সুদেষ্ণা ঘোষ-এর গল্প
খুব নরম কোনও পারফিউমের মতো
রুপু রাতে শুয়ে প্রচুর কথা বলে। সারাদিন মেট্রোর ভিড়়, অটোর লাইন চাকরির অপমানের ধকল সামলে আমি ঘুমনোর ভান করি। ভাগ্যিস অন্ধকার! রুপু হাসলে আর উপায় থাকে না।
আমাদের এই উত্তর কলকাতার বাড়়িটা জলের খুব কাছে। পাড়়াটা ভাল নয়। রাতে যত বাড়়ে, অনেক লোক আসে-যায়। হাওয়ায় অচেনা পালক ভাসে। সস্তা পারফিউমের গন্ধও, যা নাকে এলেই আমার কান্না পায়। দূরে চকচকে পানশালা থেকে ভেসে আসে উদ্দাম ড্রামের আওয়াজ। আমি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়়ার চেষ্টা করি। আশপাশের বাড়়িতে খুব জোরে-জোরে সিরিয়াল চলে। তখন আমার মনে পড়ে হারমোনিকার কথা। হারমোনিকার একটা ম্যাজিক আছে। ওর কথা মনে হলেই সুরটা আস্তে-আস্তে এগিয়ে আসে। কানে-কানে কীসব আদরের কথা বলতে চায়। পেঁচিয়ে ধরে স্মৃতি বা স্বপ্নের মতো। কিন্তু আমি আস্কারা দিই না। চট করে লাইট নিভিয়ে দিই।
এমনিতে আমাদের বাড়়িতে সাধারণ মানুষের থাকতে ভয়ই লাগবে। এত বড়় বাড়়ি। আর-একটা বড় খাঁচায় অনেকগুলো মুনিয়া পাখি। পাখিগুলো মানুষের দেখা না পেতে-পেতে কেমন শান্ত হয়ে গেছে। দিদিয়া ওদের রোজ সকালে খেতে দিত। বাড়়িতে একটা গোল ঘোরানো সিঁড়়ি, যার দু’পাশে ফাটলে কত না মুখ জমা হয়েছে। এবাড়়িটা একসময় খুব জমজমাট ছিল। একে-একে অনেক মানুষ মারা গেছে। কেউ-কেউ চলে গেছে। তাদের কথা অবশ্য আলাদা। কিন্তু তাদের রেখে যাওয়া অনেক জিনিস আছে। যেমন, এই মেহগনি কাঠের খাট, আলমারি, কাচের ওয়ার্ড্রোবে সার-সার চিনামাটির পুতুল। বিশাল তিনপাল্লার একটা ড্রেসিংটেবিল, একসঙ্গে তিনটে মুখ যাতে দেখে প্রথমবার আমি চমকে উঠেছিলাম। আমার সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে একদম ফাঁকা আলমারির এককোনায় একটা ছোট্ট বাচ্চাদের ফুল-ফুল তোয়ালে। দেখে এত ভয় করেছিল। এই আলমারিতে জামাইবাবু মারা যাওয়ার পর কেউ আর হাত দেয় না। এখানে এই তোয়ালেটা দেখে আমার দিদিয়ার ছায়া-ঘেরা মুখ ভেসে এসেছিল।
কাছেই একটা মসজিদ। আজানের আওয়াজে আকাশ পোর্সেলিনের মতো চিরে যায় যখন-তখন। পাশের বাড়িতে কেউ থাকে না। জাল দিয়ে ঘেরা বারান্দায় সারাদিন কালো-সাদা দুটো বিড়়াল ঘোরে। ঘুমোয়। কখনও রক্তাভ হলুদ চোখে মুনিয়াগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।
রুপু সারাদিন এখন একাই থাকে। আমার অফিস থেকে ফিরতে বেশ দেরিই হয়। রুপু স্কুলে যায়। স্কুল থেকে ফিরে কার্টুন দেখে। কার্টুন চ্যানেলে এক-একটায় এক-একরকম গল্প। একটা কার্টুন চ্যানেলে সারাদিন সব বাসেদের নিয়ে গল্প দেখায়। হলুদ-সবুজ বাস। একটা বাসের রং গোলাপি। তাকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে কারশেডে। একদিকের হেডলাইট ভাঙা। গোলাপি বাসের কি মনখারাপ। দেখতে-দেখতে রুপুর খুব কষ্ট হয়। রুপু ঠোঁট চেপে জিজ্ঞেস করে, ‘‘এসব তো সত্যি নয় মা? তাই?’’
আমি জোরে-জোরে মাথা নাড়ি। রুপুর নাকের পাশ দিয়ে রক্তের শুকনো দাগ। ফরসা গালের উপর লাল রংটা রুবির মতো লাগে। রুপুর ছোট থেকে খুব শ্বাসকষ্ট। এখনও খুব সাবধানে থাকতে হয়। আজ সন্ধেতেও অল্প ইনহেলার দিতে হল। ওর চোখে একটা সবুজ আভা আছে। এমনিতে দেখা যায় না। কিন্তু ঠিক সন্ধেবেলার আগে যখন জাহাজের ভোঁ বেজে ওঠে আর পাখির ডানায় আকাশ অন্ধকার হয়ে যায়। আমার মনে হয় ওর চোখটা সবুজ। মনে হওয়ার অবশ্য অন্য কারণও আছে।
আমাদের বাড়িতে একটা দেওয়াল জোড়া পাতাবাহার গাছ। এখন ওরা সারা দেওয়াল জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সেদিনটা আমার মনে আছে, একটা ছোট্ট হরলিকসের শিশিতে দুটো পাতাওলা একটা গাছকে এনে দিয়েছিল, তখন রুপু প্রথমবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। মাথায় বিশাল ব্যান্ডেজ। কথায়-কথায় শুধু হাসে। চোখে ভাল দেখে না। গাছটা দেখে কেন এত খুশি হয়েছিল কে জানে। দিদিয়াই এনেছিল। কিন্তু সেই আনার পর থেকেই গাছটার সবুজ ওর ভিতর চারিয়ে গিয়েছে। অন্তত চোখে তো বটেই। তারপর অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আমি প্রায়ই দেখতাম, রুপু গাছের সামনে বসে কী বলছে। আমাকে দেখলে হাসত। প্রথমে পাত্তা দিইনি। হাসি কত রোগবালাই দূরে ঠেলে। কিন্তু দিদিয়া চলে যাওয়ার পর ওর হাসি আমাকে অন্যমনস্ক করে দিত।
দেওয়াল থেকে মাঝেমধ্যে বালি ঝরত। সেই আওয়াজ পেরিয়ে, মেঘের ডাক পেরিয়ে আমি মাঝে-মাঝে জিজ্ঞেস করতাম, কীরে, কী বলিস?
রুপু বলত, কিছু না মা।
কিন্তু ওর চোখে সেই ছোটবেলার শ্বাসকষ্টের ছায়া ভাসত। ও দৌড়়ে আসত। বলত, ‘‘মা, চোখ বোজো।’’
কেন? চোখ বন্ধ করতে ভয় করত। যদি ঘুমিয়ে পড়়ি। তখন এত চাপ চলছে তখন, ঘুম রেহাই দিত না।
রুপু তখন ফিসফিস করে বলত, এবার থেকে তাড়়াতাড়়ি চলে আসবে।
চোখ বন্ধ করে শুনি রুপু বলছে, গাছের খুব মনখারাপ। এত ছোট জায়গায় ওর কষ্ট হয়। তবে ওরা খুব শিগগিরই ছড়়িয়ে যাবে। ঢেকে ফেলবে সমস্ত ফাটল।’’ শুনতে-শুনতে আমার চোখের মণি ককিয়ে যায়। রুপুর চোখ কি আবার সবুজ হয়ে যাচ্ছে? আমার মনে হয়।
রুপু তখন হাসে। ওর হাসি দেখলে আমার এবার মনে পড়়ে ছোটবেলার সেই পুরনো ফেলে দেওয়া একটা ডানাভাঙা অ্যান্টেনার কথা। যে অনেকদিন সকলের লক্ষ্য ছাড়়াই সন্ধেবেলার অন্ধকারকে ফিসফিস করে গোঁয়ার্তুমি করে কীসব বলছে। অন্ধকার কোনও কথা না শুনে ঝাঁপিয়ে পড়়ছে। কেউ দেখেও দেখেনি।
রুপু কি এরকমই থাকবে? চিরকাল? ভবিষ্যতের জন্য আমার মাঝে-মাঝে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেত। সিলিংয়ে তখন একটুখানি করুণ চাঁদের আলো। এই বালি ঝরে যাওয়া বাড়়ি, তিন মুখের সঙ্গে দেখা-করানো আয়না, ছোট্ট ফুল-ফুল তোয়ালে, এরা কি রুপুকে ছেড়়ে দেবে? আমার আর রুপুর গল্পটা কি চাপা পড়ে যাবে? দিদিয়ার যেমন গেল?
দিদির কথা খুব মনে পড়়ে, যখন সন্ধে হওয়ার আগেই স্ট্রিটল্যাম্পগুলো জ্বলে ওঠে। তখন ওদের দেখে মনকেমন করে। এখন তো জ্বলার কথা নয়। অথচ জোর করে জ্বালানো, এসময়টা ওদের দেখলে খুব খারাপ লাগে, দিদি বলত। দিদিকে আমি ছোট থেকেই হিংসে করি। এমন কফি রঙের গায়ের রং আর চোখদুটো যেন কোনও ভুলে যাওয়ার সঙ্গে প্রাণপণ লড়়ছে। দিদির একটা পুরনো দিনের মারফি রেডিও ছিল। সারাদিন খুব মৃদু আওয়াজে সেটা চালিয়েই রাখত। খুব সুন্দর গাইতও। মিহি সুরে গান গাইত। একটা কী গান ছিল, প্রথম লাইনটা মনে নেই।
ভিতরে এক জায়গায়, ‘সকল গৃহ হারাল যার’, গাইতে গিয়ে ও কেমন ঝুঁকে পড়ত সামনের দিকে। থেমে গিয়ে বলত, ‘‘রিনি এই হিমের মধ্যে শীতের মধ্যে তোর কষ্ট হবে বলেই তো কিছু বলি না। না হলে তো আমি কবেই সব বলতাম…’’
আমি কিছু বলতাম না। শুধু জ্যোৎস্না ফিকে হয়ে আসত। বুঝতে পারতাম, সময় হয়ে আসছে। আমাদের এই মাঠের ভিতর জ্যোৎস্নায় অলৌকিক হয়ে ওঠা বাড়িটায় রোজ একটা-দুটো করে মুনিয়া মরে যেতে শুরু করেছে।
একদিন অফিস থেকে অনেক রাত হল। রাস্তায় কীসব অবরোধ হয়েছে। এসে দেখি দিদি নেই। জোরসে ফ্যান ঘুরছে। রুপু একা ঘুমিয়ে আছে মাদুরের উপর। চারদিকে খেলনার স্তূপ। দিদি রুপুকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারে না। এক মিনিটের জন্য কোথাও বেরোলেও নীচ থেকে বাপনকে ডেকে তবে যায়। কিন্তু ঘরের মধ্যে একটা ছাইরঙা বেলুনকে ভাসতে দেখে আমার এমন সন্দেহ হল। রুপুকে ধরে ঝাঁকাতেই ও চোখ খুলল। অনেক কিছু বানাতে চেষ্টা করল। তারপর অসহায়ের মতো বলল, দিদিয়া চলে গেছে মা। ওই গানটার সঙ্গে।
আমি একমুহূর্তের জন্য চড় তুলেছিলাম। কিন্তু দেখলাম চারদিকে দেওয়ালের গায়ে সব অচেনা মুখ। গোল কুয়োর মতো সিঁড়িটা যেন ঝাঁপ দিয়েছে রহস্যের দিকে কারও পরোয়া না করে। আমি চড়টা নামিয়ে নিলাম। নীচে কাদের পায়ের আওয়াজ। নীচের ঘর থেকে বাংলা টিউশন পড়়ে পিঠে খুব ভারী ব্যাগ নিয়ে চারটে মেয়ে বেরোচ্ছে। আমার দিকে একজন তাকাল। মাথায় একটা নীল রঙের প্রজাপতি। নাহ, একটা ফিনফিনে ক্লিপ। শুধু আদ্যিকালের দরজার উপরে বিশাল স্টাফ করা হরিণের মাথাটাকে অদ্ভুত নিশ্চিন্ত মনে হল।
রুপু আগে এরকম ছিল না। দিদি চলে যাওয়ার পর থেকে এরকম হয়ে গেছে। এখন এরকম অনেক কিছুই বলে। সব যে আমি শুনি, তা নয়। ইন ফ্যাক্ট রুপু সব কথা শোনার দরকার হয় না। তবে কিছু-কিছু কথা বলার সময় রুপুর চোখ-মুখ পালটে যায়। ওর চোখ পালটে যাওয়াকে আমি খুব ভয় করি। তাই ছুটে এসে শুনি ও কী বলছে। একদিন দেখি বলছে, আমি বিদায় নেওয়ার সময় তুমি কী করব?
কিছু নয়। শুধু তোকে যেতে দেব না।
খুব বেশি যে কথাটা বলে সেটা হল ‘‘অন্ধকার কাঁপছে মা।’’ এটা বলার পর ও আর কিছু বলে না। আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। আমার অভ্যেস হয়ে গেছে অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা করা।
রুপু সারা ঘরে তারার স্টিকার আটকেছে। ফসফরাস দেওয়া। অন্ধকারে ওরা চিকমিক করে। তখন অদ্ভুত লাগে।
এসব কথাই হয় ঘুমের মধ্যে। জেগে থাকলে রুপু কোনও কথা বলতে চায় না।
সারাদিন লেখাপড়া নয়তো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। সবই ফোনে। মাঝে-মাঝে কানে হেডফোন লাগিয়ে খুব হাসে। নয়তো টিভিতে কার্টুন।
মাঝে অনেকগুলো দিন গলে গেছে মেঘ-কুয়াশা-আকাঙ্ক্ষা-অভিমানে। রুপু একবারও দিদিয়ার কথা জিজ্ঞেস করেনি। দিদি চলে যাওয়ার পর রেডিওটা আমি লুকিয়ে ফেলেছিলাম ওই তোয়ালের ভিতর। রুপু যে দিদির খুব আদরের ছিল, তা তো সত্যি। আমি চাইনি এসব দেখে ও ফিরে যাক। স্বপ্ন বা স্মৃতির ভুলভুলাইয়ার মধ্যে। দিদিয়া খুব বেশি নিষ্ঠুরও ছিল তো। একবার মনে আছে বিশাল-বিশাল বেলুন কিনে এনে দিয়েছে রুপুর জন্য। সারা বাড়়ি সেসব বেলুন উড়়ছে সিনেমার স্বপ্নদৃশ্যের মতো। রুপু কিছুতেই পড়়বে না সেদিন। এক-আধদিন না পড়লেই বা কী ক্ষতি! দিদিয়া খানিক পরে নির্বিকার মুখ করে একটা ছোট্ট নটরাজ পেনসিল দিয়ে বেলুনগুলো ধরছে আর ফাটাচ্ছে। একটু করে রক্ত হারিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট রুপুর মুখ থেকে। শেষ বেলুনটাকে জড়িয়ে আছে মরিয়ার মতো। কিন্তু বড় বেশি একরোখা ছিল দিদিয়া। এসব নিশ্চয়ই ও ভুলে যায়নি। নটরাজ পেনসিলের পর পেনসিল কিনে দিয়ে আমি সেই স্মৃতিদের তাতিয়ে রাখি।
দিদিয়াকে আমার চিরকাল হিংসেই হত। এমন কফির মতো রং, এমন গানের গলা। এমন নিষ্ঠুর হাতে বেলুন জড়়িয়ে ধরা। রুপুকে আমি শক্ত করে ধরে থাকি ঘুমের ভিতর। ও ইদানীং খুব বেশি কথা বলছে। সারারাত কথার আধফোটা একটা ঝরনা কবেকার না-হওয়া শিশুদের মতো ঝাঁপিয়ে আসে আমাদের স্বপ্নে। একবার রুপু বলল, ‘‘একটা বাড়ি আমাকে পুরস্কার দিতে চায়। কিন্তু বাড়়িটা খুনি!’’
‘‘পুরস্কার তো পুরস্কারই।’’ আমি বলতে চাই, কিন্তু জ্যোৎস্না এসে সব গোলমাল করে দেয়।
অনেকগুলো দরজা যেগুলো শক্ত করে বন্ধ করা ছিল একটা অহংকারের খিল দিয়ে। এই বসন্তের হাওয়ায় যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ইদানীং। একদিন ওকে বলেই ফেললাম, খুব দিদিয়ার কথা ভাবিস না তুই?
ও বলল, ‘‘কী যা-তা বলছ। সারাদিন অফিস করে তুমি স্ট্রেসড হয়ে গেছ।’’ বলে হাসল। হাসিটার জন্যেই এত কিছু! আমি তাকিয়ে দেখলাম, অন্ধকারে পাশের বাড়়ির হুলোটার রক্তমাখা মুখ ঝলসে উঠছে। আমি চোখ বন্ধ করে দেখলাম, আমাদের খালি পাখির খাঁচাটা মুখ বন্ধ করে ডানা মেলে রুপুর আঁকার খাতায় চলে যাচ্ছে।
দিদিয়ার কথা ওই মুনিয়ারা সবচেয়ে বেশি মনে রেখেছিল। যাদের দিদি রোজ সকালে খাওয়াত। এমনভাবে চিৎকার করত, যেন বাড়িতে একটা বড়় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে শিগগিরই।
যা ভেবেছি তাই হল। পাতাবাহারের আক্রোশ ছড়়িয়ে পড়়ল আমাদের গোপন রাতগুলোর শিরায়। খুব শিগগিরই রুপু বলে উঠল, ‘‘আমি খুব পজ়েসিভ। যেটা চাইছি না পেলে মাথায় খুন চেপে যায়।’’
রুপুর গলায় তার জন্মেরও আগে মরে যাওয়া বাবার গলা ফুটে ওঠায় আমি চিরকালের ওপারে জেগে উঠি। এগুলো তো কথা নয়। রুপু কি চাইছে, দিদিয়া, রেডিয়ো না গান? নাকি অন্য কিছু?
রুপু সারা ঘরে তারা আটকেছে। অন্ধকারে ওরা চিকমিক করে। কী অদ্ভুত লাগে।
খুব দামি পারফিউমের মতো মৃদু শরীরের রুপু কখন বলবে, অন্ধকার কি কাঁপছে মা?
আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করি। সারাঘরে ওর শৈশব ছড়়ানো। এ বি সি ডি। লাল-হলুদ-সবুজ-বেগুনি ব্লক। কথা-বলা সবুজ টিয়াপাখি। গোলাপি রঙের সেলাইখোলা টেডিবেয়ার। আমি অন্ধকারে হাত বাড়়াই। ওর হাসিটা মুছে দিতে চাই। আর কিছু নয়।
বাইরে তখন আকাশ চৌচির করে কেঁদে উঠছে কার চাওয়াগুলো!
সুদেষ্ণার কবিতার মতো এই গল্পও আমাকে কিছুক্ষণ স্তব্ধ করে রাখল। বিষণ্ণতা যেন সুরেলা হয়ে উঠল, গান হয়ে উঠল এই গল্পে, সেইসঙ্গে আসন্ন ভয়াবহ বিপর্যস্ততা ইঙ্গিত দিচ্ছে বিভিন্ন প্রতীকের মাধ্যমে। এই মাপের গল্প তো কমই পড়ি আজকাল বাংলাভাষায়।
গল্পটা পড়তে পড়তে হারিয়ে গিয়েছিলাম এক দুর্বার স্রোতের অবর্তে। ঠিক যেন কোন এক গোলক ধাঁধায় পথ হারানো পথিক। অথবা বলতে গেলে সেই ছোটোবেলায় নিশিপাওয়ার ডাক।