
রূপশ্রী ঘোষের কবিতাগুচ্ছ
আয়ু
তোমারও ছিল একটা আশ্রয়
তুমি তাকে খড়কুটো ভেবে দিয়েছ উড়িয়ে
চড়াই ঠোঁট কুড়িয়ে নিয়ে
বুনেছে এক নতুন বাসা,
একাকী তালগাছ মগডাল,
অপেক্ষা পাখির ছানা
তোমার খবর এখনো উড়োচিঠি বয়ে আনে রোজ
কেবল পায়রাপায়ে থাকে না কোনো সুতো
যে ঘরে আগুন দিয়েছিলে
একদিন আবার সেই
একই ঘর নিয়েছ বুনে, কেবল তাঁতি বদলায়।
তাঁতি বদল হতে হতে
একদিন শূন্য তাঁতঘর
একাকী মাকুর হাহাকার,
চড়কা কাটা বুড়ো
সব দেশি সুতো শেষ করে হয়েছে নিরুদ্দেশ।
অতিথি
যে ঘর আজ নীরব প্রাণহীন তুমি তাতে বারবার টোকা দাও কেন?
দেয়ালে টাঙানো ছবি পচা ফুলমালা গলায়
গন্ধ ছড়ায়, জল বাতাসাহীন
যে ঘর ভিতর থেকে বন্ধ তুমি তাতে বারবার টোকা দাও কেন প্রাণ?
দূরে সাইরেন বাজে, যে গাড়ি মৃতদেহ বহন করে তার নাম স্বর্গরথ
এ গাড়ি বিকল হলে স্বর্গে ফিরে যাবে না কখনো,
আগেও যায়নি
দেহ ঢুকে যাবে লোহার গেট পার,
তাজা ফুলমালা পুড়ে হবে ছাই।
রাস্তাজুড়ে রয়ে যাবে কত সাদা খই, খুচরো পয়সা, কীর্তন হরিবোল।
দীপশিখা নিভে গেলে সলতে পুড়ে ছাই, বাতাসে মিশে যায় ধূসর গন্ধ
পোড়া সলতেয় দিয়ো না তেল,
সে প্রদীপের গায়ে কেবল লেগে থাকে দহন
মৃত শরীরে তুমিও এসো একদিন,
আমাদের আলিঙ্গন হবে নির্জীব।
যে ঘর আজ নীরব, প্রাণহীন তুমি তাতে বারবার দিয়ো না টোকা, বাতাস
*****
প্রেমের কবিতা
তুমি যে মনে বুনবে শূন্যঘর
আমি সে বুকে লিখে দেব শ্মশানভূমি
ভূমি মৃত হলে তাতে ফলবে না আহার
গলায় দলা পাকিয়ে এলে বুঝি এ শূন্যতা
তোমারই হাতে গড়া, জানি এ অভিমান
তোমারও মন পোড়ায়
****
গোধূলি
পড়ন্ত বেলার বাসি ফুল
আজ বুঝে গেছে ঘনিয়ে এল সময়
ঝরা পাতার গায়ে লেগে থাকে শীত,
তবুও আগুন জ্বলে
কত পাতা পুড়ে আজ
নব বসন্ত আসে কোকিল সুরে
যে ফুল বাসি হয়,
তার নিহিত বীজ জল মাটি পেলে
নববর্ষায় প্রজাপতি আবার মধু হবে
****
চিত্র
ঝুপ ঝুপ করে নামে ভোর
বাইপাস দখল নেয় শ্রমিক সাইকেল
পাশাপাশি কাঁধে হাত রেখে কত গল্প
থাকে না কোনো লাল হলুদ সবুজের দাপট
বেলা গড়ায়, বাড়ে তেজি সূর্যের হুঙ্কার
কাচ নামিয়ে ফর্সা মুখেরা দেখে বাইপাস
****
উদ্বাস্তু বিষাদ
কতটা পথ তোমাকে ফেলে এসেছি জীবন
আরও কতটা পেরোতে হবে জানি না
পুরো পথ জুড়ে আঁকা হবে, শুধু পিছুটান।
সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে জাহাজও মেপে চলে জল
পিছনে ফেলে যায় জলছাপ, অগভীর ঢিবি এসে যদি
ছুঁয়ে যায় তার দেহ, নিমেষে গুঁড়িয়ে সব সমাধি সলিল।
তোমাকে ভালোবাসি বলতে ভয় করে নশ্বর
এক এক করে যে স্টেশন ছেড়ে যায় ট্রেন
সবেতেই আজও ফুঁপিয়ে কাঁদে প্রহরী হুইসেল
বাতাসে উদ্বাস্তু বিষাদ।
****
মুখ
আয়নায় যে বিষাদমুখ দেখি রোজ
সে তো তোমারই তৈরি করা এক
প্রতিবিম্ব মুকুর।
কী চেয়েছিলে আর কী যে পেলে তুমি
নিজেও জানো না। জল হাওয়ায় বড়ো করে
যে পরিচিত মুখের প্রতিবিম্ব তুমি চাইতে রোজ
তা পেলে না কোথাও।
প্রতিবিম্ব কখনো সোজা
মেরুদণ্ড হয় না জল। তোমারই ছায়া দেখো
দেখবে তিরতির করে কেঁপে যায় তালগাছ।
****
সহবাস
তুমি যাকে ভালোবাসা হিসেবে চাও, সে তো আসলে শরীর নির্জীব
ধূপ ধুনো, বেলপাতা দিয়ে তোমার মনের খবর কজন রাখে মহাদেব
পার্বতী দেহ ছিন্নভিন্ন হলে বুঝেছ একান্নপীঠ মন্দিরমাত্র, সেখানে কেউ
অন্ন রাঁধে না অন্নপূর্ণা, শ্মশানকালীও রেখেছে পায়ের তলায় আজীবন
যে রাস্তা বাঁক নিতে নিতে একদিন হারায় পথ, সেও ফিরতে চায় কানাগলি
তার বুকের উপর ছবি এঁকে ভিক্ষে করে চিত্রকর, সেও এক আশ্রয় পথচারি
উদার সীমান্ত হয়ে আকাশ অনন্ত অসীম, তাইতো পাখিরা আজ নিশ্চিন্ত মন
মরুভূমিও মরীচিকা চায় রোজ, প্রতিটি মরুদ্যানে কাঁটা গাছ জন্ম বারবার।
তুমি যাকে ভালোবাসা বলো, আমি তাকে দিগন্ত বলি পৃথিবী
বেশ গুছিয়ে বলা,ভালো