
পর্ণশবরীর কথকতা ১৬ প্রাপ্তি চক্রবর্তী
বছরের এই সময়টায় মন ভালো থাকে, আবার কিছুটা খারাপও। খুব বেশি রোদ্দুর এই সময়ে ভালো নয়। কিছুটা বৃষ্টি, কিছুটা মেঘ আর রৌদ্রের লুকোচুরি আছে বলেই আশ্বিনেও বর্ষার গান আছে। বিকেলের দিকটায় রোদ ক্রমে কমলালেবুর খোসার মতো রঙ নিতে থাকে মেঘ ভেঙে বেরিয়ে। ভোরের দিকে মায়ের বহু পরিহিত একখান নরম সুতির চাদর গায়ে জড়িয়ে নিতে হয়। ছেলেবেলা ফিরে আসে ধীর পদক্ষেপে। মাখা সন্দেশ খেতে ইচ্ছে করে। শিউলি ফোটা ভোরে পায়ে পায়ে নেমে যেতে ইচ্ছে হয় শিশির জমানো ঘাস-জমিতে।
মহালয়া আসে, যায়। একটা পরিবারের ব্যাস ছোট হয়ে আসে ক্রমে। তর্পণের সময় বৃদ্ধি পায়। পুজো আসছে মানে স্মৃতিও আসছে। মা-বাবার স্মৃতি, তাঁদের ছেলেবেলা, তাঁদের মা-বাবা, ভাই-বোন, ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া পরিবার..
উত্তরপুরুষের কোনো একজন স্মৃতিরক্ষা না করলে প্রজন্মের সঙ্গে সঙ্গে সব ধুলো হয়ে যায়। আমি স্মৃতিরক্ষা করি। পুজোর স্মৃতি, ঘাসের শিষে শিউলি কিংবা বকুল গেঁথে মিশনের পুরাতন নাটমন্দিরের চাতালে ছোটো হাতে রেখে আসার স্মৃতি, বর্ষা শেষে ঘাসেদের দীর্ঘ হয়ে ওঠার স্মৃতি..
একটা সময় পর্যন্ত আমাদের সকলের ছেলেবেলা একইরকম। শিশুদের খেলা, আনন্দ সৃষ্টির আদি থেকে অমন। রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ল। লিখতে বসে বুঝি স্মৃতি লাইন ধরে সেজেগুজে এসে সার দিয়ে বসে না। বাবুলগামের ভেতরে পাওয়া জলছবির মতো আবছা অল্প একটু আভাস দিয়ে মিলিয়ে যায়, নতুন স্মৃতি আসে। আমি কাঁচামাল লিখে রাখি। একবারে যেটুকু কলমে আসছে। সত্যটুকুই। বানানো স্মৃতি দিয়ে পুজোর আগে দীনবন্ধুর কাছে দুইবোনের ঝুলুম-ঝালুম চুল কাটানো, মায়ের নতুন কমলা-সোনা জরিপার ঘিয়ে রঙা তাঁতের শাড়ি, বাবার আর্দির পাঞ্জাবি আর এক ছিটের থেকে বানানো জামাকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
শুনলাম দীনবন্ধু অতিবৃদ্ধ হয়ে শয্যাশায়ী, মিশনের উঁচু দোরের সামনে আবাল্য দেখে আসা সোনা-পাগলা নেই, নতুন পাড়ার ছাপড়ার থেকে এদেশে পাকাপাকি বসত করা রসিক নাপিত মেদিনীদাদু উধাও। এঁরা হিসেবের খাতায় ‘নেই মানুষের’ দলের। তবু এঁদের সঙ্গে স্মৃতি জড়িয়ে-মড়িয়ে থাকে প্যাঁচ খেয়ে। আমি ছেড়ে বেরোতে পারি না। একটা যুদ্ধ শেষে নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতির প্রাক মুহূর্তে ধীর-ললিত শারদ সকালে আমি স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখি।
যুদ্ধের আগে রামচন্দ্র যেমন শেষবারের জন্য নির্মল চোখে দেখে নিয়েছিলেন বর্ষার সৌন্দর্য।
(ক্রমশ)