মহিলা কামরা ৭
রূপশ্রী ঘোষ
পূর্বের পর্ব– মহিলা কামরা ৫ ও ৬
মুকুটের পালক
রাজকুমারদা পেয়ারা নিয়ে এসে চুপ থাকতে পারে না। সব দিদিমণিদের মনে করিয়ে দেয় যে, সে হাজির। এক দিদিমণিকে বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকল, দিদিমণি আজ পেয়ারা দেব না? দিদিমণি বাধ্য হয়ে তাঁর প্রবলেম বলতে শুরু করলেন, “আরে নিতেই তো পারি। মুশকিল কি জানো, আমি খেতে ভুলে যাই। ব্যাগে পড়ে থেকে পেকেপুকে একাকার হয়ে যায়, যখন ব্যাগ থেকে পেয়ারা বেরোয় তখন দেখি পচা গন্ধ হয়ে গেছে। এক যদি টিফিন খাওয়ার পরে পরেই খাই তাহলে হয়, যদি পরে খাব বলে রেখে দি তাহলেই গ্যালো। ঠিক আছে তাও দাও ডাঁসা দেখে একটা।”
রাজকুমার ডাঁসা দেখে একটা দিয়ে দিল।
দিদিমণির পাশে আর এক দিদিমণি বসে ছিলেন। উনি বলতে লাগলেন, “তুমি ডাঁসা পছন্দ কর? আমার মেয়েও তাই।”
— “আমার মেয়েরা আবার ডাঁসা একদম পছন্দ করে না, একটু পাকা পাকা হলে তাদের খুব ভালো। বড়ো মেয়ে তো আবার মাঝখান থেকে বীজগুলো খেয়ে খোলাটা ফেলে রাখে।”
— “আমার মেয়ের বাব্বা! একচুল এদিক ওদিক হওয়া চলবে না। না পাকা, না খুব কাঁচা। ওই একেবারে ডাঁসা যাকে বলে সেটাই চাই।”
— “তোমার মেয়ে এখন কি করে যেন?”
— “সে তো মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেছে।”
— “ও তাই? সেটা জানতাম না তো!”
— “হ্যাঁ, ও আগে তো ডেন্টালে পেয়েছিল। সেটায় দিইনি। এবারে মেডিকেলে পেয়ে গেছে তাতে দিয়েছি। তোমার ভাই এখন কি করে যেন? এম ডি করে ফেলেছে?”
— “না, আমার ভাই ছ’বার এম ডি’র চান্স ছেড়েছে। সে তো এম বি বি এস করেই জোকা ই এস আই তে চাকরি পেয়ে গেছিল। সেখান থেকে ছুটি পাচ্ছিল না বলে করতে পারেনি। আর চাকরিটা ও ছাড়তে চায়নি। এবারে এম ডি নিয়ে ভর্তি হয়েছে।”
— “এম ডি করলে টাকা পায় তো?”
— “তা জানি না।”
— “হ্যাঁ এম ডি করলে ওরা একটা পড়ার খরচ পায়।”
— “তা আমি একেবারেই জানি না। তবে ও যে চাকরিটা করত, জোকা থেকে সেই টাকাটা পায় জানি। আর এখানে কত কি পায় একেবারেই জানি না। তবে তার একদম ছুটি নেই। সারা সপ্তাহ যেতে হয়। এবং এক বছর কোনো ছুটি পাবে না।”
— “রুগিও দেখতে হয় তো?”
— “হ্যাঁ, রুগিও দেখে আবার কোর্সটাও করছে।”
— “ওই আমাদের বি এড করার মতোই, তাই না বল?”
— “হ্যাঁ, তাই। তোমার মেয়ে কোথায় পড়ে?”
— “হলদিয়ায়। হলদিয়া মেডিকেল কলেজ।”
— “তাহলে ওখানেই থাকে তো? তোমার কাছে তো থাকে না?”
— “হ্যাঁ, ওখানেই থাকে। তোমার ভাই কোথায় করছে?”
— “আমার ভাই তো কলকাতা মেডিকেল কলেজে।”
— “ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে?”
— “হ্যাঁ, এই জানুয়ারিতেই হল।”
— “ডাক্তার? বউও কি ডাক্তারি করে?”
— “না, ডাক্তার নয়। সে জিওগ্রাফি অনার্স। M.A য়েও করেছে।”
— “না, সাধারণত ডাক্তাররা তো ডাক্তার মেয়েই পছন্দ করে তাই…”
— “ভাই তো বিয়েই করবে না বলেছিল, আমরা দেখে পছন্দ করে দিয়েছি। ভাইয়ের সবই তো জোর করে।”
— “আমার মেয়ে তো প্রেসিডেন্সিতে আগে ভর্তি হয়েছিল, জেনারেল সাবজেক্ট নিয়ে। ওখানে একটা বছর নষ্ট হল।”
— “কি নিয়ে পড়ছিল?”
— “বায়োলজি।”
— “আরে আমার ভাইয়ের তো এই ডাক্তারিতে একদম ইচ্ছে ছিল না। সে ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভালো র্যাংক করেছিল। যাদবপুরে চান্স পেয়েছিল তো। শুধুমাত্র বাবার জন্যে, বাবার ইচ্ছে ছেলে ডাক্তার হোক।”
— “যাদবপুরে চান্স পেয়েছিল মানে তো, ও খুব ভালো ছেলে। জয়েন্ট দিয়ে পেয়েছিল তো?”
— “হ্যাঁ, জয়েন্ট দিয়ে।”
— “আমার মেয়ে তো নিট দিয়ে পেয়েছে। এখন ওয়েস্টবেঙ্গল জয়েন্ট উঠে গেছে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের ছেলেমেয়েদের তো খুব মুশকিল। ওই সেন্ট্রালের সঙ্গে প্রতিযোগিতা। এখন খুব টাফ হয়ে গেছে। লাস্টবার তো অশান্তিও হয়েছে, এই নিয়ে অনেক লেখালেখিও হয়েছে।”
— “ও, আমি জানি না।”
— “হ্যাঁ, আসলে তোমার ভাই যখন পড়ত তখন হয়তো সব জানতে, এখন আর খোঁজ খবর রাখার দরকার হয় না।”
— “হ্যাঁ, তখন সব জানতাম। দেখতাম অ্যানাটমির ক্লাস থাকত যখন ভাই তখন পুরো পাগলের মতো আচরণ করত। বাড়ি ফিরে কারও সঙ্গে কথা বলত না। একটুতেই রেগে যেত সে এক যা তা অবস্থা।”
— “হ্যাঁ ওইসময় তো ওরকমই হয় শুনেছি।”
— “এলাম গো, নামতে হবে।”
দিন আনি দিন খাই
ফেরার ট্রেন। দুপুর হলেও ভিড় ছিল। তাই দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে গেছিলাম। এদিকে তপনদা এসে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আমাকে আনারদানা সাধতে থাকল। আমি না বললেও সে শুনবে কেন। হাজার প্রশ্ন। কেন খাবেন না? মিষ্টি লাগে বলে? তাহলে টক-মিষ্টিটা দেব। বললাম, না কোনোটাই দেবেন না। তারপর তপনদা ব্যাগটা গুছিয়ে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে গেল। আমি তপনদার সঙ্গে কথা শুরু করলাম।
— “প্রতিদিন এক ব্যাগ মাল বিক্রি হয়ে যায়?”
— “না, প্রতিদিন এক ব্যাগ হয় না, তবে মাঝে মাঝে পুরোটা হয়ে যায়।”
— “সকালে কখন বিক্রি শুরু করেন?”
— “সকালে নটার ট্রেনে শুরু করি।”
— “শেষ করেন কটার ট্রেনে?”
— “ওঠা ঠিক নেই, বিক্রির উপর নির্ভর করে। কোনোদিন সাতটা, কোনোদিন আটটা, কোনোদিন বা নটাও বেজে যায়।”
— “আপনার বাড়ি কোথায়?”
— “জায়গার নাম বললেন।”
— “মাল কোথা থেকে কেনেন? বাড়ির কাছেই তৈরি হয়?”
— “না, টিটাগড় থেকে নিয়ে আসি।”
— “অতদূর থেকে? রোজ ওখানে কিনে নিয়ে ট্রেনে উঠে যান?”
— “না না, প্রতি রবিবার যাই মাল আনতে। একবারে অনেকটা মাল নিয়ে আসি, ছদিন বিক্রি করি তারপর আবার রবিবার যাই।”
“দরজার রড ধরে পিন্টু আগেই দাঁড়িয়ে ছিল। তপনদা আর আমার কথোপকথনটা জুলজুল করে তাকিয়ে শুনছিল। তখন আমার মনে হল ওর সঙ্গেও একটু কথা বলা যাক।”
— “তোমার ক’ঝুড়ি মোসাম্বি বিক্রি হয় পিন্টু?”
— “যেদিন যেমন দিদিমণি।”
“পিন্টু দিদিমণি বলেই সম্বোধন করে সবাইকে।”
— “কোনোদিন এক, কোনোদিন দুই। যেদিন টাকার খুব দরকার থাকে সেদিন দুপুরে বিক্রি শেষ করে আবার মার্কেটে চলে যাই। মাল নিয়ে এসে বিকেলের ট্রেনে বিক্রি করি।”
— “মার্কেট কোথায়?”
— “মেছোয়া। সেই কলেজ স্ট্রিট পেরিয়ে যেতে হয়।”
— “তোমার বাড়ি কোথায়?”
— “ডায়মন্ড, দিদিমণি।”
— “কী?”
আমি শুনতে না পাওয়ায় তপনদা বলে দিল — ডায়মন্ড হারবার।
পিন্টু হাসি হাসি মুখ করে বলল, “ওখানে এখন অনেক ইলিশ পাওয়া যায় দিদিমণি। আমাদের এর মধ্যে দশ দিনমতো খাওয়া হয়ে গেছে।”
— “তুমি তাহলে এবার লেবু ছেড়ে ইলিশ বিক্রি করতে পারো ট্রেনে…”
তপনদা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, “না ম্যাডাম ওরম মনে হয় যেখানে যে জিনিসটা পাওয়া যায় সেটার বুঝি দাম কম। আসলে তা নয়। দাম বেশিই থাকে।”
পিন্টু — “হ্যাঁ, দাম কম বলছি না। বলছি খুব পাওয়া যায় এখন।”
তপনদা — “সে সব বাজারেই পাওয়া যায়।”
পিন্টু — “ওখানে অনেক জায়গার ইলিশই পাওয়া যায়। বাংলাদেশ।”
তপনদা সঙ্গে সঙ্গে — “হ্যাঁ, ওই একটা দেশ বলুন। কত মাছ পাওয়া যায়। মাছের অভাব নেই ওদের। আর পদ্মার ইলিশ তো যেকোনো জায়গায় বসেই পাওয়া যায়। আপনি দুবাইতে থাকুন পদ্মার ইলিশ পাবেন, অস্ট্রেলিয়ায় থাকুন, পদ্মার ইলিশ পাবেন… সত্যি।”
আমার নামার সময় হয়ে যাচ্ছে দেখে তপনদা জানতে চাইল, “কোথায় থাকেন? আজ কি আপনি তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন? অন্যদিন তো মনে হয় চারটের ট্রেন হয়ে যায়।”
— “হ্যাঁ আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়েছি।”
— “আজ কি তাহলে টিফিন টাইমে চলে এসেছেন?”
— “কলেজে অমন টিফিন টাইম বলে কিছু নেই। যার যখন ক্লাস শেষ হয় চলে আসতে পারে।”
— “ও কলেজ, আমি ভেবেছিলাম স্কুল। তা কোন কলেজ?”
বললাম।
— “খুব স্টুডেন্টের চাপ তাই না?”
— “না না, একেবারেই না। পাশাপাশি অনেক কলেজ আছে তো তাই খুব বেশি চাপ নেই।”
— “ম্যাডাম থাকেন কোথায়? যান কিভাবে?”
সব শুনে নিয়ে — “এদিকে আসার সময় মনে হয় না, কখন পৌঁছবো? জায়গাটা তো খুব সুন্দর!” বলেই মুচকি হাসি। “বাড়ি ফেরার সময় রিলিফ, তাই না ম্যাডাম?”
— “না না, আমার তেমন মনে হয় না। এটুকু রাস্তা তো আসতেই হয়। বলে হাসলাম।”
আসলে আমি তো গাড়ি, বাস, ট্রেনে করে অনেক দূরে যেতেই ভালোবাসি। তারজন্য কত পা ছড়িয়ে বসে ভাত খেয়েছি। সে এক অন্য গল্প।
যদি আরও অনেক বছর এই কলেজে পড়াই, কলকাতার যেখানেই থাকি না কেন সম্ভবতঃ এই ট্রেনেই যাতায়াত করব। কারো কারো জীবন হয়তো পাল্টে যাবে, হঠাৎ কোনো একদিন থেকে সে আর আসবে না। আবার নতুন অনেকেও হয়ে উঠবে সহযাত্রী। মুখচোরা হলেও ধীরে ধীরে হয়তো আরও কারো কারো সঙ্গে আমারও পরিচয় হয়ে যাবে। দশ মিনিট স্টেশনে অপেক্ষা, আর ট্রেনে পনেরো – কুড়ি মিনিট মিলিয়ে দিনে মাত্র আধঘন্টা। তাও জীবনের একটা অংশ এই ট্রেনে যাত্রা, এই মহিলা কামরা।
(ক্রমশ)
লেখাটি ভালো লাগলে, আবহমানের জন্য আপনার ইচ্ছেমতো অবদান রাখতে পারেন
এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে ফোন পে-র মাধ্যমে।
এই অবদান একেবারেই বাধ্যতামূলক নয়।
স্ক্যান করার জন্য কিউ আর কোড–