
সোমা দত্ত-র নিবন্ধ
মেঘ জমেছে ঈশান কোণে
একটি নৃশংস ধর্ষণ এবং হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল এই শহরের বুকে। সেদিন রাতে নীরজ চোপড়া জ্যাভেলিন ছুড়লেন রূপোর মেডেলে। আরশাদ নাদিম তার সোনার মেডেল লুফে নিলেন।
আমরা অলিম্পিকের প্রথম রৌপ্য পদক নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে ব্যস্ত হওয়ার পাশাপাশি আরশাদ নাদিমের অনায়াস মেডেল পাওয়া নিয়ে ঈষৎ ঈর্ষান্বিত বোধ করতে শুরু করেছি সবেমাত্র। ঠিক সেই সময়ে আর জি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চেস্ট ডিপার্টমেন্টে রাত লিখল এক দুর্বিষহ অত্যাচারের ঘটনা। একজন কর্তব্যরত মহিলা ডাক্তারকে গ্যাং রেপ করে পিটিয়ে পিটিয়ে খুন করা হল। এবং খুন হয়ে যাওয়া দেহটিকেও পুনরায় ধর্ষণ করা হল। যারা করলেন তারা বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না ধরা পড়ার বিষয়ে। উধাও হলেন এই যা। তৎ-পরবর্তী কর্তব্যরত ক্ষমতার প্রমাণ সাফাই অভিযানের বিবিধ বর্ণনা এবং আলোচনা আপাতত ঘুরে বেড়াচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। আমরা এক বা একাধিক তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা তুলে নিতে পারি যার মধ্যে রাজ্যের মন্ত্রীর নামও রয়েছে, মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপালের নামও রয়েছে আবার পুলিশও রয়েছে সঙ্গতে।
আশ্চর্য এই তুমুল আত্মবিশ্বাস!
সেই আত্মবিশ্বাস যা এই ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু আশ্চর্য লাগলেও আমরা জানি, যারা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত তাদের প্রগাঢ় আত্মবিশ্বাসের কারণ হল প্রশাসনের প্রতি পরম নির্ভরতা। কারণ এরকম দুর্বল এবং নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ স্ক্রিপ্টের উপস্থাপনা করার সাহস তখনই পাওয়া যায় যখন প্রশাসনের হাত মাথায় থাকে। তবে, এই প্রশাসন কেমন প্রশাসন? না নিজের মাথায় ঘোল ঢেলে নিজেকেই মুর্দাবাদ বলে গাধার পিঠে ঘুরে বেড়ানো প্রশাসন। এই প্রশাসন কেমন প্রশাসন? না প্রহসনের খেলা দেখাতে গিয়ে প্রহসনের আতুরঘর হয়ে ওঠা প্রশাসন।
কিন্তু এরপরে যা হল তা ছক্কা-পাঞ্জা না ফেলেই জিতে যাওয়া অপরাধীরা আন্দাজ করেননি। কেন করেননি তার অবশ্য একটা ইতিহাস আছে।
ধর্ষণ এবং খুন কি এই রাজ্য আগে দেখেনি? দেখেছে। ভয়ংকর ভাবে দেখেছে। রাজনৈতিক সংঘর্ষের কারণে হোক বা যেকোন দাঙ্গা জাতীয় উত্তেজনার ফলাফল হিসেবে হোক পৈশাচিক ধর্ষণ এবং খুনের অভিজ্ঞতা আগেও হয়েছে। আপনি বানতলা, জামতলা, হেতাল, বেতাল, তাপসী, রূপসী যা কিছুই উদাহরণ রাখুন না কেন সবই বৈধ। সবই ঘটেছে এবং কেউ কোন প্রমাণসাপেক্ষ অত্যাচারকে মেরিট দিয়ে আড়াল করতে চাইছেনা এক্ষেত্রে। সেসব হয়েছে এবং তারপরে ধরপাকড়, কেসকাবারি, নিউজ কভার সেসবও হয়েছে। এমনকী অন্তর্দলীয় বা আন্তরর্দলীয় বচসার তুমুল হানাহানিও হয়েছে। মিছিল হয়েছে, প্রতিবাদের মেঘ জমেছে ঈশান কোণে। সবই হয়েছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত বৃষ্টি এসে সব ধুয়ে দিয়েছে। তো বর্বর নরখাদকের দল(যেহেতু রোদ্দুর রায়ের ভাষায় তার কপিরাইট রয়েছে তাই এটুকুই বলা যেতে পারে) এবারও সেরকমই ভেবে রেখেছিল। ক’দিন বর্ষা অঝোরে কাঁদাবে, শহরে জল হবে, জমে থাকা জল শহরের কালশিটে নিয়ে বড় বড় গর্ত ভরাট করবে। রাস্তাঘাটে গাড়ি ঘোড়া দাঁড়িয়ে পড়বে, চালকের মনোবল ভেঙে পড়বে। তারপর ডেঙ্গু ছড়াবে। শহর জুড়ে তখন শুধু মশা আর তার নিরোধক ছোটাছুটি করতে শুরু করবে। ব্যস! সব খালাস।
কিন্তু এক্ষেত্রে খালাস হয়নি। নিকাশী পাইপে ফেঁসে গেছে, রক্ত-মাংসের সঙ্গে মিশে থাকা ঘৃণা।
শহরের অলিতে গলিতে প্রতিটি মেয়ের বুকের লাবডুব খুন হয়ে গেছে। প্রত্যেকের যোনিপথে ক্লাচারের কাটা বিঁধে গেছে। প্রত্যেকের শ্রোণীচক্রে ফাটল ধরেছে, চোখ দিয়ে গড়িয়েছে রক্ত।
তিলোত্তমা তোমাকে এই শহর ভুলবে না।
১৪-ই আগস্ট কলকাতার প্রতিটি মেয়ের নগ্নতার উপরে গড়িয়ে পড়েছে তোমার অবরুদ্ধ চিৎকার আর শয়তানের বীর্য। প্রতিটি মায়ের আঁচল ছিঁড়ে গেছে, সবেমাত্র জন্ম নিয়েছে যে শিশু তার নাড়ির টানের ব্যথা আর্তনাদ করে উঠেছে। গুমরে গুমরে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদে ম্লান গেছে শহরের মেয়েদের চিত্রকলা। এ শহর ভুলে গেছে প্রেমের ছলাকলা। চতুর্দিকে ভাসমান লাশের কন্ঠ থেকে শোনা গেছে তোমার মুখ চাপা চিৎকার।
এই প্রতিবাদ মহাকাশে পৌঁছবে তিলোত্তমা।
অবদমিত এই আবেগকে হুলিগান দিয়ে ভাঙচুর করা যাবেনা। জীবন গদ্যময় হয়ে গেছে অচিরেই এবং ঠিক সেরকমই কোন ব্লু প্রিন্ট ছাড়াই প্রতিবাদ আঁকা শুরু হয়ে গেছে গদ্যের কড়া ভাষ্যে, ঘটনার অনতিবিলম্বেই। পোস্টার পড়েছে চতুর্দিকে। দলে দলে মানুষ রাস্তায় বেরিয়েছেন প্রতিবাদে। মেয়েরা দখল নিয়েছে রাতের। কনসিকোয়েন্স জন্ম দিয়েছে নতুন কনসিকোয়েন্সের। এরপর, ঠিক-ভুল, ভুল-ঠিক উচ্চারণ করতে করতে সব স্বর একদিন শুধু ঠিক কথাই উচ্চারণ করবে।
এছাড়া–
যারা ভাবছেন প্রচুর জল মিশে রয়েছে এই প্রতিবাদে তারা হয়ত অনেক বিপরীতধর্মী আলোকপাত শুনছেন। অনেকেই হয়ত আগের অভিজ্ঞতা টেনে এনে প্রশ্ন রাখছেন যে তখন কেন এরকম আন্দোলন হয়নি। অনেকেই হয়ত বলেছেন, অমুক ঘটনার সময় এত জোরালো প্রতিবাদ কেন হয়নি। আরও অনেকে হয়ত ভাবছেন দলিত মেয়েদের উপর যে পরিমাণ অত্যাচারের ঘটনা হয় সেগুলো নিয়ে তো কই কেউ প্রতিবাদ করেনা। এবং আরও কয়েকজন হয়ত আরও গভীরে ভাবছেন। তারা ভাবছেন খাপ পঞ্চায়েতের অন্যায়ের শিকার হয়ে বহু মেয়ে মরে এবং পুড়ে ছাই হয়। কই সে ছাই চাপা আগুনে তো কারো আগ্রহ হয় না। কই তখন তো প্রতিবাদ রাজপথে আসে না।
এইসব নেতির প্রেক্ষিতে, যুক্তি তর্ক যা কিছু উঠে আসছে এক সময়ের পরে কিন্তু কোনটাই চাপা পড়া গল্প হবেনা। সবই একযোগে ধ্বনিত হবে। কারণ এই যে প্রশ্নগুলো আসছে মানুষের মনে এটাও ওই শাসকের প্রতি ঘনীভূত হওয়া বিদ্বেষ থেকেই আসছে। আমরা যদি যেকোন মুহূর্তে এইসব প্রশ্নের প্রসঙ্গে ভাবি যে মানুষ এই প্রতিবাদ চাইছে না বা প্রতিবাদের মুখ ঘুরিয়ে দিতে চাইছে তাই জন্য এতসব কথা সেটা সর্বৈব ভুল। মানুষ যোগ সাজস চাইছে। ঘটনার সম্মিলিত স্লোগান চাইছে। বিচার না পাওয়ার ফুঁসে ওঠা যন্ত্রণাটা বেরিয়ে পড়ছে মানুষের বুক থেকে। দীর্ঘদিন ধরে এইসব পুরোনো ঘায়ের সঙ্গে জমতে জমতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেছিলেন অরাজকতার সঙ্গে বেঁচে থাকা জীবনে। আগুনে ঘি পড়ার মতন তাদের বোবা কান্নাগুলো দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে। চোখের জলের আগুনে পুড়ে যাচ্ছে আপোষ বাক্যের যেকোন অজুহাত।
সুতরাং এই প্রতিবাদ কিন্তু শুধুমাত্র একটি ঘটনার প্রতিবাদ নয়। দীর্ঘদিনের জমে থাকা অজস্র অন্যায় দুর্নীতি এবং ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মুষ্টিবদ্ধ হাত। নির্মম অত্যাচার মানুষের ভয়ের আগল ভেঙে দিয়েছে। মানুষ বিপন্ন হয়ে উঠেছেন এবং আগামী দিনে আরও বেশি বিপন্ন হয়ে উঠতে চলেছেন এমন ধারণা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।এই মাত্রাছাড়ানো আগুনে প্রাণের ভয়ও তুচ্ছ হয়ে যায়।
তবুও যেসব অব্যয়ভাব রয়ে গেছে কিছু মনের কিনারায়, তার ইঙ্গিতেও আশাবাদী আলো আছে। সেইসব বিচ্ছিন্ন ভাবনা যেমন ‘এসব করে কি হবে’, ‘জমায়েত মিছিল করে আর কি এমন হবে’, ‘মহিলারা রাত জেগে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তাতেই বা কি হবে’ এইসব খুব বাঞ্ছিতভাবেই তৈরি হচ্ছে। কিন্তু তবুও… ফের অব্যয়! ‘এসব প্রতিবাদের জন্য তো কেউ কোন বিশেষ পরিকল্পনা বদলাতে বাধ্য হবেন এমন আশা করা যায় না’। এই আশঙ্কাও খুবই ইতিবাচক কারণ ফলাফল সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তবেই প্রতিবাদ করতে চাইছেন।
কিন্তু এরপর? যা সত্য তা যে সত্য সেটি কীভাবে প্রমাণিত হয়? আমরা তো সাজানো সমাধান পেতে চাইনা।
সেক্ষেত্রে অনেক কিছুই করা যেতে পারে। কালো ক্ষমতার দপ্তরকে ঘেরাও করা যেতে পারে।শহরের হাসপাতালগুলোকে ঘেরাও করে অনশনে বসা যেতে পারে। যদিও এর আগে চাকরি নিয়োগ দুর্নীতির জন্য যে সমস্ত ছেলে মেয়েরা অনশনে বসেছিলেন তাদের সমস্যার আজ পর্যন্ত কোন সুরাহা হয়েছে বলে জানা যায়নি। তবুও অনশন যথেষ্ট চাপ তৈরি করতে পারে যদি তার জায়গা ধারালো হয়। বিরোধ কোথায় দানা বাঁধছে তার উপর বিরোধের প্রতিক্রিয়া অনেকখানি নির্ভর করে।
এবং আপাতভাবে নিরীহ যে আন্দোলন বা প্রতিবাদী কর্মসূচিগুলো হচ্ছে যেমন মহিলাদের রাত দখল করা বা অন্যান্য মিছিল সেগুলো সরাসরি কোন প্রভাব যদি তৈরি করতে নাও পারে পরোক্ষভাবে করবে কারণ এইসব শব্দমিছিল তাদের উদাহরণ রেখে যাচ্ছে। দৃষ্টান্ত তৈরি করছে এক নতুন সামাজিক জীবনের চাহিদার। প্রত্যেকটি স্তর থেকে সকলে মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিবাদ মিছিলে হাঁটছেন স্বতঃপ্রণোদিতভাবে। অঞ্চলে অঞ্চলে চুপ করে বসে থাকা মানুষের মধ্যে ঘনিয়ে উঠছে অপরাধবোধের মেঘ। তারা জোগাড় করছেন পথে নামবার রসদ। একী বিপ্লব নয়!
মানুষ যদি সামাজিকভাবে একে অন্যের যন্ত্রণামুক্তির প্রতি ক্রিয়াশীল থাকে, দায়বদ্ধতা অনুভব করে নিজের তবে কি না হতে পারে। বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দু একজন অভিনেত্রী ক্যামেরায় নিদর্শন রাখতে পারেন কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জনের বা প্রহসনের শাঁখে ফুঁ দিয়ে উদাহরণ রাখতে পারেন সেন্টিমেন্টাল জাগলিং-এর। ক্রিকেটার পা দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারেন তার দাদাগিরি। কোনটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। শুধু অবহেলা করে যেমন সোশ্যাল মিডিয়ার একটি পেজের জনপ্রিয়তাকে শূন্য করে দেওয়া যায় তেমন অবেহেলাই করেই এইসব প্রতিক্রিয়াকেও রাখা যেতে পারে প্রতিবাদের তলানিতে।