অজিত সিং বনাম অজিত সিং <br />  পঞ্চবিংশতি পর্ব <br /> তৃষ্ণা বসাক

অজিত সিং বনাম অজিত সিং
পঞ্চবিংশতি পর্ব
তৃষ্ণা বসাক

অজিত সিং বনাম অজিত সিং দ্বাবিংশতি পর্ব তৃষ্ণা বসাক অজিত সিং প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের ২৫তম পর্ব। এই উপন্যাসের সব চরিত্র কাল্পনিক।

২৫

নতুন মেট্রো স্টেশনে নেমে একেবারে চমকে গেল তাজমুল। অনেক বছর আগে সে একটা কুরিয়ার কম্পানিতে কাজ করত, তখন এদিকে আসতে হত চিঠি বা পার্সেল দিতে। এখানে অনেক বড় বড় লেক ছিল। লোকে বলত সায়র। তাজমুল চেষ্টা করত এই এলাকার চিঠিগুলো একদম শেষ বিকেলে দিতে। একেকদিন চিঠি দেওয়া হয়ে গেলে, কোন একটা সায়রের পাড়ে বসে থাকত চুপ করে, পাশের মাঠে ছেলেরা ফুটবল খেলত, বক চুপ করে বসে থাকত ওপাশে, উল্টোদিকের বস্তি সুভাষ কলোনি থেকে গা ধুতে আসত মেয়ে বউরা, পিয়ালি টাউন থেকে অনেক ভেতরে চাঁপাতলি গ্রামে যে জীবন সে ফেলে এসেছে, তার যেন একটা স্বাদ নিত সে বসে বসে। সেই সময় তার মনে হয়েছিল, এই কোম্পানির কাজেই আস্তে আস্তে উন্নতি করে একদিন ও ডেস্কে বসে কাজ করবে, মাইনে জমিয়ে জমিয়ে এই জায়গায় একটা বাড়ি করবে, চিঠি দিতে গিয়ে প র্দার ফাঁক দিয়ে যেমন সোফা সেট, কাচের টেবিল, বইয়ের তাক, মস্ত টিভি, টিভির পাশে মাটির ঘোড়া আর দেয়ালে ছবি টাঙ্গানো ঘরের এক ঝলক দেখতে পায়, যেরকম ঘর সিনেমার বাইরে প্রথম দেখল সে, সেইরকম ঘর থাকবে সে বাড়িতে, একটা বারান্দা, একটা ছাদ।সামনে এক চিলতে বাগান, সেখানে একটা আমগাছ লাগাবে সে। ছোট থেকে খুব আমের বক্ত সে। কিন্তু তাদের একটাও আমগাছ ছিল না। লোকের গাছ থেকে পাড়তে গিয়ে কত হেনস্থা হয়েছে সে, পোড় শিবম্নিরের পেছন দিকে যে ঘন জঙ্গলের মতো আমবাগান, সেখানে ইচ্ছে থাকলেও সে যেতে পারত না, মা বলত মা শুনেছে শিব ঠাকুর নাকি নিজেই ত্রিশূল নিয়ে সে বাগান পাহারা দ্যায়। সেই রটনা মুসলমান পাড়া অব্দি এসে পৌঁছেছিল। মা বিশ্বাস করত সে কথা। তাজমুল শিব ঠাকুরকে চেনে না, তাঁকে বা তাঁর ত্রিশূল্কে সে ভয় পায় না, কিন্তু তাঁর মাথার জটায় অনেক সাপ জড়িয়ে থাকে, ক্যালেন্ডারের ছবিতে দেখেছে সে। তাই কোনদিন সে যেতে পারেনি ৈ আমবাগানে। কখনো কারো গাছের নিচে আম পড়ে থাকলে কুড়িয়ে বাড়ি নিয়ে গিয়েছে। তার অধিকাংশই মা ফেলে দিয়েছে আদুড়ে খাওয়া বলে। মাঝে মাঝে কিনে আনত আম মা, যখন মরসুম শেষ প্রায়, খুব সস্তা, ভালো স্বাদ হলেও তাজমুলের ভালো লাগেনি, তার মনে হয়েছে আসল দামি আম তো শেষই হয়ে গেছে। তাই নিজে বাড়ি করলে আম গাছ লাগাবেই সে, এটা তার স্বপ্ন ছিল। এক বুড়োর বাড়ি প্রায় চিঠি দিতে আসতে হত, মুখ চেনা হয়ে গেছিল, পুজোয় একশ টাকা দিয়েছিলেন বকশিস, বলেছিলেন ‘তোকে ঈদেই দেওয়া উচিত বোধহয়, তবে তোদের পরব আমার ঠিক মনে থাকে না। গোলমেলে ভারি। চাঁদ দেখা না দেখা নিয়ে ডেট পালটে যায়, তাই এখনই দিয়ে দিলাম’ তিনি মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতেন কোথায় বাড়ি, নদী কাছে কিনা, বাড়িতে কে কে আছে, সংসার কীভাবে চলে এইসব। তাঁকে একদিন তাজমুল জিগ্যেস করেছিল, ‘স্যার একটা কথা জিগ্যেস করব? কিছু মনে করবেন না তো?’
বুড়ো বলেছিলেন ‘যা বলবি বল। আমার একটা ফোন আসবে এখন’
‘না মনে, এখানে জমি খালি আছে স্যার? পাওয়া যাবে? কত করে কাটা যাচ্ছে এখন জানেন?’ শুনে খানিকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে হাসিতে ফেটে পড়েছিলেন সেই বুড়ো, তারপর হাসতে হাসতে বলেছিলেন ‘এই সুপর্ণা শুনে যাও, আমাদের কুরিয়ারের ছেলেটা কী বলছে! এখানে জমি কিনবে, জিগ্যেস করছে কত করে কাটা’
সুপর্ণা সম্ভবত স্যারের স্ত্রীর নাম। এক একদিন উনিও চিঠি নিয়েছেন স্যার না থাকলে, চেনে তাজমুল ওঁকে। জল চাইলে সন্দেশ দিয়ে জল দিয়েছেন প্রতিবার। হাত কাটা ম্যাক্সি পরে থাকেন সবসময়। ফর্সা রোগা ছোটখাট চেহারা। দেখে খুব ভালো মানুষ মনে হত তাজমুলের। সেই মহিলা বুড়োর কথা শুনে হাসিতে ফেটে পড়লেন। মেয়েমানুষ যে এত উঁচু গলায় হাসতে পারে তা নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাসই করত না তাজমুল। ও আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায়নি। দরকারও ছিল না। চিঠি দিয়ে সই করিয়ে নেওয়া হয়েই গেছিল। কিন্তু বেরিয়ে আসতে আসতে সেই হাসিটা যেন তাড়া করে আসছিল ওকে। গেট বন্ধ করে রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় অব্দি ওর পেছন পেছন আসছিল।
হাসিটা অনেকদিন পর্যন্ত কানে বাজত তাজমুলের। কানে বাজত বলেই ও খুব দ্রুত বুঝতে পেরেছিল, লোকের বাড়ি বাড়ি চিঠি বিলি করে ও কোনদিনই ওর স্বপ্নের ঠিকানায় পৌঁছতে পারবে না। সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে বেশি ওপরে ওঠা যায় না। লিফট বা এস্কেলেটর লাগে। ও সইদুলের কথা ভাবত, একই এলাকার ছেলে, ওর সঙ্গে একই সময়ে কলকাতায় এসেছিল, এই সেদিন অব্দি পিতজা ডেলিভারি বয়ের কাজ করত, আজকাল গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়ায়, একদিন চেপে ধরতে বলেছিল ইম্পোর্ট এক্সপোর্ট কোম্পানিতে কাজ করে। তাজমুল বিশ্বাস করেছিল কথাটা। সইদুল তো পড়াশনায় ভালো ছিল, টুয়েলভ অব্দি পড়েছিল, বাবা হকারি করতে গিয়ে রেলে কাটা পড়ায় আর শেষ করতে পারেনি, সুযোগ পেলেই বই নিয়ে বসে থাকত, এমনকি ঠোঙা পর্যন্ত পড়তে দেখেছে সইদুলকে। কোন বড় কোম্পানিতে চাকরি পাওয়া ওর পক্ষে অসম্ভব নয়। সেদিন কিছু দরকারও ছিল না। চিঠি দিয়ে সই করিয়ে নেওয়া হয়েই গেছিল। কিন্তু বেরিয়ে আসতে আসতে সেই হাসিটা যেন তাড়া করে আসছিল ওকে। গেট বন্ধ করে রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় অব্দি ওর পেছন পেছন আসছিল।
হাসিটা অনেকদিন পর্যন্ত কানে বাজত তাজমুলের। কানে বাজত বলেই ও খুব দ্রুত বুঝতে পেরেছিল, লোকের বাড়ি বাড়ি চিঠি বিলি করে ও কোনদিনই ওর স্বপ্নের ঠিকানায় পৌঁছতে পারবে না। সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে বেশি ওপরে ওঠা যায় না। লিফট বা এস্কেলেটর লাগে। ও সইদুলের কথা ভাবত, একই এলাকার ছেলে, ওর সঙ্গে একই সময়ে কলকাতায় এসেছিল, এই সেদিন অব্দি পিতজা ডেলিভারি বয়ের কাজ করত, আজকাল গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়ায়, একদিন চেপে ধরতে বলেছিল ইম্পোর্ট এক্সপোর্ট কোম্পানিতে কাজ করে। তাজমুল বিশ্বাস করেছিল কথাটা। সইদুল তো পড়াশনায় ভালো ছিল, টুয়েলভ অব্দি পড়েছিল, বাবা হকারি করতে গিয়ে রেলে কাটা পড়ায় আর শেষ করতে পারেনি, সুযোগ পেলেই বই নিয়ে বসে থাকত, এমনকি ঠোঙা পর্যন্ত পড়তে দেখেছে সইদুলকে। কোন বড় কোম্পানিতে চাকরি পাওয়া ওর পক্ষে অসম্ভব নয়। সেদিন কিছু আর্জি জানাতে না পারুক, ফোন নম্বরটা বুদ্ধি করে নিয়েছিল তাজমুল। ভেতরে ভেতরে যতই ছটফটানি থাক, সইদুলকে কিছুতেই ফোন করা হয়ে উঠছিল না, ছোট বেলায় ইস্কুল থেকে ফেরার সময় তেষ্টায় বুক ফেটে গেলেও যেমন বাড়ি ফিরেই জল খেত না, তেষ্টাটাকে আরও একটু বাড়তে দিত, তেমনি ও সইদুলের সঙ্গে যোগাযোগটাকে যেন ঠেকিয়ে রাখছিল।
এর মধ্যে একদিন আবার সেই বুড়োর বাড়ি চিঠি দিতে যেতে হল আর ওকে দেখেই সেই বুড়ো হেসে হেসে বললেন ‘সুপর্ণা, জমি দেখছ তো? আমাদের জনাব তাজমুলের বাড়ি, সোজা কথা নয়’
নকশা করা গ্রিলের মধ্যে দিয়ে হাত গলে না, নইলে তাজমুল সেদিনই বুড়োটাকে গলা টিপে খুন করত। তার বদলে মাথা নিচু করে সই করিয়ে চলে এল সে। এসে আবার সেই সায়রের ধারে বসল।আজকের মতো তার চিঠি দেওয়া শেষ। এখন অফিসে ফিরে কিছু কাজ থাকে। তাজমুল ঠিক করল আজ সে আর অফিসে ফিরবে না, শুধু আজ না, কোনদিনই যাবে না।কাল তার হপ্তা পেমেন্ট নিয়ে নিয়েছে, আজকের খাটনিটা বেগার গেল, যাক, আর ওখানে ফিরলে, বাকি জীবনটাই বেগার যাবে। বিকেল প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। ওর সামনে সায়র, ডানপাশে ধানক্ষেত ছিল, কিন্তু সেখানে কয়েকটা লরি বুলডোজার দাঁড়িয়ে, কিছুদিন আগেও ওখানে সবুজ ধান লকলক করত। খুব বড় কোম্পানি কিনে নিয়েছে, বিশাল বিল্ডিং উঠবে, তিনরকম ফ্ল্যাট, বড়লোক, মধ্যবিত্ত আর গরিব। গরিব মানে তাজমুলের মতো গরিব নয়। এখন মাসে যারা পঞ্চাশ হাজার টাকা কামায় তাদের গরিবই বলে। এখানে গরিবের বরাদ্দ ফ্ল্যাটেও তাজমুল কোনদিন থাকতে পারবে না, এই কুরিয়ার কোম্পানিতে ঘসে গেলে। সে সারাদিন মুখের রক্ত তুলে খাটে, সকালে টিফিন খায় চা মুড়ি, দুপুরে আর রাতে ভাত, বিকেলের টিফিন শেষ কবে খেয়েছে মনে পড়ে না, মা মাঝে মাঝে সোনারপুর স্টেশনে এসে দেখা করে চালভাজা, পেয়ারা দিয়ে যায়, ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে যায় ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করতে। মা বলে দিয়েছে সংসারে কিছু দিতে হবে না তাকে, ও যেন নিজের আখের গুছিয়ে নেয়।
এত করেও মাসে দুশ টাকার বেশি জমাতে পারে না সে। সায়রের ধারে বসে তাজমুল ঝোলা থেকে একটা প্লাস্টিকের কৌটো বার করল, এতে একটু চালভাজা আর দুটো নারকেল নাড়ু পড়ে আছে। মার হাতের এই জিনিসগুলো খুব কিপটের মতো খরচ করে তাজমুল, সবদিন নিয়ে আসে না, যেদিন যেদিন এই দিকটায় চিঠি বিলি থাকে, সেদিন সেদিন আনে। কারণ এখানে বসে খাওয়ার মতো জায়গা আছে। খুব খিদে পেয়েছিল, কিন্তু গোগ্রাসে খেল না তাজমুল, খুঁটে খুঁটে খেল। আর খেতে খেতে সে চালভাজার মধ্যে একটা অদ্ভুত গন্ধ পেল! চমকে উঠল সে, আরে চালভাজা থেকে বিরিয়ানির গন্ধ বেরোচ্ছে তো! তখন তার মনে পড়ল, কিছুদিন আগে পাড়ার ক্লাবে একটা অনুষ্ঠানে অনেক মন্ত্রী সান্ত্রী এসেছিল। দরজায় দরজায় গেছিল তারা, তাজমুলকে একটা ছেলে ডেকেছিল হাতে হাতে চেয়ার টেয়ার পাতার জন্যে, সেখানেই বিরিয়ানির কৌটো পেয়েছিল। খাওয়া হয়ে গেলে সেটাই ধুয়ে রেখেছিল, তাতে আনা চালভাজায় তাই বিরিয়ানির গন্ধ! চালভাজা চিবোতে চিবোতে ও ওর বাঁপাশের মাঠটার দিকে দেখছিল। একটু আগেও এখানে অনেক ছেলে বল পেটাচ্ছিল। এরা যে পেছনের উদ্বাস্তু কলোনির ছেলে তা চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। এদের মায়েরা নিশ্চয় আশপাশের বড় বাবুদের বাড়ি কাজ করে, সেই বাবুদের ঘরের ছেলেরা এইসব মাঠে খেলে না আর, তারা জিমে যায়। এখন বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে, খেলা শেষ করে ছেলেরা মাঠের একপাশে বসে গজল্লা করছে, কিন্তু একটা ছেলে একা একা মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে বল নিয়ে পায়ে নাচিয়ে যাচ্ছে, পায়ে কতক্ষণ বল ধরে রাখতে পারে সেই প্র্যাক্টিস করে যাচ্ছে। ওকে দেখে হাসি পাচ্ছিল তাজমুলের। চেষ্টা, পরিশ্রম এসবের কোন দাম নেই। দুনিয়ায় যা পাবার পাবে ওই বড় বড় বাড়ির দুধ ননীতে বড় হওয়া ছেলেমেয়েরা। তাদের বাপ মা রা সব সেটিং করে রেখেছে, জলেই জল বাঁধে। ওরা, ওদের ছেলেমেয়ে, তাদের ছেলেমেয়ে –এইভাবে বংশানুক্রমিকভাবে পৃথিবীর যা কিছু সেরা সব ওরাই পাবে। এই ছেলেটা খালি পেটে মাটি কামড়ে থেকে যতই পায়ে বল নাচিয়ে যাক, সে যতই সারা কলকাতা ঘুরে চিঠি বিলি করুক, তাদের কিস্যু হবে না।তাকে সারাজীবন এই বিরিয়ানির গন্ধ মাখা চালভাজা চিবিয়ে যেতে হবে। কথাটা ভেবেই তার এমন রাগ হল যে সে প্লাস্টিকের কৌটোটা ছুঁড়ে ফেলল, সেটা গিয়ে পড়ল দীঘির জলে। ভাগ্যিস কাছে পিঠে সিকিওরিটি গার্ড নেই কেউ, নইলে এখুনি ফাইন হত তার।
জলে ভেসে ভেসে সাদা প্লাস্টিকের কৌটাটা যত তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছিল, ততই তাজমুলের মনে দুটো সংকল্প দৃঢ় হচ্ছিল।
এক- সে আর কোনদিন বিরিয়ানির খালি কৌটোয় চালভাজা খাবে না,
দুই- সে এখনই সইদুলকে ফোন করবে। তাকেও ইম্পোর্ট এক্সপোর্ট কোম্পানিতে যেন ঢুকিয়ে দ্যায় সইদুল।
সন্ধে আরও গভীর হচ্ছিল। এখানে আর বসা যাচ্ছে না। এত মশা। তবু তাজমুল ওখানে বসেই সাইদুলকে ফোন করল ধাঁ করে। তার ভয় হচ্ছিল বাড়ি ফিরতে ফিরতে তার সংকল্প তপ্ত চাটুতে জলের ফোঁটার মতো উবে না যায়। সে ভেবেছিল সইদুলকে ফোনে পাবে না, ব্যস্ততার ভান দেখাতে আজকাল প্রায়ই অনেকে ওরকম করে থাকে। কিন্তু তাকে কিছুটা আশ্চর্য করে দিয়ে ফোন ধরল সইদুল। ওর কথা শুনে একটু চুপ করে থেকে বলল ‘এ কাজ তুই কি পারবি?হেব্বি দায়িত্ব আর রিস্কের কাজ। যদিও চিঠি দেওয়া নেওয়াই করতে হবে। চিঠির বদলে থাকবে শুধু পুরিয়া।’
পুরিয়া!
পুরিয়া বোঝে না, এত বোকা নয় তাজমুল। তার এমন অবস্থা যে টাকা পেলেই সে ছোটে, কিন্তু হঠাৎ তার মার মুখটা মনে পড়ল। কলকাতা চলে আসার সময় হাত দুটো ধরে বলেছিল ‘শহরে গিয়ে কোন নেশার কবলে পড়িস নি বাপ।এখানে দেখেছিস তো তাড়ি গিলে সংসারটা কেমন ভাসিয়ে দিল তোর বাপ। শহরে নাকি শুখনো নেশার খুব চল। পুরো শরীর ছিবড়ে করে দেবে’
পুরিয়া যারা চালাচালি করে তারা তো নিজেরাই পুরিয়া খায়, খেতেই হয়। তাজমুল বলল ‘বাড়ি গিয়ে ফোন করছি তোকে। এখানে কিছু শোনা যাচ্ছে না।’
বাড়ি এসে আর ফোন করা হয়নি। বাপিদার লোক এসে খবর দিয়েছিল বাপিদা দেখা করতে বলেছে আজই। আর্জেন্ট দরকার। তাজমুল চারজনের সঙ্গে থাকত একটা ছোট্ট ঘরে গাদাগাদি করে, উঠোনের মধ্যে এরকম দশ বারোটা ঘর ছিল। এরই ভাড়া দুহাজার টাকা, ইলেকট্রিক আলাদা। একটাই কলঘর, তবে সেপটিক ট্যাংক ছিল, কলটা সবাই পাম্প করে করে বছরের এগারো মাসই খারাপ করে রাখত। একবার দুবার সারিয়ে দেবার পর বাড়িওলা স্পষ্ট বলে দ্যায় এরপর খারাপ হলে তার আর সারিয়ে দেবার দায় নেই, সবাই যেন চাঁদা তুলে সারিয়ে নেয়। এটাই যদি সবাই মেনে নিত, তাও কোন অসুবিধে ছিল না। নিজেদের গ্যাঁট থেকে যখন টাকা খসবে, শরীরের সব রাগ দিয়ে টিউকলের ওপর ঝাড়ার আগে
দুবার ভাববে। কিন্তু অধিকাংশ লোকই সোজা কথাটা সোজা ভাবে ভাবতে পারে না, তারা কেবলই সমস্যা জিইয়ে রাখতে ভালবাসে। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটনির শেষে একটা চিল্লামিল্লির বিষয় খোঁজে।এখানে দুতিন জন রিক্সাওলা আছে, তারা রাতে চুল্লু গিলে বাড়ি ফিরে কলে জল না পেয়ে বাড়িওলার বাপান্ত করে, অমনি তাদের ঘরের বউগুলো, তারাও দশ বাড়ি কাজ করে সন্ধেয় বাড়ি ফিরে বাচ্চা পেটাতে লেগেছে, অমনি বরের সঙ্গে গলা মেলায়। তারা আসলে ভাবে বরের কথায় তাল দিলে রাতের বাঁধা মারটা আর পড়বে না আজ। কিন্তু তারাও বাড়িওলার গুষ্টির তুষ্টি করলেও কেন জানি বরগুলো তাতে ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারে না, রেগেই যায় বরং। তারা খানিক চুপ মেরে ভাবে মেয়েছেলেগুলোর গলা দেখো, এখানে তো আরও দশ ঘর ভাড়াটে আছে, বাড়িওলাও পাশেই থাকে, তারা কী ভাবছে। ভাবছে সনাতন বউকে শাসনে রাখতে পারে না। যেই না মনে হওয়া অমনি তারা তেড়েফুঁড়ে ওঠে ‘শালী বড্ড বাড় বেড়েছে না তোর? সারাদিন ঢলিয়ে বেড়াস, আর রাস্তার কল থেকে দু বালতি জল আনতে মানে লাগে, তাই না?’ বলেই আর কথা না বাড়িয়ে ঘপাঘপ.. থাকে। যেসব বৌ বুঝে গেছে ঠিক কটা মার খেলে বরের স্টক শেষ হবে, ঘুমিয়ে পড়বে মড়ার মতো, তারা মুখ বুজে মার খায়। কিন্তু দু চারজন আছে তেরিয়া, চিল্লামিল্লি করে, তাতে মার আরও বেশি পড়ে, উপরন্তু সেদিন আর রান্না চাপে না, বাচ্চাগুলো কাঁদতে কাঁদতে ঘুমোয়, রোজ রাতের এই কীর্তন এড়াতে অনেক রাত অব্দি তাজমুল আর তার ঘরের বিশু বটতলায় গিয়ে বসে থাকে। এই জায়গাটা খুব ভালো। বিরাট মাঠের এক পাশে বাঁধানো বট, এখানে রাতে বসলে ফুরফুরে হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে আসে।মাঠের উল্টোদিকে নতুন ওঠা ক্লাবঘর। এখানে আরও অনেক কিছু বসবে, ঢেঁকি, দোলনা, বড় বড় কার্টুনের মূর্তি। বাপিদা খুব কাজের ছেলে। বিশু বলছিল ‘বুঝলি না, বাপিদার মতো লোকই দরকার এখন আমাদের। তুই যেকোন কাজ বল, তুড়ি মেরে করে দেবে। টাকা যে কোত্থেকে এনে দেবে তুই জানতেই পারবি না। পুরো মাখন’ বাপিদার ক্যারিশ্মা সেদিনের অনুষ্ঠানের দিনই টের পেয়েছিল তাজমুল। সেই বাপিদা তাকে ডেকেছে, কেন?

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (2)
  • comment-avatar
    Ishita+Bhaduri 4 years

    খুব ভাল হচ্ছে

  • comment-avatar
    Bidisha 4 years

    খুব ভালো হচ্ছে, তবে সব পর্ব গুলো পরপর দেখতে পাই না, লেখার পরে আগের লেখার লিংক গুলো দিলে মনে হইভালো হয়

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes