
ধারাবাহিক – ‘আমার তারা’ ময়ূরী মিত্র ৬ ও ৭
পূর্বে প্রকাশিত– প্রথম পর্ব
পুঁটি আর কড়াইশুঁটি
পর্ব – এক
ঠিক বারোয় পড়েছি তখন ৷ ঐ বয়সেই একটা নয় বছরের মেয়ে জুটলো আমার ৷ দুর্দান্ত এবং দুরন্ত কিম্ভুত তার সাজপোশাক ৷ কোনোদিন যদি ঘেরওয়ালা ফ্রকের সাথে একটি পকেটওয়ালা খোকাপ্যান্ট পরল তো আরেকদিন কেশহীন মুণ্ডুতে বাঁধল চকরাবকরা রিবন ৷ পাড়ার খুড়িপিসিদের খবর — মা ছাড়াই মামা মাসীদের কাছে মানুষ হচ্ছে মেয়েটা ৷ তার মা তাকে ফেলে কোথায় গেল – আবার কোনোদিন ফিরবে কিনা- মা ছাড়া সে মেয়ে কতটা দুখ বয়ে বেড়ায়- এসবে একছটাক কৌতুহল না দেখিয়ে প্রথম দিনই ফট করে ঠিক করলাম – এ মেয়ের মা হয়ে যাব আমি ৷
নাম দিলাম পুঁটি ৷ আমার পুঁটি মেয়ে ৷ পুঁটি মেয়েকে লালন করা কিন্তু সোজা হয়নি আমার পক্ষে ৷ প্রথম কথা বারো বছরের মা আর নয় বছরের মেয়ে ৷ আমি যদি তার ইজেরের ইলাস্টিক টেনেটুনে ঠিক করে দি তো সে তৎক্ষণাৎ আমার ঘটিহাতা ছোট্ট ব্লাউসটার টিপ বোতাম লাগিয়ে দেবে ৷ আবার আমি যদি তাকে কদবেল জারিয়ে খাওয়াই তো সে আমার মুখে সরস্বতীপুজোর চালমাখা ঠুসবে ৷ দলা দলা চালমাখা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসত আপনা হতেই –হারামজাদী পুঁটি কচি আঙুলে আমার ঠোঁট চিপে ধরত ৷ কাঁচা চাল ভেজা — মুগডাল যত ফালতু জিনিষ গিলে মর এবার ৷ দ্বিতীয় কথা হল – তার যে মা নেই এবং বাকিদের যে আছে — থাকা না থাকার এই গ্যাপটাই ধরতে পারছিল না সে ৷ শোকতাপের বালাই তো নেইই – দিনরাত রাক্ষসী হাসি হেসেই চলেছে ৷ আহা রে মা নেই গো মেয়েটার –কোনোরকমে এরকম একটা অনুভুতি তৈরি করে যখনি তার মাথায় বিলি কাটতে গ্যাছি ফিনফিনে চুল দুলিয়ে ” পটি করব ” করব বলে পালিয়েছে পুঁটি ৷ দুদিনের মধ্যে আর এলই না মোটে আমার কাছে ৷ মায়ের আদরে তার এমনি অনীহা – যেদিন আদর আদর বাই চাপতো আমার — বিনাবাক্যে আমায় কষিয়ে দিত চড় ৷
ব্যাস এবার তার বারো বছরের মাও মারপিটে নেমে পড়ল ৷ পারছিলাম না — পারছিলাম না ৷ মা হওয়ার খেলায় জিততে আর পারছিলাম না ৷ এরই মাঝে বড় মাঠে দুধেল গাই মরল ৷ পুঁটির বায়না – মরা গরুর চোখ কেমন খুলে থাকে তাই দেখবে ৷ বলাবাহুল্য পুঁটিমেয়ের এইসব বিদিকিচ্ছিরি আবদারে পরের দিকে আর তেমন অবাক হতাম না ৷ আমার মাকে লুকিয়ে দুজনে মিলে গেছি মরা গাই ঘাঁটতে ৷ হাতপা ছড়িয়ে কাঁদছে গরুর পালক ৷ হিহি করে হাসছে রাক্ষসী পুঁটি ৷ মুখ চেপে ধরেছি ৷ হঠাৎ হাত ছাড়িয়ে সে দৌড় দিল অনেকটা দূরে একা ঘুরতে থাকা একটা বাছুরের দিকে ৷ হাঁ করে দেখল খানিক ৷ তারপর টেপফ্রককে গোল্লা পাকিয়ে বানাল এক ঘেরাটোপ ৷ ছোট্ট মুন্ডিটা পুরো ঢুকিয়ে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল ৷ কত করে বোঝাল সবাই — ওরে বাছুরটা মৃত গাভীর নয় ৷ এর মা তো বেঁচে আছে ৷ তবুও কাঁদল পুটি ৷ চোখ খোলা মরা মায়ের পাশে যে কোনো এক বাচ্চার একা হয়ে থাকাটাই কাঁদাল তাকে ৷ কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেল তার ৷ শিকনি বেরিয়ে এল ফতফত ৷ মাঠের মাঝেই পুঁটিমেয়ে চড়ল তার মায়ের কোলে ৷
ছোট্ট কোলে একটা পুঁটি লাফায় দুমদাম ৷
মরা জীব
আর কি সয় !
মা মেয়ে খেলে
দিকবিদিক ভুলে ৷
সবুজ ঘাসের মাঠখানিতে
মোদের প্রাণবিন্দু ,
বৃষ্টি হয়ে ঝরে ৷
পর্ব –দুই
এ কাহিনীর যখন জন্ম তখন আমার মা বুড়ি আর
আমি ধাড়িবুড়ি ৷ আর আমার বাচ্চাকোলের পুঁটি বড় হয়েই ছুট্টে হারিয়ে গেছে ৷ তখন আমি
প্রায়ই মায়ের সঙ্গে রাত কাটাই –রাত পার করে দিনে লাফ মারি মাতৃদেহের গরম নিতে নিতে ৷[
তো তেমনই এক রাতে হাড়গোড় আমার জ্বালিয়ে দিলে গো মা ৷ সেরাতেও আমি মায়ের কাছে – খেতে বসেছি দুজনে ৷ সাধারণত মায়ের গায় যতটা সম্ভব ঠেস দিয়েই খেতে বসি আমি ৷ দুটো প্লেট থেকেই খেতে হয় তো আমাকে ৷ তাই ৷ মায়েরই নির্দেশে আমার জন্য সেদিন হাঁসের ডিমের কালচে লাল কষা ৷ আমি বলি হাঁস কষা ৷ লাল ঝালে ভাত মাখার উত্তেজনায় কোনোদিনই তিনটে শব্দ একসাথে বলতে পারি না আমি ৷ ডিম বাদ দিয়ে বলি ,হাঁস কষা ৷ হাঁসের বিশেষ গন্ধযুক্ত কুসুমের শেষ টুকরোটা জাস্ট মুখে ঢোকানো বাকি ! মা বললেন — এবার বোধহয় মরে যাব ৷ শোনামাত্তর একটিও প্রশ্ন না করে হনহন করে আমি দোতলায় ৷
সিঁড়ির ফাঁক দিয়ে দেখলাম,আমার না খাওয়া কুসুম নির্বিকারে সাফ করছেন মা ৷ আমার না খাওয়াতে কোনো বিচলন নেই মায়ের ৷ অথচ মা বেশ জানেন , একমাত্তর এ কথায়ই বড় কষ্ট পায় তার মেয়ে ৷
রাতের বিছানা ৷ চাঁদ টাদ ফুলের গন্ধ যেমন যেমন থাকার কথা রয়েছে সেখানে ৷ আলোআলো গন্ধটা আসছে বিছানায়ও — যথেচ্ছ পরিমানে ৷যে যার মতো লুটোচ্ছে মা মেয়ের মোটা রোগা শরীরে ৷ শুধু দুজন দুমুখে ৷ প্রথমে ঘুরলাম আমি ৷ স্প্রিংয়ের মতো ৷ মা ধীরে সুস্থে পাশবালিশ জড়িয়ে ৷ মা কিন্তু জানে বেশ, আমিই মার চিরকেলে পাশবালিশ ৷ লাথাতে ইচ্ছে করছিল তুলোর বালিশটাকে ৷
ততক্ষণে রাতের চেহারা পাল্টে গেছে ৷ দিনের মতো রাতেও নানাসময় নানা পরিবর্তন ৷ গাছের পাতা বাতাস ডাকছে না ৷ বাতাসের অভাবে শালার পাখিগুলোও চুপ ৷ একি রাতের ছিরি হল গো ! অতো রাতে পাখি কেন না ঘুমিয়ে ডেকে ডেকে গলাগরম করবে , এ যুক্তি খুইয়েছি তখন ৷
মায়ের নির্বিকার ভাব যে আমায় আরো ভালোবাসায় ভাসাচ্ছে ৷ যুক্তি ডুবছে মাঝনদীতে ৷ মাঝ ফুরোল না রাতের ৷ হুট করে উঠে বসে দুমদাম ঝাঁকি দিলাম মাকে ! ঘরঘরে গলায় রাতের প্রেতিনি বলে — মা তুমি কি সত্যি মরবে এবার ? ঠিক করে বল ৷ ওপাশ থেকে উত্তর – মরব না তো কি অনন্ত বাঁচবো তোর জন্য ? কান্না কান্না পাচ্ছিল ৷ পুরোটা না তাবলে ৷একটু কান্না কান্না ভাব আর কি ৷
ভোর হতেই ক্রমাগত ঝাঁকুনি ৷ ছেলেবেলায় বকুল পাড়তে যেমন করে একনাগাড়ে গাছ ঝাঁকাতাম দিতাম ,অমনি করে ৷ দুহাত দিয়ে মাকড়সার মতো আমায় ততক্ষনে জড়িয়ে ধরেছেন মা ৷ রাতের প্রশ্ন মেটালেন সূর্যোদয়ের মাঝে ৷ বললেন , মরব তো ! আবার বাঁচবোও যে ৷ প্রেতিনীর বুকে গুড়গুড় ৷ দুটো কেমনে সত্যি হবে মা ?
মা আবার তলিয়েছেন ঘুমে ৷ ভোরের হওয়া চলছে তখন ৷ মেয়েটা সংশয়ে বাগানের মাটিতেই থুপ করে বসে ৷ রাস্তায় তখন বাতাসে ঝরা ঝুড়ি ঝুড়ি কামিনী ৷ ওমা ওই দ্যাখো ! ফিচেল পাখির দল ফুলের মধ্যে দিয়ে দিয়ে এঁকেবেঁকে চলছে ৷ ফুটবল খেলছে ফুল দিয়ে ৷ আর তাদের পায়ে পায়ে ফুলগুলো দুপাশে চুড়ো খোঁপার মত উঁচু হচ্ছে ৷
ওকি ! জমা ফুলের মাঝ বরাবর একটা কেমন পথের মতো তৈরি হচ্ছে না? একদম সরু একটা পথ ৷ বাচ্চা খুকির একটুকরো পায়ের মাপের পথ ৷ দেশমাতা ডাকে !
চল খুকি চল ৷হাঁট খুকি হাঁট ৷ ফুল ঝরে ৷ফুল ফোটে ৷
পেত্নী ছুট্টে চলে লক্ষ মায়ের ডাকে ৷
সে আজ পরী হবে ৷
৪৭
শিশু বিষ্ণু
এখন ভোরের বেলা ৷ ঘুম ভাঙতে মনে পড়ল , আজো স্কুল খুলল না ৷ এখনো মানুষের ,মানুষের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলার দিন শেষ হল না ৷ মনে হচ্ছে যেন কতকাল আগে ঘটেছিল ঘটনাগুলো ! যেন কতকাল আগে আমাকে ঘিরে বসে থাকত উন্মুখ বাচ্চাগুলো ! Differently Abled বাচ্চা তাদের different abilility প্রকাশ করতেই যেন একটু বেশী হাঁসফাঁস করত ! ছাত্রের হাঁসফাঁসে নিয়ত খুঁজে পেতাম নিজের রয়ে যাওয়া !
কতদিন হল ঠিক ! ভোরের আবছাভাব নাকি মহামারী আমার সময় ও তালজ্ঞান চুরি করল ! সামান্য দূরের অতীতকে আজকাল সুদূর অতীত মনে হয় ৷ ভোরে চারপাশের ধ্বনি , মানুষের কথা কম থাকে ৷ সুপ্ত সত্য বেরোয় অনর্গল ৷ রাত শেষের প্রথম সূর্যখানি দেখলেই মনে হয় ,এই দ্যাখ গো ! ঝটকা মেরে উঠে বসেছে গোলডিম আলো !
যেমন অনেকসময় নগন্য ঘটনা অনেক সত্যে জমাট তারাটি হয়ে আমাদের কাছে আসে ৷ একবার অনেকদিন ধরে মোটেই পড়াশুনো করছিল না একটি ছেলে ৷ শাস্তি বা চকোলেট দিয়েও যখন কিছু হল না তার বাবা মা ডেকে পাঠিয়েছিলাম ৷ রূঢ় ভাষায় খানিক বকাবকিও করেছিলাম তাঁদের —
শুনুন এভাবে চললে কিচ্ছ্যু এগোবে না আপনার ছেলে ৷
মলিন মুখে বাবা মা চলে গিয়েছিলেন ৷
পরদিন দেখলাম খুব ভালো পড়াশুনো করে এসেছে ছেলে ৷ ফটাফট আঁক কষছে ৷ তার বাবাকে ডাকলাম —
খুব ভালো করেছে আপনার ছেলে ৷ একগাল হেসে আমাকে আশ্বস্ত করলেন বাবা !
— তুমি চিন্তা এত কোর না দিদি ! তোমার ছেলে ঠিক পড়বে ৷
কত সহজে “তুমি” ডেকে আমাকে তাঁর ভালোবাসার জন করে নিলেন ৷ নিজের চিন্তাকে দূর হটিয়ে আমায় বারণ করলেন চিন্তা করতে ৷ আপন ছেলেকে করে দিলেন আমার ৷ একেবারেই আমার ৷ বাড়তি শব্দ উচ্চারণ না করে বুঝিয়েও দিলেন , বাচ্চার ভালোমন্দ চিন্তায় শিক্ষকের অধিকার সবার আগে ৷
এ কথাগুলো অবশ্য মুখে বলতে পারিনি তাঁকে ৷ কারণ শিক্ষক হওয়ার গর্ব বা আভিজাত্যবোধ ৷ তখনো তো মহামারী শিক্ষককে এমন করে নিঃস্ব করেনি ৷ তবে বাবা ছেলে চলে গেলে ফাঁকা ক্লাসঘরে এক ভাইয়ের দেওয়া এ সম্মান বুক পেতে নিয়েছিলাম ৷
আভিজাত্য শব্দ নিয়ে আপত্তি হচ্ছে তো আপনাদের ? কিন্তু কী করে অস্বীকার করি শিক্ষক হওয়ার সেদিনকার শ্লাঘাটুকু ! আবার মজা দেখুন , আমার অত অহং হটিয়ে দিত বা নীতিনিষ্ঠ কেঠো দিদিমণি হওয়া থেকে আমায় বাঁচিয়ে দিত কিন্তু এই differently Abled বাচ্চাগুলোই ৷
একদিন ড্রইংক্লাসে আঁকতে দিলাম এক জোড়া সবুজ পাতা ৷ মা শকুনের মতো লক্ষ্য রেখেছিলাম ” সেই একদিন পড়া করা আর পরদিন না পড়া ” বাচ্চাটার দিকে ৷ পাতায় সবাই দেয় সবুজ রঙ ৷ আর এ পাতা ভরাল গাঢ় বেগুনি রঙে ৷ আচ্ছা করে কান মলে বললাম —-
হতভাগা পাতায় সবুজ লাগে জানিস না ?
কানে তো শুনতে পায় না এরা ! তাই আমার কথা কানে নেয় আর কী করে ! বোবা কানটায় হাত বুলিয়ে একমনে ঐ বেগুনি রঙই দিতে লাগল পাতার পর পাতা ৷ একবুক কষ্ট নিয়ে আমিও বসে রইলাম পাশে ৷ কান যে মোলে তার কষ্ট কি কম গো !
এ বাবা ! বেগুনীর অন্ধকারে আবার দিতে শুরু করল উজ্জ্বল হলুদ ৷ তারপর কমলা ৷ জোড়ায় জোড়ায় কমলা বেগনে পাতায় এখন ভরে উঠেছে তার খাতা ৷ ছেলেকালে যে যে পাতায় রথ সাজাতাম ঠিক অমন রঙের ঝাড় বেঁধেই খাতারথ সাজিয়েছে ৷ কালো পাতায় কমলা বিন্দি – পাতার মাঝে টুকরো আলো রশ্মি ৷ সূর্য সাফ করছে আঁধার ৷ অপেক্ষা একটি রথের ৷ দেবযানে বসবে আমার বুদ্ধদেব ৷
এখন এ কোভিড কালে ঘরে বসে স্মৃতি আওড়ানো ছাড়া উপায় কী ছাত্রহীন শিক্ষকের !
কাল এক বাংলার শিক্ষকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল–
জানো ময়ূরী ! কত কষ্ট করে লেসন তৈরি করে দিচ্ছি অনলাইনে ৷ আর বাচ্চাগুলো বলছে –
আমরা অনলাইন করে করে tired ম্যাডাম ! আপনি ক্লাস করে রাখুন পরে দেখে নিচ্ছি ৷ ছাত্রটির কথা বলার ঢঙে ছিল , অনলাইনে মাইনে তো পাচ্ছেন ,এত কথা কী ? মা বাবার কাছে ছাত্রের এই দুর্বিনীত ব্যবহার বললাম ৷ ছেলেকে সামান্য না বকে , ওনারা ছেলের থেকেও অনায়াসে বললেন –অনলাইনে ইন্টারেস্ট পায় না তো !
ফোনে এ ঘটনা শুনে এপার থেকে আমি বললাম –
আপনিই বা অত কথা কেন বলতে গেলেন ? এটা তো প্রাইভেট টিউশন ৷ টাকা নিয়ে লেসন দিয়ে ছেড়ে দিন ৷
আমার এহেন হতাশার কথায় শিক্ষকটি বললেন –
টাকা সব ? আমি তো মন দিয়ে বাড়তি সময় দিয়ে পড়াচ্ছি ! ছাত্রের কাছে আমার বাড়তি প্রাপ্যটা কেন পাব না ! বুঝলাম বাড়তি প্রাপ্য বলতে তিনি বোঝাতে চাইছেন – ছাত্রের দেয়া সম্মান , শ্রম মনোযোগ ! যা একদা দেওয়ার কথা ছিল ছাত্রের আর যা এখন না দিলেও চলে …..বাড়তি …বাড়তি !
হারাচ্ছে ৷ এই অনলাইন ” পাস ফেল নেই নেই ” বিদ্যাচর্চায় শিক্ষক ছাত্র অভিভাবকের সেই টান টান সুরটি হারিয়ে গেছে ৷ যাচ্ছে ৷ হয়ত ছোঁয়াচে রোগ ছড়াবার কালে বিদ্যার্জনের এই সিস্টেম সঙ্গত ছিল ৷ আরো সঙ্গত হয়ে যাচ্ছে বিদ্যার প্রার্থনা ও অর্জনের বিনয়মাধুর্য হারিয়ে যাওয়া !
খেদ করে লাভ নেই ৷ অপেক্ষায় থাকি সেই ছাত্রের , শ্রবনেন্দ্রিয়ের অসঙ্গতি নিয়েও যে সঙ্গত করে তুলেছিল গাছের পাতার সম্ভাব্য বিকল্প রঙ ! Differently Abled বাচ্চা তার ভিন্ন প্রতিভায় শিক্ষকের কানমলাকে লঘু করে ফেলার জোরটা দেখাতে পেরেছিল ! ওই বহুবরণ পাতায় ভরা ড্রইংখাতা ছিল সেদিন আমার বাড়তি প্রাপ্তি !
ফিরে আয় বুদ্ধ তোর মহাজ্ঞান নিয়ে
আমি তো জেগে আছি রে –
আর কোনোদিন তোর কান্না মলব না
শুধু একটি ভোর আঁকা ছবির বায়না করব ৷
তুই না দিলেও তোর বাবা সেটি আমার হাতে তুলে দেবেন রে বুধুয়া !
দেখিস —–
আর কাঁদব না ৷ তুই না আমিও না ৷
[ কোভিডকালে লেখা ৷
প্রথম প্রকাশ :ভোরাই পত্রিকা
দ্বিতীয় প্রকাশ : উত্তরের সারাদিন ]
★★★★★★★★★★★★★
৪৮
টকর টকর
তখনো নিশুতিভোর ৷ ভোরের নিশুতি ৷ ডালপাতাকে পাশবালিশ বানিয়ে নিঃসারে ঘুম দিচ্ছে গাছের কাক ৷ দুমদাম শব্দ করে আমাদের বাড়ি কাজে লেগে পড়ত বুড়ো ৷ কোনো এক শীতের ভোরে বুড়োকে যেদিন প্রথম দেখি সেরফ আঁতকে উঠেছিলাম ৷ নাম বুড়ো অথচ নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে আছে একটি ডালিমছাঁট চুলের মেয়ে ৷ কী বলব –মাথার প্রত্যেকটা চুল তার সমান ছুঁচলো ৷ মিষ্টির গোল্লা তার চোখ ৷ গায়ে একটা বিশাল গন্ধযুক্ত চাদর ৷ তাতে বড় বড় ফুটো ৷ প্রতিটা ফুটোয় নিখুঁত ভাবে সেফটিপিন লাগানো ৷ অনেক ফুটোয় অনেক সেফটিপিন ৷ পায়ের পাতা থেকে শুরু করে বুড়োর চাদর শেষ হতো ঠোঁটের ওপর — যেখান থেকে পুরুষমানুষের গোঁফ তৈরি শুরু হয় ৷
দেখলাম কিডনির রোগে ভুগে ভুগে বড় ঝুঁকে বেঁকে গ্যাছে সে ৷ তবুু প্রথম দেখাতেই বড়ো ভালোবাসায় ডেকে ফেললাম বুড়োসুন্দরী ৷ সে বাচ্চাকালে দুই বাচ্চার ভালোবাসার মানে যা দাঁড়ায় তেমনটাই ভালবাসলাম আমার সুন্দরীবুড়োকে ৷ আমার বুড়োপ্রেমের অনেকটাই ছিল ফ্রী টাইমে তাকে দিয়ে কিছু ফালতু খাটানোর মতলবে ৷আমি দশ ৷ আর বুড়ো বারো ৷ ধরেই নিলাম , দু দু বছরের বড় বলে বুড়োরই কাজের বল বেশি ৷ কাজের হকটাও তারই ৷ সকালবেলা আমাদের বাড়ি ঢুকে বুড়োর প্রথম কাজ এঁটো বাসন পেটানো ৷এতো জোরে আওয়াজ করে বাসন মাজত যে আমরা বলতাম , ঐ দেখো বুড়ো এসেই বাসন পেটাতে লেগেছে ৷ঝাড়ু দেয়ার সময়ও ঐ একইরকম ৷ তার ঝাঁটার ঘষঘষ শব্দে মনে হত — ঝেঁটিয়ে ঝেঁটিয়ে বাড়িসুদ্ধু সবাইকে বুঝি দূর করে দেবে বুড়ো ৷লক্ষ্য করলাম, শব্দ ছাড়া মোটে থাকতেই পারে না সে ৷
একদিন কথায় কথায় বুড়োর মা জানাল – ডাক্তার বলেছে কদিন বাদেই মরবে বুড়ো ৷ আর বলে ফেলেছে বুড়োর সামনেই ৷ যেই না এসব শুনেছে বুড়ো সেদিন থেকেই নাকি শব্দে খুব প্রেম জমেছে তার শব্দ ছাড়া বুড়ো বেজার ৷ এরপর থেকে আমি ও আমার মাকে কতদিন মিছামিছি চেঁচিয়ে ঝগড়া করতে হয়েছে বুড়োকে খুশ রাখতে ৷ আমাদের শব্দের বিনিময়ে বুড়ো কি করত জানেন? আমার হুকুম শুনে যেত দিনভর ৷ কখনো বলতাম ফুটন্ত জলে বেগুন চুবিয়ে দ্যাখ তো বুড়ো ভাসে কিনা ! কখনো —এই বুড়ো খুন্তির আওয়াজ করে করে মেটের লাল ঝোল বানা ৷ কিডনির রোগে তখন বুড়োর মাংস একদম বন্ধ ৷ তবুও দেদার মেটে খেত বুড়ো ৷ আরে ভাই কী বলব কড়া থেকে ঝোলের মেটে নামিয়েই গনগনে উনুনের পাশে বসে খেতে লাগত ৷
মৃত্যুর ব্যাপারে বুড়োর এই নির্বিকার ভাব মোটে সহ্য হত না আমার ৷ রাগ হত ৷ খুব রাগ হত ৷ রাগের চোটে বুড়োকে জাপটে নিতাম বুকে ৷ তবু শালার খাওয়া থামত না ৷ একসাথে হাফ ডজন চড় মারতাম ৷ তবু না ৷ ফলে ধীরে ধীরে রোগা হতে হতে বাচ্চদের লাইন টানা স্কেল হয়ে গেল বুড়ো ৷মা আমাদের নিয়ে গেলেন নীলের মেলায় ৷আমি কিনলাম একটি ফাইন মেমপুতুল ৷ বুড়ো কথা বলা হাত পা নাড়া পুতুল ৷ নিজে পছন্দ করে ৷ কথা বলিয়ে পুতুলটার কলকব্জা বেশ ভালো করে বুঝেও নিল ৷ বাসন মাজতে বসে আলসের ওপর পুতুল বসিয়ে রাখতো ৷কলকব্জা এদিকওদিক হয়ে যেদিন পুতুলটা কথা বলত না, বুড়োর সে কী মার পুতুলটাকে ৷ মার খেয়ে খেয়ে স্পঞ্জ নাড়ি চটকে গেল পুতুলটার ৷ একদম বেঢপ হয়ে গেল বুড়োর পুতুল ৷
একদিন কী মনে হল– বাতাস খাওয়াবার জন্য বুড়োকে নিয়ে গেলাম আমাদের ঝিলপার্কে ৷ ভাবলাম সাঁঝের শীতল বাতাস একবার শরীরে ঢুকলে ফের সোজা হবে আমার বুড়োসুন্দরী ৷ যথারীতি পুতুলটাকে বগলদাবা করে ঝিলের হাওয়া খেতে বসল বুড়ো ! তখন সন্ধ্যে ঘনায় ৷ যত বলি- ও বুড়ো আয় আমার সাথে লাইটের তলায় বস ! আমার ভয় লাগছে ! বুড়ো দেখি তত চলে যায় ঝোপের ঝুপসি আঁধারে ৷ উঁকি মেরে দেখলাম , আঁধারেই পুতুলটাকে এন্তার গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে বুড়ো ৷ অন্যদিন পুতুলকে কথা বলানোর পাগল হয়ে যায় বুড়ো ! আর সেদিন যেন কথা বলেই যেন মহাদোষ করে ফেলেছে পুতুল ৷ বকাবকির পর পুতুলটার কাছে কানমলা দিয়ে মাপও চাইলো ৷ বুড়ো আর বুড়োর পুতুল দুটোকেই বুকে ঠুসে দৌড়োতে লেগেছি ৷ হাউহাউ করে কান্না আসছে আমার ৷
— আয় বুড়ো ! আয় রে আমার বুড়োসুন্দরী ! আমার সাথে রাস্তার টিউবের নীচে স্টেপ মিলিয়ে চল ! চল চল ! পা চালা ! আয় আয় ! ধেয়ে যাই বাড়ি ৷ ও আমার মা তুই দরজা খুলে রাখ ! আমি আর বুড়ো এখনই ঘর ঢুকব রে মা ৷
ওমা ! দেখি , কেবলি আলো থেকে আঁধারে ঢুকে যাচ্ছে বুড়ো শয়তান ৷ সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলেছে বুড়ো ৷ একবার লাইটের তলায় তো পরের স্টেপে লাইট ছেড়ে আঁধারে ৷ মরোমরো বুড়োর সে কি জোর জোর হাসি সেদিন ৷
কদিন বাদেই মরল বুড়ো ৷কাঠি কাঠি পা হাত ছড়িয়ে হদ্দ মরা মরল। তারপর আমিও কত বুড়ো হয়ে গেলাম ! রয়ে গেল কেবল পুতুল।
হেথায় হোথায় ৷ কোথাও নিশ্চয়। অটুট অবিকল ৷ সে মরলে যে আরো মুশকিল !
★★★★★★★★★★★★★★★★★
৪৯
খলিফার বচন
মেয়েটা খলিফা ৷ খলিফা আমার ছাত্রী ৷ Intellectually Challenged ৷ দারুণ পরিপাটি সাজ ৷ দুবলা হাতেই ইস্ত্রী চালিয়ে , সৈন্যনীল স্কার্টটি পরে স্কুলে আসে খলিফা ৷ ঠিক আর ভুলের বাংলা হরফ সাজিয়ে এমন এক মেজাজি হাসি হেসে খাতাটি সে এগিয়ে দেয় ,মনে হয় বাংলা ভাষাটার এমনই “বেভুল ‘” হওয়ার কথা ছিল ৷ আমাদের মতো দারুণ মূর্খের মাঝে বাংলা ভাষার এই নিজস্ব ধারাটা খুব systematically ও seriously বয়ে চলেছে খলিফা ৷ ভুল করে যখন কানমোলা খেল তখনো তার মুখের চালিয়াতি ভাব আপনি মুছে ফেলুন দেখি ! পারবেনই না ৷
” গাছে সবজি উঠেছে ” বা ” মাঠে বিড়াল ফোটে ” এসব লিখেও আমাদের খলিফা বিচলিত নয় ৷ বরং রাজসিক ৷ তার চোখ তখন বলছে –
এটাই তো হবে , তাই না আন্টি ! এতদিন কী ভাবে তোমরা ভুলে থাকতে পার আন্টি ” মাঠে বিড়াল ফোটা কিংবা আকাশে রোদ ওড়া ?
মিঠে ভুলের গুল সাজিয়ে আমার মন হরণ করেছে এই ছাত্রী ৷ তাই তার নাম খলিফা মহারাজ ৷ কত লিখেছি খলিফার গল্প ৷ কিন্তু বার বার নতুন কাণ্ড করে নতুন গল্পই প্রাপ্য হয় খলিফার ৷ তার প্রতিদিনকার বাংলা নতুন ৷ নতুন বাংলায় সেও নতুন ৷ কোনোদিন তার লেখনীতে বাক্যরচনা হয় বৃষ্টি পট করে খসল তো পরের দিন সেই বৃষ্টিই হাসল ৷
বৃষ্টি হাসে যেন আন্টির কানে ৷
খলিফা বলে –
আন্টি তুমি দুটো শব্দ দিয়েছিলে বাক্যরচনায় ৷ শুধুমুধু দুটো শব্দে দুটো বাক্য লিখব কেন ! আমি একটা বাক্যে দুটো শব্দ বসিয়ে দিলাম –বৃষ্টি ও হাসি ৷ তুমি Happy তো আন্টি ? এক দুকামরার ক্লাসঘরে বসে বৃষ্টির সাথে চাষীর খুশি তুই কী করে দেখতে পাস খলিফা ! বল না আমাদের !!
উত্তরে খলিফা হাসে রাশিরাশি ৷
খলিফা –আমার খিলি পান ৷ যত চিবোই তত রসে ভরে আমার জিভ তালু , আমার পুরুষ মজানো ঠোঁট্টু ৷ খলিফার সঙ্গে শব্দ খুঁজি ৷ খুঁজে পাই ৷ আমার মনখারাপ কদম হয়ে যায় ৷
আজ খুব বিষাদ ভটভট করছিল আমার মধ্যে ৷ বললাম –খলিফা আমি যদি মরি ? খলিফা খাতায় কী একটা লিখছিল ৷ শরীর ঝাঁকিয়ে বলল –
না ৷
হয়ত তার শরীরটা আপনা হতেই ঝেঁকে গেল ৷ বর্ষা শেষে গাছের ডাল নাড়লে যেমন জল পড়ে অমনটাই কি ঝাঁকি খেলে খলিফা !
পরমুহূর্তে সব শব্দ ভুলে সে বলে উঠল –আন্টি মানে মা ৷ তুমি মরবে না কিছুতেই ৷ আমি একা হয়ে যাব ৷
তার থেকে নতুন ও পাকা পাকা শব্দ বের করার আশায় বললাম —
আমি মা তাহলে বড়দি ( স্কুলের হেড দিদিমণি ) কে ?
ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলল কাকিমা ৷ আমি বললাম —
বাহ আমি মা আর বড়দি তোকে এত ভালোবাসেন উনি কাকিমা ? খিলি পান আজ তোর শব্দ এত কম পড়ে কেন রে ?
আকুল খলিফা বলে —
কাকিমাতেও তো মা শব্দ আছে আন্টি ৷ একটু দ্যাখো না গো আন্টি মাসিমা জেঠিমা সব শব্দে কেমন মা ঘুরছে !
ঘরময় ঘুরে ঘুরে শব্দগুলো আবৃত্তি করে খলিফা আর নিজের উচ্চারিত মা ধ্বনি শোনে ৷ আমরা অবাক তাকিয়ে ৷ ভ্রূক্ষেপ না করে চরকি কাটছে খলিফা ৷
এই –এই খলিফা বারবার মা মা আর্তনাদ করে তুই কি confirmation চাইছিস !
–হ্যাঁ রে আমার খিলি পান ,সব শব্দে মা ৷ শব্দটাকে টক্কাস করে মুখে পোর যাতে কখনো সে না পালায় ৷ মাঝে মাঝে রব দিস রে ৷ সে রব শুনে ধরণী বলবে —
এইও ! খলিফা এসেছে তার মা নিয়ে !
রক্ত এবার তুমি জীবনপাখি হও !
★★★★★★★★★★★★★★★★
৫০
মায়ের হনু
হনুর মা
আরতির বাঁচার আর্তি ফুরিয়ে আসছে ৷ স্মৃতি কৌটোর কোনায়ও আর নেই ৷ আগে যখন বিভিন্ন দিক থেকে মা মা ডাক শুনতেন ববকাট মাথা আর গুল্লু চোখদুটো সেদিকেই ঘুরত ৷ চোখ জানান দিত –পুরো যাই নি রে -আছি – আছি ৷
আরতির মেয়েটা আজ তার মায়ের চারদিকে হনুমান লাফ দিয়ে দিয়ে মা মা ডাকছিল ৷ আরতি কিন্তু বাগানের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন ৷ বোধহয় ভাবছিলেন –মেয়েটার মা মা হাঁকার দেয়ার উৎপাতে এবার তাঁকে বাগানের একটা গাছ হয়ে যেতে হবে ৷ গাছের স্মৃতি নেই – শব্দ নেই – কারোর কথা শুনে চোখ তুলে তাকানোর ব্যাপার নেই ৷ আরে বাবা কাউকে ভ্রূক্ষেপ করার ব্যাপারই নেই গাছের ৷ সে কেবল সবুজ পাতা ও লাল ফলে ভরাট হয়ে থাকে ৷ চাঁদ সূর্য সব এসে আছড়ে পড়ে তার প্রশাখায় ৷ তারপর জীবজগত সেই পয়মন্ত গাছটি হাওয়া ও খাদ্য নিজের চাহিদায় খুঁজে নেয় ৷ সে শুধু উপভোগ করে একটি সম্মানিত জীবন ৷ তেমনি কি একটা গরবিনী গাছ হয়ে যাবেন আরতি ?
হনুমান যখন তার সাতজন্মের মায়ের ব্যাথা সইতে না পেরে কাঁদু কাঁদু হয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল তখন সে শুনল –শান্তা নার্স তার মায়ের পটি মোছাতে মোছাতে বলছে — মা কেঁদ না ৷ কাঁদা মানে হেরে যাওয়া ৷ এ তোমার নিজের সাথে লড়াই ৷ রোজ বাঁচার চেষ্টা করাটাই বাঁচা মা ৷
আরতির নেটিপেটি মেয়েটা দরজার ফাঁক এক প্রান্তিক মানুষের মুখে ঋকবেদের এই জোরাল উচ্চারণ এই প্রথম শুনলে ৷
পরেরবার দেখা হলে মেয়ে মা কেউ কাঁদবে না ৷
একজন গাছ হবে ৷
তো একজন বুটিদার পাখি ৷
দুজনে একসাথে চাঁদ খাবে ৷
চাঁদের অতীত নেই ৷
এই চিররোমান্টিক উপগ্রহটি চলমান ৷
★★★★★★★★★★★★
৫১
যীশু রোদ খায়
আমার যেখানে স্কুল সেই গলিতে একটি বিহারী পরিবার ভাড়া থাকেন ৷ বাবা মা আর এক মিশুকে বাচ্চা ৷ বাড়িতে আলোহাওয়া কম বলে রোজই সকালে বাচ্চাটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে রোদ নেয় ৷ সূর্যের আলো ও গরম মাখার সময় এমনই এক তৃপ্তি লেগে থাকে তার চোখে , না পেরে একদিন জিজ্ঞেস করলাম মাকে –
তোমার বাচ্চার বুঝি খুব রোদ খাওয়ার শখ ?
হাসতে হাসতে মা জবাব দিলেন —
মোটরগাড়ি নয় এরোপ্লেন নয় আমার ছেলেটার ওই একটাই বায়না দিদি ৷ দিনের যত সময় রোদ থাকবে ততসময় ও রোদে ঘুরে ঘুরে হাঁটবে ৷ ওকে রোদে হাঁটাতে হাঁটাতে বাড়ির কাজকম্ম কিচ্ছু হয় না ৷
কয়েকদিন স্কুল থেকে ফেরার সময়ও খেয়াল করলাম তাকে ৷ দেখলাম ,সন্ধের অন্ধকার নেমে আসার সময় কোনো সমস্যা নেই শিশুর ৷ প্রকৃতির পরিবর্তন খুশি মনেই গ্রহণ করছে সে ৷ আমার সঙ্গে হাসাহাসি করল ৷ মাকে ছেড়ে আমার মোটা কোলে ঝাঁপ দোল সবই খেলল ৷ যত কান্না তার আলোর ক্ষণে ছায়ায় যেতে ৷
এমনি করেই আলো মেখে ও আলোর সময় না-আলোয় আপত্তি জানাতে জানাতে শিশুর দিন কাটে ৷ একদিন স্কুল যাচ্ছি ৷ দেখলাম পাড়ার ঠাকুমারা পালা করে হাঁটাচ্ছে শিশুটিকে ৷ কখনো সে কোনো ঠাকুমার কাঁখে উঠে বসেছে ৷ কখনো পদ্মার ইলিশের মতো চ্যাটালো হয়ে কোনো ঠাকুমার পিঠে ৷ একদম ল্যাজা মুড়ো ছড়িয়ে ৷ পিঠ কোলের উচ্চতায় ঝমঝমিয়ে রোদ জমে খোকাটির ছোট শরীরের আনাচে কানাচে ৷
খোকাটি তাঁদের কখনো বলছে দাদি , কখনো ঠাকুমা ৷ বুদ্ধিমান কচি মানব সম্বোধন গোলায় ৷ সম্পর্ক নয় ৷ আরো এক মজা , তার মাও দেখি দিব্যি নিশ্চিন্তে বাঙালিনীদের কাছে সন্তানটিকে ছেড়ে রেখেছেন ৷ খুব আপনজনের কাছে অমূল্য সম্পদ রেখে যেমন নিশ্চিন্তি ভাব আসে অনেকটা তেমন তাঁর মনের ভাব ৷
সবচেয়ে মজা হল দু তিনদিন আগে ৷ জব্বর ঠাণ্ডা
পড়েছিল ৷ চারপাশের বাড়ির গোটা দুই তিন দাদি ঠাকুমা রাস্তায় মোড়া পেতে বসেছেন ৷ বাচ্চাটার তো খুব আরাম ৷ পা মাটিতে রাখতে হচ্ছে না তাকে ৷ একসঙ্গে এতগুলো দাদি পেয়ে দিশাহারা আমার রোদখোকা ৷ আদরের চোটে আদরের পরিমাপ ভুলেছে সে ৷ কোন দাদির কোলে কতক্ষণ থাকবে, কে যে তাকে বেশি রোদ দেবে কিচ্ছুটি বুঝতে পারছে না ৷
চট করে খানিক চটকে তার কানে কানে বললাম –
বল খোকা ,বল দাদি নম্বর 1,দাদি নম্বর 2,3,4— ৷ বল …বল ..5 ,6 7 ৷ এমনি করে এগো রে রোদখোকা ৷ সরিস না ভিনদেশি ঠাকুমার কোল হতে ৷
সন্ধি করে নে দাদি – ঠাকুমায় ৷ দেখবি তোর কাণ্ডে থ হয়ে জন্মের মতো থেকে যাবে রোদ ৷ অনন্ত ও অনাদি রোদ ৷
মিলিয়ে নিস এ মায়ের কথা ৷
দেখিস ! দেখিস তুই !
জানিস ছেলে ! যীশু মিল চেয়েছিলেন !
★★★★★★★★★★★★★★★
৫২
মানব বহ তুমি
খ্যাত মানুষের চেয়ে অখ্যাতর অসামান্যতা হৃদয়কে মাত করে বেশী ৷ ঠিক যেমন দ্বিপ্রহরের জ্বলজ্বলে সূর্য্যের চেয়ে ডোবা সূর্য্যের কমলা আলোয় মনের আরাম জমে ৷ জমে একেবারে পূর্ণ করে দেয় ধরাভূমি ৷
বেশ কবছর ধরে এক সদালাপী মানুষের সঙ্গে আলাপ চলছে আমার ৷ আলাপে প্রলাপে গড়ছে একটি সম্পর্ক ৷ প্রৌঢ় মানুষ , চোখে না পড়ার মতো চেহারা ৷ পাশ দিয়ে চলে গেলে কেউ খেয়ালই করবে না এক মানুষ গেল ৷
বড়ো মায়াবী ৷ মাঝে মাঝে আমার স্কুলের বাচ্চাদের জন্য মিষ্টান্ন চকোলেট আনতেন ৷ আরো একটা জিনিস লক্ষ্য করতাম ৷ সামান্য পরিচিত কাউকে সামনে দেখলে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করতেন ,ভালো আছেন তো ? ভাবতাম এ বুঝি একটা মুদ্রাদোষ তাঁর ! আর এমন হড়বড় করে কুশল জিজ্ঞেস করতেন যে উল্টোপিঠের লোকটি যথারীতি ভ্যাবাচাকা খেয়ে যেতেন ও পাল্টা কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতে ভুলে যেতেন ৷
এরই মাঝে একদিন হাসতে হাসতে এলেন ভদ্রলোক ৷ হাতে যথারীতি একটি মিষ্টির বাক্স ৷ বললাম-
এত হাসি ?
বললেন –
জিভে ক্যান্সার ৷
–মানে ?
—-মানে আবার কী ম্যাডাম ৷ ডাক্তার বলেছেন কিছুদিন পরে জিভের জল শুকিয়ে যাবে ! খাদ্যে আর স্বাদ পাব না ৷ তো এরপর তো আর কোনটার কী স্বাদ বুঝতে পারব না -তাই ভাবলাম আজি বাচ্চাগুলোকে মিষ্টি খাইয়ে যাই ৷ ভালো কাঁচাগোল্লা ৷ একদম টাটকা ৷ আমি খেয়ে দেখেছি ৷ নিন ৷ আপনার বাচ্চাদের দিন ৷
সেদিন ভদ্রলোকের হাতের আঙুলগুলো শুধু ছুঁয়েছিলাম মাত্র ৷ সান্ত্বনা দিই নি ৷ উনি তা চান নি ৷
বেশ কিছুদিন পরে আবার দেখলাম তাঁকে ৷ আরো রোগা ৷ বেঁকেচুরে যাওয়া গালে শীতবিকেল শেষ আলো ফেলেছে ৷
— ভালো আছেন তো দিদি ?
— ভাল আছি দাদা ৷
এই যাহ ! জিজ্ঞেস করলাম না তো আপনি কেমন আছেন!
ছায়ায় ছোঁয়া নদীর টান মনে মাটি মাখাল ৷
জলের পদ্ম ফুটেই রইল ৷
ঝরতে যথেষ্ট দেরি হোক ৷
★★★★★★★★★★★★★★★
৫৩
প্রাণজীবন
জীবন কী ? কোনটা জীবন ? জীব প্রাণ পাওয়ার পর থেকে যতটুকু কাল তার সহজে কাটে ততটুকুই হয়ত জীবন ৷ প্রাণকালের যে অংশ কাটতে চায় না –
মৃত্যুর প্রতীক্ষায় এক অনন্ত দশা শুরু হয় মানুষের তাকে কী করে জীবন বলি বলুন তো ! মানুষের বুদ্ধি ও কর্মহীন কাল কখনো জীবন হতে পারে ! তবু আমরা প্রাণটুকু থাকায় তৃপ্তি খুঁজি ৷ বারবার বলি –আহা মানুষটার প্রাণটুকু ধুকপুক করছে ৷ থাক না
সে ঘরের পাঁচটি সামগ্রীর মতো ! তবু তো সে এ চরাচরে আছে ! রাতের আকাশের আলোকখণ্ডকে সে চাঁদ বলে হয়ত আজ আর চিনতে পারে না ! কিন্তু চাঁদ তো তাকে দেখতে ভোলেনি ৷ অর্থাৎ চাঁদের তাকে দেখার তো কোনো পরিবর্তন ঘটেনি ৷
বাগানের ফুলটুকু ফুটলে সে হয়ত আর ঘ্রাণ নেয় না ৷ তবু ফুল তার বাগানের হয়ে সৌরভ দেয় ! এও একপ্রকার থাকা ৷ হয়ত এখান থেকেই শুরু হয় মানবজীবনের সেরা প্রশ্নের খোঁজ ! কোনটি বড় হে !
জীবনের অর্থ না কেবল প্রাণের অস্তিত্ব !
দার্জিলিংয়ের সান্দাকফুতে পুরু বরফ পড়েছে শুনে একটি ভিডিও দেখতে বসেছিলাম ৷ দেখলাম সাদা বরফের রাজ্যে পাহাড়ী রাখাল গরু চরাতে বেরিয়েছে ৷ তার মুখে ওই পাহাড়ী ভাষায় ” হ্যাট হ্যাট ” চলছে ৷ একটিও টুরিস্ট নেই ৷ লোকালয় বা বনভূমি বলে কিছু যে কখনো ছিল তাই বোঝা যাচ্ছে না ৷ গরুর ঘন্টা আর রাখালের মুখনিঃসৃত ধ্বনি স্তব্ধ বরফের মাঝে যেন প্রাণ আনল ৷ রাখালের টুপিতে যত বরফ গরুর গায়েও তত বরফ ৷ মনে হচ্ছিল -দু ধরণের সাদা জীব যেন একটা যুদ্ধে বেরিয়েছে ৷ খাবার সংগ্রহের যুদ্ধ ৷ গরু খুঁজছে তার প্রাণধারণের ঘাস ৷ আর রাখাল খুঁজছে তার পোষ্যের খাবার – যাতে সে পোষ্যকে পুষ্ট করে দুধ পেতে পারে ৷ সেই দুধ সে বেচবে ও তার প্রাণধারণের প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করবে ৷ দুজনের খোঁজায় কিন্তু মিল আর মিল ৷ অনন্ত যখন রাখালটি এদিক ওদিক বরফচাপা ঘাস খুঁজছিল আর হ্যাট হ্যাট করে গরুটিকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে মারছিল ……..প্রাণে প্রাণে মিলটাই যে দেখলাম বেশী ! অথচ দুটির জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন ৷ …ও মাগো ! প্রকৃতি যেমন প্রশ্ন জাগাতে পারে তেমনি উত্তর মিলিয়ে দিতে তার জুড়ি নেই !
বরফের আর তুষারপাতে গবাদি আর মানুষ ! আহা তোরা দুই প্রাণী প্রাণে বেঁচে থাক বাপ ! প্রাণখানি ফিরে না পেলে জীবন নদী হবে না যে ৷
★★★★★★★★★★★★★★
৫৪
ডানা দুটি মেলেছ
বড় চমৎকার করে আজ সকালটা
হয়েছিল ৷ ঠাণ্ডা হাওয়ার সঙ্গে মেঘহীন পূর্ণ সূর্য ৷ ভোর থাকতে মায়ের কাছে যেতে হয়েছিল ৷ স্কুলে আসার জন্য ফিরছি অটো করে ৷ অটো থেকেও একভাবে আকাশ দেখে যাচ্ছি ৷ আকাশকে আজ বলতে হচ্ছে না –আমাকে দেখ ৷ সে কেবল তার মোহময় রোদভাব নিয়ে বিরাজ করছে — দেখার সিদ্ধান্ত পৃথিবীর বাসিন্দার –যারা নিয়ত তার আলো তাপে সিক্ত হয় ৷
অটোয় বসে ছাগলের মতো এসবই ভেবে যাচ্ছি –দুম করে একটা আকাশনীল বল আমার কোলে ঝুপুস হয়ে পড়ল ৷ আকাশ থেকে গড়িয়ে এল নাকি ছোট একদলা আকাশ ? দেখি –নীল সোয়েটার টুপি পরা একটা গোল বাচ্চা ৷ ওয়াটার ব্যাগটাও নীল ৷ এত জোরে লাফিয়ে অটোতে উঠল –অটো কাঁপল –আমার কোল কাঁপল ৷ মায়েরা বুড়ি হলেও কোল ছলবল করতেই থাকে ৷ সন্তানকে কোলে নেওয়ার ছল বাড়ে ৷ একে অবশ্য আমাকে আর কোলে নিতে হল না ৷ সে ছেলে নিজেই মা আর আমার মাঝে নিজেকে ভালো করে সেটিং করে নিল আর শরীরের বেশি অংশটা আমার দিকে রাখল ৷
আমার কাঁধে মাথা রেখে মাকে প্রশ্ন —
প্র : মা সবসময় পড়তে ভালো লাগে ?
মা : একদম উচিত নয় –মাথা তাহলে লোহা হয়ে যায় ৷
নিজের মাথায় দুটো টোকা মেরে ছেলে দেখে নিল তার মাথা ইতিমধ্যেই লোহা হয়ে গেছে কিনা ! মা হেসে বললেন –হয়নি –মাথা তোর এখনো ফুলের মতো নরম আছে ৷ বাড়ি গিয়ে মাছ ভাত খেয়ে ঘুমবি ৷ তাহলে তোর মাথার ফুলটা আরেকটু ফুটবে ৷
ছেলের প্রশ্ন : বিকেলে যদি খেলি ?
মা : যদি তুই মোবাইল না দেখে অনেকক্ষণ
আমাদের বাড়ির সামনের মাঠটায় খেলিস
তাহলে সূর্য চলে যাওয়ার সময় মাথায় তোর
অনেকগুলো ফুল ফুটিয়ে যাবে ৷ কালো
চুলের ফাঁকে কমলালেবুর
কোয়ার রঙের ফুল ৷
ছেলে : সূর্য ফুল কোথায় পাবে ?
মা : আকাশ থেকে ৷ সেখানে তোমার অনেক
দাদু দিদা আছে তো ৷ তাঁরা পাঠিয়ে দেবেন ৷
ছেলে : সবাই আমার দাদু দিদা ?
মা : সবাই ৷
ছেলে : তাহলে সবার জন্য স্কুলের প্রেয়ার
গানটা গাইব মা ? আজ নতুন
শিখিয়েছে ৷
মা : সন্ধেবেলায় ৷ সূর্য যখন নিজেই
রেণুভরা এক ফুল হয়ে যাবে –
সবথেকে বড় ফুল ৷
খেয়াল করিনি আকাশের বৃদ্ধ বাসিন্দাদের দেখার জন্য ছেলেটা কখন তার আরেক মায়ের কোলে চড়ে বসেছে ৷ ব্যাটাও বোঝেনি এই অচেনা মা টাও তারই ৷
★★★★★★★★★★★★★★★★
৫৫
কাঁচা হলদে বাঘটা
আমাদের স্কুলের এক মেয়ে চলে গেল কদিন আগেই ৷ মেয়েটা ডাউন সিনড্রোম ৷ গোটা এক রাত শ্বাসকষ্টে জ্বালাপোড়া হয়ে ভোর নাগাদ সে গেল ৷ পরদিন আরেকজন অভিভাবক এসে যখন মেয়েটির মৃত্যুর খবর দিলেন এবং কীভাবে সে মরেছে সেটা বললেন , তখন খেয়াল করলাম স্কুলের সবথেকে দুষ্টু ছেলে বাঘু হাঁ করে শুনছে ৷
এমনিতে বাঘু সদা আনন্দিত ছেলে ৷ জীবনের সামান্য সামান্য ঘটনায় আনন্দ পেতে জানে ৷ তার আনন্দ পাওয়ার বহর দেখে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই ৷ পুলিশ ফাঁড়ির বড় মাঠের পরিবর্তে তাকে যদি বলি স্কুল বাড়ির গলি ধরে ছোট বাঘু হাসতে হাসতে রেস দেবে ৷ জুতো নেই তার ৷ পায়ের সস্তা চটিতে মাঝে মাঝে রাস্তার কুকুরের পটি মেখে যায় ৷ বাঘুর দৌড় থামে না ৷ সিকনি মোছার জন্য বড় রুমাল কিনেছে বাঘু ৷ সেটা নিয়েও হাসি ৷ কখনো সেটা দিয়ে নাক ঘষে লাল করে ফেলছে ৷ কখনো আবার সেটা পাগড়ি করে পরে সূর্য খেদায় বাঘু ৷ বলে –এই সূর্য দেখবি মজা ! খালি আমার চুলগুলো গরম করা তোর ! হ্যাট হ্যাট ! এই দ্যাখ পাগড়ি পরেছি ! এবার কোথা দিয়ে ঢুকিস দেখি !
তো সেই বাঘু তার মতো এক বাচ্চার মৃত্যুর খবর শুনে চুপ করে রইল ৷ সূর্য এদিন খুব ছিল ৷ স্পোর্টসের প্র্যাকটিস চলছিল ৷ দেখি ,খেলা বন্ধ বাঘু তার পায়ের বুড়ো আঙুলটা মন দিয়ে দেখছে ৷ আমি কাছে গেলেও চোখ আর তোলে না বাঘু ৷ অথচ সে সবার কাছে বড় গলা করে বলে বেড়ায় -ময়ূরী ম্যামকে ভয় পাই নাকি আমি ! ম্যাম ভয় পায় আমাকে ! আমি ম্যামকে তাড়া করি কিনা ! তাই ম্যাম ভয় পেয়ে বাঘু বাঘু করে ৷ কাছে যাওয়া সত্ত্বেও তাকাল না দেখে আমার বুকটা কেমন হাহাকার করে উঠল ৷ কেন কে জানে ! জিজ্ঞেস করলাম —
–বাঘু রান রেস হচ্ছে ৷ লাইনে দাঁড়া সবার সঙ্গে ৷ ওয়ান টু থ্রি বলব ৷ তারপর রুমাল নাড়ব ৷
বাঘু বলল – এখন না পরে ৷
মুখ নীচু করে উত্তরোত্তর ভ্রু কুঁচকেই যাচ্ছে ছেলেটা ৷ চোখের কোলে আঙুল ঠেকালাম ৷
বাঘু বলল – ম্যাম আমার নখে কেমন রোদ লাগছে দেখো ৷ নখগুলো কাঁচা হলুদ হয়ে গেছে ৷ তবে আমার আর সর্দি লাগবে না বল ম্যাম !
বাঘু কাঁদছে না ৷ বন্ধু মরে গেছে শুনে একটিবার জিজ্ঞেস করছে না তার কথা ৷ শুধু শরীরে রোদ
আসায় আশ্বস্ত হচ্ছে ধীরে ধীরে ৷ দুপুরের সূর্য তার সমস্ত প্রসারতা সমস্ত ঔদার্য্য দিয়ে বন্ধুহারা শিশুর চারপাশ ছেঁকে ধরেছে ৷
জীবন রাখার আকুতি বাঘুর মুখখানাকে একটি খরাতপ্ত ক্ষেত বানিয়ে দিয়েছে ৷
খরার ক্ষেত বড় জেদী হয় ৷
শস্য আনার হাসি তারই ৷
★★★★★★★★★★★
৫৬
কলাপাতায় মাখম
আজ রান্নাঘরের জানলায় উত্তরের বাতাস পেলাম ৷ খুব সামান্য সে বাতাস ৷ তবু শিরশির ভাবটা টের পাচ্ছিলাম ৷ খাটালের পেয়ারাগাছের দু একটা পাতা খসে পড়ছিল ৷ এ গাছে কোনোদিন পেয়ারা দেখিনি ৷ কেবল পাতার নাচন সারাবছর
৷ বর্ষার জলে পাতাগুলো ভিজে কুঁকড়ে যায় ৷ পাতার কোটর তৈরী হয় ৷ কার জন্য কে জানে ! পাখি যে দেখি না এমন নয় কিন্তু বৃষ্টিভেজা ডানা নিয়ে পাতার কোটরে তারা এসে বসেছে এমন দেখিনি ! অনেকসময় এমন হয় !পৃথিবী মনে করে জীবের আবাস সাজিয়ে রেখেছে ! কিন্তু গেরস্ত নেই ৷
একটি মাখনরঙ বাচ্চাকে দেখলাম , মায়ের কোলে বসে গরুর দুধ দোয়ানো দেখছে ৷ চোখ পিটপিট ৷ মা মাথার ওড়নাটা বাচ্চার শরীরে জড়িয়ে রেখেছেন ৷ আগে গোয়ালাবাড়িতে এ বাচ্চাটিকে কখনো দেখিনি ৷ বোধহয় প্রথম এ বাড়িতে এসেছে ৷ তার ছোট্ট ইজের আর তার মায়ের ঘরোয়া পোশাক দেখে বুঝলাম গোয়ালার নতুন আত্মীয় ৷
খরিদ্দারদের দুধ দেওয়া শেষ হলে বাছুর ছেড়ে দিলেন গোয়ালা ৷ দেখো দিকিনি ! নিজের মায়ের দুধ সবথেকে কম পরিমাণে পাবে সন্তান ! মানুষের লোভে রোগা থেকে যাবে অন্যান্য জীব ! ঝুপ !
মায়ের কোল হড়কে নেমে গেল মাখন ৷ তারপর নামাজ পড়ার মতো বসল বাছুরটার কাছে ৷ সাথী পেয়েছে ৷ এবার অনেকটাক্ষণ কাটাবে বাছুরের চুকচুক দুধ টানা দেখে ৷ খুশী হবে খুব ৷ পাখি ডাকলে শিশু হেসেছে ,এ কতবার দেখেছি আমি ! অন্য জীবের খুশীতে শিশু তৃপ্ত হয় ! হয়ত তার খুশী বুনোফুলের তীব্র গন্ধের মতো এসে চলে যায় ৷ কিন্তু কখনো কখনো হলেও , শিশুই তো অপরকে বেশী করে দেখে !
শিশু যখন নিবিড় বাছুরের বাঁট চোষায় , উত্তর থেকে ফের হাওয়ার ঝাঁক এল ৷ পেয়ারা পাতা আরো কিছু ঝরল মাখনের গায়ে ৷ মাখনের চোখ গাছে ঘোরে ! বসে বসে ঝরা পাতা ঘাঁটে মাখন ৷ একবার বাছুর একবার গাছের মাথা দেখে ৷
ঠিক করতে পারছে না , কোনটা বেশী জীব ! গাছ নাকি দুধ বিলিয়ে শুকনো হওয়া গরুর এই বাচ্চা ! সকালে জীবের খিদে বেশী ৷ পেটভরা দুধ না পেয়ে বাছুর ক্লান্ত হচ্ছে ৷ তার দাঁত জিভ সব বিরক্ত হয়ে উঠছে ৷ মাখন রঙের শিশু একবার চটকানো পাতাগুলো পরপর সাজায় – বাছুরের পিঠে হাত দিতে যায় ৷
মানবশিশুর স্পর্শে গাভীসন্তানের চামড়া কাঁপে তিরতির ৷ মাখনের কল্কে ফুলের মতো আঙুল মুহুর্মুহু ইচ্ছুক হয় ! জীবস্পর্শে অথবা জীবকে স্পর্শের আহল্লাদে ! জীবন স্পর্শের গোপন গভীর সুখ ! ওকি আর স্পষ্ট করে কওয়া যায় গো !
৫৭
প্রজাপতি
কিছুদিন আগে এক মেয়ে হোম সার্ভিসে খাবার দেওয়ার কাজ শুরু করেছেন ৷ স্বামী মারা গেছেন ৷ দুটি ফুলসম শিশু ও মাকে নিয়ে আনন্দে এবং নিজের জোরে বাঁচার চেষ্টা করে যাচ্ছেন ৷ চমৎকার ও পরিচ্ছন্ন রান্না ৷ খাবার দেওয়ার ধরণ, পরিমাণ এবং মেনুর ঘনঘন পরিবর্তন দেখে বুঝতে পারি , ব্যবসা থেকে অর্থপ্রাপ্তির সঙ্গে মানুষের ভালোবাসা পাবার ও ভালোবাসবার ইচ্ছেটাও সবসময় রাখে ৷ আমার পঞ্চাশ বছর আর কিছু না হোক মানুষের ভালোবাসা চিনবার ক্ষমতাটুকু দিয়েছে ৷
ফলে জীবনে এই প্রথমবার ওঁর থেকেই আমার হোম সার্ভিসে খাবার নেওয়া ৷ আজ দুপুরবেলা যখন স্কুলে খাবার দিতে এলেন , স্কুলের একটি বিশেষক্ষমতাসম্পন্ন বাচ্চা ওঁকে জিজ্ঞেস করল —
তোমার নাম কী গো ?
স্বাভাবিক মানুষরা ,বলা ভালো নিজেকে যাঁরা অতি স্বাভাবিক ভাবেন , সাধারণত এই ধরণের বাচ্চাদের আলাপচারিতা এড়িয়ে যান ৷ বড়জোর করুণামাখা গলায় দু এক কথা বলেন ও পাশ কাটান ৷ ফলে বিশেষক্ষমতাসম্পন্ন শিশু এবং পূর্ণবয়স্ক উভয়েই একটি কোটরে আটকে পড়েন ৷ বাইরের ভালোবাসা ও ভাষা তাদের কাছে আর পৌঁছয় না ৷ আজ কিন্তু এ মেয়েটি আমাদের স্কুলের ছোট বাচ্চটির উত্তর দিয়ে বললেন —
আমার নাম তো নির্ঝর ৷ তোমার নাম কী ভাই ?
বাচ্চাটির সঙ্গে আমিও আজ জানলাম –আজকাল যাঁর রান্না খেয়ে পেটভর্তি তৃপ্তি নিয়ে ঘুমোই তাঁর নাম নির্ঝর এবং তিনি স্বাভাবিক মানুষের সাথে সাথে এই সব বিশেষক্ষমতাসম্পন্ন শিশুকে সমান সম্মান ও ভালোবাসা দিতে জানেন ৷ দিতে চান ৷ আমি জানি দুপুরের এই সময়টায় নির্ঝরের আরো অনেক বাড়ি খাবার দেওয়া থাকে ৷ নিজের বাচ্চাদুটোর দেখভাল করা থাকে ৷ সময়টা যেমন কঠিন তেমন মাপা ৷ তবু দেখলাম ,নির্ঝর বাকি টিফিনকৌটোগুলো একপাশে নামিয়ে রেখে আমাদের ছাত্রীটির সঙ্গে গল্প করেই চলেছেন এবং গল্প করছেন ঠিক তারই মতো করে ৷ যেন দুই বন্ধু ৷
আমি বাচ্চাটাকে বললাম —
এবার ওঁকে ছাড় ৷ উনি কাজে যাবেন ৷
মৃদুর বেশি ধমক বোধহয় নির্ঝর পারেন না ৷ তাঁর তিরস্কারের মধ্যেও হাসি ও বেদনা কলাপাতায় মোড়া মাখন হয়ে থাকে ৷ তো সেটুকু হাসিঅশ্রু মিশিয়ে নির্ঝর বললেন —
–
দিদি ওকে বকবেন না ৷ আমাদের যেমন কথা বলার অধিকার কাছে ওদেরও আছে ৷ আমরা কথা বললে আমাদের কি কেউ থামায় দিদি যে আমরা ওদের থামাব ? আমি দিদি বুঝতেই পারি না ওদের কথাবার্তায় ঘন ঘন বাধা দেওয়ার অধিকারটা আমাদের দিলে কে !
আরো কত মধুর সত্য যে বলে চলছিলেন নির্ঝর ! ঝরঝর বৃষ্টি হয়ে ঝরছিল তাঁর বাক্য —
দিদি আমরা যদি এইসব বাচ্চাদের কথা না শুনি ওরা তো কোনোদিন স্বাভাবিক জগতের স্পর্শ পাবে না ৷ ওদেরকে আমাদের আরো বেশি করে সময় দিতে হবে ৷ আমি দুটো বাচ্চার মা ! কিন্তু দিদি আমি অন্তর থেকে বিশ্বাস করি সব বাচ্চা এবং তাদের সমস্তটুকু নিয়েই আমার সংসার ৷ আমার বড় মেয়েটাকে আমি বলেই রেখেছি কোরক স্কুলের বাচ্চাদের আসতে যেতে দেখলেই তুমি এগিয়ে গিয়ে কথা বলবে ৷
কখন দেখি আমার সেই স্প্যাস্টিক ছাত্রীটি নির্ঝরের হাত নিজের বাঁকা দুটো হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে ফেলেছে ৷ নির্ঝর এবার খাবার নিয়ে অন্য মানুষের বাড়ি যাবেন ৷ আবার কখনো না কখনো আবার স্কুলে এসে বাচ্চাকটার কাছে ফিরবেন ! — যেখানে ওর সংসার ৷
ওহ ! বড় বড় পা ফেলে চলে যাচ্ছিলেন নির্ঝর ৷ আরে ! নির্ঝরের চুল খুব লম্বা আর ঢেউ খেলানো তো ! হাঁটলে সে চুল নাচ করে ৷ পথের দুপাশের গাছপাতা পচা গরমেও এতো টাটকা দেখাচ্ছিল আজ !
মন ভালো হলে মানুষ অলীক সত্য দেখে ,তাই না ? বা কল্পসত্য ৷
আসিস রে ৷
★★★★★★★★★★★★★★
৫৮
যে সাগরে
তখন আমার মায়ের বাড়ির পাশেই বাস করত এক মিষ্টি-মস্তি বাচ্চা ৷ জযেমন ফুলের মতো দেখতে তেমনি শস্যসবুজ মন ৷ আর সে মনে দিনের সবসময়েই আনন্দের বাস ৷
কখনো বাবার সাথে সাইকেলে ঝুলে আছে , দু পা দুপাশ থেকে ৷ ইজের নেমেছে হাঁটুতে ৷ কখনো Very Simple বাঁদর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাগানের লতানে গাছের গোড়ায় ৷ চোখেমুখে ঝকঝকে প্ল্যান – লতায় চড়বে ৷ ডগায় মারবে লাফ ৷
আমায় কিছুতেই ভালোবাসবে না ৷ ভাল না বাসার যেন পণ করেছে সে মেয়ে ৷ গায়ে হাতও লাগাইনি ,দূরে দাঁড়িয়ে আছি ,তাও আমায় দেখলেই কাঁদতে শুরু করবে ৷ তারপর আরো দূরে গিয়ে ভেঙচি মেরে নিরীহ হাসি দেবে ৷
অন্যদিন আমার প্রতি তার এই বীতরাগ চুপচাপ হজম করে যাই ৷ একদিন জেদ চাপল ৷ ভালোবাসিয়েই ছাড়ব আজ বাঁদরটাকে ৷ একবার ভদ্রভাবে বললাম-
চুপচাপ কোলে আসবি ৷
নাক কুঁচকোল ৷ রেডি ছিলাম ভেতরে ভেতরে ৷ উল্টো করে কোলে তুলে নিলাম ৷ মানে মুখটা রইল মেঝের দিকে ৷ আমার এক হাতে তার মুণ্ডু — পা দুটো অন্য হাতে ৷ পাতালে ঢুকে যাচ্ছে ভেবে প্রথমটায় চুপচাপ সমর্পণ করল নিজেকে ৷ যেন মাটির সমান্তরাল আকাশপথে উড়ছে লেডিস পাখি ৷ আমার পুতুলপাখি ৷ ঘরের বিছানায় এনে ফেললাম ৷ কোল থেকে নামতেই সম্বিৎ ফিরল পাখির ৷ বেজায় চিল্লালো ৷
আমার হয়েছে আরেক মুশকিল ! পুরুষ না মজলে শরীরমন জ্বলে না এখন ! মাথা মন কোনোটাই ঘামে না প্রেমে ৷ কিন্তু বাচ্চা ভালো না বাসলে খেপি ৷ খুব খেপি ৷ সেদিনও খুব খেপে গিয়ে জানলায় রাখা মায়ের লাল টিপের পাতা থেকে টিপ খুলতে শুরু করলাম ৷ খুলছি ৷ফের লাগাচ্ছি টিপেরই পাতায় ৷ ভালোবাসার কুস্তি চলছে পাখির সঙ্গে ৷ হাওয়ায় জানলার শিকে পৌঁছেছে গন্ধরাজের পাতা ৷ অন্যমনস্ক হয়ে কখন জানি একটা টিপ তুলে লাগিয়ে দিয়েছি গাছের পাতায় ৷ দেখি কান্না থামছে তার ৷ মন দিয়ে দেখছে আমার কাণ্ড !
কী দেখিস পাখিমেয়ে ? এক উজবুক মাকে ! বেশ বেশ আমি তাই ৷
পটাপট টিপ তুলে লাগিয়ে দিতে থাকলাম গন্ধগাছের বেশ কটা পাতায় ৷ যতদূর জানলা দিয়ে হাত যায় আমার আর যতদুর দেখতে পায় আমার কোলের পাখি , ঠিক ততদূর ৷ সবুজ সবুজ পাতায় ইয়া ইয়া টুকটুকে সব টিপ ৷ ভাদ্রের রোদ তাতে চিকচিক ৷ খানিক পরেই মেঘের ছায়া পড়ে সে লাল টিপ সাজাপানের টুকরো খয়ের হয়ে যায় !
টক করে একটি লাল টিপ পরিয়ে দি কোলের মেয়েটার ছানাশুভ্র কপালে ৷ লাল রঙ বুঝি রাজি করায় তাকে আমায় ভালোবাসতে ৷
কোলে চড়ে বসেছে ৷ হি হি হি ! আরে ! কোলের মধ্যে কাতাকুতু লাগছে যে নরম নাকের ঘষায় ৷ চুক চুক চুক ৷ তিনটি সলিড চুমু ৷ মাইরি !
মাত্তর তিনটি চুমু ৷ ব্রহ্মাণ্ড ৷
প্রণাম বিদ্যাসাগর ৷
তুমি ওই লালবরণ আকাশে ৷
বাতিল না হওয়া এক রঙরঙ্গে মিশে ৷
বিধবার গগনে চিরকাল যেন থাকে সমর্থ পুরুষ ৷
হঠাৎ আসুন মহাশয় ! সর্ব ঔদার্য নিয়ে ৷
[ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে এই লেখাটা যে কেন এল আমার ! ]
★★★★★★★★★★★★★★
৫৯
তাহারা গান গায়
আদাজল খেয়ে চড়াইগুলোর পিছনে পড়েছে শালিখ দুটো ৷ সন্ধেতে বেশ কিছু দানা ছড়িয়ে দিয়েছিলাম মায়ের ঘরের বারান্দায় ৷ তারপর থেকেই মাথাখারাপ করে দিচ্ছে হিংসুটে শালিখ ৷ ওদের যে খিদে লেগেছে বলে চড়াইগুলোর সাথে ঝগড়ায় মেতেছে এমন নয় ৷ বহুদিন আমি শালিখ দুটোর জন্য আলাদা প্লেট সাজিয়ে দেখেছি ৷ নিজের খাবারে মন তো লাগাবেই না , উল্টে হামলা চালাবে চড়াইগুলোর ওপর ৷ ঝামেলা ঝঞ্ঝাটে যত আনন্দ ওদের ৷ চড়াইগুলোও কম বিচ্চু নয় ৷ সমানে শালিখের পেট ঢুঁসোচ্ছে ৷
বকুলগাছের বুলবুলি মীমাংসায় নামল ৷ শালিখ চড়াইয়ের মামলার থার্ডপার্টি ৷ মুফতে দুচারটে দানাও মেরে দিল প্যারে বুলবুলি ৷ ঝপাঝপ মারল একদম ৷ গামবাট চড়াই শালিখগুলোকে কথা বলার স্কোপই দিল না ৷ অবশ্য ঝগড়া করতে করতে সে ব্যাটাদেরও খাদ্যগ্রহণের মুড নেই ৷
ওরে — ওরে মতিহারা পক্ষী —- খুনখারাবি করবি নাকি রে ? দ্যাখো দিকি সন্ধ্যে ঘন হলো যে ! ওমা রে — সব কটা কেমন একসাথে বকুলগাছের পানে চলেছে ৷ সন্ধে জ্বালবি বুঝি বকুলদীপে !
শোনো শোনো ! পক্ষীকণ্ঠগুলো কেমন একযোগে ক্ষীরদুধের মতো মিঠে হচ্ছে ! ভোর অব্দি একটি লম্বা তৃপ্তির ঘুম দেবে ! মানুষ বড়ো অশান্ত করে ! পাখির কাকলি ! কী সুখ রে !
তোদের গান জড়িয়ে ধরুক আমার মনোহরা মাকে ৷
নিবিড়ঘন আঁধারে
ভোর হবে যবে
নতুন করে জন্ম নেব মা !
★★★★★★★★★★★★★★★★★
৬০
চোখের বাহিরে
এবার আমাদের শহরে বেজায় শীত পড়েছিল ৷ রাতের ঠাণ্ডায় শরীরে কেমন এক ঝাঁকানি বোধ করতাম ৷ বুড়ো হচ্ছি তো ৷ শীতরাত্রে কেবলই মনে হয় , রাত যেন দুষ্ট এক বাচ্চা হয়ে হাত পা ছুঁড়ছে ৷ আর বাচ্চাদের মতোই শিকনি মাখা নাকে টানা লম্বা শ্বাস ফেলছে ৷ এমনটা মনে হলেই বরাবর দেখেছি , আমার খুকিবেলার সেই শীতবুড়োটা চলে আসে স্মৃতির ডগায় ৷
আমি তাঁকে ডাকতাম শীতদাদু বলে ৷ শীতদাদু ছিলেন আমার ঠাকুরদার পণ্ডিত মশায় ৷ মানে আপনি ধরে নিতে পারেন ঠাকুরদা ও ঠাকুরদা ৷ কিন্তু যে সময় আমি তাঁকে দেখি –আমার সেই খোকা চোখের ফুটিফুটি কালে মনে হয়েছিল ছাত্র মাস্টার বুঝি একই সময়ে এসেছেন এ ধরাতলে ৷ দুজনে যেন একেবারে হাত ধরাধরি করে এসেছেন ৷ অথচ দেখুন , হিসেবে একজন আরেকজনের চেয়ে অন্তত এক কি দুদশক বড় হবেন ৷ বড় হবেন — এই ছিল স্বাভাবিক ৷একজন আরেকজনের আগুপিছু না হলে মাস্টার ছাত্র হবেনই বা কী করে ! সেসময় কিন্তু মনে হতো এঁরা আমার জোড়া ঠাকুরদা বা একই ঠাকুরদার দুটো পিঠ ৷ একদেহের সামনে পিছে দুইখান মুখ ৷
ঠাকুরদার পণ্ডিতমশায়কে কেন যে শীতদাদু বলতাম স্পষ্ট মনে করতে পারি না ৷ মাস্টারমশায়ের বয়স কিংবা স্ট্যাটাস সমঝে নিতে যে ধরনের ধারালো জ্ঞানগম্মি লাগে তা তখন ছিল না ৷ কেবল এটুকু মনে আছে ,পণ্ডিতমশায়ের কাঠি হাতের নীল শিরাগুলো দেখে কেমন এক শীত শীত ভাব হত ৷ অথচ হাতে লাঠি বা কাঁধে ঝুলি — গ্রামের পণ্ডিতমশায়দের যে ধরনের মলিন ও নিরুপায় বেশভূষা ঠিক করে রেখেছে বাংলা উপন্যাস , তার লেশমাত্তরও ছিল না শীতদাদুর ৷ কান্না ফাননা বা ক্লান্তি টানতির বালাই ছিল না ৷ মোষকালো পাম্পসুতে খচমচ করে আসতেন আমার ঠাকুরদার কাছে ৷ আনস্মার্ট লাগত না কিন্তু ৷ বরং শব্দময় গরিমা তাঁর সে চলনে ৷ দুপুরবেলায় তেলাল সর্ষে রঙের পেতলের থালায়, ঢিবি ভাতের সঙ্গে অন্তত পাঁচ ছ রকম তরকারিপত্তর দিয়ে ভাত খেতেন আমাদের বাড়িতে ৷ তাঁকে নিজের হাতে খেতে দিতেন আমার ঠাকুরদা ৷ ছাত্রের দিকে একটুও না তাকিয়ে নিমেষে তা শেষ করতেন পণ্ডিত ৷ বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা ঐ ছোট বয়সে পণ্ডিতমশায়েরবেলাজ খাওয়া দেখে কেমন কিরকির করত মনটা ৷ কালো বোর্ডে চক ঘষটে গেলে যেমন অস্বস্তি জাগে অমন ৷ খালি মনে হত- এতো মন লাগিয়ে এতো পরিমানে এতো রকমে খেয়ে ইনি এবার করবেনটা কি ? আবার পণ্ডিতমশায়কে আমার মনে ধরা বা পণ্ডিতে আমার মন লেগে যাওয়া তাঁর ঐ চারুহীন খাওয়াটি দেখেই ৷
আর আমি তখন কী করতাম , বলি ? শিকারি বিড়ালের মতো কাপ ধরে বসে আছি তো আছিই ৷ ভাবছি , খেয়ে উঠে পণ্ডিত ঠিক কী গল্পো বাঁধবেন আমার জন্য ? এতো করে খেলেন যখন – নিশ্চয় আজ আমাকে একটা ফান্টাস্টিক অন্যগল্প বলবেন ৷ অন্যগল্প –নিত্যদিনের সুখে যে গল্প থাকে না ৷ বা – বা ধরুন দরিদ্রই যে গল্প তৈরী করতে পারে ! হ্যাঁ –দুখী হিরো বা দুখী রাণীর গল্পই তো চাইতাম তাঁর কাছে ৷ কথক যেমন –তেমনই হবে তাঁর গল্পের মানুষরা — এমন একটা অদ্ভুত অপেক্ষা তৈরী হত আমার ৷ আর রোজ রোজ বোর হতাম ৷পণ্ডিতের গল্পে রোজই সার বেঁধে দাঁড়াত দুনিয়ার যত সুখী মানুষ ৷ জাস্ট ভাবুন একবার — গল্পে কোন দুখীই নেই ৷প্রজাই নেই ৷ শুধুই রাজা কিংবা শুধুই রানী – তারা সব একধারসে বেধড়ক সুখী ৷ রাগ আমার গনগনে হত ৷ বুঝে মাঝে মাঝে কাহিনীতে ভ্যারাইটি আনার চেষ্টা করতেন শীতদাদু ৷ ইয়ং হ্যান্ডসাম কুমার বা কুমারীরাও গল্পে আসতেন — কিন্তু সব ঐ দুঃখবিলাস মেখে ৷ বিরক্ত হয়ে ভাবতাম — এক পলা সর্ষের তেলও কি ঘষা যায় না এ শালার সুখে ভরা রাজা রানীর রসভরা চোখে? ঢাউস সুখে নাহয় একটু পড়ুক কোনো এক দুখু মিয়ার পানিজল !
হত না ৷ পণ্ডিত যেন জলহংসের সতর্কতায় সাইড কেটে যেতেন দুঃখগুলোকে ৷ একঢালা সুখের গপ্পে দ্রুত ঘুমে ঢুলতাম আমি। একসময় গরীব পণ্ডিতের সুখের গল্প শেষ হত ৷ ঠাকুরদার কাছ থেকে সামান্য মাসখরচটুকু নিয়ে এবার যে তাঁকে ঘরে ফিরতে হবে ৷ যেখানে তাঁর একটি রোগে ভোগা মেয়ে ৷ মেয়ের বাপ অবশ্য হেসে বলতেন —ও আমার শুকনো শাকের গোছা ৷
বড় হচ্ছিলাম আমি ৷ কত্ত তাড়াতাড়ি হারিয়ে যেতে লাগল আমার ছেলেবেলার সুখী পণ্ডিত ৷ কখন কীভাবে জানি না তো ভাই !
বহুকাল বাদে একবার শীতের সমুদ্দুর দেখতে গিয়েছিলাম ৷ সে সমুদ্রে ঢেউ সরে গ্যাছে অনেকদূর ৷ আগে যেখানে সমুদ্র এখন সেখানে একটি পায়ে চলা বালু রাস্তা ৷ রাস্তা শেষে বাতিঘর ৷ হাঁটতে লাগলাম বাতিঘরের দিকে চোখ রেখে —৷ পিছু ফিরে দেখছিলাম , তীরে কত মানুষ ৷ দোকানপাতি ! ঝাঁঝালো টিউবে জ্বলছে পসরা ৷
ওমা গো !
বাতিঘরটা এমন আঁধার কেন গো !
আলোর ঘর আমার এমন করে ভূত হয়ে গেল কখন !
মানবের জলযান দিশা হারাবে যে গো মা !

