
এক রাজার রাজত্বে
সৃজন দে সরকার
সে অনেককাল আগের কথা নয়। এক দেশে এক রাজা ছিলেন, বিরাট সে দেশের রাজা ছিল সে একাই। সে দেশের জন্যেই হোক বা অন্য কারণেই হোক, রাজার মনে সুখ ছিল না মোটে। ওদিকে দেশের মানুষ সবাই মুখে হাসি নিয়ে ঘোরাফেরা করে, সবাই রাজার নামে জয়ধ্বনি দেয়। তবুও, রাজা যেন কোন সুখ পান না তাঁর রাজত্বে।
অনেক ভেবেচিন্তে একদল সেপাহী নিয়োগ করলেন দেশের ভিতরে। বলা হল, সেপাহীরা পাহারা দেবে, দুঃখ-সুখে, কান্না-হাসির সাক্ষী হয়ে থাকবে তারা দেশের মানুষের পাশে। রাজা ৩মাস সময় দিলেন সেপাহীদের। দেখতে দেখতে ৩মাস পাড় হয়ে গেল। রাজা দূত পাঠিয়ে জানতে পারলেন, দেশের মানুষ আর আগের মতো হাসে না, তারা ভয়ে ভয়ে শুধুই কাজ করে। মাঠের ফসলে সেই সবুজ রঙ আর অবশিষ্ট নেই, সব কেমন যেন ফিকে হয়ে এসেছে। বাদলার মেঘ সমস্ত আকাশটাকে গম্ভীর করে রেখেছে। নদীর গতিও যেন আর আগের মতন নেই।
তবে, কাজ হচ্ছে, রাজকোষের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে শুনে রাজার মুখে খানিক হাসি ফুটল। কিন্তু, মনে মনে যেন বা একটু দমেও গেলেন তিনি। আবার ভেবেচিন্তে একদল পুরোহিতকে ডেকে পাঠালেন। তাদের প্রতি আজ্ঞা হল, দেশের মানুষের কাছে দেবতার নাম-গান শোনানোর। তাদের জন্যেও সময় বেঁধে দেওয়া হল ৩মাস।
পুরোহিতেরা খোল-করতাল নিয়ে মেতে উঠল। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় নানা সুরতানের ধ্বনি ভেসে আসে। রাজপ্রাসাদের বিরাট প্রকারের দেওয়ালে সেসব এসে জড়ো হয়। তাই, রাজা সেসব শুনতে পান না। তিনি মনে মনে ভাবেন, এবার বুঝি দেশের লোকের মন খানিক শান্ত হবে, ভয়-ডর কেটে যাবে।
আবারও, ৩মাস পাড় হয়ে যায়। পুরোহিতেরা কেমন কাজ করেছেন, সে খবর আসে দূতের মুখে। দূত জানায়, দেশের মানুষের ভয় আর তাদের চোখে মুখে প্রকাশ পাচ্ছে না। মাঠের ফসল কেমন পাংশুটে রকমের হয়ে এসেছে। সারাদিন দেশের ওপরে ভেসে চলা মেঘেরা সবাই যেন মরাকান্নার মতো ঝির্ঝির্ করে বৃষ্টি দিয়ে চলেছে। আর নদীর সেই মাতলামি আজ আফিমের ঘোরের মতো নিশ্চল ভক্তিতে শান্ত হয়ে উঠেছে।
শুনে রাজার মনে পুরোহিতদের প্রতি সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধা দুই’ই জাগে। তিনি ভাবেন, নিশ্চয়ই এসব করে দেশের মানুষ ও প্রকৃতিকে স্বীয় ইচ্ছার শৃঙ্খলে বাঁধতে পেরেছেন তিনি। তবু, যেন একটা খটকা লেগেই থাকে। বছরের মধ্য-গগনে এসে দাঁড়িয়ে এবারে পালা বেনিয়ানদের হাতে দেশকে তুলে দেবার। সেই কথা মত, দেশের দায়িত্ব ভার তুলে দেওয়া হবে বেনিয়ানদের। দেশবিদেশের নানা নামজাদা বেনিয়ান রাজসভাতে হাজির হলেন। তাদেরকে দেশের সমস্ত সম্পদ বুঝে নিতে নির্দেশ দিলেন রাজামশাই। খাজাঞ্চির কলমের কালি প্রায় শেষ করে রাজকোষ পূর্ণ করে বেনিয়ানেরা ঘোড়া হাতি দাপিয়ে চলল দেশ-দখলী ব্যবসা করতে।
রাজকোষ পূর্ণ হলে সাধারণ রাজা বিলাসী জীবনের চৌকাঠ পাড় করে গেলেন। ৩মাস যে কোথা দিয়ে কেটে গেল, সেটা সোনার টুংটাং আর হীরের ঝলকের ঘোরে খেয়াল করলেন না রাজা। এমনিই একসময় দূত জানালে, বেনিয়ানেরা দেশের সর্বস্বই দখল করেছে। রাজদূতের ইস্তেহার অনুযায়ী, দেশের খবর আনতে যাবার উপায় নেই। সে রাজার কাছে মার্জনা চাইলে এসে।
এবারে, বুঝি আবার তিনি হীরের খোঁচা অনুভব করলেন। যে বিরাট দেশের মানুষের জন্যে, সেই মানুষদের দ্বারা আজ তিনি রাজা হয়েছেন, সেই বিরাট দেশের মানুষদের থেকে কোন খবর না পেলে খুবই চিন্তিত হয়ে উঠলেন তিনি। রাজদূতকে দিয়ে যে কাজ হবে না, সে কাজ হতে পারে একমাত্র একজনকে দিয়ে। সে হলেন গ্রামের একজন দরিদ্র চারণকবি। রাজা তলব করলেন তাকেই। সে আসলে, রাজা জানালেন বেনিয়ানদের দখলে গিয়ে মানুষজন কেমন আছেন তা জানতে তাঁর বড্ড ইচ্ছে হয়। কবি যদি সে কাজটি করে তাঁর রাজত্বের কীর্তনকাব্য লেখেন।
রাজার পাশেই ছিলেন খাজঞ্চি। তার প্রায় ফুরিয়ে আসা নীল কালির কলমটি রাজা কবিকে দিতে অনুরোধ জানান। কারণ, গরিব কবির নিজস্ব কলম ছিল না। সে বাড়ি বাড়ি ঘুরে তার শূন্য দোয়াতে খানিক কালি ভিক্ষে করে আনত। আর সেই দিয়েই সে কাব্য লেখায় মগ্ন হয়ে উঠত। খাগের ডগা কেটে কলম বানিয়ে নিত। সে তাই নিয়ে এসেছিল সেদিন। কিন্তু, দোয়াত তার তখনও শূন্য। রাজার কাছে সেটুকু প্রার্থনাতে একটা আস্ত কলম প্রাপ্তি হবে সে ভাবেনি। সে কলমখানি মাথায় ঠেকিয়ে জানায়, দেশের মানুষের জন্যে প্রয়োজন হলে সে রাজার দপ্তরী কলমখানি ব্যবহার করবে। সে দামী কলম, দামী তার কালি। সে কি মিছি-মিছি খরচ করা চলে! এতেক বলে আবার ৩মাসের জন্যে কবি রাজাকে প্রণাম জানিয়ে বিলাসী জীবনের চৌকাঠ ছেড়ে গেয় মাটির পথে নেমে এলো।
এবারে যেন মাস তিনেক কাটতেই চায় না। বেনিয়ানেরা আর রাজার দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখে না। দিন-দিন বোঝাই জাহাজ, বোঝাই গাড়িতে সমস্ত দেশের সম্পদ পাড়ি দিচ্ছে অন্যত্র, দেশের মানুষের কথা জানতে পারছেন না তিনি। কিন্তু, তাঁর নিজের অবস্থা আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পড়তে থেকেছে, কোন কাজে মন বসে না। কোন কিছুতেই আর আগের মতো আমোদ পান না। বসে বসে ফুরিয়ে আসা গচ্ছিত রাজভান্ডারের দিকে চেয়ে শঙ্কিত মনে দিন গোনেন। হয়তো একদিন ৩মাস শেষ হয়ে এল।
রাজপ্রাসাদের অনেক সেপাই, রাজকর্মচারী বেতনের অভাবে বিদায় নিয়েছে আস্তে আস্তে। রাজার কাছের মানুষজনও আজকাল রাজার সাথে তেমন সাক্ষাৎ রাখেন না। শুধু, ‘আমি রাজা’ এই ভাবনাটুকু সম্বল করেই তিনি একদিন দিন গুনতেই ভুলে যাবেন, এমন সময় কবি এসে হাজির হলেন।
কিছু পুঁথি সঙ্গে করে কবি ফিরে এসেছে। রাজা জানতে চাইলে কবি জানায়, এসমস্তই তাঁর প্রস্তাবিত রাজ্যের কীর্তনকাব্য মাত্র। উৎসাহী রাজা নিজে সিংহাসন থেকে নেমে এসে দেখতে থাকলেন সেসব পুঁথির পাতা।
কিন্তু একী! কবি তার সঙ্গে এমন তঞ্চকতা করবার সাহস রাখে কি করে! রাজা অত্যন্ত রাগের সঙ্গে তৎক্ষণাৎ সেসব পুথি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন কবির ওপরে।
কবি নিতান্ত সাধারণ মানুষ। সে রাজাকে প্রণাম জানিয়ে বলেন, গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে সে নিজে ঘুরে এই কাব্য সকল লিখেছে। সে রাজার সমস্ত আদেশ পালন করেছে। কিন্তু সে কাব্য লেখার জন্যে রাজার কলম ব্যবহার করেনি। সে প্রতি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে তার নিজের শূন্য দোয়াত। সেই দোয়াতে সমস্ত রাজ্যের মানুষ ভরিয়ে দিয়েছেন কালি, তাঁদের শ্রমের মেহনতি ঘাম আর দুঃখের চোখের জলে। সেই স্বচ্ছ তরল কালিতেই কবি সেসব কাহিনী লিখে গেছেন।
পুঁথির পাতাগুলি রাজা আবার ভালো করে দেখলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, তাতে নানা কিছু আঁকিবুঁকি করা হয়েছে। কিন্তু তাতে যে কি লেখা হয়েছে তা স্পষ্ট করে বুঝতে পারা যাচ্ছে না আর। হয়তো এটাই সত্যি যে মেহনত আর দুঃখের কাহিনী পড়া যায় না, সেসব অদৃষ্টই থেকে যায়।
এমন মুহূর্তে রাজা নিজের কলমটির কথা জিজ্ঞেস করতে কবি তাঁকে জানান, তাতে অবশিষ্ট কালি কবি ছুঁইয়ে দিয়েছেন শান্ত নদীর গায়ে, সে নদী কেমন চক্মকি পাথরের নাচের তালে-তালে ঝর্ঝর করে বইছে। সেই কালির কলম কবি ছুঁইয়ে দিয়েছেন, মরা আকাশের গায়ে, দিতেই মেঘে মেঘে নীল রঙ আনন্দের ওড়না উড়িয়ে হেসে উঠেছে, মঠে মাঠে খিলখিলিয়ে খেলা করে বেরাছে রোদ্দুর। আর সেই কলমকে ছুঁইয়ে দিয়েছেন রাজার রাজত্বয়ের সকল মানুষের ঘরের উনুনে উনুনে। সেখানে উঠেছে নীল আগুনের শিখা, পেটের খিদের আগুণকে নিভাতে দমকে দমকে জ্বলে উঠছে উনুন। নদীর জলে, আকাশের হাসিতে মাঠে মাঠে ফলছে ফসল, জেগে উঠেছে সমস্ত মানুষজন।
রাজা নিজের হাতে দেখলেন, ফেলে দেওয়া পুঁথির থেকে সামান্য মাটি লেগেছে তার হাতেও। কবি তাঁকে প্রণাম জানিয়ে বললেন, ‘রাজামশাই আমার কাজ যে এবারে ফুরালো।’
রাজা কবির কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘না এবারেই তো তোমার কাজ শুরু হয়েছে, বছর ঘুরেছে। চলো, মাটির পথে নেমে আমরাও হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করি। আমি আর রাজা নই, আমিও তোমাদের সকলের সাথে এই সুখের হাসিটুকুই হাসতে চাই, রাজা হয়ে থাকলে আমি বেশিদিন বাঁচব না। তোমাদের কাজই তো আসলে আমার কাজ, সেখানেই তো আসল শান্তি। চলো কবি, আমরা মিলিত ভাবে আমাদের কাব্য লিখতে শুরু করি, আজ থেকেই…এখনি…’