ধারাবাহিক – ‘আমার তারা’ ময়ূরী মিত্র ৬ ও ৭

ধারাবাহিক – ‘আমার তারা’ ময়ূরী মিত্র ৬ ও ৭

পূর্বে প্রকাশিত– প্রথম পর্ব

 

 

 

পুঁটি আর কড়াইশুঁটি 

 

পর্ব – এক

 

ঠিক বারোয় পড়েছি তখন ৷ ঐ বয়সেই একটা নয় বছরের  মেয়ে জুটলো আমার ৷ দুর্দান্ত এবং দুরন্ত  কিম্ভুত তার সাজপোশাক ৷ কোনোদিন যদি ঘেরওয়ালা  ফ্রকের সাথে একটি  পকেটওয়ালা খোকাপ্যান্ট পরল তো আরেকদিন কেশহীন মুণ্ডুতে  বাঁধল  চকরাবকরা রিবন ৷  পাড়ার খুড়িপিসিদের খবর — মা ছাড়াই মামা মাসীদের কাছে মানুষ হচ্ছে  মেয়েটা ৷   তার মা তাকে ফেলে  কোথায় গেল – আবার কোনোদিন ফিরবে কিনা- মা ছাড়া সে মেয়ে কতটা দুখ বয়ে বেড়ায়- এসবে একছটাক  কৌতুহল না দেখিয়ে প্রথম দিনই ফট করে ঠিক করলাম – এ মেয়ের মা হয়ে যাব আমি ৷

নাম দিলাম পুঁটি ৷ আমার পুঁটি মেয়ে ৷  পুঁটি মেয়েকে লালন করা কিন্তু সোজা হয়নি আমার পক্ষে ৷ প্রথম কথা বারো বছরের মা আর নয় বছরের মেয়ে ৷ আমি যদি তার ইজেরের ইলাস্টিক টেনেটুনে ঠিক করে দি তো সে তৎক্ষণাৎ আমার ঘটিহাতা ছোট্ট  ব্লাউসটার টিপ বোতাম লাগিয়ে দেবে ৷ আবার আমি যদি তাকে কদবেল জারিয়ে খাওয়াই তো সে আমার মুখে  সরস্বতীপুজোর চালমাখা  ঠুসবে ৷ দলা দলা চালমাখা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসত আপনা হতেই –হারামজাদী পুঁটি কচি আঙুলে  আমার ঠোঁট চিপে ধরত ৷ কাঁচা চাল ভেজা — মুগডাল যত ফালতু জিনিষ গিলে মর এবার ৷ দ্বিতীয় কথা হল – তার  যে মা  নেই এবং বাকিদের  যে আছে  —  থাকা না থাকার এই গ্যাপটাই ধরতে পারছিল না সে ৷  শোকতাপের বালাই তো নেইই – দিনরাত রাক্ষসী হাসি হেসেই চলেছে ৷ আহা রে মা নেই গো মেয়েটার –কোনোরকমে এরকম একটা অনুভুতি তৈরি করে যখনি তার মাথায় বিলি কাটতে গ্যাছি ফিনফিনে চুল দুলিয়ে ” পটি করব ” করব বলে পালিয়েছে পুঁটি  ৷ দুদিনের মধ্যে আর এলই না মোটে আমার কাছে ৷  মায়ের আদরে তার এমনি অনীহা –  যেদিন আদর আদর বাই চাপতো আমার —  বিনাবাক্যে আমায় কষিয়ে দিত চড় ৷

ব্যাস এবার তার বারো  বছরের  মাও মারপিটে নেমে পড়ল ৷ পারছিলাম না —  পারছিলাম না ৷  মা হওয়ার খেলায় জিততে আর পারছিলাম  না ৷  এরই মাঝে বড় মাঠে দুধেল গাই মরল ৷  পুঁটির বায়না – মরা গরুর চোখ কেমন খুলে থাকে তাই দেখবে ৷ বলাবাহুল্য পুঁটিমেয়ের এইসব বিদিকিচ্ছিরি আবদারে পরের দিকে আর তেমন অবাক হতাম না ৷ আমার   মাকে লুকিয়ে দুজনে মিলে গেছি মরা গাই ঘাঁটতে ৷  হাতপা ছড়িয়ে কাঁদছে গরুর পালক ৷  হিহি করে হাসছে  রাক্ষসী পুঁটি ৷ মুখ চেপে ধরেছি ৷ হঠাৎ হাত ছাড়িয়ে সে  দৌড় দিল অনেকটা দূরে একা ঘুরতে থাকা একটা বাছুরের দিকে ৷ হাঁ করে দেখল খানিক ৷ তারপর টেপফ্রককে গোল্লা পাকিয়ে বানাল এক ঘেরাটোপ ৷  ছোট্ট মুন্ডিটা পুরো ঢুকিয়ে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল ৷ কত করে বোঝাল  সবাই — ওরে বাছুরটা মৃত গাভীর নয় ৷ এর মা তো বেঁচে আছে ৷ তবুও কাঁদল পুটি ৷ চোখ খোলা মরা মায়ের পাশে যে কোনো এক বাচ্চার একা হয়ে থাকাটাই কাঁদাল তাকে ৷  কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেল তার  ৷ শিকনি বেরিয়ে এল  ফতফত ৷ মাঠের মাঝেই পুঁটিমেয়ে  চড়ল  তার মায়ের কোলে ৷

ছোট্ট কোলে একটা  পুঁটি লাফায় দুমদাম ৷

মরা জীব

আর কি সয় !

মা মেয়ে খেলে

দিকবিদিক ভুলে ৷

সবুজ ঘাসের মাঠখানিতে

মোদের প্রাণবিন্দু ,

বৃষ্টি হয়ে ঝরে ৷

 

 

পর্ব –দুই

 

এ কাহিনীর যখন জন্ম তখন  আমার মা বুড়ি আর

আমি ধাড়িবুড়ি ৷ আর আমার বাচ্চাকোলের পুঁটি বড় হয়েই  ছুট্টে হারিয়ে গেছে ৷ তখন আমি

প্রায়ই মায়ের সঙ্গে রাত কাটাই –রাত পার করে দিনে লাফ মারি  মাতৃদেহের গরম নিতে নিতে ৷[

তো তেমনই এক রাতে  হাড়গোড় আমার জ্বালিয়ে দিলে গো মা ৷  সেরাতেও আমি মায়ের কাছে –  খেতে বসেছি দুজনে  ৷ সাধারণত মায়ের  গায় যতটা সম্ভব  ঠেস দিয়েই খেতে বসি আমি ৷ দুটো প্লেট থেকেই খেতে হয় তো আমাকে ৷ তাই ৷ মায়েরই নির্দেশে আমার জন্য সেদিন হাঁসের ডিমের কালচে  লাল কষা ৷ আমি বলি হাঁস কষা ৷ লাল ঝালে ভাত মাখার উত্তেজনায় কোনোদিনই তিনটে শব্দ একসাথে বলতে পারি না আমি ৷ ডিম বাদ দিয়ে বলি ,হাঁস কষা ৷ হাঁসের বিশেষ  গন্ধযুক্ত  কুসুমের শেষ টুকরোটা জাস্ট মুখে ঢোকানো বাকি  ! মা বললেন — এবার বোধহয় মরে যাব ৷ শোনামাত্তর একটিও প্রশ্ন না করে হনহন করে আমি দোতলায় ৷

 

সিঁড়ির ফাঁক দিয়ে দেখলাম,আমার না খাওয়া কুসুম নির্বিকারে সাফ করছেন মা ৷ আমার না খাওয়াতে  কোনো বিচলন নেই মায়ের ৷ অথচ মা বেশ জানেন , একমাত্তর এ কথায়ই বড় কষ্ট পায় তার মেয়ে ৷

 

রাতের  বিছানা ৷ চাঁদ টাদ ফুলের গন্ধ  যেমন যেমন থাকার কথা রয়েছে সেখানে ৷ আলোআলো  গন্ধটা  আসছে বিছানায়ও — যথেচ্ছ পরিমানে ৷যে যার মতো লুটোচ্ছে মা মেয়ের মোটা রোগা শরীরে ৷ শুধু দুজন দুমুখে ৷ প্রথমে ঘুরলাম আমি ৷ স্প্রিংয়ের মতো  ৷ মা ধীরে সুস্থে  পাশবালিশ জড়িয়ে ৷  মা কিন্তু জানে বেশ, আমিই মার চিরকেলে পাশবালিশ ৷  লাথাতে ইচ্ছে করছিল তুলোর বালিশটাকে ৷

 

ততক্ষণে রাতের চেহারা পাল্টে গেছে ৷ দিনের মতো রাতেও নানাসময় নানা পরিবর্তন ৷ গাছের পাতা বাতাস ডাকছে না ৷ বাতাসের অভাবে শালার পাখিগুলোও চুপ ৷ একি রাতের ছিরি হল গো ! অতো রাতে পাখি কেন না ঘুমিয়ে ডেকে ডেকে গলাগরম করবে ,   এ যুক্তি খুইয়েছি তখন ৷

 

মায়ের নির্বিকার ভাব যে আমায়  আরো ভালোবাসায় ভাসাচ্ছে ৷  যুক্তি ডুবছে  মাঝনদীতে ৷  মাঝ ফুরোল না  রাতের ৷ হুট করে উঠে বসে  দুমদাম ঝাঁকি দিলাম  মাকে ! ঘরঘরে গলায় রাতের প্রেতিনি বলে — মা তুমি কি সত্যি মরবে এবার ? ঠিক করে বল ৷ ওপাশ থেকে  উত্তর – মরব না তো কি অনন্ত বাঁচবো তোর জন্য ?  কান্না কান্না পাচ্ছিল ৷ পুরোটা না তাবলে ৷একটু কান্না কান্না ভাব আর কি ৷

 

ভোর হতেই  ক্রমাগত ঝাঁকুনি ৷ ছেলেবেলায় বকুল পাড়তে যেমন করে একনাগাড়ে গাছ ঝাঁকাতাম  দিতাম ,অমনি করে ৷ দুহাত দিয়ে মাকড়সার মতো আমায় ততক্ষনে জড়িয়ে ধরেছেন  মা ৷ রাতের প্রশ্ন মেটালেন  সূর্যোদয়ের মাঝে ৷ বললেন , মরব তো ! আবার বাঁচবোও যে ৷ প্রেতিনীর বুকে গুড়গুড় ৷ দুটো কেমনে সত্যি হবে মা ?

 

মা আবার তলিয়েছেন ঘুমে ৷  ভোরের হওয়া চলছে তখন ৷ মেয়েটা সংশয়ে বাগানের মাটিতেই   থুপ করে বসে  ৷ রাস্তায় তখন বাতাসে ঝরা ঝুড়ি ঝুড়ি  কামিনী ৷ ওমা ওই দ্যাখো !  ফিচেল পাখির দল ফুলের মধ্যে দিয়ে দিয়ে এঁকেবেঁকে চলছে ৷ ফুটবল খেলছে ফুল দিয়ে ৷ আর তাদের পায়ে পায়ে  ফুলগুলো দুপাশে চুড়ো খোঁপার মত  উঁচু হচ্ছে ৷

 

ওকি ! জমা ফুলের মাঝ বরাবর একটা কেমন পথের মতো তৈরি হচ্ছে না? একদম সরু একটা পথ ৷ বাচ্চা খুকির  একটুকরো পায়ের মাপের  পথ ৷ দেশমাতা ডাকে !

 

চল খুকি চল ৷হাঁট খুকি হাঁট ৷ ফুল ঝরে ৷ফুল ফোটে ৷

 

পেত্নী ছুট্টে চলে লক্ষ মায়ের ডাকে ৷

 

সে আজ পরী হবে ৷

 

 

 

৪৭

 

শিশু বিষ্ণু

 

এখন ভোরের বেলা ৷ ঘুম ভাঙতে মনে পড়ল , আজো স্কুল খুলল না ৷ এখনো মানুষের ,মানুষের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলার দিন শেষ হল না ৷ মনে হচ্ছে  যেন কতকাল আগে ঘটেছিল ঘটনাগুলো ! যেন কতকাল আগে  আমাকে ঘিরে বসে থাকত উন্মুখ বাচ্চাগুলো !  Differently Abled বাচ্চা তাদের different abilility প্রকাশ করতেই যেন একটু বেশী হাঁসফাঁস করত ! ছাত্রের হাঁসফাঁসে নিয়ত খুঁজে পেতাম নিজের রয়ে যাওয়া !

 

কতদিন হল ঠিক ! ভোরের আবছাভাব নাকি মহামারী  আমার সময় ও তালজ্ঞান চুরি করল !  সামান্য দূরের অতীতকে  আজকাল সুদূর অতীত মনে হয় ৷  ভোরে চারপাশের ধ্বনি , মানুষের কথা কম থাকে ৷ সুপ্ত  সত্য বেরোয় অনর্গল ৷ রাত শেষের প্রথম সূর্যখানি দেখলেই মনে হয় ,এই দ্যাখ গো ! ঝটকা মেরে উঠে বসেছে গোলডিম আলো !

 

যেমন অনেকসময়  নগন্য ঘটনা অনেক সত্যে জমাট তারাটি হয়ে আমাদের কাছে আসে ৷ একবার   অনেকদিন ধরে মোটেই পড়াশুনো করছিল না একটি ছেলে ৷  শাস্তি বা চকোলেট দিয়েও  যখন কিছু হল না তার বাবা মা ডেকে পাঠিয়েছিলাম ৷  রূঢ় ভাষায়  খানিক বকাবকিও করেছিলাম তাঁদের —

শুনুন এভাবে চললে কিচ্ছ্যু এগোবে না আপনার ছেলে ৷

 

মলিন মুখে  বাবা মা  চলে গিয়েছিলেন ৷

 

পরদিন দেখলাম খুব ভালো পড়াশুনো করে এসেছে  ছেলে ৷ ফটাফট আঁক কষছে ৷ তার বাবাকে ডাকলাম —

 

খুব ভালো করেছে আপনার ছেলে ৷ একগাল হেসে আমাকে আশ্বস্ত করলেন  বাবা !

 

— তুমি চিন্তা এত কোর না দিদি ! তোমার ছেলে ঠিক পড়বে ৷

 

কত সহজে  “তুমি” ডেকে আমাকে তাঁর ভালোবাসার জন করে নিলেন ৷  নিজের চিন্তাকে দূর হটিয়ে আমায় বারণ করলেন চিন্তা করতে ৷  আপন ছেলেকে করে দিলেন আমার ৷ একেবারেই আমার ৷ বাড়তি শব্দ উচ্চারণ না করে  বুঝিয়েও  দিলেন , বাচ্চার ভালোমন্দ চিন্তায় শিক্ষকের  অধিকার সবার আগে  ৷

 

এ কথাগুলো অবশ্য মুখে বলতে পারিনি তাঁকে ৷ কারণ  শিক্ষক হওয়ার গর্ব বা আভিজাত্যবোধ ৷ তখনো তো মহামারী শিক্ষককে এমন করে নিঃস্ব করেনি ৷ তবে বাবা ছেলে চলে গেলে ফাঁকা ক্লাসঘরে  এক ভাইয়ের দেওয়া এ সম্মান বুক পেতে নিয়েছিলাম ৷

 

আভিজাত্য শব্দ নিয়ে আপত্তি হচ্ছে তো আপনাদের ? কিন্তু কী করে অস্বীকার করি শিক্ষক হওয়ার সেদিনকার শ্লাঘাটুকু ! আবার মজা দেখুন , আমার অত অহং হটিয়ে দিত  বা নীতিনিষ্ঠ কেঠো দিদিমণি হওয়া থেকে আমায়  বাঁচিয়ে দিত  কিন্তু এই differently Abled বাচ্চাগুলোই ৷

 

একদিন  ড্রইংক্লাসে আঁকতে দিলাম এক জোড়া সবুজ পাতা ৷ মা শকুনের মতো লক্ষ্য রেখেছিলাম ” সেই একদিন পড়া করা আর  পরদিন না পড়া ”  বাচ্চাটার দিকে ৷  পাতায় সবাই দেয় সবুজ রঙ ৷  আর  এ  পাতা ভরাল  গাঢ় বেগুনি রঙে ৷  আচ্ছা করে কান মলে বললাম —-

 

হতভাগা পাতায় সবুজ লাগে জানিস না ?

 

কানে তো  শুনতে পায় না এরা ! তাই  আমার কথা কানে নেয় আর কী করে ! বোবা কানটায় হাত বুলিয়ে  একমনে ঐ বেগুনি রঙই দিতে লাগল পাতার পর  পাতা ৷ একবুক কষ্ট নিয়ে আমিও বসে রইলাম পাশে ৷ কান যে মোলে তার কষ্ট কি কম গো !

 

এ বাবা ! বেগুনীর অন্ধকারে আবার দিতে শুরু করল উজ্জ্বল  হলুদ ৷ তারপর  কমলা ৷   জোড়ায় জোড়ায় কমলা বেগনে পাতায় এখন  ভরে উঠেছে  তার খাতা ৷  ছেলেকালে  যে যে  পাতায় রথ সাজাতাম  ঠিক অমন রঙের ঝাড়  বেঁধেই খাতারথ  সাজিয়েছে  ৷ কালো পাতায় কমলা বিন্দি – পাতার মাঝে  টুকরো  আলো রশ্মি ৷  সূর্য সাফ করছে আঁধার ৷ অপেক্ষা  একটি  রথের ৷  দেবযানে বসবে আমার  বুদ্ধদেব ৷

 

এখন এ কোভিড কালে ঘরে বসে স্মৃতি আওড়ানো ছাড়া উপায় কী ছাত্রহীন শিক্ষকের !

 

কাল এক  বাংলার শিক্ষকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল–

 

জানো ময়ূরী ! কত কষ্ট করে লেসন তৈরি করে দিচ্ছি অনলাইনে ৷ আর বাচ্চাগুলো বলছে –

 

আমরা অনলাইন করে করে   tired ম্যাডাম ! আপনি ক্লাস করে রাখুন পরে দেখে নিচ্ছি ৷ ছাত্রটির কথা বলার ঢঙে ছিল , অনলাইনে মাইনে তো পাচ্ছেন ,এত কথা কী ?  মা বাবার কাছে ছাত্রের এই দুর্বিনীত ব্যবহার বললাম ৷ ছেলেকে  সামান্য না বকে , ওনারা ছেলের থেকেও অনায়াসে বললেন –অনলাইনে ইন্টারেস্ট পায় না তো !

 

ফোনে এ ঘটনা শুনে এপার থেকে আমি বললাম –

 

আপনিই বা  অত কথা  কেন বলতে গেলেন  ? এটা তো প্রাইভেট টিউশন ৷ টাকা নিয়ে লেসন দিয়ে ছেড়ে দিন ৷

 

আমার এহেন হতাশার কথায় শিক্ষকটি বললেন –

টাকা সব ? আমি তো মন দিয়ে বাড়তি সময় দিয়ে পড়াচ্ছি ! ছাত্রের কাছে আমার  বাড়তি প্রাপ্যটা কেন পাব না !  বুঝলাম বাড়তি প্রাপ্য বলতে তিনি বোঝাতে চাইছেন – ছাত্রের দেয়া  সম্মান , শ্রম মনোযোগ ! যা একদা দেওয়ার কথা ছিল ছাত্রের আর যা এখন না দিলেও চলে …..বাড়তি …বাড়তি !

 

হারাচ্ছে ৷ এই অনলাইন ” পাস ফেল নেই নেই ” বিদ্যাচর্চায় শিক্ষক ছাত্র অভিভাবকের সেই টান টান  সুরটি হারিয়ে গেছে ৷ যাচ্ছে ৷ হয়ত ছোঁয়াচে রোগ ছড়াবার কালে  বিদ্যার্জনের এই সিস্টেম সঙ্গত ছিল ৷ আরো সঙ্গত হয়ে যাচ্ছে  বিদ্যার প্রার্থনা ও অর্জনের বিনয়মাধুর্য হারিয়ে যাওয়া !

 

খেদ করে লাভ নেই ৷  অপেক্ষায় থাকি সেই ছাত্রের , শ্রবনেন্দ্রিয়ের অসঙ্গতি নিয়েও যে সঙ্গত করে তুলেছিল গাছের পাতার সম্ভাব্য বিকল্প রঙ !  Differently Abled বাচ্চা তার ভিন্ন  প্রতিভায় শিক্ষকের কানমলাকে লঘু করে ফেলার জোরটা দেখাতে পেরেছিল !  ওই বহুবরণ পাতায় ভরা ড্রইংখাতা ছিল সেদিন  আমার  বাড়তি প্রাপ্তি !

 

ফিরে আয় বুদ্ধ তোর মহাজ্ঞান নিয়ে

আমি তো জেগে আছি রে –

আর কোনোদিন তোর কান্না মলব না

শুধু একটি ভোর আঁকা ছবির বায়না করব ৷

 

তুই না দিলেও  তোর বাবা সেটি আমার হাতে তুলে দেবেন রে বুধুয়া !

দেখিস —–

আর কাঁদব না ৷ তুই না আমিও না ৷

 

[ কোভিডকালে লেখা ৷

প্রথম প্রকাশ :ভোরাই পত্রিকা

দ্বিতীয় প্রকাশ : উত্তরের সারাদিন ]

 

★★★★★★★★★★★★★

 

৪৮

 

টকর টকর

 

তখনো নিশুতিভোর ৷  ভোরের নিশুতি ৷  ডালপাতাকে পাশবালিশ বানিয়ে  নিঃসারে ঘুম দিচ্ছে গাছের  কাক ৷ দুমদাম শব্দ করে আমাদের বাড়ি কাজে লেগে পড়ত বুড়ো ৷ কোনো এক শীতের ভোরে বুড়োকে যেদিন প্রথম দেখি সেরফ আঁতকে উঠেছিলাম ৷ নাম বুড়ো অথচ নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে আছে একটি ডালিমছাঁট চুলের মেয়ে ৷ কী বলব –মাথার প্রত্যেকটা চুল তার সমান  ছুঁচলো ৷  মিষ্টির গোল্লা  তার চোখ ৷ গায়ে একটা বিশাল গন্ধযুক্ত চাদর ৷ তাতে বড় বড় ফুটো ৷  প্রতিটা ফুটোয় নিখুঁত ভাবে সেফটিপিন লাগানো ৷ অনেক ফুটোয় অনেক সেফটিপিন ৷ পায়ের পাতা থেকে শুরু করে বুড়োর চাদর শেষ হতো ঠোঁটের ওপর — যেখান থেকে পুরুষমানুষের গোঁফ তৈরি শুরু হয় ৷

 

দেখলাম  কিডনির রোগে ভুগে ভুগে  বড় ঝুঁকে বেঁকে গ্যাছে সে  ৷ তবুু প্রথম দেখাতেই বড়ো  ভালোবাসায়  ডেকে ফেললাম বুড়োসুন্দরী  ৷ সে বাচ্চাকালে দুই বাচ্চার  ভালোবাসার মানে যা দাঁড়ায় তেমনটাই ভালবাসলাম আমার  সুন্দরীবুড়োকে ৷ আমার বুড়োপ্রেমের অনেকটাই ছিল   ফ্রী টাইমে  তাকে দিয়ে কিছু ফালতু  খাটানোর  মতলবে ৷আমি  দশ ৷ আর বুড়ো বারো ৷  ধরেই নিলাম , দু দু বছরের বড় বলে বুড়োরই কাজের বল বেশি ৷ কাজের হকটাও তারই ৷ সকালবেলা আমাদের বাড়ি ঢুকে বুড়োর প্রথম কাজ এঁটো বাসন পেটানো ৷এতো জোরে আওয়াজ করে বাসন মাজত যে আমরা বলতাম , ঐ দেখো বুড়ো এসেই  বাসন পেটাতে লেগেছে ৷ঝাড়ু দেয়ার সময়ও ঐ একইরকম ৷ তার ঝাঁটার ঘষঘষ শব্দে   মনে হত — ঝেঁটিয়ে  ঝেঁটিয়ে বাড়িসুদ্ধু সবাইকে  বুঝি  দূর করে দেবে  বুড়ো ৷লক্ষ্য করলাম, শব্দ ছাড়া মোটে থাকতেই পারে না সে ৷

 

একদিন কথায় কথায় বুড়োর মা জানাল – ডাক্তার    বলেছে  কদিন বাদেই মরবে বুড়ো ৷  আর বলে ফেলেছে বুড়োর সামনেই ৷ যেই না এসব  শুনেছে বুড়ো সেদিন থেকেই নাকি শব্দে খুব প্রেম জমেছে তার শব্দ ছাড়া বুড়ো বেজার ৷ এরপর থেকে আমি ও  আমার  মাকে কতদিন মিছামিছি চেঁচিয়ে ঝগড়া করতে হয়েছে বুড়োকে খুশ রাখতে ৷ আমাদের  শব্দের বিনিময়ে বুড়ো কি করত  জানেন? আমার হুকুম শুনে যেত দিনভর ৷ কখনো বলতাম ফুটন্ত জলে বেগুন চুবিয়ে দ্যাখ  তো বুড়ো ভাসে কিনা ! কখনো —এই বুড়ো খুন্তির আওয়াজ করে করে  মেটের লাল ঝোল বানা ৷  কিডনির রোগে তখন বুড়োর মাংস একদম বন্ধ ৷  তবুও দেদার  মেটে খেত  বুড়ো ৷ আরে ভাই কী  বলব  কড়া  থেকে ঝোলের মেটে  নামিয়েই গনগনে উনুনের পাশে বসে  খেতে লাগত ৷

 

মৃত্যুর ব্যাপারে বুড়োর এই নির্বিকার ভাব মোটে সহ্য হত না আমার ৷ রাগ হত ৷ খুব রাগ হত ৷ রাগের চোটে  বুড়োকে  জাপটে নিতাম বুকে ৷ তবু  শালার খাওয়া থামত না ৷  একসাথে হাফ ডজন চড় মারতাম ৷  তবু না ৷ ফলে ধীরে ধীরে রোগা হতে হতে বাচ্চদের লাইন টানা স্কেল হয়ে গেল বুড়ো ৷মা আমাদের নিয়ে গেলেন নীলের মেলায় ৷আমি কিনলাম একটি ফাইন মেমপুতুল ৷ বুড়ো কথা বলা হাত পা নাড়া পুতুল ৷ নিজে পছন্দ করে ৷  কথা বলিয়ে পুতুলটার কলকব্জা  বেশ ভালো করে বুঝেও নিল ৷ বাসন মাজতে বসে  আলসের ওপর পুতুল বসিয়ে রাখতো ৷কলকব্জা এদিকওদিক হয়ে যেদিন পুতুলটা কথা বলত না, বুড়োর সে কী মার পুতুলটাকে ৷  মার খেয়ে খেয়ে স্পঞ্জ নাড়ি চটকে গেল পুতুলটার ৷ একদম  বেঢপ হয়ে গেল বুড়োর পুতুল ৷

 

একদিন কী  মনে হল– বাতাস খাওয়াবার জন্য বুড়োকে  নিয়ে গেলাম আমাদের ঝিলপার্কে ৷ ভাবলাম সাঁঝের শীতল বাতাস একবার শরীরে ঢুকলে ফের সোজা হবে আমার বুড়োসুন্দরী ৷ যথারীতি পুতুলটাকে বগলদাবা করে ঝিলের হাওয়া খেতে বসল  বুড়ো !  তখন সন্ধ্যে ঘনায় ৷ যত  বলি-  ও বুড়ো আয় আমার সাথে লাইটের তলায় বস ! আমার ভয় লাগছে ! বুড়ো দেখি তত চলে যায় ঝোপের  ঝুপসি আঁধারে ৷ উঁকি মেরে দেখলাম , আঁধারেই  পুতুলটাকে  এন্তার গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে বুড়ো ৷ অন্যদিন পুতুলকে কথা বলানোর পাগল হয়ে যায় বুড়ো !  আর সেদিন যেন কথা বলেই যেন  মহাদোষ করে ফেলেছে পুতুল ৷  বকাবকির পর পুতুলটার কাছে কানমলা দিয়ে মাপও চাইলো ৷  বুড়ো আর বুড়োর পুতুল দুটোকেই বুকে ঠুসে  দৌড়োতে লেগেছি ৷ হাউহাউ করে কান্না আসছে আমার ৷

 

— আয় বুড়ো ! আয় রে আমার বুড়োসুন্দরী ! আমার সাথে রাস্তার টিউবের  নীচে  স্টেপ মিলিয়ে চল ! চল  চল !  পা চালা ! আয় আয় ! ধেয়ে যাই বাড়ি ৷ ও আমার মা তুই  দরজা খুলে রাখ ! আমি আর বুড়ো এখনই ঘর ঢুকব রে মা ৷

 

ওমা !  দেখি ,  কেবলি আলো থেকে আঁধারে  ঢুকে যাচ্ছে বুড়ো শয়তান ৷   সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলেছে বুড়ো ৷  একবার লাইটের তলায় তো পরের স্টেপে লাইট ছেড়ে আঁধারে ৷  মরোমরো  বুড়োর সে কি জোর জোর হাসি সেদিন ৷

 

কদিন বাদেই মরল বুড়ো ৷কাঠি কাঠি পা হাত ছড়িয়ে হদ্দ মরা মরল।  তারপর আমিও   কত  বুড়ো হয়ে গেলাম  !  রয়ে গেল   কেবল   পুতুল।

হেথায়  হোথায় ৷  কোথাও নিশ্চয়। অটুট অবিকল ৷ সে মরলে  যে আরো মুশকিল !

 

★★★★★★★★★★★★★★★★★

 

৪৯

 

খলিফার বচন

 

মেয়েটা খলিফা ৷ খলিফা আমার ছাত্রী ৷ Intellectually Challenged ৷ দারুণ পরিপাটি সাজ ৷ দুবলা হাতেই ইস্ত্রী চালিয়ে , সৈন্যনীল স্কার্টটি পরে স্কুলে আসে খলিফা ৷ ঠিক আর ভুলের বাংলা হরফ সাজিয়ে এমন এক মেজাজি হাসি হেসে  খাতাটি সে এগিয়ে দেয় ,মনে হয় বাংলা ভাষাটার এমনই  “বেভুল ‘” হওয়ার কথা ছিল ৷  আমাদের মতো দারুণ মূর্খের মাঝে বাংলা ভাষার এই নিজস্ব ধারাটা খুব systematically ও seriously বয়ে চলেছে খলিফা ৷ ভুল করে যখন কানমোলা খেল তখনো তার মুখের চালিয়াতি ভাব আপনি মুছে ফেলুন দেখি ! পারবেনই না ৷

 

” গাছে সবজি উঠেছে ” বা ” মাঠে বিড়াল ফোটে ” এসব লিখেও আমাদের খলিফা বিচলিত নয় ৷ বরং রাজসিক ৷ তার চোখ তখন বলছে –

এটাই তো হবে , তাই না আন্টি ! এতদিন কী ভাবে তোমরা  ভুলে থাকতে পার আন্টি  ” মাঠে বিড়াল ফোটা কিংবা আকাশে রোদ ওড়া ?

 

 

মিঠে ভুলের গুল সাজিয়ে আমার মন হরণ করেছে এই ছাত্রী ৷ তাই তার নাম  খলিফা মহারাজ ৷ কত লিখেছি খলিফার গল্প ৷ কিন্তু বার বার  নতুন কাণ্ড করে নতুন গল্পই প্রাপ্য হয় খলিফার ৷ তার প্রতিদিনকার বাংলা নতুন ৷ নতুন বাংলায় সেও নতুন ৷  কোনোদিন তার লেখনীতে বাক্যরচনা হয় বৃষ্টি পট করে খসল তো পরের দিন সেই বৃষ্টিই হাসল ৷

 

বৃষ্টি হাসে যেন আন্টির কানে ৷

 

খলিফা বলে –

 

আন্টি  তুমি দুটো শব্দ দিয়েছিলে বাক্যরচনায় ৷ শুধুমুধু দুটো শব্দে দুটো বাক্য লিখব কেন !  আমি একটা বাক্যে দুটো শব্দ বসিয়ে দিলাম  –বৃষ্টি ও হাসি ৷ তুমি Happy তো আন্টি ?  এক দুকামরার ক্লাসঘরে বসে বৃষ্টির সাথে  চাষীর খুশি তুই কী করে  দেখতে পাস  খলিফা ! বল না আমাদের !!

উত্তরে খলিফা হাসে রাশিরাশি ৷

 

খলিফা –আমার খিলি পান ৷  যত চিবোই তত রসে ভরে আমার জিভ তালু , আমার  পুরুষ মজানো ঠোঁট্টু ৷ খলিফার সঙ্গে শব্দ খুঁজি ৷ খুঁজে পাই ৷ আমার মনখারাপ কদম হয়ে যায় ৷

 

আজ খুব  বিষাদ ভটভট করছিল আমার মধ্যে ৷ বললাম –খলিফা আমি যদি মরি ? খলিফা খাতায় কী একটা লিখছিল ৷ শরীর ঝাঁকিয়ে বলল –

না ৷

হয়ত তার শরীরটা আপনা হতেই ঝেঁকে গেল ৷ বর্ষা শেষে গাছের  ডাল নাড়লে যেমন জল পড়ে অমনটাই কি ঝাঁকি খেলে খলিফা !

 

পরমুহূর্তে সব শব্দ ভুলে সে বলে উঠল –আন্টি মানে মা ৷ তুমি মরবে না কিছুতেই ৷ আমি একা হয়ে যাব ৷

 

তার থেকে নতুন ও পাকা পাকা শব্দ বের করার আশায় বললাম —

আমি মা  তাহলে বড়দি ( স্কুলের হেড দিদিমণি ) কে ?

 

ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলল কাকিমা ৷ আমি বললাম —

 

বাহ আমি মা আর বড়দি তোকে এত ভালোবাসেন উনি কাকিমা ? খিলি পান আজ তোর শব্দ এত কম পড়ে কেন রে ?

 

আকুল খলিফা বলে —

কাকিমাতেও তো মা শব্দ আছে আন্টি ৷ একটু দ্যাখো না গো আন্টি মাসিমা জেঠিমা সব শব্দে কেমন মা ঘুরছে !

 

ঘরময় ঘুরে ঘুরে শব্দগুলো আবৃত্তি করে খলিফা আর নিজের উচ্চারিত মা ধ্বনি শোনে ৷ আমরা অবাক তাকিয়ে ৷ ভ্রূক্ষেপ না করে চরকি  কাটছে খলিফা ৷

এই –এই খলিফা  বারবার মা মা  আর্তনাদ করে  তুই কি  confirmation চাইছিস !

 

–হ্যাঁ রে আমার খিলি পান ,সব শব্দে মা ৷ শব্দটাকে টক্কাস করে মুখে পোর  যাতে কখনো  সে না পালায় ৷ মাঝে মাঝে রব দিস রে ৷ সে রব শুনে  ধরণী বলবে —

এইও ! খলিফা এসেছে তার মা নিয়ে !

রক্ত  এবার তুমি জীবনপাখি হও !

 

★★★★★★★★★★★★★★★★

৫০

 

মায়ের হনু

হনুর মা

 

আরতির বাঁচার আর্তি ফুরিয়ে আসছে ৷ স্মৃতি কৌটোর কোনায়ও আর নেই ৷ আগে যখন বিভিন্ন দিক থেকে মা মা ডাক শুনতেন ববকাট মাথা আর গুল্লু চোখদুটো সেদিকেই ঘুরত ৷ চোখ জানান দিত –পুরো যাই নি  রে -আছি  – আছি ৷

 

আরতির  মেয়েটা আজ তার মায়ের চারদিকে হনুমান লাফ দিয়ে দিয়ে মা মা ডাকছিল ৷ আরতি কিন্তু বাগানের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন ৷ বোধহয় ভাবছিলেন –মেয়েটার মা মা  হাঁকার দেয়ার উৎপাতে এবার তাঁকে বাগানের একটা গাছ হয়ে যেতে হবে ৷ গাছের স্মৃতি নেই – শব্দ নেই – কারোর কথা শুনে চোখ তুলে তাকানোর ব্যাপার নেই ৷ আরে বাবা কাউকে ভ্রূক্ষেপ করার ব্যাপারই নেই গাছের ৷ সে কেবল সবুজ পাতা ও লাল ফলে ভরাট হয়ে থাকে ৷ চাঁদ সূর্য সব এসে আছড়ে পড়ে তার প্রশাখায় ৷ তারপর জীবজগত সেই পয়মন্ত গাছটি হাওয়া ও খাদ্য নিজের চাহিদায় খুঁজে নেয় ৷ সে শুধু উপভোগ করে একটি সম্মানিত জীবন ৷ তেমনি  কি একটা গরবিনী গাছ হয়ে যাবেন আরতি ?

 

হনুমান  যখন তার সাতজন্মের মায়ের ব্যাথা সইতে না পেরে কাঁদু কাঁদু হয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল  তখন সে শুনল –শান্তা নার্স তার মায়ের পটি মোছাতে মোছাতে বলছে — মা কেঁদ না ৷ কাঁদা মানে হেরে যাওয়া ৷ এ তোমার নিজের সাথে লড়াই ৷ রোজ বাঁচার চেষ্টা করাটাই বাঁচা মা ৷

 

আরতির নেটিপেটি মেয়েটা  দরজার ফাঁক এক প্রান্তিক মানুষের মুখে   ঋকবেদের এই জোরাল উচ্চারণ এই প্রথম শুনলে ৷

 

পরেরবার দেখা হলে মেয়ে মা কেউ কাঁদবে না ৷

 

একজন গাছ হবে ৷

তো একজন বুটিদার পাখি ৷

দুজনে একসাথে চাঁদ খাবে ৷

চাঁদের অতীত নেই  ৷

এই চিররোমান্টিক উপগ্রহটি চলমান ৷

 

★★★★★★★★★★★★

৫১

 

যীশু রোদ  খায়

 

আমার যেখানে স্কুল সেই গলিতে একটি বিহারী পরিবার ভাড়া থাকেন ৷ বাবা মা আর এক মিশুকে বাচ্চা ৷ বাড়িতে আলোহাওয়া কম বলে রোজই সকালে বাচ্চাটা  রাস্তায় দাঁড়িয়ে রোদ নেয় ৷ সূর্যের আলো ও  গরম মাখার সময় এমনই এক তৃপ্তি লেগে থাকে তার চোখে , না পেরে একদিন জিজ্ঞেস করলাম মাকে –

 

তোমার  বাচ্চার বুঝি খুব রোদ খাওয়ার শখ ?

 

হাসতে হাসতে  মা জবাব দিলেন —

 

মোটরগাড়ি নয় এরোপ্লেন নয় আমার ছেলেটার ওই  একটাই বায়না দিদি ৷  দিনের যত সময় রোদ থাকবে ততসময় ও রোদে ঘুরে ঘুরে হাঁটবে ৷ ওকে রোদে হাঁটাতে হাঁটাতে বাড়ির কাজকম্ম কিচ্ছু হয় না ৷

 

কয়েকদিন স্কুল থেকে ফেরার সময়ও খেয়াল করলাম তাকে ৷ দেখলাম ,সন্ধের  অন্ধকার নেমে আসার সময় কোনো সমস্যা নেই শিশুর ৷ প্রকৃতির পরিবর্তন খুশি মনেই গ্রহণ করছে সে ৷ আমার সঙ্গে হাসাহাসি করল ৷ মাকে ছেড়ে আমার মোটা কোলে ঝাঁপ দোল সবই খেলল ৷ যত কান্না তার আলোর ক্ষণে ছায়ায় যেতে ৷

 

এমনি করেই আলো মেখে ও আলোর সময়  না-আলোয় আপত্তি জানাতে জানাতে  শিশুর দিন কাটে ৷  একদিন স্কুল যাচ্ছি ৷ দেখলাম  পাড়ার  ঠাকুমারা  পালা করে হাঁটাচ্ছে শিশুটিকে ৷  কখনো  সে কোনো ঠাকুমার কাঁখে  উঠে বসেছে ৷ কখনো পদ্মার ইলিশের মতো চ্যাটালো হয়ে কোনো ঠাকুমার পিঠে ৷ একদম ল্যাজা মুড়ো ছড়িয়ে ৷ পিঠ  কোলের উচ্চতায় ঝমঝমিয়ে রোদ  জমে খোকাটির ছোট শরীরের আনাচে কানাচে ৷

 

খোকাটি তাঁদের কখনো বলছে দাদি , কখনো  ঠাকুমা ৷  বুদ্ধিমান কচি মানব  সম্বোধন গোলায় ৷  সম্পর্ক নয় ৷ আরো এক মজা , তার মাও দেখি  দিব্যি নিশ্চিন্তে বাঙালিনীদের কাছে সন্তানটিকে ছেড়ে রেখেছেন ৷ খুব আপনজনের কাছে অমূল্য সম্পদ রেখে যেমন নিশ্চিন্তি ভাব আসে  অনেকটা তেমন তাঁর মনের ভাব ৷

 

সবচেয়ে মজা হল দু তিনদিন আগে ৷ জব্বর ঠাণ্ডা

পড়েছিল ৷ চারপাশের বাড়ির গোটা দুই তিন দাদি ঠাকুমা রাস্তায় মোড়া পেতে বসেছেন ৷ বাচ্চাটার তো   খুব আরাম ৷ পা মাটিতে   রাখতে হচ্ছে না তাকে ৷ একসঙ্গে এতগুলো দাদি পেয়ে দিশাহারা আমার রোদখোকা ৷ আদরের চোটে আদরের পরিমাপ ভুলেছে সে ৷ কোন দাদির কোলে কতক্ষণ থাকবে, কে যে তাকে বেশি রোদ দেবে কিচ্ছুটি  বুঝতে পারছে না ৷

 

চট করে খানিক  চটকে তার কানে কানে  বললাম –

 

বল খোকা ,বল দাদি নম্বর 1,দাদি নম্বর 2,3,4— ৷ বল …বল ..5 ,6 7 ৷ এমনি করে এগো রে  রোদখোকা ৷ সরিস না  ভিনদেশি ঠাকুমার   কোল হতে ৷

 

সন্ধি করে নে দাদি – ঠাকুমায় ৷ দেখবি তোর কাণ্ডে  থ হয়ে  জন্মের মতো থেকে যাবে রোদ ৷  অনন্ত ও অনাদি রোদ ৷

 

মিলিয়ে নিস এ মায়ের কথা ৷

দেখিস !  দেখিস তুই !

 

জানিস ছেলে ! যীশু মিল চেয়েছিলেন !

 

★★★★★★★★★★★★★★★

৫২

মানব বহ তুমি

 

খ্যাত মানুষের চেয়ে অখ্যাতর  অসামান্যতা  হৃদয়কে মাত করে বেশী ৷  ঠিক যেমন দ্বিপ্রহরের জ্বলজ্বলে সূর্য্যের চেয়ে ডোবা সূর্য্যের কমলা আলোয় মনের আরাম জমে ৷ জমে একেবারে পূর্ণ করে  দেয় ধরাভূমি ৷

 

বেশ কবছর ধরে এক সদালাপী মানুষের সঙ্গে আলাপ চলছে আমার ৷ আলাপে প্রলাপে গড়ছে একটি সম্পর্ক ৷ প্রৌঢ় মানুষ , চোখে না পড়ার মতো চেহারা ৷ পাশ দিয়ে চলে গেলে কেউ খেয়ালই করবে না এক মানুষ গেল ৷

 

বড়ো  মায়াবী ৷  মাঝে মাঝে আমার স্কুলের বাচ্চাদের জন্য মিষ্টান্ন চকোলেট আনতেন ৷   আরো একটা জিনিস লক্ষ্য করতাম ৷ সামান্য পরিচিত কাউকে সামনে দেখলে  ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করতেন ,ভালো আছেন তো ? ভাবতাম এ বুঝি একটা মুদ্রাদোষ তাঁর ! আর এমন হড়বড় করে কুশল জিজ্ঞেস করতেন যে উল্টোপিঠের লোকটি যথারীতি ভ্যাবাচাকা খেয়ে যেতেন ও পাল্টা কেমন আছেন  জিজ্ঞেস করতে ভুলে যেতেন ৷

 

এরই মাঝে একদিন হাসতে হাসতে এলেন ভদ্রলোক ৷ হাতে যথারীতি একটি মিষ্টির বাক্স ৷ বললাম-

এত হাসি ?

 

বললেন –

জিভে ক্যান্সার ৷

 

–মানে ?

 

—-মানে আবার কী ম্যাডাম ৷  ডাক্তার বলেছেন কিছুদিন পরে জিভের জল শুকিয়ে যাবে  ! খাদ্যে আর স্বাদ পাব না ৷  তো এরপর তো আর কোনটার কী  স্বাদ বুঝতে পারব না -তাই ভাবলাম আজি  বাচ্চাগুলোকে মিষ্টি খাইয়ে যাই ৷ ভালো কাঁচাগোল্লা ৷ একদম টাটকা ৷ আমি খেয়ে দেখেছি ৷ নিন ৷ আপনার বাচ্চাদের দিন ৷

 

সেদিন ভদ্রলোকের হাতের আঙুলগুলো শুধু ছুঁয়েছিলাম মাত্র ৷ সান্ত্বনা দিই  নি ৷   উনি তা চান নি ৷

 

বেশ কিছুদিন পরে আবার দেখলাম তাঁকে ৷ আরো রোগা ৷ বেঁকেচুরে যাওয়া গালে শীতবিকেল শেষ আলো ফেলেছে ৷

 

—  ভালো আছেন তো দিদি ?

—  ভাল আছি দাদা ৷

 

এই যাহ ! জিজ্ঞেস করলাম না তো আপনি কেমন আছেন!

 

ছায়ায় ছোঁয়া নদীর টান মনে মাটি  মাখাল ৷

জলের পদ্ম ফুটেই রইল ৷

ঝরতে  যথেষ্ট দেরি হোক ৷

 

★★★★★★★★★★★★★★★

৫৩

প্রাণজীবন

 

জীবন কী ? কোনটা জীবন ? জীব প্রাণ পাওয়ার পর থেকে যতটুকু কাল তার সহজে কাটে ততটুকুই হয়ত জীবন ৷ প্রাণকালের যে অংশ কাটতে চায় না –

মৃত্যুর প্রতীক্ষায় এক অনন্ত দশা শুরু হয় মানুষের তাকে কী করে জীবন বলি বলুন তো ! মানুষের বুদ্ধি ও কর্মহীন কাল কখনো জীবন হতে পারে ! তবু আমরা প্রাণটুকু থাকায় তৃপ্তি খুঁজি ৷ বারবার বলি –আহা মানুষটার প্রাণটুকু ধুকপুক করছে ৷ থাক না

সে ঘরের পাঁচটি সামগ্রীর মতো ! তবু তো সে এ চরাচরে আছে ! রাতের আকাশের আলোকখণ্ডকে সে চাঁদ বলে হয়ত আজ আর চিনতে পারে না ! কিন্তু চাঁদ তো তাকে দেখতে ভোলেনি ৷ অর্থাৎ চাঁদের তাকে দেখার তো কোনো পরিবর্তন ঘটেনি ৷

বাগানের ফুলটুকু ফুটলে সে হয়ত আর ঘ্রাণ নেয় না ৷ তবু ফুল তার বাগানের হয়ে সৌরভ দেয় ! এও একপ্রকার থাকা ৷ হয়ত এখান থেকেই শুরু হয় মানবজীবনের সেরা প্রশ্নের খোঁজ ! কোনটি বড় হে !

জীবনের অর্থ না কেবল প্রাণের অস্তিত্ব !

 

দার্জিলিংয়ের সান্দাকফুতে পুরু বরফ পড়েছে শুনে একটি ভিডিও দেখতে বসেছিলাম ৷ দেখলাম সাদা বরফের রাজ্যে  পাহাড়ী  রাখাল  গরু  চরাতে বেরিয়েছে ৷ তার মুখে ওই পাহাড়ী ভাষায় ” হ্যাট হ্যাট ” চলছে ৷ একটিও টুরিস্ট নেই ৷ লোকালয় বা  বনভূমি বলে কিছু যে কখনো ছিল তাই বোঝা যাচ্ছে না ৷  গরুর ঘন্টা আর রাখালের মুখনিঃসৃত ধ্বনি স্তব্ধ বরফের মাঝে যেন প্রাণ আনল ৷ রাখালের টুপিতে  যত বরফ গরুর গায়েও তত বরফ ৷ মনে হচ্ছিল -দু ধরণের সাদা জীব যেন একটা যুদ্ধে বেরিয়েছে ৷ খাবার সংগ্রহের যুদ্ধ ৷ গরু খুঁজছে তার প্রাণধারণের  ঘাস ৷ আর রাখাল খুঁজছে তার পোষ্যের খাবার – যাতে সে পোষ্যকে পুষ্ট করে দুধ পেতে পারে ৷ সেই দুধ সে বেচবে ও তার প্রাণধারণের প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করবে ৷  দুজনের খোঁজায় কিন্তু মিল আর মিল ৷ অনন্ত  যখন রাখালটি এদিক ওদিক বরফচাপা ঘাস খুঁজছিল আর হ্যাট হ্যাট করে গরুটিকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে মারছিল ……..প্রাণে প্রাণে মিলটাই যে দেখলাম বেশী ! অথচ দুটির জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন ৷  …ও মাগো ! প্রকৃতি যেমন প্রশ্ন জাগাতে পারে তেমনি উত্তর মিলিয়ে দিতে তার জুড়ি নেই !

 

বরফের আর তুষারপাতে গবাদি আর মানুষ ! আহা তোরা দুই প্রাণী প্রাণে বেঁচে থাক বাপ ! প্রাণখানি ফিরে না পেলে জীবন  নদী হবে না যে ৷

 

★★★★★★★★★★★★★★

৫৪

ডানা দুটি মেলেছ

 

বড় চমৎকার করে আজ সকালটা

হয়েছিল ৷ ঠাণ্ডা হাওয়ার  সঙ্গে মেঘহীন পূর্ণ সূর্য ৷ ভোর থাকতে মায়ের কাছে যেতে হয়েছিল ৷ স্কুলে আসার জন্য ফিরছি অটো করে ৷ অটো থেকেও একভাবে আকাশ দেখে যাচ্ছি ৷ আকাশকে  আজ বলতে হচ্ছে না –আমাকে দেখ ৷ সে কেবল তার মোহময় রোদভাব  নিয়ে বিরাজ করছে —  দেখার সিদ্ধান্ত পৃথিবীর বাসিন্দার –যারা নিয়ত তার আলো তাপে সিক্ত হয় ৷

অটোয় বসে ছাগলের মতো এসবই ভেবে যাচ্ছি –দুম করে একটা আকাশনীল বল আমার কোলে ঝুপুস হয়ে পড়ল ৷ আকাশ থেকে গড়িয়ে এল নাকি ছোট একদলা আকাশ ? দেখি –নীল সোয়েটার টুপি পরা একটা গোল বাচ্চা ৷ ওয়াটার ব্যাগটাও নীল ৷ এত জোরে লাফিয়ে অটোতে উঠল –অটো কাঁপল –আমার কোল কাঁপল ৷ মায়েরা বুড়ি হলেও কোল ছলবল করতেই থাকে ৷ সন্তানকে কোলে নেওয়ার ছল বাড়ে ৷ একে অবশ্য আমাকে আর কোলে নিতে হল না ৷ সে ছেলে নিজেই  মা আর আমার মাঝে নিজেকে ভালো করে সেটিং করে নিল আর শরীরের বেশি অংশটা আমার দিকে রাখল ৷

আমার কাঁধে মাথা রেখে মাকে প্রশ্ন —

প্র : মা সবসময় পড়তে ভালো লাগে ?

মা : একদম উচিত নয় –মাথা তাহলে লোহা হয়ে যায় ৷

নিজের মাথায় দুটো টোকা মেরে ছেলে দেখে নিল  তার মাথা ইতিমধ্যেই লোহা হয়ে গেছে কিনা ! মা হেসে বললেন –হয়নি –মাথা তোর এখনো ফুলের মতো নরম আছে ৷ বাড়ি গিয়ে মাছ ভাত খেয়ে ঘুমবি ৷ তাহলে তোর মাথার ফুলটা আরেকটু ফুটবে ৷

ছেলের প্রশ্ন : বিকেলে যদি খেলি ?

মা : যদি তুই  মোবাইল না দেখে অনেকক্ষণ

আমাদের বাড়ির সামনের মাঠটায় খেলিস

তাহলে সূর্য চলে যাওয়ার সময় মাথায় তোর

অনেকগুলো ফুল ফুটিয়ে যাবে ৷ কালো

চুলের ফাঁকে  কমলালেবুর

কোয়ার রঙের ফুল ৷

 

ছেলে : সূর্য  ফুল কোথায় পাবে ?

মা : আকাশ থেকে ৷ সেখানে তোমার অনেক

দাদু দিদা আছে তো ৷ তাঁরা পাঠিয়ে দেবেন ৷

ছেলে : সবাই আমার দাদু দিদা ?

মা : সবাই ৷

ছেলে : তাহলে সবার জন্য স্কুলের প্রেয়ার

গানটা গাইব মা ? আজ নতুন

শিখিয়েছে ৷

মা : সন্ধেবেলায় ৷ সূর্য যখন নিজেই

রেণুভরা  এক ফুল হয়ে যাবে –

সবথেকে বড় ফুল ৷

 

খেয়াল করিনি আকাশের বৃদ্ধ বাসিন্দাদের দেখার জন্য ছেলেটা  কখন তার আরেক মায়ের কোলে চড়ে বসেছে  ৷ ব্যাটাও বোঝেনি এই অচেনা মা টাও তারই ৷

 

 

★★★★★★★★★★★★★★★★

 

৫৫

কাঁচা হলদে বাঘটা

 

আমাদের স্কুলের এক মেয়ে চলে গেল কদিন আগেই ৷ মেয়েটা ডাউন সিনড্রোম ৷  গোটা এক রাত শ্বাসকষ্টে জ্বালাপোড়া হয়ে ভোর নাগাদ সে গেল ৷ পরদিন আরেকজন অভিভাবক এসে যখন মেয়েটির মৃত্যুর খবর  দিলেন এবং কীভাবে সে মরেছে সেটা বললেন , তখন  খেয়াল করলাম স্কুলের সবথেকে দুষ্টু  ছেলে বাঘু হাঁ করে শুনছে ৷

 

এমনিতে বাঘু  সদা আনন্দিত ছেলে ৷ জীবনের সামান্য সামান্য ঘটনায় আনন্দ পেতে জানে ৷ তার আনন্দ পাওয়ার  বহর দেখে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই ৷ পুলিশ ফাঁড়ির বড় মাঠের পরিবর্তে তাকে যদি বলি স্কুল বাড়ির গলি ধরে ছোট বাঘু হাসতে হাসতে রেস দেবে ৷ জুতো নেই তার ৷ পায়ের সস্তা চটিতে মাঝে মাঝে রাস্তার কুকুরের পটি মেখে যায় ৷ বাঘুর দৌড় থামে না ৷ সিকনি মোছার জন্য বড় রুমাল কিনেছে বাঘু ৷ সেটা নিয়েও হাসি ৷ কখনো সেটা দিয়ে নাক ঘষে লাল করে ফেলছে  ৷ কখনো আবার সেটা পাগড়ি করে পরে সূর্য খেদায় বাঘু ৷ বলে –এই সূর্য দেখবি মজা ! খালি আমার চুলগুলো গরম করা তোর ! হ্যাট হ্যাট ! এই দ্যাখ পাগড়ি পরেছি ! এবার কোথা দিয়ে ঢুকিস দেখি !

 

তো সেই বাঘু তার মতো এক বাচ্চার মৃত্যুর খবর শুনে চুপ করে রইল ৷ সূর্য এদিন খুব ছিল ৷ স্পোর্টসের প্র্যাকটিস চলছিল ৷ দেখি ,খেলা বন্ধ বাঘু তার পায়ের বুড়ো আঙুলটা মন দিয়ে দেখছে ৷ আমি কাছে গেলেও চোখ আর তোলে না বাঘু ৷ অথচ সে সবার কাছে বড় গলা করে বলে বেড়ায় -ময়ূরী ম্যামকে ভয় পাই নাকি আমি ! ম্যাম ভয় পায় আমাকে ! আমি ম্যামকে তাড়া করি কিনা ! তাই ম্যাম ভয় পেয়ে বাঘু বাঘু করে ৷ কাছে যাওয়া সত্ত্বেও তাকাল না দেখে আমার বুকটা কেমন হাহাকার করে উঠল ৷ কেন কে জানে ! জিজ্ঞেস করলাম —

 

–বাঘু রান রেস হচ্ছে ৷ লাইনে দাঁড়া সবার সঙ্গে ৷ ওয়ান টু থ্রি বলব ৷ তারপর রুমাল নাড়ব ৷

 

বাঘু বলল – এখন না পরে ৷

 

মুখ নীচু করে উত্তরোত্তর  ভ্রু কুঁচকেই যাচ্ছে ছেলেটা  ৷ চোখের কোলে আঙুল ঠেকালাম ৷

 

বাঘু বলল – ম্যাম আমার নখে কেমন রোদ লাগছে দেখো ৷ নখগুলো  কাঁচা হলুদ  হয়ে গেছে ৷ তবে আমার আর সর্দি  লাগবে না বল ম্যাম !

 

বাঘু কাঁদছে না ৷ বন্ধু মরে গেছে শুনে একটিবার জিজ্ঞেস করছে না তার কথা ৷ শুধু  শরীরে রোদ

আসায় আশ্বস্ত হচ্ছে ধীরে ধীরে ৷ দুপুরের সূর্য তার সমস্ত প্রসারতা সমস্ত ঔদার্য্য দিয়ে বন্ধুহারা শিশুর  চারপাশ ছেঁকে ধরেছে ৷

 

জীবন রাখার আকুতি বাঘুর  মুখখানাকে একটি  খরাতপ্ত ক্ষেত বানিয়ে দিয়েছে ৷

 

খরার ক্ষেত বড় জেদী হয় ৷

শস্য আনার হাসি  তারই ৷

 

 

★★★★★★★★★★★

৫৬

কলাপাতায় মাখম

 

আজ রান্নাঘরের জানলায়  উত্তরের বাতাস পেলাম ৷ খুব সামান্য সে বাতাস ৷ তবু শিরশির ভাবটা টের পাচ্ছিলাম ৷ খাটালের পেয়ারাগাছের দু একটা  পাতা খসে পড়ছিল ৷ এ গাছে কোনোদিন পেয়ারা দেখিনি ৷ কেবল পাতার নাচন  সারাবছর

৷ বর্ষার জলে পাতাগুলো ভিজে কুঁকড়ে যায় ৷ পাতার কোটর তৈরী হয়  ৷ কার জন্য কে জানে ! পাখি যে দেখি না এমন নয় কিন্তু বৃষ্টিভেজা ডানা নিয়ে পাতার কোটরে তারা এসে বসেছে এমন দেখিনি ! অনেকসময় এমন হয় !পৃথিবী মনে করে জীবের আবাস সাজিয়ে রেখেছে ! কিন্তু গেরস্ত নেই ৷

 

একটি মাখনরঙ  বাচ্চাকে  দেখলাম , মায়ের কোলে বসে গরুর দুধ দোয়ানো দেখছে ৷ চোখ  পিটপিট ৷ মা মাথার ওড়নাটা বাচ্চার শরীরে জড়িয়ে রেখেছেন ৷ আগে গোয়ালাবাড়িতে এ বাচ্চাটিকে কখনো দেখিনি ৷ বোধহয় প্রথম এ বাড়িতে এসেছে ৷ তার ছোট্ট ইজের আর তার  মায়ের ঘরোয়া পোশাক দেখে বুঝলাম গোয়ালার নতুন আত্মীয় ৷

 

খরিদ্দারদের দুধ দেওয়া শেষ হলে বাছুর ছেড়ে দিলেন গোয়ালা ৷ দেখো দিকিনি ! নিজের মায়ের দুধ সবথেকে কম পরিমাণে পাবে সন্তান !  মানুষের লোভে রোগা থেকে যাবে অন্যান্য জীব ! ঝুপ !

 

মায়ের কোল হড়কে নেমে গেল মাখন ৷ তারপর নামাজ পড়ার মতো  বসল বাছুরটার কাছে ৷ সাথী পেয়েছে ৷ এবার  অনেকটাক্ষণ কাটাবে বাছুরের  চুকচুক দুধ টানা দেখে ৷ খুশী হবে খুব ৷ পাখি ডাকলে শিশু হেসেছে ,এ কতবার দেখেছি আমি ! অন্য জীবের খুশীতে শিশু তৃপ্ত হয় ! হয়ত তার খুশী বুনোফুলের তীব্র গন্ধের মতো  এসে চলে যায় ৷ কিন্তু কখনো কখনো হলেও , শিশুই তো অপরকে বেশী করে দেখে !

 

শিশু যখন নিবিড় বাছুরের বাঁট চোষায় ,  উত্তর থেকে ফের হাওয়ার ঝাঁক এল ৷ পেয়ারা পাতা আরো কিছু ঝরল মাখনের গায়ে ৷ মাখনের চোখ  গাছে ঘোরে ! বসে বসে ঝরা পাতা ঘাঁটে মাখন ৷  একবার বাছুর একবার গাছের মাথা দেখে ৷

 

ঠিক করতে পারছে না , কোনটা বেশী জীব ! গাছ নাকি দুধ বিলিয়ে শুকনো হওয়া গরুর এই বাচ্চা ! সকালে জীবের খিদে বেশী ৷ পেটভরা দুধ না পেয়ে বাছুর  ক্লান্ত হচ্ছে ৷ তার দাঁত জিভ সব বিরক্ত হয়ে উঠছে ৷  মাখন রঙের শিশু একবার চটকানো   পাতাগুলো পরপর সাজায় – বাছুরের পিঠে হাত দিতে যায় ৷

 

মানবশিশুর স্পর্শে গাভীসন্তানের চামড়া কাঁপে তিরতির ৷ মাখনের কল্কে ফুলের মতো আঙুল  মুহুর্মুহু ইচ্ছুক হয় ! জীবস্পর্শে অথবা জীবকে স্পর্শের আহল্লাদে ! জীবন স্পর্শের গোপন গভীর  সুখ ! ওকি আর স্পষ্ট করে কওয়া যায় গো !

 

৫৭

 

প্রজাপতি

 

কিছুদিন আগে  এক মেয়ে  হোম সার্ভিসে খাবার দেওয়ার কাজ শুরু করেছেন ৷ স্বামী মারা গেছেন ৷ দুটি ফুলসম শিশু ও মাকে নিয়ে আনন্দে এবং নিজের জোরে বাঁচার চেষ্টা করে যাচ্ছেন ৷ চমৎকার ও পরিচ্ছন্ন রান্না ৷ খাবার দেওয়ার ধরণ, পরিমাণ এবং  মেনুর ঘনঘন পরিবর্তন দেখে বুঝতে পারি , ব্যবসা থেকে অর্থপ্রাপ্তির সঙ্গে  মানুষের ভালোবাসা পাবার ও ভালোবাসবার ইচ্ছেটাও সবসময় রাখে ৷ আমার পঞ্চাশ বছর আর কিছু না হোক মানুষের ভালোবাসা চিনবার ক্ষমতাটুকু দিয়েছে ৷

 

ফলে জীবনে এই প্রথমবার ওঁর থেকেই আমার হোম সার্ভিসে খাবার নেওয়া ৷ আজ দুপুরবেলা যখন স্কুলে  খাবার দিতে এলেন , স্কুলের একটি বিশেষক্ষমতাসম্পন্ন বাচ্চা  ওঁকে জিজ্ঞেস করল —

 

তোমার নাম কী গো ?

 

স্বাভাবিক মানুষরা ,বলা ভালো নিজেকে যাঁরা অতি স্বাভাবিক ভাবেন , সাধারণত এই ধরণের বাচ্চাদের আলাপচারিতা এড়িয়ে যান ৷ বড়জোর করুণামাখা গলায় দু এক কথা বলেন ও পাশ কাটান ৷  ফলে বিশেষক্ষমতাসম্পন্ন শিশু এবং পূর্ণবয়স্ক উভয়েই একটি কোটরে আটকে পড়েন ৷ বাইরের ভালোবাসা ও ভাষা তাদের কাছে আর পৌঁছয় না ৷ আজ কিন্তু এ মেয়েটি আমাদের স্কুলের ছোট বাচ্চটির উত্তর দিয়ে বললেন —

 

আমার নাম তো নির্ঝর ৷ তোমার নাম কী ভাই ?

 

 

বাচ্চাটির সঙ্গে আমিও আজ  জানলাম –আজকাল  যাঁর রান্না খেয়ে পেটভর্তি তৃপ্তি নিয়ে ঘুমোই তাঁর নাম নির্ঝর এবং তিনি স্বাভাবিক মানুষের সাথে সাথে এই সব বিশেষক্ষমতাসম্পন্ন শিশুকে সমান সম্মান ও ভালোবাসা দিতে জানেন ৷ দিতে চান ৷ আমি জানি দুপুরের এই সময়টায় নির্ঝরের আরো অনেক বাড়ি খাবার দেওয়া থাকে ৷ নিজের বাচ্চাদুটোর দেখভাল করা থাকে ৷ সময়টা   যেমন কঠিন তেমন মাপা ৷ তবু দেখলাম ,নির্ঝর বাকি টিফিনকৌটোগুলো একপাশে নামিয়ে রেখে আমাদের ছাত্রীটির সঙ্গে গল্প করেই চলেছেন এবং  গল্প করছেন ঠিক তারই মতো করে ৷ যেন দুই বন্ধু ৷

 

আমি বাচ্চাটাকে বললাম —

 

এবার ওঁকে ছাড় ৷ উনি কাজে যাবেন ৷

 

মৃদুর বেশি ধমক বোধহয় নির্ঝর পারেন না ৷ তাঁর তিরস্কারের মধ্যেও হাসি ও বেদনা কলাপাতায় মোড়া মাখন হয়ে থাকে ৷ তো সেটুকু হাসিঅশ্রু মিশিয়ে নির্ঝর বললেন —

 

দিদি ওকে বকবেন না ৷ আমাদের যেমন কথা বলার অধিকার কাছে ওদেরও আছে ৷ আমরা কথা বললে আমাদের কি কেউ থামায় দিদি যে আমরা ওদের থামাব ? আমি দিদি বুঝতেই পারি না ওদের কথাবার্তায় ঘন ঘন বাধা দেওয়ার অধিকারটা আমাদের দিলে কে !

 

 

আরো কত মধুর সত্য যে বলে চলছিলেন নির্ঝর ! ঝরঝর বৃষ্টি হয়ে ঝরছিল তাঁর  বাক্য —

 

দিদি আমরা যদি এইসব বাচ্চাদের কথা না শুনি ওরা তো কোনোদিন স্বাভাবিক জগতের স্পর্শ পাবে না ৷ ওদেরকে আমাদের আরো বেশি করে সময় দিতে হবে ৷ আমি দুটো বাচ্চার মা ! কিন্তু দিদি আমি অন্তর থেকে বিশ্বাস করি সব বাচ্চা এবং তাদের সমস্তটুকু নিয়েই আমার সংসার ৷ আমার বড় মেয়েটাকে আমি বলেই রেখেছি কোরক স্কুলের বাচ্চাদের আসতে যেতে দেখলেই তুমি এগিয়ে গিয়ে কথা বলবে ৷

 

কখন দেখি আমার সেই স্প্যাস্টিক ছাত্রীটি নির্ঝরের হাত নিজের বাঁকা দুটো হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে ফেলেছে ৷ নির্ঝর এবার খাবার নিয়ে অন্য মানুষের বাড়ি যাবেন ৷ আবার কখনো না কখনো  আবার স্কুলে এসে বাচ্চাকটার কাছে ফিরবেন ! — যেখানে ওর সংসার ৷

 

ওহ !  বড় বড় পা ফেলে চলে যাচ্ছিলেন নির্ঝর ৷  আরে ! নির্ঝরের চুল খুব লম্বা আর ঢেউ খেলানো তো ! হাঁটলে সে চুল নাচ করে ৷ পথের দুপাশের গাছপাতা  পচা গরমেও এতো টাটকা দেখাচ্ছিল আজ !

 

মন ভালো হলে মানুষ অলীক সত্য দেখে ,তাই না ? বা কল্পসত্য ৷

 

আসিস রে ৷

 

★★★★★★★★★★★★★★

৫৮

যে সাগরে

 

তখন আমার  মায়ের বাড়ির পাশেই বাস করত   এক   মিষ্টি-মস্তি বাচ্চা ৷ জযেমন ফুলের মতো দেখতে  তেমনি শস্যসবুজ  মন ৷ আর সে মনে  দিনের সবসময়েই আনন্দের  বাস ৷

 

কখনো বাবার সাথে সাইকেলে ঝুলে আছে ,  দু পা দুপাশ থেকে ৷ ইজের নেমেছে হাঁটুতে ৷ কখনো Very Simple বাঁদর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে  বাগানের লতানে গাছের গোড়ায় ৷ চোখেমুখে ঝকঝকে প্ল্যান – লতায়  চড়বে ৷  ডগায় মারবে লাফ ৷

 

আমায় কিছুতেই  ভালোবাসবে না ৷   ভাল না বাসার যেন পণ  করেছে সে মেয়ে ৷ গায়ে হাতও লাগাইনি ,দূরে দাঁড়িয়ে আছি ,তাও আমায় দেখলেই  কাঁদতে শুরু করবে ৷ তারপর আরো দূরে গিয়ে  ভেঙচি মেরে  নিরীহ হাসি দেবে ৷

 

অন্যদিন  আমার প্রতি তার এই  বীতরাগ চুপচাপ হজম করে যাই ৷ একদিন  জেদ চাপল ৷ ভালোবাসিয়েই ছাড়ব আজ বাঁদরটাকে ৷ একবার  ভদ্রভাবে বললাম-

 

চুপচাপ কোলে আসবি ৷

 

নাক কুঁচকোল ৷ রেডি ছিলাম ভেতরে ভেতরে ৷  উল্টো করে কোলে তুলে নিলাম ৷  মানে মুখটা  রইল মেঝের দিকে ৷  আমার এক হাতে তার মুণ্ডু — পা দুটো অন্য হাতে ৷  পাতালে ঢুকে যাচ্ছে ভেবে  প্রথমটায় চুপচাপ সমর্পণ  করল নিজেকে ৷  যেন মাটির সমান্তরাল আকাশপথে  উড়ছে  লেডিস  পাখি ৷ আমার পুতুলপাখি ৷  ঘরের বিছানায় এনে ফেললাম ৷ কোল থেকে  নামতেই সম্বিৎ ফিরল পাখির ৷ বেজায় চিল্লালো ৷

 

আমার হয়েছে আরেক মুশকিল ! পুরুষ না মজলে শরীরমন জ্বলে না এখন ! মাথা মন কোনোটাই ঘামে না প্রেমে ৷ কিন্তু বাচ্চা ভালো না বাসলে খেপি ৷ খুব খেপি ৷ সেদিনও  খুব খেপে গিয়ে জানলায় রাখা মায়ের লাল টিপের পাতা থেকে টিপ খুলতে শুরু করলাম ৷ খুলছি ৷ফের লাগাচ্ছি টিপেরই পাতায় ৷ ভালোবাসার কুস্তি চলছে পাখির সঙ্গে ৷ হাওয়ায়  জানলার শিকে পৌঁছেছে  গন্ধরাজের  পাতা ৷  অন্যমনস্ক হয়ে কখন জানি একটা টিপ তুলে লাগিয়ে দিয়েছি গাছের পাতায় ৷ দেখি কান্না থামছে তার ৷  মন দিয়ে দেখছে আমার কাণ্ড !

 

কী দেখিস পাখিমেয়ে ? এক উজবুক মাকে ! বেশ বেশ আমি তাই ৷

 

পটাপট  টিপ তুলে লাগিয়ে দিতে থাকলাম  গন্ধগাছের  বেশ কটা পাতায় ৷  যতদূর জানলা দিয়ে হাত যায় আমার আর যতদুর দেখতে পায় আমার কোলের পাখি , ঠিক ততদূর ৷ সবুজ সবুজ পাতায় ইয়া ইয়া টুকটুকে সব টিপ ৷ ভাদ্রের রোদ তাতে চিকচিক ৷  খানিক পরেই  মেঘের ছায়া পড়ে  সে লাল টিপ সাজাপানের টুকরো  খয়ের হয়ে যায়   !

 

টক করে একটি লাল টিপ পরিয়ে দি কোলের মেয়েটার  ছানাশুভ্র কপালে ৷  লাল রঙ বুঝি রাজি করায় তাকে আমায় ভালোবাসতে ৷

 

কোলে চড়ে বসেছে ৷ হি হি হি !  আরে ! কোলের মধ্যে কাতাকুতু লাগছে যে    নরম নাকের  ঘষায় ৷ চুক চুক চুক ৷ তিনটি সলিড  চুমু ৷ মাইরি !

 

মাত্তর তিনটি  চুমু ৷   ব্রহ্মাণ্ড ৷

 

প্রণাম বিদ্যাসাগর ৷

 

তুমি ওই লালবরণ আকাশে ৷

বাতিল না হওয়া এক রঙরঙ্গে  মিশে  ৷

বিধবার গগনে  চিরকাল যেন থাকে সমর্থ পুরুষ ৷

হঠাৎ আসুন মহাশয় ! সর্ব  ঔদার্য নিয়ে ৷

 

[ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে এই লেখাটা যে কেন এল আমার ! ]

 

★★★★★★★★★★★★★★

৫৯

তাহারা গান গায়

 

আদাজল খেয়ে চড়াইগুলোর পিছনে  পড়েছে শালিখ  দুটো ৷  সন্ধেতে  বেশ কিছু দানা ছড়িয়ে দিয়েছিলাম মায়ের ঘরের বারান্দায় ৷ তারপর থেকেই মাথাখারাপ করে দিচ্ছে হিংসুটে শালিখ ৷ ওদের যে খিদে লেগেছে বলে চড়াইগুলোর সাথে ঝগড়ায় মেতেছে এমন নয় ৷  বহুদিন আমি শালিখ দুটোর জন্য আলাদা প্লেট সাজিয়ে  দেখেছি ৷ নিজের খাবারে মন তো লাগাবেই  না , উল্টে হামলা চালাবে চড়াইগুলোর ওপর ৷ ঝামেলা ঝঞ্ঝাটে যত আনন্দ ওদের ৷ চড়াইগুলোও কম বিচ্চু নয় ৷ সমানে শালিখের পেট  ঢুঁসোচ্ছে ৷

 

বকুলগাছের বুলবুলি  মীমাংসায় নামল ৷ শালিখ চড়াইয়ের মামলার  থার্ডপার্টি ৷ মুফতে দুচারটে দানাও মেরে দিল প্যারে বুলবুলি ৷ ঝপাঝপ মারল একদম ৷ গামবাট  চড়াই শালিখগুলোকে কথা বলার স্কোপই দিল না ৷ অবশ্য ঝগড়া করতে করতে সে ব্যাটাদেরও  খাদ্যগ্রহণের মুড নেই ৷

 

ওরে —  ওরে মতিহারা পক্ষী —- খুনখারাবি করবি নাকি রে  ?  দ্যাখো দিকি সন্ধ্যে ঘন হলো যে ! ওমা রে — সব কটা কেমন একসাথে বকুলগাছের পানে চলেছে ৷ সন্ধে জ্বালবি বুঝি  বকুলদীপে !

 

শোনো শোনো ! পক্ষীকণ্ঠগুলো কেমন একযোগে ক্ষীরদুধের মতো মিঠে হচ্ছে ! ভোর অব্দি একটি লম্বা তৃপ্তির ঘুম দেবে ! মানুষ বড়ো অশান্ত করে ! পাখির কাকলি ! কী সুখ রে !

তোদের গান জড়িয়ে ধরুক আমার মনোহরা মাকে ৷

নিবিড়ঘন আঁধারে

ভোর হবে যবে

নতুন করে জন্ম নেব মা !

 

★★★★★★★★★★★★★★★★★

৬০

 

চোখের বাহিরে

 

এবার আমাদের শহরে বেজায় শীত পড়েছিল ৷ রাতের ঠাণ্ডায় শরীরে কেমন এক ঝাঁকানি বোধ করতাম ৷ বুড়ো হচ্ছি তো ৷  শীতরাত্রে কেবলই মনে হয় , রাত যেন দুষ্ট এক  বাচ্চা হয়ে   হাত পা ছুঁড়ছে  ৷ আর বাচ্চাদের মতোই শিকনি মাখা নাকে টানা লম্বা শ্বাস ফেলছে ৷ এমনটা মনে হলেই বরাবর দেখেছি ,  আমার খুকিবেলার সেই শীতবুড়োটা চলে আসে  স্মৃতির ডগায় ৷

 

আমি তাঁকে ডাকতাম শীতদাদু বলে ৷ শীতদাদু ছিলেন  আমার ঠাকুরদার পণ্ডিত মশায়  ৷ মানে আপনি ধরে নিতে পারেন ঠাকুরদা ও  ঠাকুরদা ৷ কিন্তু  যে সময় আমি তাঁকে দেখি –আমার সেই খোকা চোখের ফুটিফুটি কালে  মনে হয়েছিল  ছাত্র মাস্টার বুঝি একই সময়ে এসেছেন এ  ধরাতলে ৷ দুজনে যেন একেবারে হাত ধরাধরি করে এসেছেন ৷  অথচ দেখুন ,  হিসেবে একজন আরেকজনের চেয়ে অন্তত এক কি দুদশক বড় হবেন ৷ বড় হবেন — এই ছিল স্বাভাবিক ৷একজন আরেকজনের আগুপিছু না হলে  মাস্টার ছাত্র হবেনই   বা কী করে  ! সেসময় কিন্তু  মনে হতো  এঁরা  আমার  জোড়া ঠাকুরদা বা একই ঠাকুরদার দুটো পিঠ  ৷ একদেহের সামনে পিছে  দুইখান  মুখ ৷

 

ঠাকুরদার পণ্ডিতমশায়কে কেন যে শীতদাদু বলতাম  স্পষ্ট মনে করতে পারি না ৷   মাস্টারমশায়ের বয়স কিংবা স্ট্যাটাস  সমঝে নিতে যে ধরনের ধারালো জ্ঞানগম্মি লাগে তা তখন ছিল না ৷ কেবল এটুকু মনে আছে ,পণ্ডিতমশায়ের  কাঠি হাতের  নীল শিরাগুলো দেখে কেমন এক শীত শীত ভাব হত ৷ অথচ হাতে  লাঠি  বা কাঁধে ঝুলি — গ্রামের  পণ্ডিতমশায়দের  যে ধরনের মলিন ও নিরুপায় বেশভূষা  ঠিক  করে রেখেছে বাংলা উপন্যাস , তার লেশমাত্তরও ছিল না শীতদাদুর ৷ কান্না ফাননা বা ক্লান্তি টানতির  বালাই ছিল না ৷  মোষকালো পাম্পসুতে খচমচ করে আসতেন আমার ঠাকুরদার কাছে ৷ আনস্মার্ট লাগত না কিন্তু ৷ বরং  শব্দময় গরিমা তাঁর সে চলনে ৷ দুপুরবেলায় তেলাল সর্ষে রঙের  পেতলের থালায়,  ঢিবি ভাতের   সঙ্গে  অন্তত পাঁচ ছ রকম তরকারিপত্তর   দিয়ে ভাত খেতেন আমাদের বাড়িতে ৷ তাঁকে নিজের হাতে খেতে দিতেন আমার  ঠাকুরদা ৷ ছাত্রের দিকে একটুও  না তাকিয়ে নিমেষে তা শেষ করতেন  পণ্ডিত ৷  বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা ঐ ছোট বয়সে পণ্ডিতমশায়েরবেলাজ খাওয়া দেখে  কেমন  কিরকির করত মনটা ৷ কালো বোর্ডে  চক ঘষটে গেলে যেমন অস্বস্তি জাগে অমন ৷ খালি মনে হত-  এতো মন লাগিয়ে এতো পরিমানে এতো রকমে খেয়ে  ইনি এবার করবেনটা কি  ?  আবার পণ্ডিতমশায়কে আমার মনে ধরা বা পণ্ডিতে আমার মন লেগে যাওয়া তাঁর  ঐ   চারুহীন খাওয়াটি দেখেই  ৷

 

আর আমি তখন কী করতাম , বলি ? শিকারি বিড়ালের মতো কাপ ধরে বসে আছি তো আছিই  ৷  ভাবছি , খেয়ে উঠে পণ্ডিত  ঠিক কী গল্পো বাঁধবেন আমার জন্য  ?  এতো করে  খেলেন যখন –  নিশ্চয় আজ আমাকে একটা ফান্টাস্টিক অন্যগল্প বলবেন ৷ অন্যগল্প –নিত্যদিনের সুখে যে গল্প থাকে না ৷ বা – বা ধরুন দরিদ্রই যে গল্প তৈরী করতে পারে !   হ্যাঁ –দুখী হিরো বা দুখী রাণীর  গল্পই তো চাইতাম তাঁর কাছে ৷ কথক যেমন –তেমনই   হবে তাঁর গল্পের মানুষরা — এমন একটা অদ্ভুত অপেক্ষা তৈরী হত আমার  ৷ আর রোজ রোজ বোর  হতাম ৷পণ্ডিতের গল্পে  রোজই  সার বেঁধে দাঁড়াত  দুনিয়ার যত সুখী মানুষ  ৷ জাস্ট ভাবুন একবার — গল্পে কোন দুখীই নেই ৷প্রজাই নেই ৷ শুধুই রাজা কিংবা শুধুই রানী – তারা সব  একধারসে বেধড়ক সুখী ৷ রাগ আমার গনগনে হত ৷ বুঝে  মাঝে মাঝে কাহিনীতে  ভ্যারাইটি আনার চেষ্টা করতেন শীতদাদু  ৷ ইয়ং  হ্যান্ডসাম  কুমার বা কুমারীরাও গল্পে আসতেন — কিন্তু সব ঐ দুঃখবিলাস মেখে ৷  বিরক্ত হয়ে ভাবতাম  — এক পলা সর্ষের তেলও কি ঘষা যায় না এ শালার সুখে ভরা  রাজা রানীর  রসভরা চোখে?  ঢাউস সুখে নাহয় একটু পড়ুক কোনো এক  দুখু মিয়ার পানিজল !

 

হত না ৷ পণ্ডিত যেন জলহংসের সতর্কতায়  সাইড কেটে যেতেন দুঃখগুলোকে ৷   একঢালা সুখের গপ্পে দ্রুত ঘুমে ঢুলতাম  আমি।          একসময় গরীব পণ্ডিতের সুখের গল্প শেষ হত ৷ ঠাকুরদার কাছ থেকে সামান্য  মাসখরচটুকু নিয়ে এবার যে  তাঁকে ঘরে   ফিরতে হবে ৷ যেখানে তাঁর একটি রোগে ভোগা মেয়ে ৷ মেয়ের বাপ অবশ্য হেসে   বলতেন —ও আমার শুকনো শাকের গোছা ৷

 

বড় হচ্ছিলাম আমি ৷ কত্ত তাড়াতাড়ি  হারিয়ে যেতে লাগল আমার  ছেলেবেলার সুখী পণ্ডিত ৷  কখন কীভাবে জানি না তো ভাই !

 

বহুকাল বাদে  একবার শীতের সমুদ্দুর দেখতে গিয়েছিলাম  ৷ সে সমুদ্রে  ঢেউ সরে গ্যাছে অনেকদূর ৷  আগে যেখানে সমুদ্র এখন সেখানে একটি পায়ে চলা  বালু রাস্তা ৷ রাস্তা শেষে বাতিঘর  ৷ হাঁটতে লাগলাম বাতিঘরের দিকে চোখ রেখে  —৷  পিছু ফিরে দেখছিলাম , তীরে কত মানুষ ৷  দোকানপাতি ! ঝাঁঝালো টিউবে জ্বলছে পসরা ৷

 

ওমা গো !

 

বাতিঘরটা এমন  আঁধার কেন গো !

 

আলোর ঘর আমার এমন করে ভূত হয়ে গেল কখন !

 

মানবের জলযান দিশা  হারাবে যে গো মা  !

 

 

 

 

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes