অবিরাম, ভস্মে ঢাকা নদী
পার্থজিৎ চন্দ
আসলে এমন ভাবনার মধ্যে হয়তো কোনও ‘যুক্তি’ নেই এবং যুক্তি নেই বলেই তা আমার কাছে গৌতমের ‘রসাতল’এর মতো সুন্দর রহস্যময় ঘাতক। গৌতম বসুর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। লিখলেন রসাতল নিয়ে পার্থজিৎ চন্দ
নতুন শতাব্দী শুধু নয়, নতুন সহস্রাব্দ…একটি কাব্যগ্রন্থ ধীরে আবির্ভূত হল বাংলা কবিতার পাঠকদের কাছে। তার আগে গৌতম বসু’র ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’ (১৯৮১) ও ‘অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে’ (১৯৯১) প্রকাশিত হয়েছে। বই দু’টি দশক অতিক্রম করে বাংলার তরুণ কবিতাপাঠকদের কাছে প্রিয় ও রহস্যময় হয়ে উঠেছে। বাংলার কবিতাপাঠক অনুধাবন করেছেন, সন্ধান পেয়েছেন এক চিরপথিকের।
সে পথিকের যাত্রা অন্তরালাশ্রিতা গূঢ়তর এক মহাদেশের উদ্দেশ্যে, শিখর-আরোহনের বাসনায় নয়, বরং বৌদ্ধ-পরিব্রাজকদের মতো, মহাজন ও পদকর্তাদের পথ অনুসরণ করে তিনি আমাদের সন্ধান দিতে চাইছিলেন এক বৃহত্তর জগতের।
স্থির, নিষ্মম্প সুর যেন ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাঁর লেখার মধ্যে। এ পর্যন্ত আবিষ্কার করবার পর গৌতম বসু’কে মোটামুটি ‘এই জল প্রকৃত শ্মশানবন্ধু, এই জল রামপ্রসাদ সেন’ – ফ্রেমের মধ্যে বেঁধে ফেলার কাজ অনেকাংশে সম্পন্ন করে ফেলেছিলেন বাংলার কাব্য-সমালোচকরা। স্থির, নিষ্মম্প সুরের পবিত্র নখরাঘাতে আক্রান্ত হবার পরেও আর্কেটাইপ অভিধাপ্রিয় সমালোচকের সামনে তখন অমোঘ সোনার খাঁচা – গৌতমকে বন্দি করে ফেলা যায় তাতে। ‘রসাতল’ প্রকাশিত হল ২০০১ সালে এবং গৌতম ভেঙে ফেললেন, আরেকবা্র এই ফ্রেমটিকে।
নির্মিতির নাটকীয়তা তাঁর আয়ুধ নয়, ‘রসাতল’-এ এসে তিনি আরও নিরাভরণ করলেন তাঁর সৃষ্টিকে। ‘রসাতল’, আমার মতে গৌতমের অতি-গুরুত্বপূর্ণ এক অস্ত্র যা দিয়ে তিনি ছিন্ন করে দিয়েছিলেন আমাদের মননে ঘনিয়ে ওঠা পাশ্চাত্যের আধুনিকতার সংকীর্ণ পরিসরটিকে। Ennui, ক্লান্তি, বিচ্ছিন্নতার বোধ, অভিসন্ধিমূলক আধুনিকতা ইত্যাদি মিলেমিশে বাংলা কবিতার এক বড় অংশের মধ্যে নির্ধারণযোগ্য নির্মোক সৃষ্টি করে রেখেছে। এবং সুকৌশলে এগুলিই ঘুরেফিরে ডিসকোর্স হিসাবে আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়ে থাকে। এক সময়ে কবিতার ইন্দ্রজালিক বাস্তবতা, যা একটা সময়ে প্রতি-অবস্থান হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল আজ তাকেই সন্দেহমূলক উপাদান হিসাবে মনে করবার যথেষ্ট কারণ আছে। প্রতিনন্দনের উপস্থাপনা বাংলা কবিতাকে কতটা সমৃদ্ধ করেছে তা নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। এবং যে কারণে এই কথাগুলি বলা, গৌতম এ সবের থেকে বহুদূর…এক বড় ‘বিচ্যুতি’, হয়তো তাঁকে যত বড় বিচ্যুতি বলে মনে হয় তিনি আসলে তার থেকেও বড় বিচ্যুতি।
‘রসাতল’ গৌতমের বাঙ্ময় নৈঃশব্দ, তাঁর ভাববৃত্তের মধ্যে তিনি ধারণ করেছিলেন বহুকিছুকে। প্রথামাফিক পথে বিকল্প-নন্দন বা বিকল্প-পাঠকৃতির বদলে তাঁর অনুসন্ধান হয়ে উঠেছিল আরও বেশি গূঢ়। সত্যবীক্ষা এখানে ব্যক্তির পরিসর ছিন্ন করে সার্বলৌকিক স্তরে পৌঁছে যাবার ইচ্ছায় ডানা ঝাপটে চলেছিল। জীবনসত্তার নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ, সময়ের নিত্যবহমানতা, অন্তর্চেতনা ও হার্দ্যতা গৌতমের এই গ্রন্থের এক একটি কিরিট। তবু হয়তো এ সব কিরিট দিয়েও একটি ‘রসাতল’এর সব আলোছায়াকে ছুঁয়ে ফেলা সম্ভব নয়।
গৌতমের এই কাব্যগ্রন্থে অনেকেই আর্কেটাইপ নির্মাণ লক্ষ্য করেন, তাঁরা লক্ষ্য করেন না প্রবহমান এক আশ্চর্য দ্বিবাচনিকতাকে। একজন তীব্র অনুভূতিপ্রবণ মানুষ হেঁটে চলেছেন, কথা বলছেন নিজের সঙ্গে। দেখছেন সৃষ্টির আলো-অন্ধকার। এবং একই সঙ্গে বিশ্বজোড়া মহাহত্যাশালা, রক্তপাত…এমনকি পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স’ও তার দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে না। গৌতমের এই কাব্যগ্রন্থে এসে প্রবেশ করছে এক অন্ধকার-সন্ত্রাসময় জগত, অনেকটা ‘রক্তকরবী’র যক্ষপুরীর ছায়া জেগে উঠছে সেখানে। তবে এটা ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই যে এই জগতের দিকেই শুধু তাকিয়ে ছিলেন গৌতম তাঁর ‘রসাতল’-এ। এই অতি-গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য শুধু যুক্ত হতে দেখা যায় এই পর্বে এবং আশ্চর্যের কথা গৌতমের এই বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা হয় বেশ কম।
‘রসাতল’-এর বিভাব-কবিতাটিই এই গ্রন্থের মূল সুর নির্ধারণ করে দিয়েছিল, এখান থেকেই শুরু হয়েছিল গৌতমের দ্বিবাচনিকতা। শাহযাদপুরের কাছাকাছি একটি গ্রাম, তেজস্বী মধ্যাহ্নে গৌতম তাঁর সঙ্গীর সঙ্গে (এই সঙ্গী কি গৌতমের ছায়া?) বিনিময় করছেন প্রশ্ন-উত্তর; উপনিষদের জগত ঘনিয়ে উঠছে তাঁদের মধ্যে,
এই পথে প্রত্যহ হাঁটি, কিন্তু এমন নিভৃতে তাঁকে পাই না; আজ অতর্কিতে জিজ্ঞাসা করে বসি, ‘বন্ধন কীসে?’। আমরা তখন একটি বাঁশবন পার হচ্ছি, এখানেও কয়েক ঘর মানুষের বসবাস, তাঁদের প্রধান বৃত্তি ঝুড়ি বোনা।
‘আমি মায়াবৃত, এই জন্মই আমার বন্ধন, তবু বন্ধনমাত্র নয়, আমি মুক্তির পথেই রয়েছি।’
-ঈশ উপনিষদের একটি শ্লোক আমাদের মনে পড়ে যেতে পারে সে সময়ে-
‘হিরন্মেয়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম ।
তৎ ত্বং পূষেন্নপাবৃণু, সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে।।‘
-এই শ্লোকের মূল কথা, একটি সোনার পাত্র যেন সত্যের মুখকে চৈতন্যের থেকে আবৃত করে রেখেছে। আমাদের জন্মের মধ্যে দিয়েই এই সুবর্ণ পাত্রের জন্ম হয়, এই মায়া ও বন্ধনের শুরুয়াৎ।
আড়ালের শিল্প গৌতমের সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য, এখানেও, এমনকি প্রতিটি শব্দে উঠে আসতে পারে এক বা একাধিক ইন্টারপ্রিটেশন।
কবি ও তাঁর সঙ্গী পেরিয়ে চলেছেন এমন বাঁশবন ও ঝুড়ি-বোনা মানুষের গ্রাম। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে হয় একটি সম্ভাবনার কাছে এসে – বাঁশের ঋজুতা এসে শেষ হয়ে যায় বাঁশের ঝুড়িতে…বাঁশের ঋজুতা ক্রমশ রূপান্তরিত হয়ে যায় শৃঙ্খলে…এবং জীবনের শৃঙ্খলকে সূচিত করে চলে ঝুড়ির মধ্যে ঘনিয়ে ওঠা বাঁশের শিকল।
এই বিভাব কবিতাটি এখানে শেষ হলে হয়তো পৃথকভাবে এতটা গুরুত্ব দাবি করত না, কিন্তু এর কিছুটা পর সত্তার বন্ধনের পাশাপাশি গৌতমের কবিতায় এই প্রথমবার দেখা পাওয়া গেল অন্য এক ‘বন্ধনের’,
‘পার্থিব সম্পদের উপর অধিকারপ্রতিষ্ঠার সূত্রে মানবসমাজ স্তরবিভক্ত, স্তরগুলি বিবাদের রক্তস্রোতে ভেসে চলেছে, এ অবস্থাই আমার বন্ধন, তবু বন্ধনমাত্র নয়, আমি মুক্তির পথেই রয়েছি।’
আমরা ততক্ষণে বাঁশবনের শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি। পথ এখানে অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত, ছায়াসকল তীক্ষ্ণ, যে কাঁচা রাস্তায় গিয়ে উঠব সেটি ধরে উত্তর দিকে হাঁটলে রামকৃষ্ণপুর, দক্ষিণে বুড়োর ঘাট, আর সম্মুখে দেখতে পাচ্ছি শাহজাদপুর অঞ্চলের অন্তর্গত একটি গ্রাম, গঙ্গানারায়ণপুর। একটি তেজস্বী মধ্যাহ্নের প্রশ্বাসে গঙ্গানারায়ণপুর কেমন মিশে রয়েছে।’
-পার্থিব সম্পদের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার সূত্রে যে শ্রেণীর উদ্ভব শোষণ ও বিবাদের সৃষ্টি তাকে অনায়াস দক্ষতায় একই ফ্রেমের মধ্যে এনে বসালেন গৌতম যে ফ্রেমের মধ্যে তিনি কিছু আগেই এনে বসিয়েছেন উপনিষদের মধ্যে ঘনিয়ে থাকা প্রশ্ন’কে।
-শুধু তাই নয়, গৌতম সযত্নে পরিহার করেছিলেন নির্মিতির নাটকীয়তা; কিন্তু তিনি যে কী পরিমান দক্ষ রূপকার তা ফুটে ওঠে শেষ লাইনে গিয়ে, তেজস্বী মধ্যাহ্নের প্রশ্বাসে মিশে রয়েছে গঙ্গানারায়ণপুর। নিছক বর্ণনার পরিসর অতিক্রম করে আমরা দ্বিতীয় বা তৃতীয় পাঠে আবিষ্কার করি – কংক্রিটের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে অ্যবস্ট্রাক্ট…মধ্যাহ্নের প্রশ্বাস ও গঙ্গানারায়ণপুরের মধ্যে আর কোনও ভেদ থাকছে না কোথাও…তারা হয়ে উঠছে এক ও অভিন্ন।
‘রসাতল’-এ গৌতমের বাকনির্মিতি তরঙ্গময় গদ্যের কাছাকাছি। তার ভেতর রয়েছে অন্তর্গূঢ় স্বর, কূটৈষণা; কিন্তু সব থেকে বেশি রয়েছে এক চিরচলিষ্ণুতার প্রহর…পথঘাট। গৌতম এখানে যেন এক ভারতীয় পরিব্রাজক, হেঁটে চলেছেন। যাত্রাপথে তাঁর শব্দপ্রয়োগ অনুত্তেজিত,সুস্থির। কিন্তু তাঁর যাত্রাপথ শুধুমাত্র কল্প-আলোয় ভরা ভাবলে ভুল ভাবা হবে; মাঝে মাঝে তা অঙ্গারবর্ণ’ও ধারণ করেছে।
এই যাত্রাপথে একদিন গৌতম দেখতে পেয়েছিলেন ‘এবাজুদ্দিন লস্কর’এর বাড়ি এবং তরঙ্গময় এক ভাষায় তা হলে উঠেছিল আশ্চর্য কবিতা।
এ বাড়ি এক জন্মান্ধ ভিখারির বাড়ি, প্রগাঢ় শান্তির মধ্যে ডুবে থাকা,
‘যতবার পার হয়েছি এবাজুদ্দিনের বাড়ি, দেখেছি, বাঁশের কঞ্চির গেটটি নারকল দড়ি দিয়ে বেড়ার সঙ্গে বাঁধা, কেউ নেই এদিকে-ওদিকে। জায়গাটা নির্জন; পুবদিক থেকে বেঁকে-আসা কাঁচা রাস্তার পাশে কয়েকটা উঁচু ডাবগাছ, তারই কোল ঘেঁষে ভাঙা-ছেঁড়া ছায়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তার ভিটে। এদিকে আর কোনো বসতি নেই, রাস্তার ওধারের জমি বসবাস অথবা ফলচাষের অযোগ্য, অসমতল, তাই কাঁটাঝোপ আর আগাছায় ভরা; ঘন সবুজের ভিতর কয়েকটা ছাগল চরছে। ভাঙা ডাল, শুকনো পাতা মাড়াবার শব্দ আর নানা পাখির ডাক—এক প্রগাঢ় শান্তির ভিতর এবাজুদ্দিনের বাড়ি ডুবে আছে। কখন ফিরবেন এবাজুদ্দিন? গাছের পাতার ফাঁকে কয়েকটা ঘর দেখা যাচ্ছে খানিক দূরে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম ডাবগাছের ছায়ায়, পাখির ডাক ভেসে আসছে, শুনতে পাচ্ছি ভাঙা ডাল আর শুকনো পাতা মাড়িয়ে চলার শব্দ। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে এবাজুদ্দিনের বাড়ি স্পষ্ট দেখা যায়; উঠোনে ধান বিছানো নেই, রেডিও বাজছে না, দাওয়ায় একটা ছেঁড়া গামছা মেলা আছে’
-এই জন্মান্ধ ভিখারির বাড়ির দিকে তাকিয়ে, এবাজুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে গৌতম কোনও কাহিনি নির্মাণ করতে চাননি, শুধু তিরতির করে বয়ে চলা নদীকে এনে বসাতে চেয়েছিলেন কবিতাটির মধ্যে,
‘মাঝে-মাঝে আমি নিঃশব্দে এসে দাঁড়াতাম তাঁর সামনে; মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে প্রথমে সতর্ক হয়ে উঠলেও পরে তিনি সহজ হয়ে যেতেন। বিপুল হাওয়ায় চুলদাড়ি উড়ছে, মাথা উঁচু; গোধূলিবেলায় সেই নিশ্চল মূর্তির সম্মুখে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থেকেছি, এক আলোকময় সিংহদ্বারের দুই জন্মান্ধ প্রহরী’
-কবিতাটি শেষ হবার পর ঘিরে ধরতে বাধ্য এক ভয়াবহ স্তব্ধতা, এবাজুদ্দিনের অন্ধত্ব’র সঙ্গে ধীরে মিশে যাচ্ছে কবির অন্ধত্ব…আঁধার হয়ে উঠছে আলোর অধীক। এখানে ‘জন্মান্ধ’ শব্দটি সবিশেষ লক্ষ্য করবার। ‘রসাতল’-এর কাছে বারবার ফিরে এসে মনে হয় এই কাব্যগ্রন্থ কি আসলে এক ‘দিব্য’ চক্ষুষ্মান অন্ধের মহা-দেখা?
কারণ আরও কয়েকটি কবিতায় কখনও প্রকাশ্যে বা কখনও একটি দুটি শব্দের আড়ালে ফুটে উঠেছে অন্ধের কথা; যেমন এ মুহূর্তে উল্লেখ করা যায় ‘ব্লাইন্ড অপেরা’ নামে কবিতাটির কথা।
কবিতাটির শুরুতেই কবি আবিষ্কার করেন এক অন্ধকে, যার ‘মিহি সুতোর সেলাইয়ে দুই চোখের পাতা বন্ধ’। এরপর গৌতম তাঁর স্বকীয় ভঙ্গীতে প্রায় স্বগতোক্তির মতো বর্ণনা করে গেছেন সে অন্ধের সঙ্গে তাঁর সংক্ষিপ্ত যাত্রাপথের আনন্দ,
‘এরপর কথা বলা চলে না, তবু আমি হাঁটতে হাঁটতে একটি-দু’টি প্রশ্ন করি, সেও অল্প কথায় সাড়া দেয়। ক্রমে একটি চিত্র ভেসে ওঠে; সে আসছে অনেক দূর থেকে, দীর্ঘপথ পেরোবার পর অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল শিয়ালদহ স্টেশনের বাইরে, অবশেষে এক সহৃদয় ব্যক্তি তাকে একটি বাসে উঠিয়ে দেয়। বাস থেকে নেমে আবার দীর্ঘ অপেক্ষার পর, এবার সে খুশি, ‘ব্লাইন্ড অপেরা’র একটি নাট্যানুষ্ঠানে যোগ দিতে চলেছে।
ফুটপাথ ছেড়ে আমরা এসে পড়েছি প্রেক্ষাগৃহের সামনে, বাঁ-দিকের সঙ্কীর্ণ পথ ধরে পিছনের সাজঘরের দিকে যেতে-যেতে তাকে বলি, তুমি ঠিক কোথায় থাকো বললে না। বাড়ি থেকে কখন বেরিয়েছ তাও জানালে না আমায়।’ এই প্রথম সে থামল, ঘুরে দাঁড়াল আমার দিকে। ঝলসে-যাওয়া মুখে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমেছে, দুই ভুরুর নীচে অন্ধকার, আমায় চোখ নামিয়ে নিতে হল’
-এরপর সেই অন্ধ, শহরের ব্লাইন্ড অপেরায় যোগ দিতে আসা অন্ধ নিশ্চিতভাবে জানিয়ে দেবে, ‘বললাম যে, অনেক দূরে থাকি। এখানে আসতে আমার সময় লাগে।’
সে এক সময়ে লেখকের হাত ছেড়ে সাজঘরের কাছে থেকে হারিয়ে যাবে, যাবেই। কবি আবিষ্কার করবেন, ‘আমি একা। দাঁড়িয়ে আছি দালানে, মেঝের ‘পরে যেখানে তার দু’পায়ের ছাপ স্পষ্ট দেখা যায়। কার হাত ধরে এসেছি এখানে? কতদূর থেকে, কত আলোকবর্ষ দূর থেকে সে এসেছিল, কোন নক্ষত্রপুঞ্জের ওপারের চারণভূমিতে আজ আমার মতো একা ঘুরে বেড়ায় তার গাভীদল?
-ঠিক এখানে এসেই ভূমিকা বদলে হয়ে যাবে অন্ধ ও চক্ষুষ্মানের; অন্ধ্বত্বের সীমা ও সীমানা ধুয়ে মুছে যাবে। এক গূঢ় প্রশ্ন আমাদের মধ্যে বুনে দেবেন গৌতম যেখান থেকে বারংবার মনে হবে এই অন্ধই কি প্রকৃত চক্ষুষ্মান ও আমরা প্রত্যেকেই তার হাত ধরে হেঁটে চলেছি? এ অন্ধ কি অনেক গ্যালাক্সি পেরিয়ে আসা এক আলো, আর আমাদের ছোট্ট পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া প্রতিদিনের হাসিকান্না সেই ‘ব্লাইন্ড অপেরা’; যা দেখতে তিনি মাঝে মাঝে আসেন…আমাদের হাত ধরেন…চকিত দর্শন ও সঙ্গ দিয়ে মিলিয়ে যান আবার!
-গৌতমের এই কবিতাটি পড়বার পর চকিতে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে খেলে যাওয়া অন্ধকার বারবার ফিরে আসা অন্ধের কথা গৌতমের কবিতায় ছায়া ফেলে গেছে হয়তো,
‘অন্ধকারের মাঝে আমায় ধরেছ দুই হাতে
কখন্ তুমি এলে, হে নাথ, মৃদু চরণপাতে ? ।
ভেবেছিলেম, জীবনস্বামী, তোমায় বুঝি হারাই আমি—
আমায় তুমি হারাবে না বুঝেছি আজ রাতে ৷৷
যে নিশীথে আপন হাতে নিবিয়ে দিলেম আলো
তারি মাঝে তুমি তোমার ধ্রুবতারা জ্বালো।
তোমার পথে চলা যখন ঘুচে গেল, দেখি তখন
আপনি তুমি আমার পথে লুকিয়ে চল সাথে ॥‘
-রবীন্দ্রনাথের জীবনস্বামী’ই গৌতমের কবিতায় সেই অন্ধ যে ব্লাইন্ড অপেরায় এসেছে বহুদূর থেকে।
‘রসাতল’ এক নিরাভরণ শিল্প, কিন্তু কেউ যদি মনে করেন যে এটি একটি শুধুমাত্র ‘আলোকিত’ গ্রন্থ তা হলে তিনি সম্ভবত ভুল করবেন। এই গ্রন্থের কাছে ঘুরে ফিরে এসে মনে হয়েছে সৃষ্টির ভিতর জমাট অন্ধকার সভ্যতার ভিতর ঘনিয়ে ওঠা প্রবল দ্বেষ হত্যা ও হিংসার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকেননি গৌতম। বরং বলা যায় এই গ্রন্থে এসেই তাঁর এই লক্ষণ সব থেকে বেশি ফুটে উঠল। ‘শ্রাবণ’ ‘দিবাস্বপ্ন’-সহ বেশ কিছু কবিতায় সে গুপ্ত-হিংসা গুপ্ত হত্যার ছায়া ফুটে উঠতে দেখা যায়।
‘রসাতল’-এ গৌতম আত্মপ্রশ্নে বিপন্ন করেছেন নিজেকে বারবার, এ তাঁর এক নিজস্ব প্রক্রিয়া। ‘ঝরাপাতা’ কবিতায় আমরা পেয়ে যাই,
‘পথ থেকে একটি হলুদ পাতা কুড়িয়ে নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, ‘এটি কি জীবনের
প্রতীক, না মৃত্যুর?’
‘জ্ঞানের, পরাজয়ের।’
আত্মমগ্ন পথের বাতাস বয়ে চলে। জগতে, এই অখণ্ড নীরবতায় হাওয়া বয়; বৃক্ষশাখার ভিতর দিয়ে, জনপদ ও মানুষের ভাষার উপর দিয়ে, কখনও উদাসীন ও অবসন্ন, উন্মত্ত কখনও কখনও, এই পর্যন্ত। মাঝে-মাঝে হাওয়া যখন থেমে আসে, মনে হয়, অজানা কোনও এক গভীর শ্বাস গোপনে অঙ্কুরিত হয়ে, ক্রমে সঞ্চারিত হচ্ছে পাতায় পাতায়, বনপথে, অন্তরীক্ষে।
সবুজ, উচ্ছল, মুখর পাতাগুলি হলুদ হয়ে, রক্তবর্ণ হয়ে নেমে আসে মাটিতে, যেভাবে শাস্তি নামে, শতকোটি বছরের স্মৃতির আকাশভাঙা রূপ যেভাবে অন্ধকারে সহসা কেঁদে ওঠে, মানুষ নতমস্তকে পরাজয় স্বীকার করে যেইভাবে’
-কবিতাটির শুরুতে গৌতমের প্রশ্ন জীবন ও মৃত্যুতে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু অতি-দ্রুত তা রূপান্তরিত হয়ে গেল জ্ঞান ও পরাজয়ে। নতমস্তকে পরাজয় স্বীকার করে নেবার মধ্যে আসলে লুকিয়ে রয়েছে সব থেকে বড় জয়…হয়তো মৃত্যুকে অতিক্রম করে যাবার শিক্ষা ও সাহস জন্মাতে শুরু করে এই বোধ থেকেই।
কিন্তু যে হিংসা ও হত্যাশালার কথা হচ্ছিল গৌতমের ‘রসাতল’ প্রসঙ্গে, সে দিকে একবার তাকানো যাক, ‘গল্প’ কবিতাটিতে গৌতম স্বর্গলোকে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে ঘনিয়ে ওঠা লড়াইয়ের কথা বলছেন; বলছেন অসুরদের উপদ্রবে পৃথিবীতে নেমে আসা এক দেবীর কথা। সেই রাজরাজেশ্বরী ধীরে থিতু হলেন এক গ্রামে, তাঁর মন্দির নির্মিত হল, কবিতাটির মধ্যে গৌতম বুনে রাখলেন বেশ কিছু কূটাভাস…কোনও দিন কি রাজরাজেশ্বরী (স্বর্গীয় ভাবের অধিকারিণী দেবী) স্বর্গে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন? কিন্তু গৌতম তারপর বলে উঠলেন শিহরিত করে দেবার মতো কয়েকটি কথা,
‘কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাগ্যও রূপান্তরিত হয়; নদীর কোল-ঘেঁষা অভাবদীর্ণ, নিস্তরঙ্গ সেই গ্রাম্যজীবনে এক দুঃসময় অতর্কিতে এসে আছড়ে পড়ল। অকারণে জ্বালিয়ে দেওয়া হল ঘর-দুয়ার, কাছারি ও ধানের গোলা; বহুপূর্বে দেবী যেমন স্বর্গরাজ্য পিছনে ফেলে এসেছিলেন, প্রায় তেমনভাবেই রাতের অন্ধকারে, নৌকায়, গরুর গাড়িতে, ছেলে কাঁধে ও ঘটিবাটি মাথায় নিয়ে, পায়ে হেঁটে, মানুষ পালাতে লাগল।
রাজরাজেশ্বরী ত্যাগ করতে পারলেন না সেই পুড়ে যাওয়া গ্রাম, প্রবাসের বিষণ্ণ মৃত্তিকা’
-হিংসার কারণে উদ্বাস্তু হয়ে ওঠা মানুষের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে দেবীর স্বর্গলোক ছেড়ে আসার ঘটনাক্রম…শুধু তাই নয়, এ ছবি যেন হাজার হাজার বছর ধরে হিংসার কারণে উদ্বাস্তু হয়ে ওঠা ছুটে চলা মানুষের ছবি।
রাজরাজেশ্বরী কি মানুষের স্মৃতি, প্রতিটি ছেড়ে আসা মাটির গন্ধ? মানুষ তার মাটিকে ত্যাগ করতে বাধ্য হলেও কি সেই ‘রাজরাজেশ্বরী’ স্মৃতি ঘুরে ঘুরে বেড়ায় পৃথিবীর বুকে?
আবার পরক্ষণেই মনে হয়, আমাদের সব মৃত্তিকাই হয়তো প্রবাসের মৃত্তিকা…একদিন সেই প্রবাসের মৃত্তিকার প্রতিই জন্মে যায় তীব্র মায়া আর ভালোবাসা। তাকে ছেড়ে যাওয়া যায় না কোথাও।
‘রসাতল’ আমার কাছে আরেকটি কারণে সবিশেষ উল্লেখ্য কাব্যগ্রন্থ বলে মনে হয়, এখন। এখানে এসে গৌতম মুছে দিয়েছিলেন progression ও regression নামক দুটি অতি-পুরাতন ধারণাকে। এখানে তিনি ব্যবহার করেছিলেন এমন শব্দ এমন চিত্রকল্প যা ব্যবহার করার কথা সহস্রাব্দের শুরুতে কেউ কল্পনাও করবেন না। মীরার ভজনের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে ভারতবর্ষের যে আত্মা তাকে তিনি তুলে এনেছিলেন কবিতায়। মৃত্যুকে পরম যত্নে এনে বসিয়েছিলেন জীবনের কোলে,
‘অস্থির পাতা ও ফুলেদের প্রবোধ দিয়েছে সেই অন্ধকার হাওয়া, যেন তারা আকুল না হয়, যেন তারা বুঝতে পারে, যে-কোনও গৃহ থেকে শ্মশান খুব দূরের পথ নয়’।
আষাঢ়ের মেঘ ঘনিয়ে উঠেছে আকাশে, যে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে, যে আকাশ-চাঁদোয়ার নীচে অভিনীত হয়ে চলেছে মানুষের ছোট ছোট খেলা তার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে প্রহরের পর প্রহর। দূরে টিলার উপর স্টিম-ইঞ্জিনের ধোঁয়া, শব্দ…প্রায়-বধিরের কানে এসে প্রবেশ করবে সে শব্দ। সবটুকুর পাঠোদ্ধার হবে না, বহু সংকেত লুকিয়ে থাকবে, ভবিষ্যতের হাতে তার রহস্য উন্মোচিত হবার সম্ভাবনা থাকল। শুধু এ লেখার একদম শেষে এসে ‘নীলকণ্ঠ’ কবিতাটি একবার উদ্ধৃত করা যাক,
‘আরও একদিনের কথা মনে পড়ে। আমরা মুখোমুখি বসে ট্রেনপথে চলেছি, শেষবিকেলের রোদ এসে পড়েছে তাঁর মুখে, বুকে, কোলে; আজ যেন তিনি আরও অচেনা, আরও দূরের কেউ। পিছনে হেলিয়ে রাখা মাথা ট্রেনের গতির সঙ্গে অল্প দুলছে, চোখ দু’টি নিমীলিত, নরম হয়ে-আসা আলো তাঁর সম্মুখ হতে ক্রমে নিভে যায়।
ভাষা নেই, তাঁর ভাবনার সীমান্তের এপারে শান্ত হয়ে বসে থাকি অনেকক্ষণ; অস্ফুটস্বরে তিনি বলেন, ‘আমি ভারাক্রান্ত, আজ তোমার কথা শুনি।’
-যদিও কবিতাটির নাম ‘নীলকণ্ঠ’, যদিও এই কবিতাটির বহু ব্যাখ্যা উঠে আসতে পারে এবং সেটি হওয়াই স্বাভাবিক তবু আমার বারবার মনে হয় ট্রেনপথে চলা দুটি মানুষ আসলে গৌতম বসু ও শঙ্খ ঘোষ। মনে হয় গৌতম বসে রয়েছেন শঙ্খ’র ভাবনার সীমান্তের এপারে, শান্ত হয়ে থাকাই তাঁর স্বভাব। শঙ্খ শুনতে চাইছেন গৌতমের কথাগুলি। মৃত্যুর কানে কানে বলা কথা, এক মহা-আশ্রয়ের কানে কানে বলা কথা – সব ইন্টারপ্রিটেশন হয়তো আমার ভাবনার থেকে বেশি সত্য ও ‘যুক্তিযুক্ত’। কিন্তু আমি নিরুপায়…যতবার এই কবিতাটি পড়েছি ততবার ওই একটি ছবিই ভেসে উঠেছে আমার কাছে।
আসলে এমন ভাবনার মধ্যে হয়তো কোনও ‘যুক্তি’ নেই এবং যুক্তি নেই বলেই তা আমার কাছে গৌতমের ‘রসাতল’এর মতো সুন্দর রহস্যময় ঘাতক।
অ্যবসার্ডিজমকে অতিক্রম করে ‘দেখা’ ও সৃষ্টির যে জগৎ রয়েছে, যেখানে এসে অনুচ্চ যুক্তি ও আমাদের রেঁনেসা-জনিত জ্ঞানচর্চা ভয়াবহ ভাবে ব্যর্থ হয়ে যায় সেখানেই ফুটে উঠতে শুরু করে গৌতমের ‘রসাতল’।
বড়ো প্রিয় এই কাব্যগ্রন্থটি। আলোচনাটি ভালো লাগলো।
আপ্লুত।
কবিতার আলোচনা যেন আর একটি কবিতা হয়ে উঠেছে। অপূর্ব।