
শুভদীপ ঘোষালের কবিতাগুচ্ছ
(১)
প্রতিটি শূন্যের ভেতর অজস্র মহাশূন্যের ধারণা থাকে
যেমন তোমার ভেতরে গুঁড়ি মেরে বসে থাকা
ব্যর্থ কুকুরের অনন্ত মায়াভাব।
এই অন্ধ নির্জন শহরে আমার পতঙ্গবোধ
আমাকে আলোর দিকে নিয়ে যায়
আগুনে পুড়িয়ে মারে।
ডানাহীন রাত্রি অথবা
আণবিক পৃথিবীর ভাসা ভাসা গানের মাঝে
নিজেকে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকা
নেড়ি কুকুর মনে হয়
মনে হয় কচ্ছপখোলোস।
আমার মানুষজন্ম
বিষন্ন কুকুরের হাউলিং।
(২)
মার খেতে খেতে আর
মরে যেতে যেতে ভাবি
কত দূরে চলে গেলে
কত নটিক্যাল মাইল
এই মৃত্যু মৃত্যু আর মৃত্যু
দেখতে হবে না আমাকে?
খুব সামান্য কথা বার্তাও
লিখে রাখি আজকাল
সবকিছু ভুলে গেছি আমি?
কিছুই কি মনে নেই আর?
গণতন্ত্র থেকে সামান্য দূরে
গাঁজাখোর রাত্রি মাতাল
কারা তাস খেলে লাশ পড়ে কার?
আমার কি দিন যাবে
সামান্য লিখে লিখে?
আমিও কি ডুবে যাব
হাওয়ার লিরিকে?
(৩)
পাগলেরা সুস্থ মানুষ দেখলে শুধু হাসে অথবা ভয় পায়
আর সুস্থ মানুষেরা নৃশংস থাবার মুখে দাঁড়িয়ে
বাঁদরের নাচ দ্যাখে— হাততালি দেয়
আমি খচ্চর ক্লাউন ডিগবাজি খাই
আর সরকারি কবিতা লিখি
(৪)
যদিও ভেসে আছি হাওয়ায় হাওয়ায় আর লোকসঙ্গীতে
তোমার মুখে দীর্ঘ বেকারত্বের গাঢ় অন্ধকার ভাসমান
আমার পা টলে পাক খায় মাথা
ঘুমের ভেতরে সুসজ্জিত গাছ জলে রাজহাঁস খেলা করে
সেখানে অবধারিত শিকারিচোখ
মাতালেরা গান গায়
এইসব গানে এক ধরনের নাচের নকশা থাকে
কলকাতা শহরের সমস্ত কুকুর নির্বিকার হায় তোলে
এমনি সৃষ্টিছাড়া সময় আমি কি সমুদ্রস্নানে চলে যাব ?
আজ তাঁকে ঘৃণা করি একদিন যে বুড়ো লোকটাকে প্রণাম করেছি।
(৫)
ব্যাঙের রক্তের লোভে
ঘুমের ভেতর
দংশনবাসনা জেগে ওঠে।
অনন্ত খিদের কাছে
আমরা ক্রমশ
সরীসৃপ হয়ে যাই।
অফুরন্ত বোধের কাছে, বোধের বহুমাত্রিক উপমেয় থেকে উপশম ছিনিয়ে নিতে ব্যর্থ এক নিরুপায় জন্ম আর কিচ্ছু না, শুধু একটা পৃষ্ঠার প্রত্যাশা করেছে এবং একটা কলম (ওয়ার্ড ফাইল, কি-প্যাডও হতে পারে, তাই হোক)…তারপর বাঁধ ভেঙে যাবে, তারপর জলীয় বিচ্ছিন্নতা এলোমেলো করে দেবে জীবনযাপন, তবু টিঁকে থাকার অবর্থ্যে শব্দের আশ্রয়ে আলো জ্বলে উঠবে, যে আলোয় খিদেও নিভে আসে…
শুভদীপ, সমকালীন বাংলা কবিতায় তুমি ক্রমশ এক অমোঘ অস্তিত্ব হয়ে উঠছ। ভুল বললাম, উঠেছ। কেন?
১। এই অন্ধ, নির্জন শহরে আমার পতঙ্গবোধ
আমাকে আলোর দিকে নিয়ে যায়
আগুনে পুড়িয়ে মারে
২। আমার কি দিন যাবে
সামান্য লিখে লিখে?
আমিও কি ডুবে যাব
হাওয়ার লিরিকে?
৩।…আর সরকারি কবিতা লিখি
৪। মাতালেরা গান গায়
এই সব গানে এক ধরনের নাচের নকশা থাকে
৫। ব্যাঙের রক্তের লোভে
ঘুমের ভেতর
দংশনবাসনা জেগে ওঠে।
অনন্ত খিদের কাছে
আমরা ক্রমশ
সরীসৃপ হয়ে যাই।
এই যে অংশগুলো তুলে আনলাম, এরা হচ্ছে ছুরির সেই ধারের জায়গাটা, যেখানে অসতর্ক স্পর্শ রক্তপাত ঘটায়। সমগ্র কবিতাটি মিলেই তো ছুরিটি, তার হাতল আছে, আছে সাবধানী চালনায় ফালাফালা হওয়ার কৌশল।
কী আশ্চর্য শব্দনিক্ষেপ, রূপকের অনতিক্রম্য প্রয়োগ! এই লেখাদের ভেতর দিয়ে যে বলতে চাওয়া প্রতিফলিত হয়ে ওঠে, সমাজ তার কাছে দ্বিধা রেখে যাচ্ছে, শুধরে নেওয়ার চেষ্টা রেখে যাচ্ছে, জনান্তিকে বলে যাচ্ছে ব্যর্থতাবোধ ধরা পড়ে যাওয়ার আক্ষেপ। মহামতি প্লেটো, আপনি ঠিকই করেছিলেন, আপনার ইউটোপিয়া থেকে কবিদের ব্রাত্য করে রেখেছিলেন।