
অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘ সাদা’, চতুর্থ পর্ব
পূর্বে প্রকাশিত – প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
শিখা
গুলির শব্দটা মাঠ ছাড়িয়ে জলার দিকের চাষাপাড়ার আকাশ পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলল।
আবছা আলোয় চাতালটা দেখা যাচ্ছে। শীতের রাত। কেউ কোথাও নেই। আকাশ জুড়ে তারা, নীচে পরিত্যক্ত হাসপাতালের মাঠ, আর একটা গুলির শব্দ।
ওরা চলে যাচ্ছে। কংক্রিটের ওপর চটি – জুতো ঘষছে। একটা.. দুটো.. তিনটে.. ঠিক কতগুলো বোঝা যায় না। ফিসফিসানিগুলো খুব তাড়াহুড়োয় বদলে যাচ্ছে। মোটরসাইকেলে স্টার্ট দেবার শব্দ হল। চাঁদের আলোয় ছায়াগুলো দ্রুত উঠে বসছে একে অপরের পিঠের ওপর। ঠিক এই মুহূর্তে চাপা শব্দগুলো ছাপিয়ে ভাঙা ভাঙা পুরুষকন্ঠ বলে উঠল..
– শান্টুকে ফোন কর বে, বল কাজ হয়ে গেছে।
উত্তর এল,
– সিগন্যাল দাও। বহেড়ার দিকে থাকবে বলেছে।
তৃতীয় মোটরসাইকেল স্টার্ট দেবার শব্দ, একটা কিশোর বলে উঠল,
– লঙ্কাপুরী থেকে শুয়োরের বাচ্চাটাকে ডাক।
তারপর আবারও সবার গলা খাদে নেমে গেল।
শুকনো মাটির ঢালু জমিতে মোটর সাইকেলগুলো চলতে শুরু করেছে। দূরে সরে যাচ্ছে। হাসপাতালের ভাঙা সদর গেটের কাছে এগিয়ে যাচ্ছে তিন – চারটে মোটর সাইকেল যেতে যেতে দ্বিতীয় গুলির শব্দটা হল। কয়েক মুহূর্তে চাষাপাড়ার দিক থেকে জবাব এল।
দুরন্ত কিশোরেরা নারকীয় খেলায় মেতেছে যেন! তিনটে গুলির শব্দ শেষে পৃথিবী শান্ত হল। পুরনো পরিত্যক্ত হাসপাতাল, ঢালু জমির মাঠ, নির্মীয়মান বাড়িগুলো আর ভরা শীতের রাত আবারও নিস্তব্ধ হল।
অল্প দূরে দেখা যাচ্ছে ইঁটের তৈরি চৌকো মতো বাড়িটা। আলো নেভানো। নতুন গ্রিলের রংহীন গেটটা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রয়েছে শীতের রাতে। দেখলে বোঝা যায় না ভিতরে প্রাণের শব্দ রয়েছে। দেখলে বোঝা যায় না, ভিতরে দুটো প্রাণ দমবন্ধ করে অপেক্ষা করছে। তিনটে গুলির শব্দ ঢালু জমির মাঠ থেকে চৌকো নতুন বাড়িটাকে আলাদা করেছে। হাসপাতালের পিছনে জং পড়া কোলাপসিবল দরজার আড়ালে, ভাঙা দেয়ালের ফোকরে দাঁড়িয়ে ঘামতে ঘামতে কাঁপতে কাঁপতে শিখার মনে হল, সে আর কক্ষনো বাড়ি ফিরতে পারবে না।
অনেকক্ষণ পরে দেয়ালের ফোকর থেকে বেরিয়ে এল ওর ছোটখাটো অবয়ব। দূরে আলো জ্বলছে। নতুন বাড়িটায় আলো জ্বলে ওঠেনি এখনও।
একটু জল পাবার জন্য শিখার শরীর ছটফট করছে। কিন্তু সে ছুটতে শুরু করল। অদম্য ছুট। তার মনে হল, ওরা ফিরে আসবে। ফিরে আসবেই। তার আগে এই অনন্ত মাঠ ছাড়িয়ে চৌকো বাড়িটার দিকে পৌঁছতে হবে তাকে।
ছুটতে ছুটতে চাতালটার কাছে এসে পৌঁছল। আর একটু.. অল্প আর একটু যেতে পারলেই মাঠ শেষ হবে। খোয়া ভাঙা রাস্তাটা শুরু হবে। রাস্তার গা ঘেঁষে উঠেছে নতুন বাড়ি। নতুন বাড়ির ভিতরে নীলা নামের ছয় বছরের মেয়েটা অপেক্ষা করছে। পরিতোষ তার মুখ চেপে ধরে আছে। তার মনে হচ্ছে মোটরসাইকেলগুলো আবার যেকোনো মুহূর্তে ফিরে আসতে পারে।
কিন্তু এক জোড়া চোখ শিখার পথ আটকে দাঁড়াল। আরেকটু ছুটতে পারলেই সে তার নতুন বাড়ির নতুন সদরে পৌঁছে যেতে পারত। পরিতোষ ও নীলার প্রাণ ফিরে আসত। কিন্তু একজোড়া চোখ তার সমস্ত অস্তিত্বকে গুলিয়ে দিচ্ছে। হাসপাতালের পুরনো চাতালটার ওপর আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এক জোড়া চোখ। পলক পড়ছে না। আর পলক পড়বে না কোনোদিন। ছেলেটার গা থেকে গড়ানো রক্তের গন্ধ তাজা। আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সদ্য কৈশোর পেরোনো চোখ।
এই শীত, এই হাওয়া, ভাঙা হাসপাতালের মাঠ আর এই টাটকা মৃতদেহ…. শিখার মনে হল, তার কোথাও যাবার নিই। আর আদিমতম পৃথিবীর খোঁজ পেয়েছে আজ রাতে।
ক্রমশ….