বনলতা সেনঃ ক্লান্ত ও বিষন্ন প্রেমিকের শোকগাথা  <br /> রাহুল দাশগুপ্ত

বনলতা সেনঃ ক্লান্ত ও বিষন্ন প্রেমিকের শোকগাথা
রাহুল দাশগুপ্ত

ইতিহাস অশান্ত, অস্থির, চলমান, গতিময়। তার সঙ্গে যখন প্রেমের দেখা হয়, তখন কী হতে পারে? জীবনানন্দ দাশ দেখিয়ে গেছেন, কবিতার জন্ম হয় কীভাবে! হাজার বছর ধরে সে পৃথিবীর পথে হেঁটে চলেছে। সে আসলে কে? সভ্যতা? কোন সভ্যতা? সভ্যতার মধ্যেই যেন একটা ইউরোকেন্দ্রিকতা আছে। কিন্তু জীবনানন্দ যে মানচিত্র আঁকেন, তার মধ্যে পশ্চিম কই? সেই মানচিত্রে শুধু স্থান নেই, আছে সময়ও। কিন্তু বাখতিন কথিত সেই ‘ক্রনোটোপ’ অর্থাৎ স্থান-কালের মেলবন্ধন তো জীবনানন্দের কবিতায় কোনও ইউরোকেন্দ্রিকতাকে নির্দেশ করে না!
পৃথিবীর পথে হাজার বছর ধরে হেঁটে চলেছে সে। ‘পথ’ শব্দটি দিয়ে বোঝানো হয়েছে স্থান বা মানচিত্র। ‘হাজার বছর’ দিয়ে বোঝানো হয়েছে আবহমান সময়, যা স্পর্শ করে আছে ধূসর অতীতকে। সভ্যতার সমান বয়সী যেন এক পুরুষের ছবি আমরা দেখতে পাই। এ কোনও বিশেষ পুরুষের কথা নয়। জীবনানন্দ তাকে নির্বিশেষ করে তুলেছেন। তার গায়ে লেগে আছে ইতিহাসের গন্ধ। এ কোনও সামান্য পুরুষ নয়। এ সেই পুরুষ, যার মধ্যে রয়েছে নারীর জন্য তীব্র, ধারাবাহিক আর্তি। যার মধ্যে জ্বলছে প্রেমের অনির্বাণ আগুন। এ এক চিরন্তন পুরুষ। এ এক প্রেমিক পুরুষ। অতিমানবিকও বটে! ঐতিহাসিক নয়, কিন্তু ইতিহাসের মধ্যেই তাকে স্থাপন করা হয়েছে। অন্তত তেমনভাবেই সাজানো হয়েছে তার পরিবেশ।
কোন পৃথিবীর পথে সে হেঁটে চলেছে? সে দেখেছে সিংহল সমুদ্র, দেখেছে মালয় সাগর। বিম্বিসার, অশোকের ধূসর জগৎ। বিদর্ভ নগর, যা রয়েছে আরো দূরে। এই সবই সে দেখেছে। কিন্তু কোথাও কোনও আলো ছিল না। ছিল নিশীথের অন্ধকার, দূর অন্ধকার বা ধূসরতা। এক অস্পষ্ট অতীত। এমন এক সময়ে সে ঘুরে বেরিয়েছে, যাকে স্পষ্ট চেনা যায় না। এমন এক মানচিত্রে সে ঘুরে বেরিয়েছে, যা লন্ডন, প্যারিস, রোম, এথেন্স, নিউ ইয়র্ক নয়, যেগুলোকে ইউরোকেন্দ্রিক বয়ানে পৃথিবীর কেন্দ্র বলা হয়। সে ঘুরে বেরিয়েছে এশিয়ায় বা এই উপমহাদেশের প্রান্তিক, ঔপনিবেশিক ভূখণ্ডগুলিতে। ঘুরে বেরিয়েছে বিম্বিসার, অশোকের জগতে, যখন উপনিবেশের চিহ্নমাত্রও ছিল না। প্রান্তিকতাও ছিল না। ছিল ভারতবর্ষের নিজস্ব গৌরব ও ঔজ্জ্বল্যের দিন। অথচ সেই দিনগুলোও ধূসর হয়ে গেছে।
কখনও মনে হয় যেন সভ্যতার ক্লান্তি আর বার্ধক্যকেই এই পুরুষটির ওপর আরোপ করেছেন জীবনানন্দ। এই পুরুষটি প্রাচীন, কিন্তু তার হৃদয় প্রেমিকের। অসম্ভব ক্লান্ত এই পুরুষ। অথচ তার চারপাশে জীবনের প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাস, অবিরাম ঢেউয়ের গর্জন আর সাদা ফেনার আলোড়ন। কিন্তু সেই জীবনের সঙ্গে সে যেন কোনও সংযোগ তৈরি করতে পারছে না। তার ক্লান্তি তাকে বিচ্ছিন্ন ও একা করে দিয়েছে। গোটা একটা সভ্যতার ভার যেন সে বহন করে চলেছে, এত তার ক্লান্তি! এই প্রাচীন ও শাশ্বত পুরুষের মধ্যে রয়েছে এক রোমান্টিক ইতিহাস-চেতনা। জীবন যুদ্ধে সে পর্যদুস্ত, কিন্তু তার মধ্যে রয়ে গেছে জীবন ও প্রেমের জন্য তীর আর্তি। পুরনো, মরচে ধরা সময়, সভ্যতার মতোই তার ভেতরে আগ্রাসন চালিয়েছে বার্ধক্য।
সে লড়াই করছে সেই বার্ধক্যের সঙ্গে, আর ফিরে আসতে চাইছে জীবনের কাছে। নিজেকে মিশিয়ে দিতে চাইছে প্রাণের উচ্ছ্বাস আর আলোড়নের সঙ্গে। কিন্তু কীভাবে সে তা পারবে? পারবে যদি কোনও নারী তার জীবনে আসে। পারবে যদি সে ভেসে যেতে পারে আবার প্রেমের প্লাবনে। নারী ও প্রেম বারবার পুনর্জন্ম দিতে পারে একজন পুরুষকে। ধ্বংসস্তূপ থেকে তাকে বার করে এনে দিতে পারে পরিত্রাণের আলো। দিতে পারে সেই রহস্যময়তার স্বাদ যা একজন পুরুষকে জীবনের প্রতি নতুন করে আগ্রহী করে তোলে। এরকমই একজন রহস্যময় নারী, বনলতা সেন।
এ কী নিছকই কোনও নাম? বিশেষ কোনও নারী? বিশেষ তো বটেই, কিন্তু সে তার বৈশিষ্ট্যের জন্য। নইলে এই বনলতা সেন নির্বিশেষ নারীর প্রতিনিধি। তার প্রতিনিধিত্ব এই জায়গায় যে, কোনও নির্দিষ্ট নারী না হয়েও সে বিশেষ এক ধরনের নারীর প্রতিনিধি। এই সেই নারী, সেইসব নারী, পুরুষকে জীবনকে যারা নতুন নতুন মোচড়ে, রহস্যময়তার আস্বাদে ভরিয়ে দেয়। এই নারীই দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল সেই পুরুষকে, নিজের জীবনে যে সভ্যতার বার্ধক্য ও ক্লান্তিকে অনুভব করে। এই নারীর নিবাস নাটোরে। নাটোর পূর্ববঙ্গের একটি জায়গার নাম। কিন্তু জীবনানন্দ নাটোরকে কোন স্থানিক নির্দিষ্টতা দিতে চাননি। তিনি এই শব্দ-ধ্বনির প্রত্নতাত্ত্বিক আমেজটিকেই ব্যবহার করতে চেয়েছেন।
নাটোর শুনেই পাঠকের মনে শিহরণ জাগে। এক অস্পষ্ট, ধূসর, রহস্যময় জায়গার কথা মনে পড়ে। এই রহস্যময়তাই বনলতা সেনের মতো নারীর পক্ষে একদম উপযুক্ত। বনলতা সেন নাটোরের হবেন না তো, কোথাকার হবেন? তাছাড়া নাটোরের সঙ্গে ধূসর অতীতের যেন একটা সংশ্লিষ্টতা আছে। নাটোর যেন আমাদের ইতিহাস ও কিংবদন্তীর অংশ। বনলতা সেন সেই ইতিহাস ও কিংবদন্তীর থেকে উঠে আসা এক নারী। ক্লান্ত, অস্থির পুরুষকে শান্ত করার, শান্তি দেওয়ার মতো নারীত্ব সে অর্জন করেছে অনিবার্যভাবেই।
ক্রমে বনলতা সেন যেন ছবি হয়ে একটু একটু করে আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠতে থাকে। কবেকার পুরানো, অতীতের বিদিশা নগরীর রাতের মতো অন্ধকার তার চুল। তার মুখ দেখে মনে হয়, সেখানে যেন শ্রাবস্তীর কারুকার্য। বিদিশার মতো শ্রাবস্তীও এক প্রাচীন নগর। সেই নগরের শিল্প–স্থাপত্যের অবিনশ্বর, নান্দনিক ছাঁচে গড়ে উঠেছে যেন বনলতা সেনের মুখ। অর্থাৎ, বনলতা সেন স্রেফ কোনও সমসাময়িক নারী নয়। সে একইসঙ্গে ধ্রুপদী ও আবহমান। প্রাচীন দুই নগরের, ইতিহাস ও কিংবদন্তীর চূর্ণ সংগ্রহ করে যেন অসীম যত্নে নির্মাণ করা হয়েছে তাকে, তার অবয়ব। তার নান্দনিক উপস্থিতিতে ধরে রাখা হয়েছে আবহমান সময়কে। বনলতা সেন তাই চিরকালীন, নারী হিসাবে তার সৌন্দর্য ও নান্দনিকতার কোনও তুলনা নেই ।
অনেক দূরের কোনও সমুদ্রে, ইউলিসিসের মতো যে নাবিক হাল ভেঙে দিশা হারিয়েছে, সে ভাসতে ভাসতে কখনও দেখতে পায় অজানা কোনও দ্বীপ, দারুচিনিতে পরিপূর্ণ, সেই দ্বীপের মধ্যে বিস্তৃত সবুজ ঘাস। বনলতা সেন সেই সবুজ ঘাসের মতো, সেই দারুচিনি দ্বীপের মতো, এমন এক নারী যাকে পেলে একজন পুরুষ দিশাহীন জীবনে শুধু আশ্রয় নয়, বেঁচে থাকার আনন্দও পায়। এই নারীর চোখ পাখির নীড়ের মতো। পাখি সারাদিন অক্লান্ত হয়ে উড়ে যায়, সন্ধ্যায় ফিরে আসে তার নীড়ে, আশ্রয়ে, শান্তির আশায়। বনলতা সেনের চোখে, তার দৃষ্টিতে, আছে সেই আশ্রয় ও শান্তি।
শুধু তাই নয়, তার মধ্যেও আছে প্রিয় পুরুষের জন্য খোঁজ। তাই সে চোখ তুলে জানতে চায়, এতদিন কোথায় ছিলেন? ‘এতদিন’ মানে কতটা সময়? কতদিন ধরে সেই পুরুষটি হেঁটে চলেছে পৃথিবীর পথে? এই দীর্ঘ সময় ধরে বনলতা সেন, তার আকাঙ্খিত নারী, তারই জন্য হৃদয়ের সমস্ত আর্তি নিয়ে অপেক্ষা করে গেছে? এই প্রশ্ন তো কোনও উদাসীন নারীর হতে পারে না। এই প্রশ্ন হতে পারে শুধু সেই নারীর, যার মধ্যে বিরহ আছে, কাতরতা আছে, আর্তি ও ব্যাকুলতা আছে, অন্বেষণ আছে প্রিয় পুরুষের জন্য। এই নারীর হৃদয় নির্লিপ্ত নয়। এই নারীর হৃদয় স্পন্দিত, অপেক্ষারত, উৎকণ্ঠিত, ভারাতুর হয়ে আছে।
এভাবেই পুরুষটির মনে হয়, নারীটি যেন তার দিশাহীন জীবনে এক পরম প্রাপ্তি। অন্যদিকে নারীটিও গোপন রাখে না তার প্রতীক্ষারত হৃদয়কে। এই নারী ও পুরুষ হয়ে ওঠে বিশেষ থেকে নির্বিশেষ। নারী ও পুরুষের আবহমান, ধ্রুপদী, শাশ্বত, নান্দনিক সম্পর্ককে এভাবেই প্রতীকার্থে তুলে ধরেছেন জীবনানন্দ। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্ক এটি। এই সম্পর্ক সময়-নির্দিষ্ট নয়, চিরকালীন, সময়–অতিক্রান্ত এবং শিল্পকীর্তির মতোই। কবিতার ভাষায় তাদের মিলনের মোক্ষম মুহূর্তটি ধরেছেন জীবনানন্দ।
তারা যখনই একে অপরের মুখোমুখি হয়েছে, একে অপরের সঙ্গে কথা বলে উঠেছে, তখনই আমরা পেয়েছি বাংলা কবিতার এক অবিনশ্বর মুহূর্তকে। চিরকালীন কয়েকটি লাইনকে। অম্লান এক ছবিকে, যা পুরুষের মরিয়া প্রাপ্তি আর নারীর শান্ত আর্তিতে ভাস্বর। অন্ধকারে যেমন আলোকে আরো বেশি উজ্জ্বল মনে হয়, তেমনই অন্ধকারের প্রেক্ষাপটে মুখোমুখি হয় সেই প্রতীকী ও চিরকালীন দুই নারী ও পুরুষ। অন্ধকার তাদের মুখোমুখি হওয়ার মাহাত্ম্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়। তাদের আরও বেশি উজ্জ্বল আর ভাস্বর মনে হয় তখন। চলচ্চিত্রের ফ্রিজ শটের মতোই, এক স্থির দৃশ্যপট হয়ে থেকে যায় যেন এই মুহূর্তটি।
ক্রমে দিন শেষ হয়ে যায়। সন্ধ্যা আসে শিশিরের শব্দের মতন। শিশিরের কী কোনও শব্দ হয়? আসলে শিশির আর সন্ধ্যার একটাই মিল। তারা জানে, নীরবতার ভাষা। কিন্তু কী অসম্ভব ধ্বনিমাধুর্য আর নান্দনিকতা এই অনুভবে! শিশিরের শব্দের মতো যে সন্ধ্যা, তার অনুভূতিই তো আলাদা। সেই অনুভূতি যেমন নান্দনিক, তেমনই বিমূর্ত। তাকে শুধুই অনুভব করা যায়। কল্পনা পর্যন্ত যেন করা যায় না! চিল তার ডানা থেকে রোদের গন্ধ মুছে ফেলে। রোদের কী কোনও গন্ধ হয়? এও তো অনুভূতির ব্যাপার। বিমূর্তকে এভাবেই তিনি মূর্ত করে তোলেন। অনুভূতিকে এভাবেই তিনি ছবি করে তোলেন। কিন্তু চিল যখন তার ডানা থেকে রোদের গন্ধ মুছে ফেলে, তখন তো তা এক দৃশ্যকল্পও তৈরি করে! কী নান্দনিক আর প্রতীকী সেই দৃশ্যকল্প! চিল তার ডানা ঝেড়ে তার গায়ে লেগে থাকা সমস্ত রোদকে মুছে দেয়।
ফলে অনিবার্যভাবেই সন্ধ্যা নামে। অন্ধকারে ভরে যায় চারপাশ। পৃথিবীর সব রং আস্তে আস্তে নিভে যেতে থাকে। এই তো সেই সময়, গোটা দুনিয়া যখন স্তব্ধ, নির্জন, আলোহীন হয়ে যায়। জীবনের গভীর কথাগুলি, স্মৃতি ও স্বপ্নগুলো উৎসারিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। ফলে আয়োজন হতে থাকে পান্ডুলিপির, যেখানে সংগৃহীত হবে কত কাহিনি, কত গল্প, জোনাকিরা যেমন অন্ধকারে ঝিলমিল করে, সেভাবেই তারা সাদা পৃষ্ঠায় ঝিলমিল করতে থাকবে, অক্ষরগুলোই হয়ে উঠবে এক একটি জোনাকি।
এ এক অবসানের সময়, যখন সব পাখি ঘরে ফিরে আসে, সব নদীও। এ সেই সময়, যখন মানুষ জীবনের চূড়ান্ত হিসেব-নিকেশ সমাপ্ত করে, জীবনের সব লেনদেন ফুরিয়ে যায়, জীবনের সমস্ত তুচ্ছতাকে অতিক্রম করে জেগে থাকে শুধু এক নান্দনিক অন্ধকার। আর জেগে থাকে বনলতা সেন, সেই আবহমান, রহস্যময় নারী, প্রিয় পুরুষের মুখোমুখি। নারী ও পুরুষের মিলনের উপযুক্ত ক্ষণটি ঘনিয়ে আসে, অন্ধকার যেন রচনা করতে থাকে তাদের মিলনের জমি, যেখানে একে অপরকে স্পর্শ করে তারা নিজেদের অস্তিত্বকে সার্থক করে তুলতে পারবে।
‘বনলতা সেন’ আসলে প্রেমকে নিবিড় করে অনুভব করার কবিতা। এই কবিতায় একটা শারীরিকতা আছে, যা শেষপর্যন্ত ঠিক যৌনতার প্রারম্ভে গিয়ে থেমে যায়, রেখে যায় শুধু তার অনিবার্য ইশারাকে। এই কবিতায় সময়ের প্রাচীনতা এসেছে নারী ও প্রেমের অভাবে এক বিষন্ন পুরুষের ক্লান্তির অতিরঞ্জন হিসাবে। জীবন এই পুরুষটিকে ক্লান্ত করে দিয়েছে। জীবনের বিস্তৃত ভূগোল সে পেরিয়ে এসেছে, অতিক্রম করে এসেছে বহু প্রাচীন, ধূসর সময় ও জনপদ, তবু পৌঁছতে পারেনি তার প্রিয় নারীর কাছে।
এই নারী কী তার মতোই ব্যাকুল, তারই জন্য প্রতীক্ষারত? নাকি এই নারী একটি স্বপ্ন, একটা ইউটোপিয়া, যাকে খোঁজা এবং যার দিকে অভিযাত্রাই একজন প্রেমিকের একমাত্র অভীষ্ট, তার পরিত্রাণের ও পুনরুজ্জীবনের জন্য নির্দিষ্ট অন্তিম প্রার্থনা? জীবনানন্দ দাশ কী আসলে একজন প্রেমিকের শোকগাথাই লিখতে চেয়েছেন? তার ক্লান্তি ও বিষন্নতাকে অতিরঞ্জিত করার জন্যই কী তিনি আসলে ওই প্রাচীনতা, সময় ও পরিসরের ওই বিস্তৃতির আশ্রয় নিয়েছেন? সেই পুরুষের বাস্তবতাকেই কী তিনি পরাবাস্তবতায় রূপান্তরিত করেননি? তাকে কী তিনি ঠেলে দেননি এমন এক ইউটোপিয়ার দিকে, যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে এক শাশ্বত ও নান্দনিক নারী, যার অন্বেষণে গোটা জীবন ধরে তিনি অক্লান্ত এবং গতিশীল?
এই নারী এক পরাবাস্তব নির্মাণ, যার অস্তিত্ব রয়েছে ওই পুরুষের স্বপ্নে, কল্পনায় ও শিল্পবোধে। ওই নারীর উপস্থিতিতেই এই পুরুষের প্রতীক্ষা অর্থবহ হয়ে ওঠে। কবিতার শেষে নারী-পুরুষের মিলন-দৃশ্যটি যেন রচিত হয় এক অতিপ্রাকৃতিক পরিবেশে, অন্ধকারের মধ্যে ফুটে ওঠে সেই দৃশ্যটি, কথক মুখোমুখি হয় বনলতা সেনের। কী তীব্র, সূতীব্র অভিঘাত সেই দৃশ্যের, পাঠক যেন আলোড়িত হতে থাকে। হাজার বছর ধরে যে পুরুষ হেঁটে এসেছে, অবশেষে সে প্রিয় নারীর সঙ্গে মিলনের মুহূর্তে এসে পৌঁছেছে। যে নারীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিদিশা ও শ্রাবস্তীর স্মৃতি, সে মুখোমুখি হয়েছে প্রিয় পুরুষের।
নেপথ্যে ছড়িয়ে আছে শুধু মুঠো মুঠো অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যে ডুবে আছে নারী ও পুরুষটি। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। আর তৈরি করছে এমন এক বর্তমান, যা আসলে আবহমানতারই অংশ। আবহমানের মধ্যে মিশে আছে সেই বর্তমান, প্রেমকে উত্তীর্ণ করেছে অবিনশ্বরতায়। নারী ও পুরুষটি যেন হয়ে উঠেছে অতিকথার চরিত্র। জীবনানন্দ এই কবিতায় প্রেমকে অতিরঞ্জিত করেছেন। তার ওপর মহত্ব আরোপ করেছেন। যেন মিথোলজির ফ্রেম থেকে তিনি তুলে এনেছেন দু’টি চরিত্রকে, যাদের একজন নারী, অপরজন পুরুষ। এই চরিত্র দুটিকে তিনি প্রতীক, চিত্রকল্প এবং দৃশ্যকল্প সাজিয়ে নির্মাণ করেছেন। তাদের ঐতিহাসিকতা ও প্রামাণ্যতা দিতে চেয়েছেন। তারপর তাদের স্থাপন করতে চেয়েছেন এক সমান্তরাল দুনিয়ায়, যেখানে রয়েছে শুধু স্বপ্ন, স্মৃতি, পরাবাস্তবতা, অতিকথা আর অন্ধকার। বিস্মৃতি ও বিনাশের অনিবার্যতা, যার ইশারা হয়ে আসে নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকার।
কিন্তু সেই অনিবার্যতাকে অতিক্রম করে যেতে চেয়েছে প্রেম। এই কবিতায় নিজের জন্য তৈরি করে নিতে চেয়েছে এক শাশ্বত, অক্ষয় পরিসর, যা হয়তো আমাদের গার্সিয়া মার্কেসের ’লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা ’ মনে করিয়ে দিতে পারে। প্রেম বিশেষ একটি মুহূর্তে সুতীব্র ও ঘনীভূত হয়ে উঠতে চেয়েছে, সেই মূহূর্তটি এই কবিতার ক্লাইম্যাক্স। নারী–পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে কত ধ্রুপদী, প্রতীকী, ইশারাময়, নান্দনিক সম্ভাবনা থাকে, এই কবিতায় তাকেই দেখিয়ে দিয়েছেন জীবনানন্দ। এক পরাবাস্তব পরিবেশ রচনা করেছেন। এ এক প্রেমিক পুরুষের শোকগাথা, যে ক্লান্ত ও বিষন্ন, যার জীবনে বনলতা সেন নিছক এক সম্ভাবনা হয়েই থেকে যায়। তার জীবন ফুরিয়ে যায় প্রিয় নারীর অপেক্ষায়। সেই নারীর সঙ্গে তার দেখা হয় স্বপ্নে ও কল্পনায়, পরাবাস্তবতায় ও অতিকথায়। তৈরি হয় মিলনের সম্ভাবনা। অন্ধকারে মিশে থাকে সেই নারী, বসে থাকে মুখোমুখি, ক্লান্ত ও বিষন্ন পুরুষটির জীবনে এক অনির্বাণ ইশারার মতো….

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes