অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গদ্য
অ্যানাটমি অফ এ ফল
তুষারশুভ্র জমিতে পড়ে আছে একটি লাশ। অল্প কিছুক্ষণ আগে তৈরি হওয়া জীবনের ও ঈর্ষার কলতান আর ছুঁয়ে যাচ্ছে না তাকে। লাল বরফ থেকে বহুদূরে শৈত্যবিহীন নতুন ঘরের মায়াময় অন্ধকারে সেই দৃশ্য চাক্ষুষ করছে তারা। সম্পর্কের লাশের গন্ধ তখনও চেনে না তারা।
পড়ে যাওয়ার কতরকম রঙের ভিতরে প্রবেশ করে বেরিয়ে এল তারা। আতঙ্কের আগে সবার যেমন সাধারণ একটি গল্প থাকে।
সেদিন শরতের শেষ, হেমন্তের শুরু, অথচ উৎসব আসেনি তখনও। রাস্তার আলো জ্বলে উঠেছিল, দুপুরের পরে রাত নেমে এসেছিল। আর নির্জন ভাঙা রাস্তায় পরিচয়পত্র পাবার আশায় লাইনে দাঁড়িয়ে আগডুম বাগডুম ভাবছিলাম। দিন দুয়েক আগে আমার প্রথম উপন্যাসের প্রথম কিস্তি প্রকাশ পেয়েছিল। একজন মানুষও পড়ে দেখেনি। সে নিয়ে ভাবনা ছিল না। আমি ভাবছিলাম দূরপাল্লার লরিগুলি জি.টি রোডের ধার দিয়ে যেতে যেতে একদলা কুয়াশা ফেলে যাচ্ছে কি না। সেই দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় কি না। কিংবা রেললাইনের ছোট ব্রিজ টপকে নবচক্রপাড়ার মোড়ে রোঁয়া ওঠা চাদর গায়ে শীতবুড়ো এল কি না। ঠিক সেই মুহূর্তে এক অতি চেনা ও বিরাট অচেনা বন্ধু মৃত্যুর গল্প শুনিয়েছিল আমায়। টলোমলো কাঁচা উপন্যাসের প্রথম পাঠক হয়ে মৃত্যুর গল্প শোনাতে এল সে। সেই কিশোর কল্পনায় দেখেছিল হাসপাতালের বেড থেকে পড়ে যাওয়া বাবার প্রাণ নিভছে ধীরে ধীরে। মুঠো-ছাই ভাসিয়ে জল থেকে উঠে আসার আগে জলের যে টান, সেখানে দাঁড়িয়ে দেখেছিল শহরে জ্বলে উঠছে আলো, চিমনি থেকে উবে যাওয়া বাবার মতো জ্বলে যাচ্ছে আরেকটি প্রাণ। সেই যে সেবক সংঘের ভাঙা রাস্তা থেকে ছুটে এসেছিলাম বাড়ি, আজও সেই দৌড় চলছে আমার। অস্থির দৌড় আর পড়ে যাওয়ার মাঝে ভাসছে দু’টি প্রাণ। সামুদ্রিক ভিড়ের মাঝে ধুতি-চাদর পরা লজ্জিত কিশোর ঢুকে পড়ল আমার কাঁচা উপন্যাসের খসড়ায়। আমি তাকে লালন করি আমার বদ্ধোন্মাদ অস্থিরতায়।
জন্মের হেমন্তকাল শেষে একলা শীতের বেলা উপন্যাসের খসড়া করতে কেটে গেল। গরম হাওয়া দ্রুত ঢুকে আসছিল কলকাতায়। শুষ্ক রোদের মধ্যে ধুলো-স্নান সেরে ছুটে যাচ্ছিল সেক্টর-ফাইভের বাস। মেলায় একটি দু’ফর্মা সম্বল করে দাঁড়িয়েছিল সেদিনের কিশোর। আমাকে খুঁজেছিল। আমার ভিখিরি প্রাণ দৌড় শেষ করে শ্বাস টেনে বলেছিল “এই তবে…!” একটি অন্ধকার ইদারায় পড়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে যেভাবে হাঁসফাঁস করে মানুষ।!
তারপরে আর কী… হেমন্তকালে মনে পড়ে আমাদের একটি নদী ছিল। তার পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছ, হাওয়া দেয়, জলের আওয়াজ… আমরা ভেবেছিলাম এই নদী সহজ! পতনের মোহময় সুখ। সেই সুখে আলো জ্বালালাম। মানুষের হাসি কিনে আনলাম। আর ছবির মধ্যে ধরে রাখলাম শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের মিথ্যে।
তারপর মধ্যরাতে কত পথ উজিয়ে এসে একটি ঘর সাজানো হল। ঘরের মাপ পাঁচশ বর্গফুট। ঘরের মধ্যে বিশেষ কিছু নেই। শুধু আমাদের মতোই পতনোন্মুখ একটি ছবির কাচ ভাঙার শব্দ লেগে থাকে। তবুও দু’জন কবিতার কথা ভাবে, বাজার করে, বাসন কেনে, রেলগেটে সন্ধে নামে। মধ্যরাতে কান্না নামে চারজোড়া চোখ বেয়ে। মিটেও যায় দুঃখ, বৈশ্বিক স্বপ্ন দেখতে চেয়ে। নতুন বইয়ের গন্ধ আসে, গলা কাটা দামে খরিদ আসে, বেহিসেবের ভয় আসে। ঈর্ষা নেই চিৎকার আছে। বরফের ওপরে পতিত দাম্পত্যের লাশ থেকে তখনও বহুদূরে।
দুটো এলোমেলো বোকাসোকা প্রাণ, কাজ ভাগ করে নিতে নিতে, জীবন ভাগ করে নেওয়া শেখার আগেই আতান্তরে পড়বে। পড়ে যাবার মোহময় সুখ ততদিনে উবে গেছে। এসেছে হিসেব ও না চাওয়ার ফিরিস্তি। আর এই ফাঁকে খাদ্যের মজাদার কূটনীতি ঢুকে আসবে একটু পরে। সেই বুদ্ধিতে দু’জনের কেউ দায়ী নয়, তবু আটকে আছে দূরত্বের ভুল। অথবা ভুলের দূরত্ব।
এই তো আবার হেমন্ত আসছে। এই সময় শেষরাতে ঘুম ভেঙে যায়। একটি স্বপ্ন ফিরে ফিরে দেখি। ভুল… ভুল… ভুলে ভরা জল, জলের টানে এলোপাথাড়ি হাত পা ছুঁড়ছে সেই অলীক কিশোর। প্রথমে নিজেকে বাঁচাতে, তারপর হাতড়াচ্ছে, খুঁজছে নানান রঙের অন্ধবিশ্বাস পরে থাকা একটা হাত। হাতটা ক্রমে সরে যাচ্ছে পাঁচশ বর্গফুটের জমে থাকা ধুলো থেকে। জলের ভিতরে চলে যাচ্ছে, একশো উনিশের গতিতে ডুবে যাচ্ছে। তল পাচ্ছে না কেউ। জানত না, আসলে তল পায় না কেউ।
আমার শেষ পড়ে যাওয়ার গল্পখানি এখনও বাকি। সেদিন হাইটেনশন লাইনে ব্রেকডাউন, এলাকা জুড়ে চাপ চাপ জমাট অন্ধকার। সবাই চুপ, অদৃশ্য মানুষের ফিসফাস, আর বদ্ধ হাওয়া জলের ধারে। আমার চোখের সামনে ছিল কালো দেওয়াল, ভেজা পায়ের নীচে ভেজা মাটি। যেকোনো ভাবনা গঠিত হবার আগে, যেকোনো প্রশ্ন বুঝে ওঠার আগে ঘন অন্ধত্বে দেখলাম, আমি পড়ে যাচ্ছি। পড়ে যাচ্ছি, ডান পায়ের পাতাসমেত ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে পশমের পাপোষ। বাঁ পায়ের পাতা যেন অভিমানের বশে সরে যাচ্ছে বিপরীতে। শিরাগুলোয় এক পাহাড় সমান চাপ, যন্ত্রণা। আমার চোখের সামনে কালো দেওয়ালখানি খুঁজে পেলাম না। আমার দু’টি হাত হাওয়ায় নকশা কেটে প্রাণপণ খুঁজছে চেনা গন্ধ, চেনা হাত, নিদেনপক্ষে অতি চেনা পোশাকের কোণ। খুব চেনা স্বরের মিথ্যে শব্দ ছাপিয়ে কানে উঠে আসছে তীক্ষ্ণ বাঁশি। দূর থেকে ছুটে আসছে মা, আরও এক চেনা পায়ের শব্দ পাচ্ছি না। মনে পড়ছে প্রথম উপন্যাস, প্রথম প্রতিক্রিয়া। মনে পড়ছে আলো ও ভিড়ের ঝলমলে সন্ধে, ঘেমে ওঠা গাছকৌটো, হাতব্যাগে রাখা ডুপ্লিকেট চাবি, কাচভাঙা ছবি, বাসনের আওয়াজ, দরজার কাছে পাশাপাশি রাখা দু’জোড়া জুতো, আর খালি পড়ে থাকা নীল চটিটা।
আমার দু’টি পায়ের শিরা যেন ছিঁড়ে এল। শক্ত মেঝের মধ্যে পড়ে যাওয়ার আগে বাঁ দিকের পায়ে রেখে দিলাম আমার সকল স্মৃতির ভার।
মায়ের হাত এগিয়ে এল। আমার চিৎকার জুড়িয়ে এল। আমি খুঁজে নিলাম একটি হৃৎস্পন্দন। ভয় পেয়ে যাওয়া হৃৎস্পন্দন যেন আপনমনে খেলা বন্ধ করে মুহূর্তে থমকে দেখছে! দেখলাম, জড়িয়ে থাকা হৃৎস্পন্দন খুঁজে পেয়ে আমার হৃৎপিণ্ড সমে ফিরছে।
জলের টানে দাঁড়িয়ে থেকে চিমনি থেকে প্রাণ উবে যেতে দেখেছিল যে আধভেজা কিশোর, তারই প্রাণ বহন করছি আমি। তাকে পড়ে যেতে দেওয়া যায় না। আমাদের পতনের সকল কাটাছেঁড়া এইখানে এসে মিশে গেছে।