নিকারাগুয়ার কাব্য ৫
জায়কান্দো বেলির কবিতা (দ্বিতীয় পর্ব)
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার
পারস্যে একসময় জরথুস্ট্রীয় দ্বৈতবাদ, ব্যাবিলনীয় লোককথা, অন্যান্য পৌত্তলিক ধর্মাবলী, বৌদ্ধ নীতি এবং খ্রিস্টধর্মের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণে তৈরি হয় মানিবাদ। এই ধর্মের প্রবক্তা ছিলেন ইরানের ধর্মপ্রচারক মানি। এশিয়া ছাড়াও সমগ্র রোমান সাম্রাজ্য জুড়ে এই ধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল। টিঁকে ছিল প্রায় হাজার বছরের কাছাকাছি। দক্ষিণ চিনের কিছু কিছু অঞ্চলে এখনও এই ধর্ম্যাভ্যাস প্রচলিত আছে, যদিও তা খুবই গোপনে। মানিবাদ অনুযায়ী ঈশ্বর এবং শয়তানের দ্বন্দ্ব চিরন্তন, এবং এই দ্বন্দ্বে মানুষ ঈশ্বরের প্রতিনিধি। নিকারাগুয়ার সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও ধ্যান-ধারণায় মানিবাদ খুব সূক্ষ্মভাবে মিশেছিল। জায়কান্দো বেলি তাঁর কবিতা 'যৌনতার ক্ষুদ্র পাঠ, আমি'তে নিকারাগুয়ার মানিবাদকে ভিন্নভাবে ব্যবহার করলেন। আদম এবং ইভের গল্পে প্রবৃত্তির আরেক নাম পাপ। সেই পাপে প্ররোচিত করে শয়তান। জায়কান্দো বেলি শয়তানকে অস্বীকার করলেন না, তবে এই অতিসরলীকরণকে অতিক্রম করে গেলেন। বললেন, সকল প্রকার কর্ষণই সংস্কৃতির আদিমন্ত্র ।
কর্ষণের আগে আগে কৃষক মাটিকে যোগ্য করে তুলতে আগাছা নিড়ান, মাটির শক্ত ঢেলা ভেঙ্গে মিহি করে, শক্ত পাথরগুলি সযত্নে সরিয়ে প্রস্তুত করেন তাকে। অতঃপর বীজবপন ও প্রাণের উদগম। সেই যে সম্পূর্ণ নগ্নতা, সেখানেই তো গর্ভের স্পন্দন ও প্রতিশ্রুতি। ‘আমি’ কবিতায় বেলি সেই প্রতিশ্রুতিময় নগ্নতাকে তুলে ধরেন।
“আমি তোমার শয্যা
তোমার মৃত্তিকা
তোমার অলাবু
আমার ভেতরে তুমি উপচে পড়ো,প্রতিটি বিন্দু
এই বীজ আমার বড় প্রিয়
তাই তো ধারণ করি”
জায়কান্দো বেলির কবিতা পড়তে গেলে বারবার মল্লিকা সেনগুপ্তর কবিতা মনে পড়ে
“খসম তুমি চাবুক মারো
তোমায় ভালবাসতে বাসতে
ভাবতে ভাবতে তোমার কথা
কুড়ুল মারি নিজের পায়ে
তোমায় ভালোবাসি বলেই
লুকিয়ে রাখি অশ্রুফোঁটা
কিন্তু গোপন হয় না আমার
গোলাপ ফুলের রক্তক্ষরণ
তোমার সঙ্গে বাইশ বছর
তোমার জন্য পুত্র প্রসব
জীবনযাপন জীবনযাপন” (শাহবানু জন্ম)
‘যৌনতার ক্ষুদ্রপাঠ, আমি’ কবিতায় বেলি যতিচিহ্নকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করেন। যেখানে থাকার কথা,অনেকসময় সে সেখানে থাকে ন।যেন যা তিনি বলতে চান, সেই আবেগ, সেই উত্তাপ ও উদযাপন যতির আঘাত লেগে চূর্ণ হয়ে যেতে পারে।
যৌনতার ক্ষুদ্রপাঠ, আমি
জায়কান্দো বেলি
অনুবাদে শ্যামশ্রী রায় কর্মকার
১.
শরীরের পূর্ণ দৈর্ঘ্যে ভেসে বেড়ানোর অর্থ
পৃথিবী প্রদক্ষিণ, কম্পাসরহিত অষ্টবায়ুতে নৌযাত্রা
ঢেউয়ের বিরুদ্ধে যাওয়া দ্বীপ উপদ্বীপ খাড়ি তরঙ্গবাঁধ
তেমন সহজ নয়, তবু ভালো লাগে
একদিন বা একটি রাত্রিতে শয্যাকে প্রবোধ দিতে দিতে
সমাপন করে ফেলবে, এমন ভেব না
রন্ধ্ররহস্য বহু চাঁদকে ভরিয়ে তুলতে পারে
২.
শরীর সংকেতশব্দে সাজানো একটি জন্মপত্রিকা
নক্ষত্রের খোঁজ কর
হঠাৎ প্রবল ঝড় অথবা শ্রবণভেদী চিৎকার এসে
তোমাকে যদি ভীত করে তোলে, হয়তো বদলে নিতে পারবে যাত্রাপথ
কররেখায় যে বাঁক তুমি আশা করোনি
(৩)
সমূহ বিস্তার ধরে বারংবার যাও
শ্বেত পদ্ম ফুটে থাকা জলাশয় আবিষ্কার কর
তোমার নোঙর দিয়ে আদরে ভরিয়ে দাও পদ্মের গহন
গভীরে ঝাঁপাও, হয়ে ওঠো ছিলাটান
সুগন্ধ, লবণ, মধু থেকেও নিজেকে যেন বঞ্চিত কোরো না
গুরু হয়ে আসা বায়ু, শাসাঙ্গে বাদল মস্তিষ্কের গভীর কুয়াশা
পায়ে ভূকম্পন
চুমুর ঘুমন্ত জোয়ার
(৪)
নিজেকে স্থাপন করো গলিত মাটিতে, ক্ষয়কে ভয় কোরো না, ধীরে যাও, ধীরে
শৃঙ্গের আরোহী হবে, এ আশা কোরো না
দূরে থাকো, দূরে থাকো নন্দনকাননদ্বার থেকে
পতিত যে দেবদূত, দোলা দাও তাকে
দখল হয়ে যাওয়া আগুন-তলোয়ারকে অরণ্যে হারিয়ে যেতে দাও
আপেল দংশন করো এইবার
(৫)
সমুদ্রের যেমন সৌরভ আছে
ব্যথাও তেমন সুরভিত
হে লালা, পরস্পর চোখে চোখ রাখ, নিজেকে গর্ভিনী করে তোল
ক্রন্দনরত যে ত্বক পিচ্ছিল হয়ে ওঠে, সেই ফুলছাপের ওপর
নিজেকে গড়িয়ে দাও
পদযুগলের শেষে আবিষ্কারের মূল্য দাও
অন্বেষণ কর, খোঁজ পথের গোপন কথা, গোড়ালির আকার
খিলান-পদক্ষেপ, উপসাগর কীভাবে সেই সব পদক্ষেপ গড়ে দেয়
স্বাদ নাও তার
(৭)
কানের ঝিনুক কী বলে, শোনো
ভেজা ভাব কীভাবে গোঙায়
কানের লতিকা অধরসমীপে যায়, শ্বাসধ্বনি বাজে
বর্ষণ উত্তাল হয় ছোট ছোট পাহাড়ের মতো
আশ্লেষিত ত্বকের দ্রোহ ও কাঁপন বুকের সমুদ্রে শান্ত সেতুর মতো গ্রীবা নেমে আসে
হৃদির জোয়ার তার কাছে ফিসফিস করে বলে
খুঁজে নাও গুহাজল, খোঁজো
অশ্লীলতার সংজ্ঞা ব্যক্তি বিশেষে বদলে যায়। ডেভিডের যে মূর্তি শিল্পের প্রতীক হিসেবে নন্দিত ও বন্দিত হয়ে এসেছে এতকাল, কোনও এক দেশের স্কুলে সেই ডেভিড শ্রেণীকক্ষে অশ্লীলতার প্রতীক হয়ে ওঠে। বহু সমালোচক নিকারাগুয়ার কবিতাকে গদ্য কবিতা বলে নস্যাৎ করতে চেয়েছেন। তাঁরা পরিশীলিত কবিতায় বিশ্বাসী। তাঁদের মতে স্টকমার্কেটে ওঠাপড়া, খালি মদের বোতল, আধখাওয়া সিগারেট বা বিবর্ণ ছেঁড়া প্লাস্টিক কবিতার বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পারে না। এই ধরনের কবিতা তাঁদের কাছে অস্বস্তিকর, অশ্লীল। আর্নেস্তো কার্ডেনালের কবিতাকেও এই নিন্দার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। কিন্তু তাঁরা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন যে “মৃত্যু কোনও শেষ নয়, ভিন্ন সম্ভাবনা, আয়ুষ্কাল”।
এই স্টকমার্কেটের উত্থানপতন নিয়ে আতঙ্ক, খালি বোতল, আধ খাওয়া সিগারেট বা ছেঁড়া প্লাস্টিক অতিবাহিত সময়ের কথা বলে। এরা যেন এক একটা মুহূর্তের মৃতদেহ। তাই এই কবিতা আসলে পুনরুত্থানের জন্য প্রতীক্ষার মতো। স্টকমার্কেটে ওঠাপড়া নিয়ে আতঙ্কের সঙ্গে ভাল ফসলের জন্য বা সফল বাণিজ্যের জন্য স্তোত্রপাঠের সঙ্গে আসলে কি তেমন কোনও পার্থক্য আছে? এও তো লক্ষী বা কুবেরের উপাসনা। আরেকটু ভাল করে বেঁচে থাকবার আবহমান প্রয়াস। যে জীবন গদ্যময়, প্রাসঙ্গিক ও দৈনন্দিন, নিকারাগুয়ার কবিতায় সেই জীবনের কথা আছে। জায়কান্দো বেলির আরেকটি অবশ্য উল্লেখ্য কবিতা “শ্বেত কুমারী” বা “হোয়াইট ভার্জিন” যেমন একটি সুরনন্দিত উপাখ্যান, মেয়েদের ঋতুমতী হয়ে ওঠার পায়ে একটি পুষ্পিত অর্পণ।সেই কবিতা আসাম এবং বাংলায় অম্বুবাচী পালনের কথা মনে করায়, কামাখ্যা মন্দিরে ঋতুমতী ও উর্বরা দেবীর উপাসনার কথা। জায়কান্দো বেলির কবিতা তাই জীবনের কথা বলে, জীবনকে উদযাপন করতে বলে।