
অজিত সিং বনাম অজিত সিং
পর্ব ৫৬
তৃষ্ণা বসাক
৫৬
পটা ভেবে রেখেছিল এই সপ্তায় বাড়ি যাবে। টানা তিন
মাস যেতে পারেনি, একটা ডিউটি থেকে আরেকটা
ডিউটি। এরকম হয়েছে সারা রাত জেগে ফিরেছে, এসেই
বেরিয়ে পড়তে হয়েছে পার্টি নিয়ে। শরীর খারাপ লেগেছে,
ঘুমে স্টিয়ারিং-র ওপর ঢুলে আসতে চেয়েছে মাথা। তবু
ছোড়দা শোনেনি। বলেছে এক্সট্রা পয়সা পাবি, বেশি
টেন্ডাইমেন্ডাই করিস না। আরে এক্সট্রা পয়সা পেলে তো
আর এক্সট্রা শরীর বানিয়ে পাঠাবে না ভগবান। একটাই
দিয়েছে, ছোটখাটো রিপেয়ার হবে, কিন্তু রিপ্লেসমেন্ট
কোনদিন না। ছোড়দা এক্সট্রা পয়সা দেয়, অনেক পার্টিও
ভালই টিপস দেয়, তবু এই ধকলে পটার শরীর একদম
শেষ হয়ে যায়। এমনিতেই সে পেটরোগা। তার খাবার
খরচা পার্টি দিলেও সকালের টিফিন তার নিজের।। কারণ
সকালে ওই লুচি কি ছোলে বাটুরে খেলে তাকে আর
দেখতে হবে না।লুচি জোর করে মনিয়ারা খাওয়ায় তাকে
বছরে দু একবার।দোলে আর মেয়ের জন্মদিনে। কিন্তু
মনিয়ারার রান্নার হাত এত পাকা যে একটুও বাড়তি
তেল বুঝতে পারে না সে লুচি খেলে।সারাবছর তার
সকালের টিফিন চিঁড়ে মুড়ি দই কলা। কখনো সুযোগ
থাকলে সে গরম ভাত খেয়ে নেয় একমুঠো। সে
বেরোলেই মুড়ি চিঁড়ে নিয়ে বেরোয়, সবজায়গায় দই না
পেলে এমনিই খেয়ে নেয় চিনি দিয়ে। তবে লাল চা টা
তার চাইই চাই। বাংলার বাইরে লাল চা মানেই বোঝে
না। ছোড়দা তার অসুবিধের কথা শুনে একটা পুরনো
ইলেকট্রিক কেটলি দিয়েছে, এক গোছা চায়ের পাউচ। খুব
সুবিধে হয়েছে তাতে।ছোড়দা এত ঝামেলায় ফেলে মাঝে
মাঝেই, কিন্তু ওর মনটা খুব বড়। বড়দার মতো কিপ্পুস
নয়। সবাই রুমকির কাছে যাবার জন্যে ছোড়দাকে বঁটিতে
কাটে পারলে। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে, সারাক্ষণ খিচখিচ
কান্নাকাটি আফসাল ঝাপসাল করে বৌ, বউদি, মা,
এমনকি ছেলেমেয়েদেরও শেখানো আছে, তারা কেউ বাবার
সঙ্গে কথা বলে না, ডাকলেও সাড়া দেয় না। তাই
বাড়িতে থাকা মানে প্রতিটা মুহূর্তই কাঁটার ওপর থাকা
ছোড়দার কাছে। কিন্তু পটা তো অনেক দিন ধরে দেখছে
ছোড়দাকে। রুমকির কাছে যাবার আগে থেকে। সেই
ছোড়দা আর বড়দার মধ্যে কোন তফাত ছিল না প্রায়।
বড়দার মতোই সন্দেহ বাতিক, কিপটে আর ছোটমন ছিল
ছোড়দা। রুমকির কাছে যাওয়ার পর থেকে তার আমূল
বদল ঘটেছে।তার জগত কত বড় হয়ে গেছে। ছোট ছোট
বিষয়ে সে মাথাই ঘামায় না আর।পটার কোন কিছু
লাগবে জানলে ঠিক সেটা দেবে তাকে, তার জন্যে মাইনে
থেকে কোনদিন পয়সা কাটার কথা বলবে না। পটা
ভাবে, এ কি রুমকির কামাল? নাকি রুমকি কোন
ফ্যাক্টরই নয়, আসল কথা হল প্রেম, প্রেম মানুষকে নতুন
জন্ম দেয়। যদিও সিনেমার স্টাইলে পাহাড় থেকে ঝাঁপ
দিয়ে বা বৃষ্টির জলে ভিজতে ভিজতে সে প্রেম করেনি
মনিয়ারার সঙ্গে, কিন্তু তার চোখের মায়ায় সে এমন
হারিয়ে গেছিল, যে বৈষ্ণব পরিবারের ছেলে হয়েও একটা
মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করতে ভয়ই পেল না সে। প্রেমই
এইসব করিয়ে নেয়। যে লোকটা তার গাড়ি ভাড়া করবে
আজ, তার মতো রুক্ষ মানুষও ছুটছে প্রেমের টানে।
ছোড়দা অনেক টানে তাকে। পার্টিও দরাজ হাতে বকশিশ
দেয়, অবশ্য এরকম হয় মূলত সিজনে। পুজোর আগে
থেকে ফেব্রুয়ারি মার্চ অব্দি চলে। কিন্তু পটার আর ভালো
লাগছে না। মেয়ে সরস্বতী পুজো করল, মনিয়ারার খুব
বুদ্ধি, এসবে মেয়েকে বাধা দেয় না, কিন্তু নিজে খুব
কায়দা করে সরে থাকে, মেয়ে ঠাকুমাকে নিয়ে করে সব,
এসময় পটা থাকলে সুবিধে হয়, কিন্তু সে যেতে পারল
না, রোজ বুকিং, রোজ বুকিং, ছোড়দা ছাড়বে না
তাকে, বেশি বলতে গেলে টাকা বাড়িয়ে দিল, বলল ওর
জন্যে কলকাতায় ফ্ল্যাট বুক করে দেবে, এমন এক পার্টি
আছে, যার আঙুলে সবাই বাঁধা। ফ্ল্যাটের কথায় চুপ
করে গেল পটা। মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল। কতদিন,
কতদিন বলেছে মেয়ে ‘ও বাবা আমরা কলকাতায় থাকতে
পারি না সবাই মিলে? আমি তাহলে বড় ইস্কুলে পড়তে
পারি, মাও একটা বুটিক খুলতে পারে, কত লাভ হবে
ভাবো’
‘বুটিক আবার কী?’ পটা বুদ্ধুর মতো বলে
‘আরে বুটিক গো। চুড়িদার, শাড়ির ওপর সুতোর কাজ
করে কত হাজার হাজার টাকায় বিক্রি হয়। সিনেমার
লোকরা কিনবে। গ্রামে কোন সুযোগ নেই। মার এত
ভালো সেলাই। কে দাম দেবে?’
সেই কলকাতায় ফ্ল্যাট হবে তার? সত্যি? তবু সে রাগ
রাগ গলায় বলেছিল ‘সরস্বতী পুজো হল না, কিন্তু দোলে
আমি বাড়ি যাবই। তখন যদি আটকাও, আমি কিন্তু সব
ছেড়ে চলে যাব।’
ছোড়দা সস্নেহে বলেছিল ‘আরে পাগলা, দোলে তোকে কে
আটকাবে, ওই মোল্লাটাকে ডিউটি দিয়ে দেব। ওদের তো
আবার গায়ে রং লাগলে জাত যায়’
কথাটা খুব খারাপ লেগেছিল পটার।ছোড়দা যদি জানত
তার বৌ মুসলমান, এরকম বলতে পারত? তার
বাড়ির সব পুজো আচ্চায় মনিয়ারা একটু আলগা হয়ে
থাকলেও এই দোলে সে একেবারে পাগলের মতো আনন্দ
করে। পটা, ছোটবেলা থেকে বৈষ্ণব পরিবারে মানুষ,
ওদের নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে পুজো পার্বন, তার কিন্তু কখনো
মনে হয়নি, মনিয়ারাকে হিন্দু করে নেওয়া উচিত। বরং
তার বরাবর মনে হয়, যে যা বিশ্বাস করে, তাকে সেটাই
রাখতে দিতে হয়। নইলে তার মন পাওয়া যায় না। সে
যে কৃষ্ণ ভজে আর মনিয়ারা আল্লাহ, এতে কি তাদের
সংসারে কোন অসুবিধে হয়েছে, নাকি আদর সোহাগ কিছু
কম পড়েছে? সেই মনিয়ারা কিন্তু দোলে খুব আনন্দ
করে। ও বলেছে ওর বাপেরবাড়ির পাড়ার মেয়েদের খুব
ইচ্ছে হত হিন্দু মেয়েদের সঙ্গে মিলে রং খেলবে। এই
একটা উৎসবে শামিল হতে পারলে ওদের মনে হত
চারদিকে এই এত নিষেধের বেড়াজাল ওরা পেরিয়ে যাবে।
কিন্তু বাড়ির ভয়ে, মৌলবীর ভয়ে কোনদিন খেলতে
পায়নি। এখন সিঁদুর পরে সে সব বাধা সে পেরিয়ে
গেছে। বালতি বালতি রং গোলে সে। প্যাকেট প্যাকেট
আবির কেনে। গজা, চিকচিকে মিস্টি, মঠ কিনে কিনে
রাখে। বিকেলে সব মেয়েদের নেমন্তন্ন করে ঘুগনি আর
লুচি খাওয়ায়। মার এত আনন্দ আর কিছুতে দেখেনি
মেয়ে। সেও তাই বছর ভর অপেক্ষা করে থাকে দোলের
জন্যে। দোলের আনন্দ পুজোতেও যেন হয় না। তাই বছর
বছর দোলে বাড়ি ফিরবেই পটা। আর মা, মেয়ে আর
মনিয়ারার জন্যে নতুন কিছু পরার নেবেই। সারাদিনের
হুল্লোড়ের পর সবাই স্নান করে সেই নতুন জামা শাড়ি
পরে উঠোনে বসে। ফিনিক ফোটা জোছনায় উঠোন ভেসে
যায়। সবার শ্যাম্পু করা চুল, শ্যাম্পুর গন্ধ, আবিরের
গন্ধ, নতুন জামার গন্ধ, আর ভাঙ্গের শরবতের নেশা,
তারপর সুর আর গান। মা কীর্তন গায় বেশ, পটা খোল
বাজায়, মেয়ে কবিতা বলে, আর সবাইকে অবাক করে
দেয় মনিয়ারা গান গেয়ে। যেমন তার গলা, তেমনই
তার হিন্দি গানের স্টক। পটা অবাক হয়ে ভাবে এত সুখ
তার কপালে ছিল?
দোলে যাবার জন্যে সে জামাকাপড় কিনে ফেলেছিল। আর
মনিয়ারার জন্য রুপোর নূপুর, অনেকদিনের শখ। হঠাৎ
ছোড়দা ফোন করল ‘তুই কি সত্যিই চাস কলকাতায়
তোর ফ্ল্যাট হোক নিজের?’
ছোড়দার কথা কোনদিকে যাচ্ছে বুঝতে বাকি থাকল না
পটার।
সে তেরিয়া গলায় বলল ‘দোলে আমাকে কিছুতেই ডিউটি
করাতে পারবে না এইসব বাড় খাইয়ে। পরশু দোল। কাল
সকালের ট্রেনে আমি বাড়ি যাব’
‘পরশু তুই বাড়িই থাকবি পটা। কিন্তু কাল ভোরে তোকে
একটু ঘাটালের দিকে যেতে হবে, ওখানে এক জায়গায়
পার্টিকে নামিয়ে দিয়ে তুই গাড়ি নিয়েই বাড়ি চলে যাবি।
আই প্রমিস। তিনদিন গাড়ি রেখে দিবি, তারপর মেয়ে
বৌ মাকে গাড়ি চাপিয়ে কলকাতায় আসবি, তোদের
থাকার ফ্ল্যাট রেডি থাকবে, তিনমাস পরে নতুন ফ্ল্যাট
পাবি’
পটা বুঝতেই পারল না ও কী বলবে। তার দুদিকে দুটো
দুনিয়া। একদিকে ঝকঝকে জীবন, অন্যদিকে সেই ঘষে
চলা জীবন। একটা দোলের দিন নাহয় সে দিনের দিন
গেল।
সে দোনামনা করছিল তবু। ছোড়দা শক্ত গলায় বলল
‘তুই কিন্তু তৈরি থাক। এই পার্টিই তোকে সব দেবে।
বোকামি করিস না’
পটা সব সংশয় ঝেড়ে ফেলে বলল ‘যাব’
ছোড়দা তখন নিশ্চিন্ত গলায় বলল ‘বাঁচালি আমাকে।
দোলের দিন জানিসই তো রুমকির ওখানে থাকব।সে
রাজাই মরুক আর চ্যাকড়াই ছিঁড়ুক। এত ইম্পরটেন্ট
একটা পার্টি অন্য কারো হাতে দিয়ে আমি শান্তি পেতাম
না। তার ওপর এত অদ্ভুত একটা কাজ’
অদ্ভুত কাজ। ভেতরে টং করে বাজে কথাটা। আবার
ড্রাগ পাচার নাকি? সেই যে জেলে আলাপ হওয়া লোকটা,
প্রায় ফোন করে তাকে, বলে খুব ছোট্ট কাজ রে পটা,
একটা ছোট প্যাকেট, কোন ওজন অব্দি নেই,
আরেকজনকে পৌঁছে দিবি শুধু। তার বদলে মোটা টাকা।
পটা কি এতই বুদ্ধু যে বুঝবে না ওই হালকা প্যাকেটে
ড্রাগ ভরা আছে? এক বছর জেল খেটে, তাও চুরি
চামারি খুন ধর্ষণ নয়, পুলিশের গায়ে হাত তোলার
অপরাধে তার জেল হয়েছিল, তার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে।
পরে সে ফোন আর সে ধরেইনি। মেয়েকে দিয়ে ব্লক করে
রেখেছে। পার্টিকে নিয়ে যাবে, তাকে এক জায়গায় ড্রপ
করে দেবে তারপর চলে আসবে।অথবা তাকে নিয়ে চলে
আসবে। এইটুকুই তো তার কাজ।এর মধ্যে অদ্ভুত কাজ
যদি থাকে, তা পার্টির। সে কী করবে, কেন করবে
–এইসব নিয়ে প্রশ্ন করতে নেই। সে পার্টি ওখানে গিয়ে
কী করবে তাতে তার কি? সেই যে দুটো ছেলে মেয়েকে
সে নিয়ে গেল মন্দারমনিতে, তারা যে ওখানে গিয়ে
সুইসাইড করল, সে তো তাদের জানার কথা নয়।
জানলে অবিশ্যি সে কিছুতেই নিয়ে যেত না। এখানে
পার্টির অদ্ভুত কাজটা কী, সেটা নিয়ে পরে কোন
লাফড়ায় সে ফাঁসবে কী না কে জানে। সেটা না জেনে
পটা এবার এক পাও নড়বে না।সেবার কুমারেশ ছিল বলে
ও পুলিশের হাত থেকে বেঁচেছে।পুলিশকে হাতে না রেখে
তো আর কুমারেশ হোটেলের ব্যবসা করে খায় না।
মালিক ওর ঘাড়ে সব চাপিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে। সেই
কুমারেশ পুলিশকে বুঝিয়ে ছেড়েছে যে পটার গাড়ি ছেড়ে
ওর পাওনা গন্ডা বুঝিয়ে দেওয়ার পরেই ওরা সুইসাইড
করে। পটা এর বিন্দুবিসর্গ জানে না। সবজায়গায় তো
আর পটা কুমারেশকে পাবে না। আর সবচেয়ে মুশকিল
রাস্তায় কোন বিপদে পড়লে ছোড়দাকে পাবে না। কারণ
বেশিরভাগ ট্রিপ হয় শুক্রবার থেকে রবি। ওই তিনদিন
ফোন বন্ধ ছোড়দার। এমারজেন্সি হচ্ছে রুমকির
ল্যান্ডলাইন। কিন্তু ছোট বউদি বলেই রেখেছে কেউ
মরলেও যেন ওই নম্বরে ফোন না করা হয়। এটা অবশ্য
বলতেই পারে ছোট বউদি। এখন
সে তেরিয়া গলায় বলল ‘ দেখো ছোড়দা। ফালতু
ঝামেলায় আমি পড়তে চাই না। তোমার পার্টি কে, তার
কী কাজ তা না জেনে আমি গাড়িতে হাতই দেব না’
‘আরে খেপিস কেন? তোর কোন রিস্ক নেই। একজন
হারিয়ে গেছে। শিলাই নদীর আশেপাশে নাকি দেখা গেছে,
তাই দেখতে যাচ্ছে পার্টি। ওখানে তাদের লোক থাকবে।
গিয়ে তোকে ছেড়ে দেবে। তুই পোঁ করে চলে যাবি ঘর।
আরে বুঝলি না, ছোটবেলার আশিক, তার জন্য লোকে
দুনিয়া তোলপাড় করে দিতে পারে’
বলে ছোড়দা যে নামটা বলল, তাতে চমকে উঠল পটা।
সত্যি, সত্যি এঁকে নিয়ে যাবে সে! খুব সাদামাটা নিরীহ
জীবন তার, কোন রং নেই, কোন মশলা নেই। রাজ্য
রাজনীতির অন্দরের খবরেও তার কোন আগ্রহ নেই।
একটা খবরের কাগজ রাখা হয় , সেটা দশ হাত হয়ে
যখন আসে, তখন তার ধড় মুণ্ডু থাকে না প্রায়ই।পটা
কাজ না থাকলে হয়তো নাড়েচাড়ে একটু। অনেকসময়
দেখা যায় সে গত বছরের একটা কাগজ পড়ছে। ওকে
নিয়ে হাসাহাসি করে ছোড়দা আর সব ড্রাইভার।
তারপর ছোড়দা বলে ‘পটার আর দোষ কী? দশ বছর
কুড়ি বছর আগেও তো একই খবর বেরোত। নামগুলো
শুধু বদলে গেছে’
পটা মাথা চুলকে ভাবে, সত্যি তো, সে তো পড়েও
বুঝতে পারেনি এটা পুরনো কাগজ। টিভিও তো দেখা হয়
না। তবে খবর উড়ে উড়ে আসে। ছোড়দা নানান
কিসিমের লোকের সঙ্গে ওঠে বসে। ওর হাত অনেক ওপর
মহলে ছড়ানো আছে। রুমকির সঙ্গে জোটার পর থেকে
ওর দৌড় আরও বেড়ে গেছে। এইজন্যে বড়দা ওর ওপর
রুমকির কেস নিয়ে ক্ষেপে থাকলেও কিছু বলতে পারে না,
ব্যবসা আলাদা করার কথা ভাবতেও পারে না। ছোড়দা
ছাড়া ব্যবসা কানা। শুধু যে পার্টিকে তুললে আর
নামালেই গাড়ির কারবার চলবে তা তো নয়, পুলিশ,
পার্টির দাদা, মন্ত্রী সান্ত্রী সবার সঙ্গে মাখন সম্পর্ক না
রাখতে পারলে করে খেতে হচ্ছে না। গাড়ি কখন
অ্যাক্সিডেন্ট করল, ট্রাফিক রুল ভাঙল, কাকে ঠুকে দিল-
সব খেয়াল রাখতে হয়।যেসব নাম ছোড়দার মুখে
হরবখত শুনতে পায়, তার একটা ইনি। তার মনে পড়ল
ছোড়দা বেশ কবার বলেছে, খুব শিগগির টিকিট পাবে
লোকটা। বাইরে থেকে এসে বাংলাকে পকেটে পুরে
রেখেছে। কত লোকের টিকি বাধা এর হাতে। তার বুঝতে
বাকি রইল না এই পরম প্রতাপশালী লোকটাই একটা
জাস্ট ফোন করে তাকে ফ্ল্যাট পাইয়ে দিতে পারে।কিন্তু
তাকে আবার খারাপ কাজে জড়াবে না তো? হঠাৎ একটা
কথা মনে হয় তার। এত ক্ষমতা যার সে ছোটবেলার
আশিককে খুঁজতে বেরিয়েছে পাগলের মতো! প্রেমের এত
ক্ষমতা! খুব মায়া হয় তার লোকটার জন্যে। নাহ, ফ্ল্যাট
নয় এমনিই সে যাবে লোকটার জন্যে।সে ছোড়দার দেওয়া
নম্বরটা সেভ করে রাখে ফোনে। এইটুকু সে পারে। নম্বর
সেভ করা। ফোন করা, ফোন রিসিভ করা, কিন্তু সেই
যে একটা পার্টি স্মার্ট ফোন নেই বলে হেব্বি খিচিমিচি
করছিল, গুগল ম্যাপে জায়গা চিনতে পারছে না বলে, সে
ফোন তো ছোড়দা কতবার তাকে দিতে চেয়েছে, সেও
রাগারাগি করেছে পটার ওপর। কিন্তু স্মার্ট ফোনের নাম
শুনলেই ছিটকে পালিয়ে গেছে পটা। সে এসব মোটেই
শিখতে পারবে না।ওই একনাগাড়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে
থাকলে সে রাস্তা খেয়াল করবে কখন? অ্যাক্সিডেন্ট করে
বসবে না? ছোড়দা তাকে নরমে গরমে অনেকবার
বুঝিয়েছে স্মার্ট ফোন ছাড়া ড্রাইভারি আস্তে আস্তে অচল
হয়ে যাবে, তখন এত ভালো স্টিয়ারিঙে হাত নিয়েও বসে
যেতে হবে পটাকে। ছোড়দা প্রায়ই বলে ‘আগে যেমন জলে
কুমীর ডাঙায় বাঘের সঙ্গে লড়াই করে মানুষকে টিকে
থাকতে হয়েছে, এখন তাকে মেশিনের সঙ্গে লড়াই করে
টিকতে হবে। তুই বুঝতে পারছিস না দুনিয়াটা আস্তে
আস্তে মেশিনের দখলে চলে যাচ্ছে। মেশিনের সঙ্গে গলাগলি
ভাব না করলে তুই টিকে থাকতে পারবি না’
দুনিয়াটা যে মেশিনের দখলে চলে যাচ্ছে, তা কি আর
বোঝে নি পটা? তা হলেও এক কথা ছিল, কিন্তু মানুষ
গুলোই তো মেশিন হয়ে যাচ্ছে। কেউ আর গায়ে পড়ে
কথা বলে না, তার গাঁয়ের লোকেরাই তো, কোন কথা
জিজ্ঞেস করলে একটা হ্যাঁ হুঁ তে উত্তর দেয়। অথচ এই
গ্রামেই কত হাসি খেলা এক সময়। প্রেমের জন্যে সংসার
ভাসিয়ে দিয়েছে রামপ্রসাদ। খালের ধারে তার ভাঙ্গা
নৌকোটা দেখলে খুব দুঃখ হয় আজকাল। দোলে বাড়ি
গেলে একদিন নৌকা চড়াতে হবে মেয়েকে। বড় নদীর
কাছে নিয়ে যাবে। আর গাড়িটা তো আছেই। একদিন
কাছেপিঠে এক রাত থাকার মতো কোথাও ঘুরে
আসবে। কোনদিন সে ওদের বাইরে রাত কাটানোর মতো
বেড়াতে নিয়ে যায়নি। মেয়ে একবার ‘তোমার সমুদ্র
ভ্রমণের অভিজ্ঞতা’ রচনায় লিখে এসেছিল ‘আমি কোনদিন
সমুদ্র দেখিনি’। তাতে মনিয়ারা ওকে বকেছিল খুব।
বানিয়ে বানিয়ে লিখে আসতে পারলি না? অতগুলো নম্বর
ছেড়ে এলি?মেয়ে তাতে অবিচলিত ভাবে বলেছিল ‘আমি
যা দেখিনি তা লিখব কী করে? বাবা কি কোনদিন সমুদ্র
দেখাতে নিয়ে গেছে?’ পাশের ঘর থেকে শুনে পটার বুকে
এসে লেগেছিল কথাটা। নাহ এবার গিয়ে সে ওদের দীঘা
ঘুরিয়ে আনবে। এত ভালো সুযোগ। গাড়িটা থাকছে।
ছোড়দা নিশ্চয় আপত্তি করবে না।
ভাবতে ভাবতেই ছোড়দার ফোন বাজে। ‘পটা এখুনি
বেরোতে হবে। তাড়াতাড়ি খেয়ে তৈরি হয়ে নে।‘
‘এখনই! বললে যে কাল’
‘আরে তোর তো ভালই হল, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাবি
কাল বিকেলের মধ্যেই’
‘কিন্তু এত রাতে!’
‘আরে একটা কিচাইন হয়ে গেছে, একটা আগুনে পোড়ার
কেস নিয়ে পুলিশ তোলপাড় করছে, কলকাতায় থাকাটা
রিস্কি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে যা’ বলে ছোড়দা
কোথা থেকে পিক আপ করবে লোকেশনটা দিয়ে দেয়
তাকে।
‘তুই বাড়ির জন্যে যা কিনেছিস, নিয়ে নে একেবারে।
আর শোন কাল বিকেল অব্দি আমাকে ফোনে পাবি,
তারপরও , যদি কোন অসুবিধে হয়, শুধু তোর ফোন
ধরব। কিন্তু পার্টিকে নামিয়ে দেবার পর আর জ্বালাবি
না। দেখবি কত টিপস পাবি, আর নতুন ফ্ল্যাট। এ দু
তিনদিন বেড়াচেড়া মেয়ে বউকে নিয়ে। রাখলাম’ ছোড়দা
ফোন রেখে দেবার পরেও উঠে চট করে খেয়ে নিতে
পারে না পটা। কেমন থম হয়ে বসে থাকে।
সে অকারণেই দেখতে পায় দুটো সাদা পোশাক পরা
ছেলে মেয়ে নিস্পন্দ শুয়ে আছে সমুদ্রের ধারে।
অধীর অপেক্ষা থাকে। প্রায় শেষ হয়ে আসছে। ভবানী শাস্ত্রীকেই একমাত্র পুরো কালো মনে হল। আর কোনো শেড নেই চরিত্রে। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।