ভাষা কি স্বাধীন? <br /> রূপশ্রী ঘোষ

ভাষা কি স্বাধীন?
রূপশ্রী ঘোষ

ভাষা কি স্বাধীন?

পৃথিবীর কোনো ভাষাই কি স্বাধীন? অর্থাৎ একজন মানুষ যে ভাষায় বড়ো হন তিনি কি সর্বসমক্ষে স্বচ্ছন্দে তাঁর ভাষায় কথা বলতে পারেন? পারে্ন না। ধরা যাক কোনো একজন গ্রামের মানুষের কথা, তিনি কলকাতায় এসেছেন। কলকাতার মান্যচলিত ভাষা তখনও রপ্ত করে উঠতে পারেননি। সঠিকভাবে তাঁর ‘স’ এর উচ্চারণ জানা নেই। তাঁরই কোনো ঘনিষ্ঠ বা পরিচিত কলকাতার মানুষই উচ্চারণ শুনে শুরুতেই, “শ্যামবাজারের শশীবাবু সকাল সকাল শশা কিনে…” লাইনটা পুরোটা হিন্দি দন্ত -স উচ্চারণে ব্যঙ্গ শুরু করে দেবেন। তিনি ‘স’ এর উচ্চারণ বোঝার আগেই লজ্জায়, ভয়ে এমন গুটিয়ে যাবেন যে, আর মন খুলে মনের ভাব প্রকাশ করা তো দূর অস্ত সাধারণ গল্প করতেও কুন্ঠা বোধ করবেন। কোনোভাবেই সেই মানুষটার উচ্চারণ সমস্যা কেন? সেসব কারণ তলিয়ে ভাবার চেষ্টা করবেন না বা সেটা আদৌ সমস্যা কিনা সেই দিকটাও খতিয়ে ভাবার কথা ভুলেও চিন্তা করবেন না। কলকাতার মানুষই যে শুধু গ্রামের মানুষের উচ্চারণ নিয়ে ব্যঙ্গ করেন তা কিন্তু নয়। এক জেলার মানুষ অন্য জেলার মানুষকেও উচ্চারণ নিয়ে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েন না। হুগলির মানুষকে বর্ধমানের মানুষের উদ্দেশ্যে বলতে শোনা যায়, “তোরা তো – কই, কেনোর জায়গায় কয়, ক্যানে এসব বলিস”। উল্টোদিকে বর্ধমানের লোক হুগলির লোককে বলে, “তোরা তো গইড়ে গইড়ে পইড়ে যাব বলিস’। তোদের উচ্চারণ কী এমন ভালো? খুব নিখুঁত বিচারে আবার দেখা যায় এক জেলার মধ্যেও অঞ্চলভেদে উচ্চারণ ভেদ আছে। গোটা হুগলি বা গোটা বর্ধমান একই উচ্চারণে কথা বলে না।
সুদূর গ্রাম থেকে কলকাতায় পড়তে আসা ছেলেমেয়েগুলো তো প্রথমদিকে উচ্চারণ জড়তায় গুটিয়েই থাকে। ক্রমশ কলকাতার ধাঁচ বুঝে স্বস্তি উপার্জন করে। পূর্ববঙ্গের দিকেও যদি তাকাই সেখানেও ভাষার বিভাজন, ভাষা নিয়ে কটাক্ষ লক্ষ করা যায়। কুমিল্যার ভাষা, বরিশালের ভাষা, সিলেটের ভাষা অঞ্চলভেদে ভাষার ভেদাভেদ নিয়েও কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি চলে। কেবল বাংলাভাষার আঞ্চলিকতাতেই সীমাবদ্ধ না থেকে একটু দূরের দিকে তাকিয়ে এক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, জার্মানিতেও এই আঞ্চলিকতার খোঁচা একে অপরকে দিতে দেখেছি। পূর্ব জার্মানি এবং পশ্চিম জার্মানির ভাষার মধ্যেও যে উচ্চারণের তফাৎ আছে, এবং তা নিয়ে তাদের হাসি ঠাট্টা ব্যঙ্গ লক্ষ করেছি। অঞ্চল, প্রদেশের সংকীর্ণ গণ্ডি ছাড়িয়ে আমরা যদি জাতীয় স্তরে উত্তীর্ণ হই সেখানেও ভেদাভেদ লক্ষ করা যায়। আমেরিকার ইংরেজি, ব্রিটিশ ইংরেজি, অস্ট্রেলিয়ার ইংরেজির মধ্যে উচ্চারণ পার্থক্য, ভাষার বাঁধন, কিছুক্ষেত্রে বানানেও বিভেদ দেখা যায়। তা নিয়ে ব্যঙ্গ কটাক্ষও চোখে পড়ে।
এ তো গেল কথা বলার বিষয়, লেখার বিষয়েও কি আমরা যথেষ্ট স্বাধীন? না, তাও নয়। আমরা মেদিনীপুরে, পুরুলিয়ায়, বীরভূমে হুগলিতে, বর্ধমানে যে উচ্চারণে কথা বলি সে উচ্চারণে কি লিখি? নাকি লিখলে সে লেখা মান্যতা পাবে? আজকাল কিছু আঞ্চলিক কবিতা আবৃত্তি করতে শোনা যায় বটে কিন্তু তা কতটা? গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ সবই তো সেই কলকাতার বাংলা ভাষায় লেখা হয়। অর্থাৎ উপভাষাকে যে পাঁচটা ভাগে ভাগ করা হয়েছে, সিলেবাসের অন্তর্ভূক্ত করে পড়ানো হচ্ছে সে তো শুধু পার্থক্যটুকু বোঝানোর জন্যই। সেই উপভাষায় সাহিত্যের রমরমা কতটা? পারিবারিক দ্বন্দ্বের মতো আমরা আঞ্চলিক ভাষার দ্বন্দ্বেও মেতে থাকি। একে অপরকে কটাক্ষ করি। এবং অঞ্চলের বাইরে বেরিয়েই যেন একমাত্র বাংলাভাষা রাঢ়ী বাংলাতেই কথা বলি বা লিখি। এখানেও কোথাও একটা কর্তৃত্ব ফলানোর ব্যাপার এসে যায়। একা রাঢ়ী রাজত্ব করে বাকি বাংলা কাঙাল হয়ে যায়।
বানানের দিকে তাকালে দেখা যায় সেখানেও বিড়ম্বনার শেষ থাকে না। বাংলা বানানে তিনটে ‘শ’ এর হিন্দির মতো আলাদা কোনো উচ্চারণ নেই। ‘ন’ এব ‘ণ’, ‘য’ ও ‘জ’ এর ক্ষেত্রেও একই কথা। তারফলে বানান ভুল করার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। উচ্চারণ অনুযায়ী বানান লেখা না হওয়ার ফলে অসুবিধাটা কোথায় হয় একটু দেখা যাক – একজন কলকাতার বাচ্চা বাংলা শেখে তিনখানা স, শ, ষ এর উচ্চারণ কেবলমাত্র ‘শ’ এর উচ্চারণ দেখে। ফলত সে লিখতেও চায় সেটাই। যে সমস্ত বানান ‘স’ দিয়ে শুরু বা শেষ হওয়ার কথা সেসমস্ত বানানেই ‘শ’ এসে যায়। এখানে বাচ্চাটার না পারাটার মধ্যে কোনো দোষ দেখি না, কিন্তু বাংলা বানানের মা, বাপ জ্ঞান নেই বলে তাকেই হেয় হতে হয়। আমাদের চিরাচরিত প্রথার কোনো দোষ বর্তায় না। বাংলা বানান বিষয়ে যে ঝুড়ি ঝুড়ি নিয়ম, একজন বাচ্চার উপর কি সেই নিয়মের বোঝা চাপানো যায়? নাকি বড়োরাও সব জানেন? উচ্চশিক্ষার দারস্থ না হলে তো এসব নিয়মের কচকচির মুখোমুখি হওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না।
জার্মানভাষার বানানের ক্ষেত্রে জার্মানভাষীদের কিন্তু সে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না। এখানে উচ্চারণ আর বানানের মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকায় মুখস্থ করার একটা অতিরিক্ত চাপ বাচ্চার উপর এসে পড়ে। তখনই তারা সেই ভাষার প্রতি আনুগত্য হারায়। ইংরেজির ক্ষেত্রেও উচ্চারণ এবং বানানের তফাৎ থাকলেও বাংলার থেকে ইংরেজিটাই সহজ মনে হয় একজন বাঙালির কাছেও। বাংলাভাষার প্যাঁচ নিয়ে মানুষ এত পাত্তাও দেয় না। অনায়াসে বাংলা বানান ভুল করতে পারে কিন্তু অনায়াসে ইংরেজি বানান ভুল করার করার কথা ভুলেও ভাবে না বাঙালিরা। ইংরেজি বানানে ভুল যদিওবা হয় তার জন্য যে হীনমন্যতায় ভুগে বাংলা বানান ভুল করে, তাকে হীনমন্যতায় ভুগতে বা অনুতাপ করতে দেখা যায় না।
মান্যচলিত ভাষার কর্তৃত্ব মানতে গিয়ে কোনো কোনো মানুষকে নিজের উপর একটা অতিরিক্ত চাপ চাপিয়ে নিতেও দেখা যায়। অর্থাৎ সে বা তিনি কলকাতার ভাষাতেই কথা বলতে পারেন বা কলকাতার আদব কায়দা মেনেই বড়ো হয়েছেন এমন একটা দায় তাঁর সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে দেখা যায়। একজন রাজবংশী বন্ধুকেই দেখেছিলাম কাজের সূত্রে কলকাতায় পোস্টিং হওয়ায় তিনি তাঁর শিকড় ভুলে কতটা কলকাতার মতো সেটাই প্রতিষ্ঠা করতেন। আবার শিকড় ভুলতে না পারা মানুষও দেখা যায়। এই শিকড় ভুলতে না পারা মানুষগুলো যখন মনের আনন্দে কথা বলেন তখনই তথাকথিত এলিট সমাজে ব্যঙ্গের পাত্র হয়ে যান।
ভাষা মনের ভাব প্রকাশ করে। স্বচ্ছন্দে মনের ভাব প্রকাশ করতে হলে প্রত্যেকটি মানুষের উচিত প্রত্যেকের ভাষাকে যথাযথ সম্মান করা। আঞ্চলিক, প্রাদেশিক বা জাতীয় সর্ব স্তরের ক্ষেত্রেই কথাটা সত্যি। কেবলমাত্র একটা দিন আড়ম্বড় করে মাতৃভাষার উদ্‌যাপন নয়। প্রতিদিনই চলুক যার যার নিজের নিজের ভাষা চর্যা। কোনো ভাষাকেই অসম্মান নয়, আঞ্চলিক থেকে জাতীয় সব স্তরেই ভাষা সম্মান পাক। ভাষার সম্মানহানী করা মানে নিজেদের দৈন্যতাকেই প্রকট করা।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes