
কবিতাগুচ্ছ/ রাহুল দাশগুপ্ত
সুদূর পাখিরা
নিজের বাড়ির ছাদে সুদূর পাখিরা উড়ে আসে
এদের দেখেছি আমি অতিদূর তুষার-নদীতে
অচেনা সাগরপাড়ে বালু ভেঙে ছুটতে দেখেছি
ট্রেনের বাঁশির সাথে নিচু হতে গোপন নিশীথে।
পরিচয় হারিয়েছি, নিভে গেছে প্রিয় সম্বোধন
একমাত্র পরিচয় আরশিতে রিচার্ড বার্টন
প্রেমিক ও প্রতিবাদী, কথা বলি চাষাড়ে ভাষায়
আমার চুলের নিচে অনামিকা শহরযাপন।
আমাকে বলে না কেউ আমি দেখি সুদূর পাখিরা
ট্রেনের আওয়াজ শুনে নেশাগ্রস্ত উড়ে আসে ছাদে
এলোমেলো ঝড়গুলো ছুটে আসে তাদের পিছনে
জলের গভীর থেকে উঠে আসে নীচের ভাঙন
পরিচয়হীন আমি দু’হাতে আঁকড়ে ধরি মাটি
আমার ঘরের মাটি আমার চোখের জলে ভেজা।
রাত্রি, তোমাকে
১
তোমার গান শুনে মনে মনে বলেছিলাম,
‘কোটি কোটি চুমু ও গোলাপ ঝরে পড়ুক তোমার উপর’
আর আমায় বেশ অবাক করেই
আকাশের সব নক্ষত্র ঝরে পড়েছিল একসঙ্গে।
২
আমরা যেসব মুহূর্তের জন্ম দিয়েছিলাম
সে শুধুই তোমার; কোনও অধিকার আমি দাবি করব না।
তুমি যেসব নীরবতার জন্ম দিয়েছিলে
সে শুধুই আমার; কারণ সে আমার ব্যক্তিগত ভুল।
৩
প্রতিটি রাত আমায় নিয়ে যায় তুতেনখামেনের সমাধিতে
প্রতিটা ভোর জন্ম দেয় একেকটা বিষণ্ণ রাত্রির
কারণ প্রতিটা রাত জানে, তুমি আছ;
আর প্রতিটা ভোর জানে, তুমি নেই।
8
‘বেস্ট অব লাক’ শুনতে চেয়েছ তুমি
কি হবে এভাবে সবজিওয়ালির মতো
সৌভাগ্যকে শব্দের কাছে বেচে?
তোমার জন্য শুভেচ্ছা থাক মনে।
ভায়োলিন
কান পেতে শোনো মেয়ে শীতের পাতারা নেমে এলে
সমাধির ঘাসে ঘাসে কত ভায়োলিন বেজে ওঠে
দূর সরোবর থেকে রাজহাঁস উড়ে এলে কোনও
পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে কত ভায়োলিন বেজে ওঠে
ভোরবেলা চোখ খুলে শিশুরা প্রথম আলো মেখে
অকপট হেসে গেলে, কত ভায়োলিন বেজে ওঠে।
মাঝে মোমবাতি রেখে দুটি মুখ কাছাকাছি এলে
ফিসফিসানির স্বরে কত ভায়োলিন বেজে ওঠে
ঝড়ের দাপটে যদি শরীর উতলা হয়ে যায়
সে শরীরে সুরে সুরে কত ভায়োলিন বেজে ওঠে
যে কথা যায় না বলা সে যখন নীরবতা হয়ে
দুটি চোখে ফুটে ওঠে, কত ভায়োলিন বেজে ওঠে
বুকের ভেতর নিয়ে ঘুমে থাকা শিশু মেয়েটিকে
চুলে বিলি কেটে দিলে কত ভায়োলিন বেজে ওঠে
শোনো মেয়ে, ভালোবাসা সবাই পারে না, যারা পারে
তারা যদি ব্যথা পায়, কত ভায়োলিন বেজে ওঠে…
তোমার মুখ
তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয়
তোমাকেই ভালোবাসি, তোমাকেই, আর কেউ নয়
তোমার মুখের দিকে তাকালে বদলে যায় সব
নিমেষে জাদুর মতো, কী জানি কেমন করে হয়!
তোমাকে ছাড়াই আমি বেশ থাকি, জমে ওঠে কথা
প্রতিটি দিনের কত না বলা নিবিড় নীরবতা
তোমার মুখেও থাকে ইশারার গূঢ় আঁকিবুকি
আমি সেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে ফিরি, মন দিয়ে পড়ি
তোমাকে কতটা পাই, তবু সে না পাওয়ার থেকে বেশি
তুমি যত দূরে থাকো, ততো থাকো আরও কাছাকাছি
তোমাকে দেখি না, তবু তোমার কথাই ভেবে যাই
ফিসফিস করে বলি, ‘তোমাকেই শুধু পেতে চাই।’
তোমার প্রতিটা কথা, চোখের চাহনি, হাসিমুখ
বারবার ফিরে আসে, আর তাতে কী দারুণ সুখ!
তুমি আছো কত দূরে, তবুও নিজের মতো লাগে
আমার কিছুটা যেন তোমার ভিতরে মিশে থাকে…
একটি নিপুণ ছুরি
একটি নিপুণ ছুরি
ছুঁয়ে আছে চরাচর
আমি তার স্বাদ পাই
নদীর জলের মতো ভোরে
কোথায় কখন কার
লেগে যায় কে-ই বোঝে
শুধু তার ধারটুকু
লেগে থাকে বুকের ভেতরে
রক্তের স্রোতে ভিজে
হঠাৎ খেয়াল হয়
জীবন মসৃণ নয়
সামান্য টলোমলো হলে
ছুরির আঘাতে ক্ষত
হলে সে অতর্কিত
দেখে যত বিস্মিত
হও, সে যে শুকোতে না পারে
কেউ তবু বেঁচে ওঠে
কেউ মরে পুরোপুরি
সতর্ক হয়ে কেউ
প্রস্তুত হয়, ঢাল গড়ে
একটি নিপুণ ছুরি
জনশ্রুতি হয়ে যায়
বাতাসের স্বর হয়ে
বাউলের পায়ে পায়ে ঘোরে…
অভিযান
ঈশ্বরের ছায়া শাদা
ঢেকে ছিল প্রীতিউপহারে
একটি নিপুণ শিশু
শুভেচ্ছার দিনলিপি খুলে
ভিতরে ঢুকেছে খুব
আর দেখে বিপুলা সে নদী
ঈশ্বরের ছায়া পড়ে
ভেসে গেছে দুধে ও পায়েসে
দিগন্তকরুণ সেই সাগরের মুখ থেকে
ফিরেছে সে বহুদূর
বজ্র যেথা খুলে গিয়ে পদ্মপাতে জমে আছে
একবিন্দু জল
খেলবে বলে এসেছিল
অথচ নিপুণ শিশু
ফিরে আসছে ভস্ম হয়ে
পুজোর আগুনে।
শিল্প
নিখাদ পরাজয়ে শিল্প নেই
একটি ধাঁধা আছে,
প্রাচীনকাল থেকে
মানুষ কেন লেখে
জানতে চাও?
নিখাদ পরাজয়ে শিল্প নেই
মানুষ তাই লেখে
পরস্পরকে সে
না বুঝে সেই ব্যথা
লিখতে চায়
নিখাদ পরাজয়ে শিল্প নেই
মানুষ বুঝে তাই
না-বোঝা ব্যথাগুলো
অস্ত্রে সজ্জিত
থাকতে চায়!
এত রোদ নিয়ে গেছো
দুপুরে দেবাঞ্জনা
এত রোদ নিয়ে গেছো
বিকেলে আঁধার
বিকেলে আঁধার খুব
দশদিক নিশ্চুপ
নেই সুবাতাস
ঝড়ের পূর্বাভাস
দিয়ে যায় ঘরে ঘরে
জাগে সন্ত্রাস
নিজস্ব বেদনায়
একা রাত জেগে থাকে
ফুল, নিষ্পাপ
আমি সে গন্ধ পাই
ঘুমের ভিতরে শুনি
শ্বাসপ্রশ্বাস
ভোর এক আততায়ী
নিষেধ মানে না, আসে
সশস্ত্র হয়ে
স্বস্তির পৃথিবীকে
শিরা কেটে রক্তিম
করে নির্ভয়ে
দেখা কী আবার হবে
সে কথা কে জানে কবে
নেই আশ্বাস!
এখন তোমার কথা
মনে এলে জেগে ওঠে
শুধুই বিষাদ…
অভিযুক্ত
শূন্যের প্রাসাদ গড়ে
রাজা সেজে বসে আছে
ভিখিরি যুবক
বন্ধুরা সবাই হাসে
থুতু ফেলে, গালি দেয়
অভিযোগ করে
আসল রাজার কাছে
আসল রাজার দূত
তল্লাশি চালায়
ভিক্ষার সমস্ত ঝুলি
আঁতিপাতি করে খুঁজে
তারাও অবাক
ঝুলির ভিতরে পুরী
পুরীর ভিতরে রাজা
রাজার ভিতরে
সেই ভিখিরি যুবক
একা অন্যমনে বসে
দু’হাতে বিলোয়
ভিক্ষার কঠিন দানা
ভিক্ষার সোনার দানা
সেই বন্ধুদের।
প্রকৃত শোকের কাছে
প্রকৃত শোকের কাছে সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায়
রোজকার জীবনের শীত, গ্ৰীষ্ম, মামুলি ঋতুরা
প্রকৃত শোকের আছে নিজস্ব উচ্চতা, সম্মোহন
ধ্যানের স্তব্ধতা আর আত্মার গভীর উচ্চারণ
প্রকৃত শোকের কাছে মাথা নত হয় অনায়াসে
ছড়ানো -ছিটানো যত লোভ, সব অর্থহীন লাগে
প্রকৃত শোকের আছে বেদনার গোপন আহ্লাদ
সুরের নিবিড় স্পর্শ, প্রার্থনার মতো মন্ত্রধ্বনি
প্রকৃত শোকের কাছে যেতে হয় খুব সাবধানে
অতর্কিত যাতায়াতে সে তবু চমকে দিতে পারে
প্রকৃত শোকের আছে স্বীকারোক্তি,উচ্ছ্বাস, প্রেরণা
প্রকৃতির মতো খুব গভীর, বিস্তৃত নীরবতা
আমি যাই তার কাছে, প্রকৃত শোকের কাছে,দেখি
আয়নার মুখোমুখি সে আমাকে বসিয়ে দিয়েছে
আমি দেখি আমাকেই , উন্মোচিত, ক্ষতচিহ্নে গড়া
নিরাসক্ত তার মুখ, প্রকৃত শোকের, ছায়া ভরা…