অজিত সিং বনাম অজিত সিং <br />  শেষ পর্ব <br /> তৃষ্ণা বসাক

অজিত সিং বনাম অজিত সিং
শেষ পর্ব
তৃষ্ণা বসাক

৫৭

কালিকাপুর থেকে গাড়ি ব্যাক করতে গিয়ে গিয়ে একদম
বমকে গেল পটা। শুধু গরু আর গরু। এত গরু এল
কোত্থেকে? আবার এত রাতে! চারদিকে গমগমে শহর,
তার মধ্যে এত গরু কোথা থেকে এল?
পেছনে লোকটা এতক্ষণ চুপচাপ ছিল।গরু দেখে বলে
উঠল,
‘গরু আমার একদম ভালো লাগে না জানো ভাই। গরুরা
মোটেই গরু নয় বুঝলে কিনা। আমি কী বলতে চাইছি,
বুঝেছ তো?মানে গরুরা মোটেই গোবেচারা নয়, হেব্বি
ছুপা রুস্তম টাইপ। দেখলেই কেমন মনে হয় ওদের
ভোলাপনের পেছনে অনেক প্যাঁচ লুকিয়ে আছে। ড্যাবড্যাবে
চোখের পেছনে গিজগিজ করছে শয়তানি বুদ্ধি। কত
ডাকল আমায় গরুগুলো, এত, এত টাকা, আমায় টাকা
দেখাচ্ছে। আরে বোকাচোদা আমাকে চেনেনি’

পটার হেভি ভালো লেগেছিল কথাটা।যদিও গরুরা ওকে
ডাকছে কথাটার মানে ও ধরতে পারল না। গরুরা তো
ডাকলে বাছুরকেই ডাকবে।গরু পটার একদম ভালো লাগে
না। গরু নিয়ে কম সমস্যায় পড়েনি সে। শ্বশুরবাড়ি
যাবার কথা উঠলেই তার ভয়ে পেট খারাপ হয়ে যায়।
যদি গরু খাইয়ে দ্যায়। একটা অবোলা প্রাণি, বেচারি
নিজেও জানে না, তাকে নিয়ে এত বড় দেশটা ভাগ হয়ে
গেছে। কত দাঙ্গা হাঙ্গামা। আর কে যেন বলেছে গরুর
দুধে নাকি সোনা আছে, কথাটা সত্যি। গরু পাচার করে

তো লালে লাল হয়ে গেল সব। সেই যে ফিংফিঙে
হিরোইন, টুমটুমি, কটা সিনেমায় মুখ দেখিয়েছে ঠিক নেই,
সে নাকি সপ্তায় সপ্তায় লন্ডনে শপিং করতে যায়। পটাদের
তো হরিশার হাটই ভরসা। আর মিথ্যে বলবে না, মনি,
মনিয়ারা, যেমন তার রান্নার হাত, তেমনি হাতের কাজ।
মার ব্লাউজ, সায়া, মেয়ের নানা ডিজাইনের ফ্রক সব সে
নিজের হাতে বানায়। পটাকেও একটা হলুদ পাঞ্জাবি
দিয়েছে গেল পুজোয়, তাতে কত লতাপাতা নকশা। পটা
ঠিক করেছে সামনের পুজোয় মনিকে একটা সেলাই মেশিন
কিনে তাক লাগিয়ে দেবে। মনি বলছিল গ্রামের অনেকেই
ওর কাছে বানাতে দ্যায়, টাকাও দ্যায়, কিন্তু খালি হাতে
সে এত অর্ডার নিতে পারছে না। সে যাক গে, সেসব
পটার ঘরের কথা, কিন্তু টুমটুমির লন্ডনে জামাকাপড়
কেনার আসল রহস্যই তো গরু। আজকাল সব টাকাই
নাকি গরু আর কয়লার। আর বিছানার। পটা মাঝে
মাঝে ভাবে গরু খেলে কি সত্যি জাত যাবে ওর? জাত
যাবার হলে এতদিন তো গেছে। গরুখাওয়া মেয়েকে বিয়ে
করেছে, তার সঙ্গে শুয়েছে, সন্তান হয়েছে ওর। দূর ওসব
বাজে কথা, মুনি ঋষিরা আগে নাকি নিত্যি গরু খেত।
তা তারা হিমালয়ের বরফে বসে ধ্যান করত, গরু না
খেলে চলবে কী করে? কিন্তু এই বাংলার গরমে ওসব কি
খাওয়া যায় রোজ? মনি তো বলে তাদের পড়শি ঘরে
চুনো মাছ জোটাই শক্ত, বেশিই হয় কুচো চিংড়ি দিয়ে
শাকপাতা, ডাবের শাঁস পেঁয়াজ রসুন দিয়ে, নয়তো লটে

মাছ শুখনো শুখনো করে রাঁধো না, এক থালা ভাত উঠে
যাবে। গরু নিয়ে এত ঝঞ্ঝাট বলে মাংস জুটলে মুরগিই
হয়। তবে বিশেষ বিশেষ দিনে নিয়ম রক্ষার গরু হয়
বৈকি। তবে পটা জানে কলকাতার আর মফস্বলের হোটেলে
গরুর মাংসের মুখ্য খদ্দের হিন্দুর ছেলেরা। এত সস্তায়
আর মাংস পাবে কোথায়?পটা আশ্চর্য হয়ে ভাবে একটা
চারপাওলা প্রাণি কিভাবে জাতের মাপকাঠি হতে পারে?
আসলে এটা ঠিক, ছোট থেকে শেখা সংস্কার ছাড়া শক্ত,
শুধু যদি পোষ্য বলে মায়ার কথা ধরা যায়, তবে
অনেকে ছাগলও তো পোষে। তবে যাই বলো বাপু, খিদের
ওপর ধর্ম নেই।একদিন গরু খেয়ে পরীক্ষা করে দেখতে
হবে জাত যায় কিনা। মনি বলে, আব্বু, আম্মি কেবল
বলে জামাই আসে না, দেশঘরে বেশিদিন জামাই না এলে
বাজে কথা বলে লোকে, কে যেন বলেছে সেদিন, আদৌ
বিয়ে শাদি হয়নি মনিয়ারার, কলকাতায় ও ব্যবসা খুলে
বসেছে, সে কথা কানে যেতে টানা দুদিন ফুঁপিয়ে
কেঁদেছিল মনি। এই জাত ধর্ম ব্যাপারটার ওপর ঘেন্নাই
ধরে গেছে তার।মনির বাপেরবাড়ির সবাইকে যদি সে
একবার ডেকে দেখাতে পারত তাদের ঘরকন্না! কত সুখে
আছে মনি, ভরা সংসার তার। হয়তো খুব স্বচ্ছলতা নেই,
কিন্তু স্নেহের বাঁধন খুব পোক্ত। কিন্তু সে দেখাবার উপায়
আছে নাকি? তবে তো সব জানাজানি হয়ে যাবে।
বাইরের কথা কি ভাববে, তার নিজের মা-ই তো বিষ
খাবে। মা চলে গেলে, যদি কলকাতায় একটা ডেরা

করতে পারে, তবে মনিয়ারার পড়শিদের সে দেখিয়ে দেবে
কেমন সুন্দর সংসার করছে মনি।

কালিকাপুরের ফ্ল্যাট থেকে নতুন পার্টিকে তুলতে তুলতে
এইসব ভাবছিল কেন যে পটা কে জানে। সাদা পাঞ্জাবি
পাজামা পরা মানুষটা যখন উঠছিল তার গাড়িতে সে
একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। যেন একটা কালো চিতা ঢুকে
এল গাড়িতে। এই সেই লোক, যার কথা এত শুনেছে
ছোড়দার মুখে। শুধু ছোড়দা কেন, একবার তো খবরেই
দেখেছে টিভিতে, ক্যাম্পাসে সবাইকে ছেড়ে এর সামনে
ডান্ডা ধরে বাইট নিচ্ছে একটা মেয়ে। ছোড়দা বলে এই
লোকটা নাকি কিং মেকার। তবে নিজেই কিং হয়ে যাবে
খুব শিগগির।সিং ইজ কিং। এর পক্ষে পটাকে একটা
ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে দেওয়া কোন ব্যাপার না। না,
ফ্ল্যাটের জন্যে না, এমনিই মানুষটাকে খুব ভালো লেগে
গেল তার। সারাজীবন সে তো ইঁদুরের মতো বাঁচল। এ
যেন একটা শের। আর শের এখন শেরনির খোঁজে
চলেছে। নিজের চোখের সামনে যেন একটা ব্লক বাস্টার
সিনেমা দেখতে পাচ্ছে পটা।
পুরোটাই টানটান সিনেমা। কে আগুনে পুড়ে গেছে, তার
সঙ্গে এর কি সম্বন্ধ বুঝতেই পারল না পটা। খুব কৌতূহল
হচ্ছে তার জানার। কিন্তু এমনিতেই পার্টি কথা না বললে
আগ বাড়িয়ে কথা বলা মানা তাদের। এক একজন থাকে
একটু বক্তিয়ার টাইপ। তারা বকে বকে কানের মাথা

ঝালাপালা করে দেয়, পরে পার্টি ছোড়দার কাছে কমপ্লেন
করে। বলে ‘বাব্বা একদম সবজান্তা সিধু জেঠা
জেঠামশাই টাইপ ড্রাইভার পাঠিয়েছিলেন এবার। আমাদের
সব কথার মধ্যে ফোড়ন কাটা চাই। তার ওপর কোথাও
নেমে চা খেতে গেলেও নজর রাখবে, আমরা আজেবাজে
কিচ্ছু খাচ্ছি কিনা। পুরো টুরটাই মাটি।’
সেইসব শুনে শুনে পটা আরও চুপ মেরে গেছে। এমনিতেই
সে বেশি কথা বলে না, তারপর ছোড়দার বকুনির ভয়ে
আরও চুপচাপ হয়ে থাকে। মোটের ওপর পার্টিকে সে
ডরিয়েই চলে। আর এই পার্টিকে কিছু যে জিজ্ঞেস করবে
এত সাহস নেই তার। তাছাড়া তার মন বাড়ি ফেরার
জন্য অস্থির ছিল, কিছুই ভাল লাগছিল না।

কলকাতা ছাড়ল যখন, তখনই বেশ রাত। কোথায় যেতে
হবে জানত পটা। ওর বাড়ি সেখান থেকে খুব দূরে নয়,
সেটা সে জানত। সেটা ভেবেই এই রাতে গাড়ি চালানোর
ধকল ওর গায়ে লাগছিল না। ছোড়দা যা বলেছিল, তাতে
প্ল্যানটা ছিল এরকম। মোটামুটি বারোটা সাড়ে বারটার
মধ্যে পার্টির বন্ধুর বাড়ি পৌঁছে যাবে, সেখানে রাতটা
কাটিয়ে, সকালে একটু খোঁজাখুঁজি, পেয়ে গেলে তো হয়েই
গেল। না পেলেও ওকে দুপুরের বেশি আটকে রাখবে না
পার্টি। লোকাল গাড়ি ঠিক করে নেবে কি অন্য ব্যবস্থা
করবে- এসব কিছু বলেনি ছোড়দা তাকে, তার দরকারও
নেই।সে আদার ব্যাপারি, জাহাজের খবর জেনে তার কী

হবে? দোলে কত তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌছবে সেটাই তার
আসল চিন্তা। যত গাড়ি চলছিল, তত ফ্ল্যাটের কথাটা
একটা ধাপ্পা ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছিল না পটার। কাজ
নেই, কর্ম নেই, একরাত গাড়ি করে নিয়ে যাচ্ছে বলে
তাকে অমনি একটা ফ্ল্যাট দিয়ে দেবে? এ কি ছেলের
হাতের মোয়া? কলকাতা শহরে কত কার রেন্টাল
কোম্পানি আছে, কত ড্রাইভার, তার মধ্যে পটা কে, যে
তাকে ফ্ল্যাট দেবেন ইনি?
রাস্তাঘাট ক্রমশ ফাঁকা হয়ে আসছে, বসন্তের হালকা
হাওয়া ধীরে ধীরে সামান্য শীতল হয়ে উঠছে, পটা এই
মার্চেও গলায় একটা মাফলার জড়িয়ে আছে, কালো আর
হলুদ উলের এই কম্বিনেশন মেয়ের বেছে দেওয়া, এই
মাফলার মনিয়ারা বুনে দিয়েছে, মাফলারের একটা প্রান্ত
বুকে পড়েছে, খুব আরাম লাগছে তার, মনে হচ্ছে বৌ
আর মেয়ে তাকে ছুঁয়ে আছে।পেছনে যে বসে আছে, সেই
লোকটার জন্যে খুব মায়া হল তার। এত টাকা, এত
ক্ষমতা, তবু আপনার বলতে কেউ নেই তার।সামনের
আয়না দিয়ে আড়চোখে দেখল লোকটাকে পটা। ফোনে
কাউকে ধরার চেষ্টা করছে, লাইন লাগছে না। চাপা
গলায় একটা গালাগাল দিয়ে ফোনটা সিটে ছুঁড়ে ফেলল
লোকটা। প্রচুর লোককে নিয়ে যাতায়াত করে সে। নানান
কিসিমের লোক। আজকাল গালাগাল শুনে শিক্ষিত,
অশিক্ষিত বোঝা যায় না। এমনকি মেয়েরাও, বাচ্চা বাচ্চা
স্কুল কলেজের মেয়েরাও যা গালাগাল দেয়, শুনলে কান

লাল হয়ে যায় পটার। আজকাল মেয়েরা সিগারেট খায়
খুব। মদ সিগারেট বিড়ি টুকু অবদি না ছোঁয়া পটা
ভাবল কী বাজে একটা নেশা ছেলেদের কাছে শিখছে
মেয়েরা।
সবাই গালাগাল দেয় একদম খুল্লমখুল্লা, বয়স্ক লোক কে
আছে না আছে কেয়ারই করে না। কিন্তু পটা লক্ষ্য করল
এই লোকটা একটা খারাপ গাল দিল ঠিকই, কিন্তু সেটা
একদম চাপা গলায়, তাতে বেশ অবাক হয়ে গেল পটা।
কেউ তো গাড়ির ড্রাইভারকে মানুষই ভাবে না। তার
সামনে যাচ্ছেতাই গালাগাল তো দেয়ই, তাছাড়া জোড়া
থাকলে তাকে কেয়ার না করে শরীরের খেলায় মেতে
ওঠে। দেখতে না চাইলেও সামনের আয়নায় পটা দেখে
ছেলেটা অক্লেশে মেয়েটার জামার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিল,
কিংবা মেয়েটা মুখ নামিয়ে আনল ছেলেটার উরুর ওপর,
আর চুমু খাবার তো শেষ নেই। সেখানে এই লোকটা
একটা সামান্য ড্রাইভার আছে বলে গালাগালও চাপা স্বরে
দিচ্ছে। লোকটাকে বড্ড ভালো লেগে গেল। তার মনে হল
লোকটার বাড়িতে কি কেউ আছে? দু মুঠো রেঁধে
দেওয়ার মতো? আহা, বাঙালি না হলে কি দু মুঠো বলা
যায় না? এইসব লোকরা খুব একা হয় জানে পটা। সে
বলব কি বলব না করেও বলে ফেলল সাহস করে ‘
স্যার বাড়ি থেকে কি খেয়ে বেরিয়েছেন? না কি কোথাও
দাঁড় করাব? খেয়ে নেবেন? এই রাস্তায় একটা খুব ভালো
ধাবা আছে, বেশি আউট লোকের ভিড় হয় না’

অজিত এই প্রথম পটার দিকে পুরো তাকাল। এত বছর
সে বঙ্গালে আছে, কোন ড্রাইভার তাকে জিজ্ঞেস করেনি
সে বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছে কিনা। সে কিছু খেয়েছে কি
না, কী খাবে এ কথা তো একজনই জিজ্ঞেস করত, আর
কোনদিন করবে না। মোহরের সঙ্গে তার আর কোনদিন
দেখা হবে কি না সন্দেহ। মোহরের তার স্বামীর সঙ্গে
সম্পর্ক যাই থাক, স্বামীর ব্যাপারে ভারতীয় বিশেষ করে
বঙ্গালি মেয়েরা বড্ড ন্যাকামি করে। সতী লক্ষ্মী হয়ে
যায়। ভবানী শাস্ত্রী যত হারামি লোকই হোক না কেন,
যদি মোহর ভাবে ওকে অজিত আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে,
তবে সে সন্দেহ আর যাবে না। পুলিশ কেস করবে না
হয়তো, কিন্তু অজিতের সঙ্গে আর আগের জীবনে ফিরবে
না, আর জিজ্ঞেস করবে না মাছের সর্ষে ঝাল খাবে না
পাতলা ঝোল? গলার কাছে কী যেন আটকে ধরল, চোখে
জল এল। কী যে হয়েছে, যখন থেকে জেনেছে দোলনচাঁপা
বারিক তার সেই তিতলি, সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। সে
যে রাফ অ্যান্ড টাফ অজিত সিং, সিং ইজ কিং- তা কি
সে নিজেই ভুলে যাচ্ছে? মোহর তার ফোন ধরছে না,
কিন্তু ওর সঙ্গে তো ইউনিভার্সিটিতে দেখা তো হবেই
তার, কথাও হবে নিশ্চয়। কারণ চাকরি করে খেতে হলে
অজিত সিংকে বিছানায় না রাখুক, হাতে রাখতেই হবে।
সুযোগ পেলে অজিত বলবে শাস্ত্রীজীর মৃত্যুর সঙ্গে তার
কোন যোগ নেই, যদিও ওকে খাল্লাস করতে ইচ্ছে হয়েছে

মাঝে মাঝেই, লোকটাকে একবার দেখেই অসহ্য লেগেছিল,
তাছাড়া মনে হয়েছে, ওকে সরিয়ে দিতে পারলেই মোহর
পুরো তার হবে। কিন্তু ওকে এত ফালতু মনে হয়েছে, যে
খুন করার যোগ্যই মনে হয়নি। তাছাড়া প্রত্যেকের খুন
করার আলাদা আলাদা টেকনিক। বড় বড় শিল্পীদের
যেমন গান গাইবার স্টাইল আলাদা। আগুন তার
টেকনিক নয়। এটা কে করল? নাকি এমনিই লেগে
গেছে? সারাজীবন লোকের ঘরে এমনকি নিজের ঘরে যে
আগুন লাগিয়ে মজা দেখেছে, এটা তার ওপর আগুনের
প্রতিশোধ? নিজের ঘরে আগুন? হ্যাঁ এটা ভাবতেও
পারেনি অজিত। কিন্তু যেদিন কিঞ্জলের ডাকে সাউথ
সিটিতে গেছিল, কিঞ্জল এক দল ছেলেমেয়েকে দেখিয়ে
দিলেও বলতে পারেনি ঠিক কী করেছিল ওরা, তারপর
বলেছিল যাক গে ছেড়ে দাও। কিন্তু অজিত ছাড়েনি।
মোহরের মেয়ে মানে তারও মেয়ে, তার বেটিকে তং করে
কেউ পার পাবে না, এটা জানা উচিত সবার। তার
লোক পরে গিয়ে দু চার ঘা দিয়েছিল পালের গোদা
ছেলেটাকে। থ্রেট দিয়েছিল। সে কাঁদতে কাঁদতে যা
বলেছিল তা ভয়ঙ্কর। কিঞ্জলকে স্ট্রিপ অফ করা হয়েছিল
আর তা করেছিল ভবানী শাস্ত্রীর নির্দেশে। নিজের কানকে
বিশ্বাস করতে পারেনি অজিত। নিজে তো সারাদিন
নোংরা ঘাঁটে, কিন্তু এত নোংরা সে আশাও করতে
পারেনি। বাবা হয়ে মেয়েকে… এই যে সে কোথায়
চলেছে, ওর চিন্তা রয়ে গেল কিঞ্জলের জন্যে।অজিত মন

থেকে যার হাত ধরে, তার হাত কোনদিন ছাড়ে না।
কিঞ্জলকে সে মেয়ের মতো ভালবাসত। মোহর তার
জীবনের কতখানি যে ছিল, সে জানে না। দাদাজী ছোট
থেকে যে বঙ্গালি অউরতদের কথা বলত, মোহর সম্ভবত
ছিল তার শেষ উদাহরণ। তা শুধু তার কালো দীর্ঘ চুল,
তার প্রতিমার মতো মুখ বা তার খাঁটি বাঙালি উচ্চারণের
বাংলা বলা- এসবের জন্যে নয়, মনের দিক থেকেও সে
পুরো বাঙালি মেয়ে, যে শুধু অজিত নয়, অফিসের
প্রতিটি স্টাফ খেয়েছে কিনা রোজ জিজ্ঞেস করত।
শনিবার শনিবার তাদের খেলাঘরের সংসারে সে তার
জন্যেই রাঁধত, কী ভালবাসে অজিত, কখন কী খাবে সব
তার নখদর্পণে ছিল। শুধু তাই নয়, এক শনিবার রাতে
অজিত ধূম জ্বর নিয়ে ফিরেছিল, সেদিন সারারাত
জেগেছিল মোহর, ওষুধ খাওয়ানো, জলপটি দেওয়া,
বারবার টেম্পারেচার মাপা-ভোরবেলা জ্বর নেমে গেছে
দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে সে একটু ঘুমিয়েছিল। অজিত অনেক
পরে ঘুম ভেঙে দেখেছিল ঘিয়ের গন্ধ ওঠা গরম গরম
আলু মরিচ নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মোহর। সেই
দৃশ্যটি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখের দৃশ্য। ওই দেখেই সব
অসুখ সেরে গিয়েছিল অজিতের। এই মোহরকেই অফিসের
বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কত শক্ত হয়ে লড়তে দেখেছে
সে। দাদাজী তো বলতই বঙ্গালি মেয়েদের মন খুব বড়
আর নরম, কিন্তু দরকার পড়লে ওরা লোহার মতো শক্ত
হয়ে যায়, দেবী দুর্গার মতো অসুর বধ করে।অন্যায় ওরা

সহ্য করে না। এটা কি পুরো ঠিক বলত দাদাজী?
অন্যায়ের বিরুদ্ধে যদি দাঁড়াতই মোহর, তাহলে তো ওর
এই চাকরিটাই হত না। পার্টির ব্যাকিং পেছনে না থাকলে
কিছু হয় না। তার জন্যে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি লাগে, নিজে
না করলেও অন্যের দুর্নীতিকে সমর্থন করতে হয়।
হায় রে, এ কেমন জীবন তার! এক দিকে মোহর, যার
মাথায় ক্ষমতার ছাতা, আর একদিকে দোলনচাঁপা, তার
তিতলি, যার মাথায় কোন ছাতা নেই, কোথায় কোন
নির্জন অন্ধকার পথে একা একা হয়তো বৃষ্টিতে ভিজছে
সে। মোহরকে কি সে বঙ্গালি অউরতের মুখ ভেবে ভুল
করেছিল? মোহরের কাছ থেকে দোলনচাঁপার দিকে তার
এই যাত্রা- এ এক আশ্চর্য অভিযান মনে হল তার। এই
পথে দুঃখ ছাড়া কিছু পাবে না হঠাৎ মনে হল তার।
এতদিন যে পথে হেঁটেছে, তার থেকে এ পথ একদম
আলাদা।
অজিত বলল ‘বহুত ভুখ লেগেছে সাচমুচ।তুমে ক্যায়সে
পাতা? তোমার যেমন ইচ্ছে তেমন দাঁড় করাও। সাহুজী
বলেছিল বটে কলকাতা শহরে ড্রাইভার অনেক পাবেন,
কিন্তু আমি যা দেব, তেমন আর জিন্দেগিতে পাবেন না।
কী নাম তোমার যেন?’
‘পটা’ আহ্লাদে গলে যেতে যেতে বলে পটা।

অজিত চেয়ে দেখল, পটা যেমন বলেছিল, জায়গাটা
সত্যিই তাই।ঠিক বড় রাস্তার ওপরে নয় বলেই হয়তো

এত ভিড় কম। বড় নয়, ছোট্ট কোজি একটা জায়গা,
ঠিক যেন ধাবা নয়, কলকাতার নতুন কাফেগুলোর মতো,
যেখানে নতুন নতুন আংরেজি ধরনের ছেলেমেয়েরা খেতে
আসে।টেবিল সার্ভিস নেই, তাই ধাক্কাধাক্কিও নেই।
কাউন্টারে গিয়ে কুপন কেটে অপেক্ষা করতে হয়, তারপর
খাবার রেডি হয়ে গেলে নিজেরাই নিয়ে আসতে হয়।
কাউন্টারটি বেশ সুন্দর, পেছনে দেওয়ালে একটা বড়
পোস্টার, হলুদ সরষেক্ষেত দিয়ে দূরে কোথায় চলে যাচ্ছে
একটা মেয়ে, তার ওড়না হাওয়ায় উড়ছে। মিউজিক
সিস্টেমে বল্লে বল্লে জাতীয় কোন পাঞ্জাবি পপ বা হিন্দির
আইটেম সং বাজছে না, বাজছে সেই কবেকার সিলসিলা
সিনেমার গান ‘এ কাঁহা আ গয়ে হম’। রাত খুব বেশি
হয়নি, সাড়ে বারোটা হবে। এই সময় রোড সাইড
ধাবাগুলোতে রীতিমতো ভিড় থাকে। এখানে আদৌ ভিড়
নেই। দুটি টেবিলে লোক খাচ্ছে, একটায় চারটে ইয়াং
ছেলে, আর একটায় একা একটা মেয়ে।
অজিত সপ্রশংস চোখে পটার দিকে তাকাল। ‘আরে ইয়ার,
তুম তো কোহিনূর হো। এ তো দারুণ জায়গা। রিয়েলি
এ কাঁহা আ গয়ে হম’
পটার আহ্লাদে গদগদ হয়ে গেল। নিজের জন্য ভাত আর
ডাল আর অজিতের জন্য তন্দুরি রুটি আর চিকেন
কষার অর্ডার দিয়ে ও ভাবল একবার বাড়িতে ফোন
করে। মেয়ে আর মা ঘুমিয়ে পড়লেও মনিয়ারা অনেক
রাত জেগে সেলাই করে।

ঠিক তাই। ফোন করতেই মনিয়ারা ধরে বলল ‘হ্যালো,
এত রাতে ফোন করছ? শরীর ভালো তো? খেয়েছ?
কাল সকালেই আসছ তো? শোন না মেয়ে পরশু’
এক ধমকে মনিয়ারাকে থামিয়ে দিল পটা। মেয়েছেলেরা
ফোন পেলেই এত আনসান বকে। ‘আরে রাখো তো, পরে
করছি’
মনিয়ারা রেগে বলল ‘নিজেই করেছ, নিজেই রাখো।
সারাজীবন আমি একাই করেছি, আমিই সামলে নেব’
বলতে বলতে তার গলা বুজে এল কান্নায়। পটার তখন
ওসব বোঝার সময় নেই।সে দেখতে পেয়েছে যে টেবিলে
একটা মেয়ে একা বসে আছে, সেই টেবিলের দিকে এগিয়ে
যাচ্ছে অজিত।অমনি তার বিপদের অ্যান্টেনাটা টং করে
উঠেছে। মেয়েছেলের কেস মানেই লাফড়া। কেন যে সে
এসব ঝামেলায় জড়াল? সে দেখল, একটা লম্বা চওড়া
লোকও রুমালে মুখ মুছতে মুছতে ওই টেবিলটার দিকে
এগিয়ে আসছে। সে নিঃশ্বাস চেপে দাঁড়িয়ে রইল।
লোকটাকে আসতে দেখে অজিতও থমকে গেছে। তার মুখে
ফুটে উঠছে হতাশা আর আনন্দ এক সঙ্গে। লোকটা এসে
বলল ‘এই পলা, যাও ওয়াশরুমে ঘুরে এসো, খুব ক্লিন,
এখনো রেডি হয়নি খাবার।’ মেয়েটা অমনি উঠে দাঁড়াল
ব্যাগ নিয়ে। হাঁটার সময় দেখল একটা পা ছোট বড়
আছে। খুঁড়িয়ে হাঁটছে।
অজিত নিজেদের টেবিলে ফিরে হতাশায় মাথা নাড়ল।
অস্ফুটে বলল ‘না এ নয়। কিন্তু কোথায় সে?’

পটা তখন খাবার নিয়ে এল কাউন্টার থেকে। কিন্তু
তার খিদে মরে গেছিল।
অজিত যদিও খেল খুব পরিপাটি করেই। মা দেখলে খুব
খুশি হত। মা বলে যারা সাপটে খেতে জানে, তাদের মন
খুব পরিষ্কার হয়। তোর মতো খুঁটে খুঁটে খাওয়া লোকজন
মোটেই ভাল না। আদ্ধেক কথা মনের মধ্যে পুষে রেখে
দেয়। তাদের নিয়ে বাড়ির লোকের বড় জ্বালা।
মার কথায় মুখ টিপে হেসেছিল মনিয়ারা আর মেয়ে
বলেছিল ‘ও ঠাম্মা, তুমি নিজের ছেলেকে খারাপ বলছ?’
‘তোরা বড় আড়বুঝো। আমি বলছি, যারা চুপচাপ সোনা
মুখ করে যা দেব তাই খায়, এক কণা ভাতও ফেলে না,
তাদের বোঝা যায়, কী ভাবছে, কী করছে। কিন্তু তোর
বাবা দেখ, মনে মনে সব গুমরে মরে। কারণ ওই যে
পাখির মতো ঠুকরে খাওয়া’
অজিতের উল্টো দিকে বসে পটা সেই ঠুকরেই খাচ্ছিল।
একে তো তার খিদে মরে গেছে, তার ওপর সে অজিতকে
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তার মন পড়ার চেষ্টা করছিল। এই
যে একটু আগে অজিত ওই টেবিলের দিকে এগুচ্ছিল, তার
কারণ কি সে ভেবেছে ওই মেয়েটাই সে, যার খোঁজে সে
বেরিয়েছে? মানুষটা বুনো হাঁসের পেছনে দৌড়চ্ছে মনে
হচ্ছিল তার।
কোন বড় মানুষ যখন হারিয়ে যায়, তখন স্পষ্ট বুঝতে
হবে, হয় সে খুন হয়েছে, নয় তাকে তুলে নিয়ে গেছে
কেউ। সে এরকম রাস্তাঘাটে ঘুরবে নাকি? এই তো

কিছুদিন আগে একটা রিটায়ার্ড ইনকাম ট্যাক্স অফিসার
হারিয়ে গেল বাড়ি থেকে বেরিয়ে। চারদিকে বিজ্ঞাপন।
রেডিও, টিভি সবজায়গায়। তারপর তার পচা গলা লাশ
পাওয়া গেল একটা নয়ানজুলি থেকে।
পটা খাবে না, খাবে না করে ভাতটুকু খেয়েই ফেলল,
ভাত ডাল আর আলুভাজা। মা বলে ভাত লক্ষ্মীর দানা,
নষ্ট করতে নেই। ওহ, এই মা, বৌ এদের কথাগুলো এমন
মাথায় চেপে থাকে, যে সারাজীবন আর নিজের ইচ্ছে
মতোই বাঁচতেই পারল না। এই ভরপেট ভাত খেয়ে এখন
সে গাড়ি চালাবে কী করে? ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসবে
হাওয়া খেলেই।

গাড়িতে উঠে সিংজীকে ব্যাগ থেকে একটা বোতল বার
কর গলায় ঢালতে দেখল পটা। দুখী হলেই কেন যে মাল
খেতে হয় এটা মাথায় ঢোকে না পটার। সে চুপচাপ গাড়ি
স্টার্ট দিল।
অজিত পেছন থেকে জড়ানো গলায় বলল ‘তোমার
ফেমিলি আছে পটা? কে কে আছে? বৌ আছে তোমার?
তোমাকে ভালবাসে?’
একটু আগেও কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না পটার, এখন
ওর বুকের সব জমা কথা হড়কা বানের মতো বেরিয়ে
এল। তার মুসলমান মেয়েকে বিয়ে, সেই নিয়ে তার
আতান্তর, শ্বশুরবাড়ি যেতে না পারা, তার জেল খাটা,
মনিয়ারার মতো একটা এত বড় মনের মেয়ে, এত

কাজের, মেয়ের আঁকার হাত, দোলে তাদের আয়োজন –
কিচ্ছু বলতে বাকি থাকল না।
শুনে একদম গুম মেরে গেল অজিত। তারপর একটা
খিস্তি মেরে বলল ‘বোকাচোদা, এত আস্তে গাড়ি চালাচ্ছিস
কেন? আমার তিতলিকে ধরব কী করে তাহলে? ওই
মুখ, তুই ভাবতে পারবি না। শালা আমি একা না, তোরা
তোরা গোটা বাঙ্গালির জাতই হারিয়ে ফেলেছিস ওই মুখটা’
পটা একদম চুপসে গেল। ড্রাইভারির লাইনে তো পার্টির
গালাগাল জলভাত। তবু এই লোকটার কথায় তার চোখে
জল এসে গেল।
সে স্পিড বাড়াল একটু। রাস্তা ফাঁকা ঠিকই, কিন্তু এই
সময়েই তো বড় বড় ট্র্যাকগুলো চলে, তাই রাতটা
এড়িয়েই যেতে চায় পটা। কিন্তু আজ একেবারে ফেঁসে
গেছে। তারপর ফেমিলির কথায় লোকটার মনে হয় নরম
জায়গায় লেগেছে, ক্ষেপে বোম। এখন পাগল সামলাবে কী
করে?
‘জানিস আমার মা একবার তলাবে কুঁদতে গেছিল, আমার
বৌ দড়িতে ঝোলার আগে বলেছিল এখানে তলাব নেই
তলাব? আমি শুধু একটা চড়, বিশ্বাস কর। আমার
দাদাজী তো বলে যায়নি ওদেরও তিসরা আঁখ ছিল, ওরা
সারাজীবন আমার বুকের মধ্যে কথা বলে যাবে। এই
পটা, চল তোর বাড়ি চল, চল না’
আচ্ছা জ্বালা তো, এত রাতে মোদোমাতাল নিয়ে বাড়ি
ঢুকবে? এখান থেকে তার বাড়ি ঘণ্টা দুই আরো, পাশে

একটা শর্ট কাট আছে। কী করবে বুঝতে পারছিল না
পটা, এদিকে চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছিল। হঠাৎ
উল্টোদিক থেকে একটা লরি আসতে দেখল সে, ওর মাথা
কাজ করছিল না, ঘুম সাপের বিষের মতো ওর শরীরে
ছড়িয়ে পড়ছিল, ওর একবার মনে হল দরজা খুলে
লাফিয়ে পড়ে পালায়, কিন্তু এই মানুষটা বেঘর,
বেসাহারা, সেও মানুষটাকে ফেলে পালাবে? ও প্রাণপণে
স্টিয়ারিং ধরে গাড়িটা সাইড করার চেষ্টা করল, বাঁদিকে
শুধু রেলিংগুলো চকচক করছে, আর বাকি নিকষ
অন্ধকার। পটা রেলিংগুলোর দিকে গাড়ি নিতে নিতে
ভাবছিল, মনিয়ারা খুব রাগ করেছে নির্ঘাত, ফোনটা
নিজেই করে ওইভাবে রেখে দিল, সব কেনাকাটা করেই
রাখবে সে। কিন্তু অজিত সিং যদি যায়, তবে তো
একসেট নতুন চাদর, বালিশের ওয়াড় লাগবে, তবে লক্ষ্মী
বৌ মনিয়ারা সব জাদুকরীর মতো সামলে নেবে। মেয়েটা
কী যে খুশি হবে নতুন লোক দেখলে! সবাই একসঙ্গে
ঘুরতে যাবে, সেই যে ভাঙ্গা নৌকাটা, ওর সংসার অমন
হতে দেবে না পটা, ওর নৌকা ফুটো না, কোন জল
ঢুকতে দেবে না। কলকাতার স্কুলে পড়বে মেয়ে,
মনিয়ারার বুটিক হবে, সারাদিন পর একটা সুন্দর ফ্ল্যাটে
ফিরবে তারা, আআআআআ… জোর ধাক্কা লাগে আচমকা,
গাড়িটা ডুবে যাচ্ছে অতল জলের তলায়…

রেলিং ভেঙে গাড়িটা নয়ানজুলিতে পড়ছে। পটা বুঝতে
পারছিল না কী হচ্ছে। ওর চারপাশে অনেক রঙ, রঙ্গিন
মঠগুলো রাখা থালায়। মনিয়ারা ওকে মুঠো মুঠো আবির
মাখিয়ে দিল, বিশেষ বিশেষ দিনে ও হাতে মেহেন্দি
লাগায়। মা এই ব্যাপারটাকে ভালো চোখে নেয় না।
গজগজ করে ‘দোলে পুজোয় হিন্দু ঘরে আবার কে কবে
মেহেন্দি লাগায়? বিয়ে হলে এক কথা ছিল’
মার কথায় পটা আপত্তি করেছে দু একবার। ‘মেহেন্দি
লাগানোর কী আছে? মা যখন পছন্দ করে না।’
এই একটা কথা শোনেনি মনিয়ারা, ঘরের দরজা বন্ধ
করে নমাজ পড়ে, কেউ দেখতে পায় না, কিন্তু হাতের
মেহেন্দি, সে তো সবাই দেখে। লোকের মনে ফালতু প্রশ্ন
তুলে কী হবে?
ফলে উৎসবের দিনগুলো মনি একদম দূরেই থাকত ওর
কাছ থেকে। কিন্তু এখন মনিয়ারা ওর মেহেন্দি মাখা দুই
হাত দিয়ে দু গালে আবির মাখিয়ে দিচ্ছে, স্পষ্ট দেখল
পটা। একটু পরেই তো ও বাড়ি ফিরবে, তখন গিয়ে ক্ষমা
চেয়ে নেবে ওর কাছে।কিন্তু চারদিকে এত জল কেন? সে
তো রাস্তায় গাড়ি চালচ্ছিল, জলে নামল কোথা থেকে?
জল যেন গর্ভের তরলের মতো ওকে চারদিক থেকে ঘিরে
ধরছিল, ও তার মধ্যে একটা চোখ না ফোটা ভ্রূণের
মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছিল। আবার কি ও কোথাও জন্মাবে?
কার কোলে? আবার কি কোন বিয়েবাড়িতে দুটো কালো
চোখের মায়ায় আটকে পড়বে সে? ওর সব চিন্তা চেতনা

জলে ভেসে যাবার আগে শেষবারের মতো ও ওই চোখ
দুটি দেখতে পেল।
অজিত জলে ডুবে যাচ্ছিল। হঠাৎ জলের মধ্যে একটা
প্রজাপতি। ও তাকে ধরতে গেল।

শেষের পরের কথা

কুন্তল আজ জেসিকাকে মার কাছে নিয়ে যাবে।
তাজমুল আজ মি বসুকে নিয়ে মার কাছে যাবে। মুড়ি
ভাজা শেখা বাকি।
শতরূপা আজ দীপুর সঙ্গে মার কাছে যাবেন।
গগন ঘুরতে ঘুরতে একদিন মোহর আর কিঞ্জলের কাছে
পৌঁছে যায়।
প্রদীপ্ত ইন্সপেক্টরকে ফোন করে করে ক্লান্ত, সে ভুবনেশ্বরে
ফিরে যাচ্ছে।
বিদিশা অক্ষরের জীবনে পাশ ফেরে শোয়। আপাতত
তাকে কারো দরকার নেই। আবার কেউ নিজেকে হারিয়ে
ফেললে সে আসবে।
মার্কেজ এসে দাঁড়ায় দোলনের কাছে, দোলন বলে ‘চলো’।
-দোলন, দোলন তুমি কোথাও পৌঁছতে চাও না?
-চাই তো।
মার্কেজের হাত ধরে দোলন হাঁটে।
-কোথায় যাবে ঠিক করেছ কিছু?
-ঠিক করে নেব। রাস্তাই ঠিক করে দেবে।

-চলো।
-সেই টেস্ট টিউবটা কোথায়?
-ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি। পেছনের পুকুরটায়। ভেতরের লোক
চারটে এত ছোট হয়ে গেছিল আর দেখাই যাবে না।
-পুকুরে ফেললে! একটু যেন শিউরে ওঠে দোলন।
-কেন?
-না পুকুর বুজিয়ে তো বাড়ি হবে, মালটি স্টোরিড।
বাঙলার একমাত্র শিল্প তো এটাই। তার নিচে এই নরকের
কীটগুলো, কোন ক্ষতি করবে না তো?
মার্কেজ একটু চুপ করে থাকে, পুকুর বোজানোর গল্প তার
থেকে আর বেশি কে জানে? পুকুরের ওপরেই দাঁড়িয়ে
রয়েছে এই বাংলা। তাই বাংলার বধূ, বুকের সব মধু
শুকিয়ে ঘাট না পেয়ে আঘাটায় চলে গেল।
সে বলল, ‘ওরকম নরকের কীট আরও কত কোটি কোটি
রয়ে গেছে, আবার নতুন কত জন্মাচ্ছে, ওদের নিয়ে
ভাবলে চলবে না।
এমনিতেও এখন আমাদের আবার হারিয়ে যেতে হবে।
এখন যে চানাচুর বিক্রি হচ্ছে, তা যতক্ষণ না মিইয়ে
যায়… ’
চানাচুর!
সেই মুহূর্তেই যেন মাটি ফুঁড়ে একটা লোক সামনে এসে
দাঁড়ায়।
‘নিন ম্যাডাম একটা নিন। পঞ্চাশ বছরের ওপর ধরে
বেচছি সার। আমার মতো কাউকে পাবেন না, কতজন

এল গেল চোখের সামনে দিয়ে। সব দুদিনের স্যার। লাইন
ধরে থাকার দম নেই। একটা চানাচুর নিন না স্যার। টক
ঝাল মিস্টি বিশ্ববাংলা চানাচুর। গান্ধী, সুভাষকে খাওয়াতে
পারিনি ঠিকই, তবে নেহেরুজী খেয়েছিলেন একবার, আর
তারপর তো কেউ বাদ নেই’
দোলন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে
লোকটা কিন্তু নির্বিকার মুখে বলে ‘আমি কিন্তু এ লাইনে
নতুন নই ম্যাডাম। সেই কবে থেকে বিক্রি করছি। প্রথমে
ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ
চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা
চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে
বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার
আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল
এজেন্ট আমি। এই চানাচুর বেচেই সংসার চলছে, সবাই চেনে
আমাকে। বুঝলেন না ম্যাডাম থিংক গ্লোবাল, অ্যাক্ট
লোকাল। চোখ বন্ধ করে নিতে পারেন’
মার্কেজ বলে ‘চপ, চানাচুর, গরুর চোনা, যে ঢপই বেচো,
আমরা তোমার গ্রাহক নই হে, ফোটো।’ সে বেশ
নিষ্ঠুরভাবেই লোকটাকে ধাক্কা মেরে ফেলে। আর অমনি
তার ঝোলা থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসে লক্ষ কোটি
চানাচুরের প্যাকেট, যার মধ্যে ধীরে ধীরে ডুবে যায় এই
দেশ।
মার্কেজ ওর হাত ধরে টানে
‘পালাই চলো’।

ওরা হেঁটে চলে। গ্রাম থেকে শহরে। আত্মগোপন থেকে
প্রকাশ্যে। মরে যায় আবার বেঁচে ওঠে। পড়ে যায় আবার
উঠে দাঁড়ায়। ওদের যাত্রা শেষ হবার নয়।ওরা হাঁটতেই
থাকে।

জলের গভীরে শুয়ে পটা ভাবছিল, এবার হয়তো তার
মেয়ে বৌ নিজেদের মতো বাঁচতে পারবে। ছোড়দা দেখুক
না দেখুক, একটা মোটা বীমা করা আছে তার, সে
বীমাটির নাম মনিয়ারা, সে তার দরদ দিয়ে, হাতের
কাজ দিয়ে সংসারটি টেনে নিয়ে যাবে ঠিক।
আর অজিত ভাবছিল কি শান্তি এই শুয়ে থাকার মধ্যে।
লতাগুল্মের মধ্যে দিয়ে একটা প্রজাপতি তার কাছে
আসছিল। আসছিল, আসছিল। ওর চোখ ঘুমে জড়িয়ে
আসছে, শরীরের ওপর যেন কত ওজন, জল এত ভারি
হয়! ওকে তো কেউ বলছে না ‘নেহি পাপ্পু নেহি’, কেউ
ছুটে আসছে না বাঁচাতে, যাদের কারো বাড়ির সমস্যা,
কারো চাকরি, কারো কোন শত্রুকে সে হঠিয়েছে। শুধু
দুজনের জন্যে কিছু করতে পারেনি। একজন এই পটা,
ওকে একটা ফ্ল্যাট করে দেব, বলেছিল সাহুকে। পটা এখন
তার পাশে শুয়ে আছে। সাহুকে তো ফোন করে বলে
দেওয়া যায়। কোন পকেটে ফোনটা যে রাখা। আর, আর
পিকেবি, যার চাকরির হয়ে উমেদারি করতে এসেছিল,

বলেছিল আমার এক রিলেটিভ সিংজী, কেন কেন
বোকাচোদা মুখ ফুটে বলতে পারেনি, সে ওই ড বক্সীর
মেয়ে দোলনচাঁপা বক্সী, পাপ্পুর ছোটবেলার তিতলি। বঙ্গালি
মেয়ে বলতেই যার নরম কিন্তু দৃঢ় মুখের রেখা মনে
পড়ত তার। এরপর তো কত বঙ্গালি মেয়েই এসেছে তার
জীবনে। কিন্তু তিতলিকেই খুঁজেছে সে। এই সেই মুখ যা
কোন কালো হাত লেগে ময়লা হয়ে যায়নি। বিগত চার
পাঁচ দশক ধরে, তাই বা কেন, যুগ যুগ ধরে একরকম
থেকে গেছে।যা কিছু পবিত্র, যা কিছু শাশ্বত। অজিত
জলের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে ভাবল, সে চলে যাবে,
যাদের হয়ে সে কাজ করেছে, তারাও কেউ থাকবে না,
যারা আসছে তারাও কেউ থাকবে না, কিন্তু ওই মুখ
থেকে যাবে। দোলন, দোলন তুম কভি হার না মাননা।
অজিত দেখতে পেল অন্ধকার রাস্তা গলিপথ দিয়ে একটা
মেয়ে ধীরে ধীরে কিন্তু না থেমে এগিয়ে যাচ্ছে। সে
জানতেও পারবে না, একজন তাকে…
লাল, সবুজ, কমলা রঙের মাছ অজিতের শরীরকে ঘিরে
ফেলছিল। অজিত শুধু দেখতে চাইছিল, সেই অলীক
বর্ণচ্ছটার প্রজাপতিটাকেই।

অজিত সিং জলের তলায় শুয়ে আছে, অজিত সিং জলের
ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে।দাদাজী বাঙ্গালির যে গরিমার
দিকে পাপ্পুকে আঙুল দিয়ে দেখাত, তা আজ কোথায়?

বাঙ্গালি মানেই দিমাগের কাম । ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার,
প্রফেসর অফসর, রাইটার…
হা হা। মার্কেজ হাসছে । ‘বুঝলে দোলন এখন আর
বিহার থেকে বেশি সুপারি আনতে হয় না। সব
এখানকার। গ্রো লোকাল। থিংক গ্লোবাল। শালা আমিও
অজিত সিং এখন, যোগানন্দ মার্কেজ , আমি অজিত সিং
–ভুলো না কথাটা। আমরাও অজিত সিং, হাহাহা।’
কিছু কি পড়ে রইল বসন্ত বাতাসে? আবিরের গন্ধ দম
বন্ধ করে রাখল আরও কিছু জীবনকে? হে পথিক, একটু
দাঁড়িও, অশ্রু ফেলো এইসব জীবনের জন্যে।
হে পথিক, বাংলার পথ দিয়ে যাবার সময় অজিত সিং-র জন্য দু ফোঁটা চোখের জল ফেলতে ভুলো না।

(সমাপ্ত)

তৃষ্ণা বসাক-এর এই উপন্যাসের প্রতিটি ধারাবাহিক একসঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন অজিত সিং বনাম অজিত সিং, ধারাবাহিক উপন্যাস

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (7)
  • comment-avatar
    anindita mandal 3 years

    শেষ হয়েও রেশ রয়ে গেল। অজিত সিংএর জন্য প্রথম থেকেই একটা মায়া হচ্ছিল। পরিস্থিতি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে না। উপন্যাসের সবচেয়ে সুন্দর দিক হল, চরিত্রগুলো সাদা বা কালো নয়। সব রকম ছায়া আলোয় তৈরি। মানুষ ঠিক যেমন হয়। শুধু ভবানী শাস্ত্রী নিকষ কালো। ঠিক যেমন দোলন আকাশের মতো সাদা। মুক্তির আকাশ এমন সাদা না হলে বাকিরা মুক্তি পাবে কোথায়? অজিত মুক্তি পেল। দোলনকে ভাবতে ভাবতে ডুবছে, এই কি মুক্তি নয়? খুব আনন্দ হয়েছে উপন্যাসটি পড়ে। লেখকের দীর্ঘ সাহিত্য জীবন কামনা করি।

  • comment-avatar
    সৌমেন বসাক 3 years

    অসাধারণ সমাপ্তি।

  • comment-avatar
    অতনু ভট্টাচার্য 3 years

    একটা অদ্ভুত পরিণতি।সমাজের এই চেহারাকে এঁকে ফেললেন লেখক শক্তভাবে।ভনিতাহীন।অনেক শুভেচ্ছা।

  • comment-avatar
    ঈশিতা ভাদুড়ী 3 years

    খুব সুন্দরভাবে শেষ হলো। বইটি সংগ্রহযোগ্য হবে।

  • comment-avatar

    যতগুলো পর্ব পেয়েছি সব পড়েছি – শেষটাও। তবে আবহমানের কাছে একটাই অনুরোধ যেন পর্বগুলো পর পর পড়বার সুযোগ দেন। ছডিয়ে ছিটিয়ে আছে। ক্রমানুসারে নেই। 

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes