তিরন্দাজির পথে, জেন <br /> নবম পর্ব  <br /> পার্থজিৎ চন্দ

তিরন্দাজির পথে, জেন
নবম পর্ব
পার্থজিৎ চন্দ

‘জেন’- শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে চলা রহস্যময়, মিস্টিক এক সাধনপদ্ধতি; প্রাচ্যের সুগভীর দর্শনের একটি ধারা, যে ধারার মধ্যে মিশে রয়েছে পারমিতার ছায়া, ‘না-জানা’র মধ্য দিয়ে জানার গূঢ় পদ্ধতি। একটি সুবিখ্যাত জেন-কবিতায় পাওয়া যায়, ‘Sitting quietly, doing nothing / Spring comes, and the grass grows itself’। এই ‘কিছুই না-করা’র পদ্ধতি অর্জন করতে হয় দীর্ঘ অনুশীলনের মাধ্যমে। আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের এই ধারার সঙ্গে তিরন্দাজির মতো একটি শৌর্যময় বিষয়ের কি কোনও সংযোগ থাকতে পারে? তিরন্দাজি কি শিল্প? এই শিল্পের মধ্যে দিয়ে কি প্রবেশ করা সম্ভব জেন-এর মিস্টিক পৃথিবীতে? আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল অয়গেন হেরিগেল-এর ‘Zen in the Art of Archery’। ব্যক্তি-অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ এ কাহিনি যেন এক রোমাঞ্চকর শান্ত থ্রিলার, ইউরোপের চোখে ‘জেন’ দর্শন অথবা ভিন্নধারার ডিসকোর্স।

নবম পর্ব

জাপানে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় কেটে গেল, একদিন গুরুজি বললেন, ‘এবার তোমাদের একটা পরীক্ষায় ঊত্তীর্ণ হতে হবে, সেখানে শুধুমাত্র তির ছোড়ার দক্ষতা দেখা হবে না। একজন তিরন্দাজের আধ্যাত্মিক উন্নতির বিষয়টি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ, সেটাও দেখা হবে। আমি চাই দর্শকের উপস্থিতি যেন কোনও সময়ে তোমাদের মনঃসংযোগে চিড় ধরাতে না পারে। নিজের মধ্যে ডুব দিয়ে, অন্য কোনও দিকে মন না-দিয়ে শুধু নিজের কাজ করে যাবে।’
গুরুজি তারপর এ নিয়ে আর একটাও বাক্য-ব্যয় করেননি, আমাদের মনের মধ্যে গুরুজির বলা পরীক্ষার বিষয়টি ঘুরতে থাকত। মাঝে মাঝে কয়েকটি তির ছোড়ার পর অনুশীলন শেষ হয়ে যেত। পরের কয়েক সপ্তাহ এভাবেই কেটে গেল। বাড়িতে অনুশীলনের কাজ দেওয়া হত, ঠিকঠাক শ্বাস নেবার মধ্যে দিয়ে প্রতিটি পদক্ষেপ মেনে তির-ছোড়ার বিষয়টি সেরে নিতাম আমরা।
আমরা গুরুজির দেখানো ও শেখা্নো পথেই অনুশীলন করতাম, কিন্তু ধীরে ধীরে আবিষ্কার করছিলাম তিরন্দাজির মধ্যে যে নৃত্যের ছন্দ লুকিয়ে রয়েছে তির-ধনুক ছাড়া তাকে কিছুতেই প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। আমাদের অবচেতন মন চলে যাচ্ছে তিরধনুকের দিকেই।
শরীরকে শিথিল করার বিষয়ে যত মনযোগ দিতাম এ বিষয়টি মনের মধ্যে তত চেপে বসত। কিন্তু বাড়িতে তির-ধনুক নিয়ে অনুশীলন করার সময় ম্যাজিক ঘটে যেত, গভীর প্রশান্তির ভেতর ডুবে যেতে তখন কোনও অসুবিধা হত না। সে মুহূর্তে আমাদের মধ্যে উদ্বেগের লেশমাত্র থাকত না; দর্শক থাকবে, না থাকবে-না সে নিয়ে কোনও চিন্তা থাকত না।
সব শেষে পরীক্ষার দিন এসে গেল, আমরা সবাই এত ভাল ভাবে ঊত্তীর্ণ হয়ে গেলাম যে গুরুজিকে কিছুই বলতে হল না। দর্শকরা আমাদের কৃতিত্ব নিজের চোখে দেখে নিয়েছে, এখন তাদের কাছে আর কিছু ব্যাখ্যা করার নেই। তিনি ওখানেই আমাদের স্বীকৃতি দিয়ে দিলেন। এখন থেকে আমরা তিরন্দাজির অন্দরমহলের বাসিন্দা; শুধু তাই নয়, আমাদের কাছে গুরুজির দেওয়া প্রাথমিক ডিগ্রি রয়েছে। সে বড় আনন্দের দিন। সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মতো সে অনুষ্ঠান শেষ হল, শেষের আগে গুরুজি দুটি তির নিক্ষেপ করলেন। সে এক দেখার মতো বিষয়। কয়েক দিন পর আমার স্ত্রী’ও একটি প্রতিযোগিতার শেষে ইকেবানায় সর্বোচ্চ-স্তরের স্বীকৃতি পেল।
এরপর থেকে অনুশীলনের ধারা বদলে গেল, এখন আর তিরের পর তির ছুড়ে যেতে হয় না। কয়েকটি তির ছুড়েই গুরুজি তিরন্দাজির মহান ঐতিহ্য নিয়ে কথাবার্তায় চলে যান। যে পর্যায়ে আমরা এসে পৌঁছেছি সেখানে আমাদের তার যোগ্য হয়ে উঠতে হবে, বারবার এ কথা বলেন। তাঁর কথার মধ্যে অনেক রহস্যময় উপমা, অনেক চিত্রকল্প… কিন্তু সামান্য ইঙ্গিতেই আমরা এখন বুঝতে পেরে যাই তিনি কী বলতে চাইছেন। তাঁর কথার বেশিরভাগ অংশ জুড়ে থাকে ‘শিল্পশূন্য’ শিল্পের ‘হয়ে’ ওঠার কথা। একজন তিরন্দাজকে দক্ষতার চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছাতে গেলে এই বিষয়টি আত্তিকরণ করা সব থেকে বেশি দরকার।
বিষয়টি আর একটু বিশদে বলা দরকার; বিষয়টির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে ‘কাল্পনিক সত্য ঘটনা’র মতো কয়েকটি জিনিস। ‘শিল্পশূন্য’ শিল্পের একজন প্রকৃত সাধকের কাছে খরগোশের শিং বা কচ্ছপের চু্লের মতো অলীক জিনিসও তির হয়ে উঠতে পারে। আবার এই তিনিই খরগোশের শিং বা কচ্ছপের চুলের সাহায্য ছাড়াও লক্ষ্যভেদ করতে পারেন। যখন তিনি সেটা পারবেন তখনই তিনি প্রকৃত গুরুর উচ্চতায় আরোহণ করতে পারবেন। তখন তিনি নিজেই রূপান্তরিত হবেন শিল্পশূন্য শিল্পের ধারকে; তখন তিনি একাধারে হয়ে উঠবেন গুরু এবং ‘গুরু নন’ এমন এক অস্তিত্ব।
তিরন্দাজির এ পর্যায়ে এসে সমস্ত চলাচল স্তব্ধতায় রূপান্তরিত হয়, নৃত্যহীন কী যেন নৃত্য করতে শুরু করে। জেনের ভেতর তার ছায়া পড়ে।
কিন্তু আমার মন বিষণ্ণ হয়ে উঠছিল একটূ একটু করে, একদিন গুরুজিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এরপর তো আমরা ইউরোপে ফিরে যাব, আপনাকে ছাড়া আমাদের তিরন্দাজি কীভাবে চলবে?’
‘যেদিন তোমাদের চূড়ান্ত পরীক্ষা নিয়েছিলাম সেদিনই এ প্রশ্নের উত্তর তোমার পেয়ে যাবার কথা। তোমরা এখন এমন এক স্তরে গিয়ে পৌঁছেছো যেখানে গুরু ও শিষ্য একই ব্যক্তিতে পরিণত হন। এখন থেকে তুমি যে কোনও সময়ে আমাকে তোমার থেকে পৃথক করতে পারবে। আমাদের মধ্যে অসীম সমুদ্র শুয়ে থাকলেও আমি তোমাদের মধ্যে থাকব, এতদিন তোমরা যা শিখেছ তার মধ্যে দিয়েই তোমরা আমাদের অস্তিত্ব অনুভব করবে। এখন আমার আর প্রতিদিন অনুশীলন করবার কথা মনে করিয়ে দেবার দরকার নেই, আবার এটাও আশা করি যে কোনও অজুহাতেই তোমরা নিজেদের অনুশীলন থেকে বিরত রাখবে না। তিরন্দাজি অনেকটা পবিত্র উৎসবের মতো, তিরধনুক ছাড়া ঠিক মতো শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়েও তোমরা অন্তত প্রতিদিন এর অনুশীলন করতে পারো। কিন্তু আমার নিজে মুখে এসব তোমাদের বলার প্রয়োজন নেই; কারণ আমি জানি তোমরা এই আধ্যাত্মিক অনুশীলন ছেড়ে থাকতে পারবে না। আর একটা কথা, আমাকে চিঠি লেখার দরকার নেই; মাঝে মাঝে অনুশীলনের ছবি পাঠাবে, তাতেই হবে। ছবি দেখে আমি বুঝতে পারব তোমরা কীভাবে ধনুক তুলছ। ওর মধ্যে দিয়েই আমার যা জানার জানা হয়ে যাবে।’
গুরুজি আপনমনে কথাগুলি বলে যাচ্ছিলেন, যেন ঋষির কথা শুনছিলাম আমরা। গুরুজি অতিগুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কথা আমাদের জানাতে চাইছিলেন দেশে ফেরার আগে। তিনি আবার বলতে শুরু করেছিলেন, ‘আর একটা বিষয়ে তোমাদের সতর্ক করা দরকার। এই কয়েক বছরে তোমরা নতুন মানুষে রূপান্তরিত হয়েছ। তিরন্দাজির এটিই ঐতিহ্য, তিরন্দাজের জীবনে সে গভীর, সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন নিয়ে আসে। এখন হয়তো তোমরা পরিবর্তনটা ঠিক বুঝতে পারছ না, কিন্তু দেশে ফিরে গিয়ে বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা হলে কথাবার্তা হলেই বুঝবে। বুঝবে তারা তোমার কাছে আর আগের মানুষ নেই; তুমিও তাদের কাছে অনেকটা বদলে গেছ। তুমি তখন তাদের অন্য চোখে দেখবে, তারাও তোমাকে অন্য চোখে দেখবে। এটা আমার ক্ষেত্রেও হয়েছিল, যাঁরা যাঁরা জেনের আত্মা একবার স্পর্শ করেছে তাঁদের সবার ক্ষেত্রেই এই একই ব্যাপার ঘটে।’
অবশেষে বিদায় সম্বর্ধনার দিন এগিয়ে এল, এটিকে বিদায়-অনুষ্ঠান বলা যেতে পারে, আবার নাও যেতে পারে। গুরুজি আগেই বলে দিয়েছেন তিনি আমাদের মধ্যে কীভাবে থেকে যাবেন। ফলে তাঁর থেকে বিদায় নেবার কোনও উপায় নেই। গুরুজি আমার হাতে তাঁর সব থেকে ভাল ধনুকটি তুলে দিলেন। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি কথাও বললেন, ‘তুমি যখন এই ধনুক তুলে ধরবে তখনই আমার অস্তিত্ব অনুভব করবে। অনেকেই নিছক কৌতুহলবশত তোমার কাছে আসবে, তাদের কারও হাতে কোনওদিন এ ধনুক দিও না। কারণ তিরন্দাজি নিছক কোনও কৌতুহলের বিষয় নয়। ধনুক তুলে ধরার জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, তিলে তিলে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। আর একটা কথা, একদিন এ ধনুক পুরানো হয়ে যাবে, জীর্ণ হয়ে যাবে। তখন এটিকে আমার স্মৃতি হিসাবে রেখে দেবার কোনও চিন্তা যেন মনে না-আসে। ধনুকটিকে ধ্বংস করে ফেলবে, পারলে পুড়িয়ে ফেলবে… শুধু যেন এক মুঠো ছাই ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট না-থাকে।’

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)