
অন্য চোখেঃ আজ উৎসব
সমীরণ চট্টোপাধ্যায়
সমীরণ চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম কলকাতায়, ১৯৬৫ সালে; হিন্দু স্কুলের উঠোন ঘুরে আই আই টি, কম্পিউটার সায়েন্সে বি.টেক, এম.টেক, পি.এইচ.ডি করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক, স্তাতকোত্তর – সব পরীক্ষাতেই প্রথম চারে স্থানাধিকারী এই ছাত্র দেশে, বিদেশে নানা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে নানা উচ্চ পদে কাজ করেছেন। এই মুহূর্তে টেকনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ উপাচার্যের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। নামী পত্র পত্রিকায় প্রায় দুশো মৌলিক গবেষণা পত্র ছাপা হয়েছে কৃত্রিম মেধার প্রয়োগ, ওয়ারলেস নেটওয়ার্ক ইত্যাদি বিষয়ে। তাঁর কাছে গবেষণা করে পিএইচডি করেছেন কুড়ি জন ছাত্র, ছাত্রী। যাদবপুরে তথ্য প্রযুক্তি বিভাগ তৈরি করেছেন নিজের হাতে, প্রায় একাই। বেশ কিছু পুরস্কার, বৃত্তি পেয়েছেন আরও অনেকের মতোই। ছক ভাঙা, অস্থির জীবনে, নিজের কাজের চেয়েও বেশি আনন্দ সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনে। আর আছে বাংলা ভাষার প্রতি এক অহৈতুকি টান – অক্লান্ত, আন্তরিক। চঞ্চলতা, সমাজ চেতনার নিজস্বতা, এবং সকলের সাথে পথ চলার আনন্দ – এটুকুতেই এই মানুষটির জীবন সম্পৃক্ত।
বাঙালীর বার মাসে তেরো পার্বণ – একথা পুরনো হয়ে গেছে। এখনতো খেলা-মেলা-উৎসব সারা বছর জুড়ে। আর তেত্রিশ কোটি দেবতার তালিকা না জানুন, ছুটির দৌলতে, তেত্রিশ দেবতার কথা আপনি জানেন নিশ্চয়। বরং লিস্টি দীর্ঘতর হয়েছে সেকুলার হবার আকুল অনুপ্রেরণায়। তা’তে পার্বণের সংখ্যা আরও কিছু বেড়েছে বইকি। তবে সেটা কোন বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা এইটাই, যে আমাদের শিরায় শিরায় ধমনীতে, ধমনীতে সর্বক্ষণ উদযাপনের নেশা। এটাও বড়ো কথা নয়। যেকোন অনুষ্ঠানকে উৎসবের রূপ দিতে হবে। শিল্প আনার অনুষ্ঠানে সানাই বাজাতে হবে বিয়ে বাড়ির মতো, রবি ঠাকুরের গান গাইতে হবে রবীন্দ্রজয়ন্তীর মতো, বাচিক শিল্পী আসবে, শুধু বড়ো মাঠ নেই বলে শ্রমিক আর মালিকের টি-২০ টাই যা হবেনা। কেননা একটা সিনেমায় বলেছিল, আঙুরবালা নাম হলে কদলীবালা কেন হবেনা? আলবৎ হবে। ঠিক তেমনি, জাত শিল্পীর চোখে, শিল্প বাণিজ্য, কলা শিল্প, চারুকলা শিল্প সবই একই। কারণ এ সকলই আসলে উৎসব। তাই ক্রিকেট ম্যাচে শচিনের ড্রাইভের পরেই একটু নাচ হয়ে যাবে। ঠিক কি না!
অনেক বাচালতা করেছি। এবার কাজের কথায় আসি। এই আজকেই একটা মস্ত বড়ো কাজ করলাম। আমি কী করলাম সেকথায় পরে আসছি। বলাই বাহুল্য, কাজ মানে উদযাপন। কাজের জায়গা মানে অডিটোরিয়াম। তবে একদিনে কি কোন উৎসব করা যায়? দেখেন না সাত দিনের দুর্গা পুজোর জন্য খুঁটি পুঁততে হয় কত দিন আগে? তারপর থিম ঠিক করতে লাগবে, ঠাকুর লাগবে, ডেকরেটর লাগবে, ভোগ লাগবে, পুরোহিত লাগবে – এ কী একদিনের কাজ? “তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি” – এসব কথাই ভুলে থাকা উচিত। অতএব, একটা সভা করা যদি কাজ হয়, তবে সভাপতি লাগবে, প্রধান অতিথি লাগবে, অনেক মান্যগণ্য লোক লাগবে, যারা নিশ্চয়ই নামী এবং অবশ্যই দামী। দু একজন বিদেশের লোক থাকতেই হবে, তা’ সে নেপালই হোক, আর বাংলাদেশই হোক। এঁদের প্রতি জনের জন্য গড়ে চার জন লস্কর লাগবে যাদের কাজ যাই হোক, অতি উচ্চশিক্ষিত হতেই হবে। এঁরা সবাই অবশ্যই আসতে পারবেননা। এঁদের শরীর এবং ব্যস্ততা আমার আপনার মতো নয়। সুতরাং ঘরের লোকেরাই আসবেন, বাকীদের জন্য প্রযুক্তি আছে। তার আগে ঔপনিবেশিক পদ্ধতিতে পোশাক প’রে প্রবেশ আছে, জাতীয় সঙ্গীতের দুই তরফের বাজনা আছে (আপনি কার সঙ্গে গলা মেলাবেন বোঝার আগেই ৫২ সেকেন্ড কেটে যাবে)। জাতীয়তাবাদী থিমে দীর্ঘ নৃত্য আছে আর অসংখ্য কৌশলী বক্তৃতা আছে। লোকসভার মতো, যার যেমন ক্ষমতা, তার ততক্ষণ সময়। তবে দীর্ঘ বক্তৃতা আর কেউ শুনতে চায়না। অত ধৈর্য কথায়? আর আন্তর্জাতিক মানের সুন্দরী সঞ্চালিকা আছেন। মেলাবেন তিনি মেলাবেন। বেতাল অনুষ্ঠানকে তিনি বারেবারে সমে এনে ফেলবেনই।
এবং অবশ্যই দুর্গার ঘন ঘন সপরিবার প্রবেশ আছে। সবে আমরা বিশ্বজয় করেছি। এখন মান্যগন্যদের চারা গাছ না হলে দুর্গা মূর্তি না দিলেই নয়। ফুল দেওয়া ব্যাপারটা পুরনো হয়ে গেছে তবু থাক। তবে একটা নতুনত্ব আনতে হবে। তাই ডান দিক থেকে, বাম দিক থেকে অতিথিদের ডাকাডাকি। আপনি সারাদিন ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাতে একটা পেন কিলার খেয়ে নেবেন। তা’ হোক, ঘাড়ের একটা ব্যায়াম হল। পলিটিক্সেও দুই দিকে থাকা গেল। সব রঙ চঙে করে দিন, আপনি কাদের সেকথা যেন সম্পূর্ণ গুলিয়ে যায়। আর আছে সেলফি। পছন্দের অতিথির প্রায় গায়ে পড়ে যত খুশি সেলফি তুলুন, বন্ধুদের দিয়ে ছবি তোলান, আর ফেসবুকে যত খুশি আপলোড করে দিন। কেন যেন এসেছিলেন তা’ এতক্ষণে ভুলেই গেছেন। সবে তো বোধন হচ্ছে, যুদ্ধ হয়ে সন্ধি হতে এখনও অনেক বাকী।
সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সভার দিন না হয় বোধন হল। তার আগের এক মাস! দশ হাতে দশ জনে কাজ করছে। মানে প্রস্তুতি আর কী। একই কাজও কখনও কখনও একাধিক জন করছে। মাঝে মাঝেই ফাউল হয়ে যাচ্ছে। আর প্ল্যানিং? ঘন ঘন মিটিং? দু তিন ঘণ্টা আলোচনা? আলো পড়ছে বটে, কিন্তু ভীষণ সময় নিচ্ছে। একদিনও দেখলাম না সভার আসল কুশীলব যিনি, মানে যিনি আসল কাজটি করবেন তিনি এলেন। মাইকওলা এলেন, ক্যাটারার এলেন, তোচন ঘোষ (মানে যিনি বড়ো অতিথিদের আনবেন আর কি) এলেন, স্পন্সর এলেন, আমিও গেলাম, সব দেখলাম। কিছু করিনি বলবেন না। মনে রাখবেন, ‘they also serve who stand and stare।’ তবে? বুদ্ধি কম দিদিমণি একই কাজ তিনবার তিন রাত জেগে করলেন। মায় প্রধান পুরোহিত টেনশনে পড়ে গিয়ে পা মচকে ফেললেন। কিন্তু দম বটে। হাসপাতাল গেলেন আবার ফিরে এলেন। ভাঙা পা নিয়ে কত কী করা যায়, তা’ কি আমরা জানিনা? না ভুলে গেছি? “ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়ে।”
অতঃপর হাই টি। সবাইকে কী একই রকম চা দেওয়া যায়? সবাই কি বড়ো হয়েও টালির চালে থাকতে পারে? সবাই কি আর ইকনমি ক্লাসে চড়তে পারে? আবার ইকনমি ক্লাসে চড়ে বলেই কি সবার সাথে চা খেতে পারে? অতএব, আমি খেলাম হলঘরে। চেয়ারে বসে। লাইন ছোট। আর যারা না থাকলে এই দিনটাই আসত না তাদের লাইন লম্বা। করিডরে এঁকে বেঁকে চলে যাচ্ছে। মন দিয়ে খেয়ে এসে দেখি লাইন একটু এগিয়েছে। খবর নিলাম, প্রথামাফিক। সব ঠিক আছে জেনে মনে হল এত ঠিক থাকার কথা ছিলনা তো!
এতক্ষণে পুজো শুরু হয়েছে। আলো একটু কমেছে। অবতারের ভিড়ে হাঁপিয়ে ওঠা দেবতা একটু মুক্তি পেয়েছেন। ভক্ত আর ঠাকুরের যদি বা দেখা হচ্ছে, তাল কাটছে ফটোগ্রাফারের ফ্ল্যাশে। তা’ হোক, তবু তো সত্যিকারের কাজটা মানে পুজোটা তো এখনই হচ্ছে। এইবার আমিও কিছু কাজ করলাম। দু একটা ফুল, মালা আমিও দিলাম। কথা নেই, শুধু একটু দেখা, কয়েক সেকেন্ডের। তা’তেই কী আনন্দ! তখন গ্রীন রুমে কী গভীর কথা! কে কোন ঠাকুরকে এনেছে, কে কার সাথে ফটো তুলেছে, কোন ঠাকুর কত দরো!
অবশেষে মিছিল করে বিসর্জন হল। বাকী তো শুধু এটুকুই – “আসছে বছর আবার হবে।” কিশোর কুমারের গানটা গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরলাম – “এ, কি যে হল, কেন হল, শুরু হল, শেষ হল, কেন হল, জানিনা তা”