষ করতে। পাঠক মনে করুন পাগলকে বুলাকির চড় মারার দৃশ্যটির কথা যেখানে পাগল হঠাৎ বুলাকির চলার পথের উপর এসে পড়ে বলে – “এই যে, এসে পড়েছেন দেখছি!”
বিরক্ত বুলাকি সপাটে চড় মারে পাগলকে। তারপর পাগলের হাসি শুরু হল। বুলাকির ও পাল্টা হাসি আরম্ভ হল। না, এই হাসিতে আর বিরক্তি নেই। যেন পাগলের হাসির পাল্টা ইশারা রয়েছে বুলাকির এই হাসিতে। এই হাসাহাসিতে যেন উভয়ের মধ্যেই একটা বোঝাপড়া হয়ে গেল। আজ নতুন গামলা জোগাড় করে পাগল যেন বুলাকিকে – একটি নারীকে জিতে নিল।
বিপরীতে অচল জগদ্দলের চালক বিমল চিরদিনের মত হারিয়ে ফেলল তার আকাঙ্খিত নারীকে – কাজল গুপ্ত অভিনীত স্ত্রী চরিত্রটিকে।
গামলাটিকে রক্ষণ করার মতো ছাতা বা আশ্রয়ও রয়েছে পাগলের। কিন্তু বিমলের চোখের সামনেই ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে ফেলা হলো জগদ্দলকে।
যে দৃশ্যে বিমল অচল জগদ্দলকে ঠেলে নিয়ে ঢুকছে রেল শহরে, ঋত্বিক খুব প্রতীকী ভাবেই ক্যামেরা তাক করলেন চশমার দোকানের বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংয়ের উপর যেখানে ফ্রেমের চশমা পরিহিত দুটি চোখ যেন সারা সমাজের চোখের প্রতিভূ হয়ে ব্যর্থ বিমলের দিকে তাকিয়ে আছে। সত্যই, সারা রেল শহর যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল অচল জগদ্দলকে দেখতে। এযাবৎ বিমলের আকর্ষণ পেতে ব্যর্থ বুলাকি আজ বিমলের পৌরুষের এই চরম বিপর্যয়টিকে যেন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে। হাসিতে ফেটে পড়ে সে। তাকে অনুসরণ করে হাসতে থাকে সারা সমাজ। বিমলের পৌরুষের পতন সবার প্রথম একটি নারীর চোখেই ধরা পড়ে।
এই দৃশ্যে গৌড়বাবু – মাস্টার মেকানিককে (জ্ঞানেশ মুখার্জী অভিনীত চরিত্র) গম্ভীর হয়ে যেতে দেখা যায়। সুলতান কেঁদে ফেলে। বিমলের পরে আর যদি কেউ জগদ্দলকে ভালোবেসে থাকে তবে সে সুলতান। সর্দার হাসতে হাসতে সুলতানকে কোলে তুলে নেয়। সুলতানকে লুট করে নেয় সারা সমাজ। শেষ পর্যন্ত দেখি বিমলের সঙ্গ ছেড়েছে তার একান্ত অনুগামী, গোদা বাঙলায় তার চেলা, সুলতান। সুলতান আজ পাগলের সাথে কথা বলে তার গামলার বিষয়ে। নতুন গামলা নিয়ে সমাজের সামনে গৌরব প্রকাশরত পাগল যেন ধীরে ধীরে সামাজিক, কমিউনিকেটিভ হয়ে ওঠে। আর এখানেই বরাবরের জন্য হেরে যায় বিমল। তার পৌরুষদৌর্বল্য – ফ্রাস্ট্রেশন তাকে অ্যাসোশ্যাল করে দেয়।
সুবোধ ঘোষের মূল গল্পের শেষে আমরা দেখি জগদ্দলকে ভাঙ্গা হচ্ছে আর বিমল বিমর্ষ হয়ে ঘরে শুয়ে আছে। আর ঋত্বিক শেষ করেন সম্পূর্ণ অন্য ভাবে। দেখি, ঠেলাগাড়িতে ভাঙ্গা লোহার টুকরো গুলিকে নিয়ে চলে যাচ্ছে ঠিকাদারের মজুররা। প্রিয়জনের মৃতদেহ নিয়ে শেষযাত্রায় সময় যেভাবে বেরিয়ে আসে মানুষ শেষ বার এক পলক দেখবে বলে বিমল সেই ভাবে, অসহায় ভাবে বেরিয়ে আসে। জগদ্দল এর হেডলাইটের কাঁচ থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে ঝলকে ওঠে বিমলের চোখে। শেষবারের জন্য ঝলকে উঠে জগদ্দলের হেডলাইট চিরকালের জন্য বিদায় হয়। ইতিমধ্যে ভেসে আসে জগদ্দলের হর্ণের আওয়াজ। বিমল ছুটে গিয়ে দেখে শিশুটি জগদ্দলের বাতিল হয়ে যাওয়া হর্ণের উপর চেপে বসে খেলাচ্ছলে বাজাচ্ছে বাঁশিটি। বিমলের হতাশ শূন্য দৃষ্টিতে এবার ফুটে ওঠে প্রসন্নতা। মুখ ভরে ওঠে হাসিতে। স্পষ্ট দেখা যায় বিমলের জুলপির চুলে পাক ধরেছে। বিমলের চেহারা এখন পুনরায় পরিবর্তিত হয় বৃদ্ধ পিতার রূপে। জগদ্দল আবার পুত্রের ভূমিকায় ফিরে আসে। আর বাঁশিটি যেন অকাল প্রয়াত পুত্রের শেষ স্মৃতি। বিমলের পরে এই স্মৃতি রক্ষা করার দায়িত্ব যেন নিয়েছে ঐ শিশুটি – যেন যুগব্যাপী হয়ে চলেছে পিতা-পুত্রের ধারাটি। শিশ্নদৌর্বল্যের কারণে পুরুষের বংশলোপ হওয়ার ভয় থাকে। বিমলকে শেষমুহূর্তে সমস্ত রকমের ভয়, ফ্রাস্ট্রেশন মুক্ত দেখি আমরা। ঋত্বিক এইভাবে গল্পের প্রধান ভাবটির সাহিত্য থেকে সিনেমায় ইন্টারসেমিওটিক ট্রান্সক্রিপশন করে দেন।
ঋত্বিকবাবু সচেতন ভাবেই ফ্যালাগোসেন্ট্রিজম ভিউপয়েন্ট বা দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই চলচ্চিত্রটিকে দেখাতে চেয়েছেন। আমরা জানি, ত্যাগী সন্ন্যাসীর চোখে উপস্থেন্দ্রিয় যন্ত্রমাত্র যে যন্ত্রের নিয়ন্ত্রক ব্যক্তিত্ব। মানব সভ্যতায় বিভিন্ন ধর্মের আঙ্গিক বিশেষত প্যাগান ধর্মগুলি লিঙ্গের মঙ্গলময় দিকের আরাধনা করে। এই সার্বিক কল্যাণকামিতার নিরিখে উপস্থ যন্ত্র হয়ে ওঠে প্রাণময় পিতৃসত্ত্বা। উপস্থ যন্ত্র এইভাবে আর যন্ত্র থাকে না। হয়ে ওঠে অযান্ত্রিক। “অযান্ত্রিক” জগদ্দল বিমলের শিশ্নপ্রতিভূ বা পৌরুষস্বরূপ হয়েও তাই শেষ পর্যন্ত বিমলের উত্তরণ ঘটায় পিতৃসত্ত্বায়। ঋত্বিক এইভাবে শেষ পর্যন্ত জিতিয়ে দেন বিমলকেও। অপটিমিজম বা আশাবাদের মধ্যে দিয়েই শেষ হয় চলচ্চিত্র অযান্ত্রিক।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes