
মেঘ, প্লুটো আর জোনাকির গোল্ডেন রেশিও
অরিজিৎ চক্রবর্তী
সম্প্রতি বিডন স্ট্রিট শুভম-এর প্রযোজনায় ১০ জানুয়ারি ২০২৫ শনিবার ‘আমি প্লুটো’ দেখতে গিয়েছিলাম মিনার্ভায়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় অনমিত্র খাঁর নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হলো এই নাটক। মঞ্চের এক অদ্ভূত মায়াবী আলো আর শব্দের নৈকট্যে ঘটে গেল মুগ্ধতার অপার সম্ভাবনা। প্রসঙ্গ: “আমি প্লুটো” ! এবং তার অভিমান, অনুভব , অত্যাচার, অবসাদের একটি বহুরৈখিক চক্রময়তা।যুক্তি প্রতিযুক্তির দৃশ্যান্তর।
সুতরাং যদি প্লুটোকে একটি বিচ্ছিন্ন সত্তার পরিবর্তে কুইপার বেল্টের প্রেক্ষাপটে আবিষ্কৃত করা হত , তবে এটি কখনই আটটি গ্রহের সঙ্গে জায়গা পেত না। বস্তুত প্লুটো আবিষ্কারের কয়েক দশক পরে, কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞানী, তার ছোট আকার, বরফের গঠন এবং অস্বাভাবিক কক্ষপথের বৈশিষ্ট্যের কারণে প্লুটোর মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। সম্পূর্ণ নাটকটির ছত্রে ছত্রে নির্দেশক অনমিত্র খাঁ সুকৌশলে যার প্রয়োগ বিন্যাস ঘটিয়েছেন।
পৃথিবী থেকে কত দূরে প্লুটো? একটা তুলনা টেনে ব্যাখ্যা করলে বোঝা যাবে। আলো দৌড়োয় সেকেন্ডে ৩০০,০০০ কিলোমিটার। ওই বেগে ছুটেও সূর্য থেকে পৃথিবীতে পৌঁছতে আলোর সময় লাগে আট মিনিটের কিছু বেশি কাল। আর আলোর বেগে দৌড়ে পৃথিবী থেকে প্লুটো পৌঁছতে সময় লাগবে সাড়ে চার ঘণ্টা। এত দূরের লক্ষ্যে পৌঁছতে নিউ হরাইজনস যাত্রা শুরু করেছিল ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে। প্লুটো তখনও বামন বনে যায়নি।
প্লুটো কঠিন ত্বকের পৃথিবীর মতো গ্রহ এবং বৃহস্পতির মতো গ্যাস আস্তরণের পিণ্ড। যেখানে রয়েছে লক্ষ লক্ষ হিমশীতল পাথরের চাঁই। প্লুটোর নিজস্ব চাঁদ পাঁচটা। এ সবের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে অতি সন্তর্পণে ঘণ্টায় ৫২,০০০ কিলোমিটার বেগে ছুটছে নিউ হরাইজনস। হ্যাঁ, খুব সাবধানে, কারণ ওই বেগে ধাবমান যান যদি ধাক্কা খায় একটা ছোট পাথরের টুকরোর সঙ্গেও, তা হলে সংঘর্ষ হবে বিরাট মাপের। ভেঙে খান খান হবে যান।
নাটকের কাঠামো জুড়ে বিজ্ঞানের তত্ত্বকথাকে খুব সহজ সরল গল্পের ছলে চরিত্রদের মুখে বসিয়ে দিয়েছেন নির্দেশক। বিজ্ঞানের ক্লান্তহীন এক স্বতোৎস্বারিত স্পন্দনের যোগফল “আমি প্লুটো”!
গ্রহ প্লুটোর চরিত্রে সুদীপ ধাড়ার অভিনয় এই নাটকের ইউ এস পি। কী আশ্চর্য দক্ষতায় নাটকের বাস্তব ও কল্পনাকে সে তার অভিনয়ে অকল্পনীয় করেছে এবং সমস্ত নাটক জুড়ে সুদীপের যে আধিপত্যের বিস্তার, তাকে স্যুলুট করতেই হয় । যাদের কথা না বললেই নয়, সহযোগী তিন মুখ্য শিশুশিল্পী। প্লুটো চরিত্রে দেবরূপ দত্ত ভৌমিক, নীলের চরিত্রে আসমান দত্ত এবং রূপসার ভূমিকায় স্বরগীতি মোদক। এদের সবাই তাদের চরিত্রের ক্যানভাসে যথেষ্টই বলিষ্ঠ অভিনয় করেছে। বাংলা নাটকে ছোটদের কাজ করিয়ে নেওয়ার দৃঢ়তা আজকাল সেভাবে চোখে পড়ে না। আসলে নাটকটি দেখতে দেখতে বারংবার মনে হয়েছে সম্পূর্ণ টিমের নিষ্ঠা আর শ্রমের ফসল ছাড়া এহেন কাল্পনিক বাস্তবতার রূপারোপ কঠিন। বড়দের অভিনয়ও প্রসংশনীয়। কিন্তু পুরো মঞ্চটাই ছোটোদের দখলে চলে গেছে।
“আমি প্লুটো”-র কল্প অনুসন্ধানের বাস্তব জগতে শুভঙ্কর দে-র আলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ঋতব্রত জোয়ারদার ও সমরেন্দ্র সিন্হার গ্রাফিক্স দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল মঞ্চজুড়ে দেদীপ্যমান মুগ্ধতার ফ্র্যাক্টালের জগৎ! সৌমিক চক্রবর্তী ও স্বাধীন গাঙ্গুলীর মঞ্চ, অস্মিতা খাঁ-এর পোশাক এবং শেখ ইস্রাফিলের রূপসজ্জা সমস্তকিছুই যেন সেই গোল্ডেন রেশিওর গাণিতিক অবগুণ্ঠন। সহজ কথায় বললে, মঞ্চের সাবজেক্টকে এমনভাবে ফ্রেমের আনুভূমিক রেখায় রাখা হয়েছে— যাতে তা সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিমধুর হয়। সেই নির্দিষ্ট অনুপাতটি হচ্ছে ১.৬১৮:১, যা কি না আবার গ্রিক হরফ ‘ফাই’-এর মান নির্দেশ করে।