
সপ্তর্ষি বসু-র গল্প
ড্রিম ডেস্টিনেশন
অফিস থেকে ফেরার পথে আজকাল এই চিলড্রেন্স পার্কটায় এসে বসে,নমিতা। শেষ বিকেলের আলোয় ছোট-ছোট বাচ্চা গুলো খেলা ধুলো করে,প্রাণভরে ওদের দেখে সে। ওদের নিষ্পাপ মুখ,নরম কণ্ঠস্বর,স্নিগ্ধ হাসি দেখে সে নিজের ভিতরের পুঞ্জীভূত অসন্তোষের বিরুদ্ধে কঠিন লড়াই ছুঁড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে;কখনো জেতে কখনো হারে-কিন্তু ফলাফল যাই হোক না কেন,তা মোটেই সুদূরপ্রসারী হয় না। সময়-অসময়ে অলক্ষ্যে বেড়ে ওঠা কোনও ছিদ্রপথ দিয়ে প্রতিপক্ষ আরো শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসে বারবার। তখন মন-মেজাজ কেমন যেন খিচড়ে থাকে,কাজে মন লাগে না,অল্পেতেই রেগে যায়,দুনিয়া শুদ্ধ সব কিছুই যেন কেমন বিস্বাদ মনে হয়।
নমিতা বেশ বুঝতে পারে অতৃপ্তির কালো ছায়া ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করছে,তার অস্তিত্ব জুড়ে হাজার হাজার অসন্তোষের চারা মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে,এক গুচ্ছ অপ্রসন্নতা তার দৃষ্টিপথ জুড়ে হিংস্র শ্বাপদের মতো জিভ চাটছে ।
খুব ধীরে ধীরে তারা জড়ো হচ্ছে ।দল পাকাচ্ছে ।পুঞ্জীভূত হচ্ছে একটা মর্মান্তিক আক্রমণের প্রত্যাশায় ।
তাদের কাছে এই যুদ্ধ সহজ ।এই যুদ্ধ অনায়াস ।এই যুদ্ধ লড়াই বিহীন ।
কারণ প্রতিপক্ষ এখানে হীন-দুর্বল-অক্ষম ।তার প্রতি-আক্রমণের সাহস নেই,মনোবল নেই,প্রত্যয় নেই ।আয়ুধ বলতে পলায়নপর মানসিকতা ।
তাই যখন শত্রুর নির্মম আক্রমণ রচিত হয়,তখন ভীরু যোদ্ধা প্রতি আক্রমণে না গিয়ে পশ্চাৎপদ হয় । পালিয়ে যায় ।দৌড়ায় ।পাগলের মতো দৌড়ায় ।যদি ছুঁতে না পারে তাহলে মুক্তি ।কিন্তু অর্বাচীন সে,শত্রু উন্নত,বুদ্ধিমান এবং শক্তিশালী ।তাই,সহজে পিছু ছাড়ে না ।তাড়া করে যায়,করেই যায়,যতক্ষণ না তাদের নিদারুণ কর্কশ চিৎকারে,তাদের নিষ্করুণ আক্রোশে,তাদের নির্দয় আঘাতে প্রতিপক্ষের মস্তিকের প্রতিটা স্নায়ু অন্ধকারে ডুবে যায় ।
তারপর কতক্ষণ,কে জানে কতক্ষণ,নমিতা বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অনির্দিষ্টের দিকে ,সময়ের হিসেব থাকে না । পৃথিবীর সব কিছু ভূলুণ্ঠিত হয় । শূন্য মাধ্যমে বিরাজ করে সে ।
কিছুটা সময় এভাবে কাটে,তারপর কোনো এক সময় একটা বাচ্চার চিৎকার,কর্কশ ক্যাকোফোনি অথবা একটা ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা হঠাৎ এসে তাঁকে জাগিয়ে তোলে ।
ধাতস্থ হতে সে একটু সময় নেয় ।ব্যাগ থেকে বোতল বের করে ঢকঢক করে কিছুটা জল পান করে ।মুখে-গলায়-ঘাড়ে জল দেয় । চশমার কাঁচটা মুছে নেয় । তারপর উঠে পড়ে ।
কিন্তু অবসাদের হুল গুলো পিছু ছাড়ে না,চিন্তনের কোমল শরীরে মুহুমুর্হু দংশন করতে করতে, তার সাথে বাবাইয়ের জামা কেনে,দিদির ওষুধ কেনে,নিজের বই কেনে,তারপর ফিরে আসে বাড়ি।
ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢোকে নমিতা। নগ্ন করে নিজেকে। শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে পড়ে,একটু শান্তির বাসনায়। কিন্তু শান্তি সন্ধি করতে আসে না ,ফলে রিজার্ভারের ঈষদুষ্ণ গরম জলের মতো হাজার হাজার অপ্রিয় প্রশ্ন এসে তীব্র বেগে ছিটকে পড়ে তাঁর ব্রহ্ম তালুতে।প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কেঁপে ওঠে নমিতা । শরীরের প্রতিটা শিরা-উপশিরা তাঁর জ্বলতে থাকে । গলার কাছে কষ্টের পিণ্ড জেগে ওঠে । হাঁটু শক্তিহীন হয়ে পড়ে ।কান্না পায় তার প্রচণ্ড কান্না,সে দু’হাত দিয়ে তার ফুরিয়ে যাওয়া শরীর টাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে,কাঁদতেই থাকে,যতক্ষণ পর্যন্ত না নিদারুণ জিজ্ঞাসা গুলো একটা প্রাচীন মুখাবয়বের ছায়া হয়ে কলঘরের জানলা দিয়ে উড়ে যায় আধো – অন্ধকার আকাশে।
সংসার তিন জনের হলেও কাজ কিছু কম থাকে না অনুসূয়ার । সেই ভোর পাঁচটায় উঠে বাসন মাজা,কাপড় কাচা,রান্না করা,সব একা হাতে সামলাতে হয় ।
নমিতা অবশ্য বারবার করে অনুরোধ করেছে,একটা পরিচারিকা রাখার,নিদেন পক্ষে বাসন মাজার জন্য ।কিন্তু অনুসূয়া রাজি হয় নি ।
একটা মেয়ের উপর আর কতটা চাপ দেয়া যায় । মা-ছেলের খাওয়া-পড়া ছাড়াও,বাবুর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার খরচা;সরকারি কলেজ তবু তো খরচ খুব কম নয় ।আর কোন মুখে নিজের স্বাছন্দের জন্য অর্থ অপচয়ের কথা বলা যায় ।
তবু নমিতা শুনতো না ।আর অনুসূয়াও রাজি হতো না । কয়েক দিন টানা-মানি চলতো,শেষ পর্যন্ত জিততো অনুসূয়াই।
তবে নমিতা ভাঙতো কিন্তু মচকাতো না ।অনুসূয়া কাপড় কাচলে,সে বাসন মেজে দিত,অনুসূয়া রান্না করলে সে বাজার করে দিত । অনুসূয়া ঘর ঝাড় দিলে নমিতা মুছে দিত ।
নিজের অফিস সামলে যখনই সময় পেত দিদির হাতে হাতে কাজ করে দিত । এখন যে করে না তা নয় ।এখনও করে দেয়,করে দেয়ার চেষ্টা করে,কিন্তু পারে না ।
বালতি উপচে যায়,জলে ডিটারজেন্ট মেশাতে ভুলে যায়,এঁটো বাসন ভালো করে না ধুয়েই তুলে রাখে,রান্নায় নুন পড়ে না অথবা মাত্রাধিক পড়ে যায় ।
নমিতার যে একটা কিছু হয়েছে,এ নিয়ে অনুসূয়ার মনে একটা সন্দেহের দানা অনেক দিন ধরেই বাঁধছিল ।কিন্তু যত দিন যাচ্ছে,সংশয় বিশ্বাসে পরিণত হচ্ছে ।
যদিও সাংসারিক টুকিটাকি ভুল-ভ্রান্তি নিয়ে অনুসূয়া অত ভাবিত নয়,এর আগেও এমন করেছে । পরিমাণে কম কিন্তু করেছে ।একটু ভাবুক গোছের তাই ভাতে জল দিতে,চায়ে চিনি দিতে অথবা কলাপ্সেবেল গেটে তালা দিতে আগেও ভুলেছে ।পরে আবার নিজেই এই নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করেছে,কিন্তু এই বার ব্যাপারটা ভিন্ন ।
হঠাৎ করে কেমন যেন একটা চুপ মেরে গেছে নমিতা।কথা বললে দায়সারা উত্তর দেয়।খাওয়া-দাওয়া ঠিক করে,করে না । সাজ-পোশাকে নজর নেই।সারাক্ষণ শুধু কি যেন একটা ভেবে চলেছে।
ওর এমন শূন্য দৃষ্টি,অগোছালো আচরণ এবং উদাসীন হাবভাব অনুসূয়া আগে কখনো লক্ষ্য করে নি । তাই নমিতার এই অদ্ভুত আচরণ তাঁকে বিচলিত করে তুলেছে ।
সে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানা ভাবে প্রশ্ন করেছে,বারেবারে জানতে চেয়েছে,কিন্তু নমিতার দুর্ভেদ্য রক্ষণ ভাঙতে পারে নি।তার প্রচেষ্টা প্রতিবার দৃঢ় ভাবে প্রতিহত করে নমিতা নিজেকে আরো,আরো গুটিয়ে নিয়েছে।কিন্তু এমন ভাবে তো বেশি দিন চলতে দেওয়া যায় না,শেষে যদি মেয়েটার বড় কিছু একটা হয়ে যায়,তখন কি হবে? গোটা জীবনের মতো শেষ জীবনটাও মেয়েটার… না,না তাঁকেই কোনও উপায় বার করতে হবে। কিন্তু কি উপায়?সে তো আর এগিয়ে গিয়ে নিজে থেকে ডাক্তার দেখানোর কথা বলতে পারবে না,কারণ এতো আর সাধারণ সর্দি-কাশি নয়,এ হল মানসিক সমস্যা-অবসাদ;কি বলতে কি বলে ফেলবে,শেষে যদি অভিমানী মেয়েটা গোটা বিষয়টা অন্য ভাবে নেয়,তখন?তখন তো হিতে বিপরীত হবে। কিন্তু তাহলে করবে’টা কি?হঠাৎ চরম অস্থিরতা গ্রাস করল অনুসূয়াকে সে আর শুয়ে থাকতে পারল না,বিছানা ছেড়ে উঠে লাগোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
খুব ধীরে ধীরে বিকেল ফুরিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিম আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের আড়ালে ডুবে যাচ্ছে দিনমণি,বহুদূর থেকে উড়ে যাচ্ছে ঘর ফেরত পাখিদের দল,ননীদার চপের দোকানে ভিড় বাড়ছে দ্রুত,বাচ্চারা হৈ-হুল্লোড় করতে করতে স্কুল থেকে ফিরছে ।
বিকেলের বহু পরিচিত ছবি দেখতে দেখতে অনুসূয়া আবার ডুবে গেল,বোনের ভাবনায়।
চোখের সামনে মেয়েটা এই ভাবে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবে,এটা কি মেনে নেওয়া যায়?কিন্তু কি করবে অনুসূয়া,এই বয়সে এসে সে নিজে উদ্যোগ নিয়ে কি বা করতে পারে? খুব ভালো হত যদি কারো সাথে পরামর্শ করা যেত,কিন্তু তেমন বন্ধু বা আত্মীয় কোথায়,যাকে নির্দ্বিধায় সব বলা যায় ।সবাই সামনে খুব সহানুভূতি দেখাবে কিন্তু পিছন ঘুরলেই গুজব ছড়াতে বিন্দুমাত্র ভাববে না,তাহলে কাকে,কাকে বলবে সে?
প্যাঁ…।বিচ্ছিরি রকম শব্দের একটা হর্ন মারতে মারতে বাড়ির নিচে একটা অটো এসে থামল,বাবাই নেমেছে,মাকে দেখে হাত নাড়ছে,শেষ বিকেলের আলোয় চব্বিশ বছরের ছেলেকে দেখে হঠাৎ অনুসূয়ার মনে হল,ছেলে আর ছোট নেই ।
ক্রিং ক্রিং টেলিফোন বেজে উঠতেই দ্রুত পায়ে এক তলায় নেমে গেছে তৃষ্ণা,আর ফাঁকা ঘরে সুযোগ পেতেই জাপটে ধরছে সুদীপ নমিতাকে,’না না।। কি করছ…না…’ আঁতকে উঠেছে নমিতা !
– নমিতা,একটা…একটা লিপ কিস একটা… প্লিজ নমিতা ।
‘না!’ নমিতা বাঁধা দিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু সুদীপ আজ অমিত বলশালী যুবক,তাকে থামানোর সাধ্য আজ কার আছে?সে নমিতার সকল নিষেধ অমান্য করে নমিতার ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দিয়েছে।
ঘটনার আকস্মিকতায় নমিতা হতভম্ব হয়ে গেছে,বাক্য হারিয়ে ফেলেছে সে,নিজেকেও কি হারিয়ে ফেলে নি?
জীবনে প্রথম বার…পরম আবেশে নমিতার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু না এখনই নয়,বিয়ের আগে এসব,না,না কক্ষনো না,হঠাৎ নমিতার সম্বিৎ ফিরে আসে।সে সুদীপকে ঠেলতে থাকে।
কিন্তু সুদীপ নাছোড়,সে আরো বল প্রয়োগ করছে।হেরে যাচ্ছে নমিতা।আর সেই সুযোগে আরও গভীরে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করছে সুদীপ।
নমিতা বুঝতে পারছে এবার একটা কেলেঙ্কারি কিছু হবে,তাই সে প্রতিরোধের মাত্রা বাড়িয়ে তুলেছে। কিন্তু পারছে না,পারছে না তবু সুদীপের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে।
সুযোগ বুঝে সুদীপ ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে নমিতাকে।
নমিতা হাঁসফাঁস করছে!তার দমবন্ধ হয়ে আসছে!সে নিজেকে একটু একটু করে খুইয়ে ফেলছে যেন,কিন্তু না হেরে গেলে হবে না,জোর-জবরদস্তি করে আর যাই হোক ভালোবাসা পাওয়া যায় না!তাই তাকে লড়তেই হবে,সে এবারে শরীরের সব শক্তি এক জায়গায় জড়ো করে জোরসে ধাক্কা মারল সুদীপকে,ছিটকে মাটিতে পড়েছে সুদীপ,নমিতা হাঁপাচ্ছে।
সে লজ্জিত কিন্তু অপরাধী নয়। তা সত্বেও প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে তার,ভালোবাসার মানুষকে আঘাত করার কষ্ট। পিছন ঘুরে মুখে কাপড় চাপা দিয়েছে সে। সুদীপ উঠে এসে তাকে সামলাবে না সে সুদীপকে,বুঝতে পারছে না;মাঝখান দিয়ে হেলে-দুলে সময় বয়ে চলেছে;টিকটিক টিকটিক…
অভিমানের কাছে নতজানু হয়ে এই ভাবে কত অনুক্ষণ কেটে গেছে খেয়াল নেই,হুঁশ ফিরল,সুদীপের মর্মভেদী চিৎকারে,’বাঁচাও…বাঁচাও আমাকে নমিতা। ‘
চকিতে পিছন ঘুরতেই সে দেখল,ধু ধু মরু-প্রান্তরে একটু একটু করে চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে সুদীপ। দেখেই এক ছুটে তার কাছে যেতে চাইল নমিতা,কিন্তু একি সে নড়তে পারছে না কেন?হঠাৎ কি হল তার? হাত-পা এমন অবশ হয়ে যাচ্ছে কেন? কেন প্রবল চেষ্টা করেও সে এক ফোঁটা এগোতে পারছে না।
ওদিকে সুদীপের আর্তনাদ থামছে না, ‘বাঁচাও নমিতা বাঁচাও আমাকে প্লিজ।‘
-হ্যাঁ,হ্যাঁ আমি আসছি।বারবার আশ্বস্ত করছে নমিতা কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করতে পারছে না।
কোনো এক অলৌকিক শক্তি যেন এক পলকে তার শরীরের ওজন কয়েক হাজার গুন বাড়িয়ে দিয়েছে,চেষ্টা করেও সে এক ফোঁটা এগোতে পারছে না। আর ওদিকে ধীরে ধীরে আরো আরো অতলে তলিয়ে যাচ্ছে সুদীপ।
নমিতা চেষ্টা করছে,খুব চেষ্টা করছে,কিন্তু পারছে না। কিছুতেই এগোতে পারছে না,তার মনে হচ্ছে যেন কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাকে একটা বৃহৎ অক্টোপাসের মত আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে,সে যত নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে ততই সে আরো দৃঢ় ভাবে আটকা পড়ছে।
-আর পারছি না নমিতা,আর পারছি না।
-লক্ষ্মীটি,আর একটু ধৈর্য্য ধরো,আমি আসছি।আমি আসছি। আমি তোমায় কিছু হতে দেব না,কিছু না।
-না,তুমি আসতে পারবে না।আজ না,কাল না,কখনো না,কখনো না নমিতা তুমি…
ডুবে যাচ্ছে সুদীপ ক্রমাগত,একটা হাঙ্গর এগিয়ে আসছে দ্রুত,হাজার হাজার চিল ঘিরে ফেলছে সুদীপকে ,কুকুর চিৎকার করছে অবিরত কুকুর চিৎকার করছে…
ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসল নমিতা।উফফ!কি ভয়ানক স্বপ্ন! টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে বেড সাইড টেবিল থেকে জলের বোতলটা টেনে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে ঢকঢক করে কিছুটা জল গলাধঃকরণ করল সে। ঘরে এসি চলছে তাও সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। এমন মারাত্বক দুঃস্বপ্ন সে ইতিমধ্যে দেখেছে কিনা মনে পড়ছে না।
কি ভয়ঙ্কর স্বপ্ন! বিশেষজ্ঞরা বলেন,অবচেতন মনের চিন্তারাই ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন হয়ে দেখা দেয় ।তাহলে কি এই বিশ্রী স্বপ্ন-সীমাহীন অনিয়ন্ত্রিত ভাবনার প্রতিফলন,যা এখন গোটা দিনের পর রাতেও ওভারটাইম করছে । পিছু ছাড়ছে না। দুঃস্বপ্ন হয়ে হানা দিচ্ছে। কিন্তু কেন?কেন?
কেন,কবেকার সব কথা,প্রস্তরীভূত ঘটনা,আবোল-তাবোল চিন্তার সাথে মিশে গিয়ে মনটাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে তুলছে? কেন বারবার মন চলে যাচ্ছে,সেই সব রং চটা দিনে,সেই সব আঁকা-বাঁকা পথে কেন? কেন? কেন?
কেন,কেন একটা প্রৌঢ়কে টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলছে ঝরা পাতার ফিসফিসানি আর বিকেলের মায়াবী আলোয় প্রস্ফুটিত সেই সব অনন্য সময়ে,যখন একটা বছর তেইশের ছেলের সাথে একটা বছর উনিশের মেয়ে গোলাপি মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়াতো নিশ্চিন্ত মনে ।
কিন্তু সে সব তো এখন গত জন্মের কথা মনে হয় । মাঝে মাঝে,বিশ্বাস করতে সত্যি কষ্ট হয় নিজের জীবনটাও কখনো অমন প্রাণবন্ত অমন রঙিন ছিল।
নিজের অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নমিতা এ.সি’ র টেম্পারেচারটা একটু কমিয়ে দিয়ে গায়ের চাদরটা টেনে নিয়ে আবার একটু ঘুমের আশায় চোখ বন্ধ করল ।
কিন্তু ঘুম এল না ।নানা স্মৃতি,নানা চিন্তা এসে নিদ্রার পথে কাঁটা বিছিয়ে দিল। অনেক রাত অবধি এপাশ-ওপাশ করল সে ।
তারপর যখন সত্যি ঘুম এলো নমিতার,বাইরে তখন চাঁদের আলো শিউলি ফুলের রঙের সাথে মিশে গেছে ।
“সুদীপ মানে সুদীপ রায় বর্মণ ছিল নমিতার বাল্য বন্ধু তৃষ্ণার জেঠতুতো দাদা। ত্রিপুরা থেকে কলকাতায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসে তৃষ্ণাদের বাড়িতে উঠেছিল।লম্বা-চওড়া,ধবধবে ফর্সা,বাদামি চোখ,টিকালো নাক,এক মাথা কোঁকড়া চুল,একদম রাজপুত্রের মত দেখতে ছিল।“
নমিতার অবস্থা দিনে দিনে আরো খারাপ হচ্ছে দেখে,অনুসূয়া আর দেরি করেন নি নিজের ছেলেকেই নিজের দুশ্চিন্তার কথা বলতে করতে শুরু করেন ।
সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠরত সন্তানও মায়ের সাথে একমত হয় ।সে স্বীকার করে যে,মানির মধ্যে এক অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা দিতে শুরু করেছে । সেও লক্ষ্য করেছে আজকাল মানির কথা-বার্তা,আচার-আচরণ অনেক বদলে গেছে । মানুষটা আর আগের মতন নেই । একদম অন্যরকম হয়ে গেছে ।কিন্তু কেন? কেন এমন হচ্ছে?
এই কঠিন প্রশ্নটা সে ছুঁড়ে দিয়েছে মায়ের দিকে । অনুসূয়া যদি কারণ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হতো,তাহলে কি সে সন্তানের সাহায্য চাইতো?
অনুসূয়া উত্তর দিতে পারেন নি ।
‘কিন্তু কোনো কারণ তো অবশ্যই থাকবে? শুধু শুধু একটা মানুষ অবসাদের চোরাবালিতে নিমজ্জিত হয় না । দুঃখ বিলাসিতা মানির স্বভাব জাত নয় । কিছু একটা আছে মা । কিছু একটা । ‘ বাবাই… অনুসন্ধিৎসু অনুসূয়াকে বলেছে ।
কিন্তু কি? কি? অফিস পলিটিক্স,চোরা কোনো দুরারোগ্য রোগ অথবা প্রেম,নতুন কিংবা পুরনো ।
বাকি সম্ভাবনা গুলোকে একে একে ধূলিসাৎ করে দিয়ে বাবাই পুরনো প্রেমের দিকে আঙ্গুল তুলেছে । যদি কিছু থাকে,থাকতে পারে,বিগত দিনের নিভে যাওয়া আলোয় ।
অনুসূয়া তাই ছেলেকে বোনের ধূলি-ধূসরিত প্রেম কাহিনীর বিবরণ দিতে শুরু করেছে।
‘কৃতি ছাত্রের পাশাপাশি সে খেলাধুলাতেও তুখোড় ছিল।ত্রিপুরার একটা ক্লাবে ফার্স্ট ডিভিশনে ফুটবল খেলত,এখানেও এসে কলকাতায় একটা নামি ক্লাবের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়ে গেছিল।
তা এহেন একটা ‘সর্বগুনসম্পন্ন’ যুবক যে মেয়েদের মনে ঝড় তুলবে,সেটাই স্বাভাবিক,হয়েও ছিল তাই। ‘সুদীপ দা’ র সাথে আলাপ করার জন্যে তৃষ্ণার বন্ধুরা উতলা হয়ে উঠছিল।কেউ কেউ আবার এক কদম এগিয়ে বেনামে চিঠিও দিতেও শুরু করেছিল,কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয় নি,সুদীপের পাত্তা কেউই পায় নি,রাজপুত্রের মন পাওয়া কি অতই সোজা! অনুসূয়া একটু থামল ।
বাবাই বলল,কি হল?থামলে কেন?
-দাঁড়া .একটা পান খাই । ভাত খেয়ে পান না খেলে,খাবার হজম হয় না । বলে অনুসূয়া পানের ডিবা থেকে একটা পান বের করে মুখে দিয়ে,আয়েশ করে একটু চিবিয়ে নিয়ে আবার শুরু করলেন ।
‘সেদিন রবীন্দ্র জয়ন্তী ছিল;তখন কার দিনে কিন্তু আজকের মতো নমো নমো করে নয়,রবীন্দ্র জয়ন্তী প্রতিটা পাড়ায় সাড়ম্বরে পালন করা হত ।নাচ-গান -নাটক-আবৃতি,সে এক মহাযজ্ঞ। এক মাস আগে থেকে মিনিমাম রিহার্সাল চলত। কচি-কাঁচা থেকে বুড়ো -বুড়ি পাড়ার সবাই অংশগ্রহণ করতো। সেই বার তৃষ্ণার সাথে ওর দাদা সুদীপও এসেছিল আমাদের পাড়ার রবীন্দ্রানুষ্ঠান দেখতে ।
আর সেদিনই সুদীপ হলুদ শাড়িতে নৃত্যরত নমিতাকে প্রথম বারের জন্য দেখেছিল,আর দেখেই তোদের ভাষায় ওই ‘ফ্ল্যাট’ হয়ে গেছিল ।
-তাই নাকি,এতো সুন্দর দেখতে ছিল মানিকে?
-হ্যাঁ,তাই নয় তো কি? পিঠ ছাপানো কালো চুল,টানা টানা চোখ,একটু ভোঁতা নাক,কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রং আর মেদহীন ছিপছিপে গড়ন । কি অপূর্ব দেখতে ছিল তখন নমিতাকে ।
প্রায় প্রতি দিন ব্ল্যাঙ্ক ফোন কল আসতো ।বেনামে চিঠি আসতো । ভরে ভরে বিয়ের সম্বন্ধ আসতো ।
এলাকার ডাকসাইটে সুন্দরী ছিল,আমার বোন । এখন দেখলে কেউ বলবে?অনুসূয়ার গলা দিয়ে হতাশা ঝরে পড়ে ,মাথায় চুল নেই ।গায়ের রং রোদে পোড়া । চোখে ঢাউস চশমা । কি থেকে কি হয়ে গেল মেয়েটা ।
অনুসূয়া একটু চুপ করে রইল ।
বাবাইও মা কে তাড়া দিল না । একটু সময় দিল মা কে ।
অনুসূয়া আঁচলের খুঁট দিয়ে অবাধ্য চোখের জল মুছে,আবার শুরু করল ।
অনুষ্ঠান শেষে সুদীপ নিজে গিয়ে আলাপ করেছিল নমিতার সাথে ,আর প্রথম আলাপেই নিজের মুগ্ধতা প্রকাশ করেছিল ।
প্রথম প্রথম পাত্তা না দিলেও,শেষে নমিতা সুদীপের জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়;শুরু হয় ওদের প্রেম কাহিনী ।
-বাহ্,বেশ ভালো তো। তারপর?
-বছর চারেক প্রেম করার পর যখন দুই বাড়িতেই সব মেনে নিয়েছে,বিয়ের ডেটও প্রায় পাকা, তখনই হঠাৎ ওদের সম্পর্কটা ভেঙে যায়।
-ভেঙে যায় কিন্তু কেন?
-জানি না,জানি না,মাথা নাড়তে থাকে অনুসূয়া ,বহু বার জিজ্ঞাসা করেছি,ওকে,সুদীপকে কেউ কিছু বলে নি। কিছু না। তবে…
-তবে কি?
-মনে হয় সাম হাউ আমিই দায়ী।
-তুমি?
-হুমম,আমি।
-কেন?
-তোর তখন তিন বছর বয়স,তোর বাবা হঠাৎ করে বাইক দুর্ঘটনায় মারা গেল। তোর বাবা যেহেতু সৎ ছেলে ছিল,তাই তোর জ্যাঠারা আমাকে বাড়ি থেকে এক কাপড়ে তাড়িয়ে দিল ।আমি ছেলে কোলে এসে উঠলাম বাপের বাড়ি। বাবা আমার এই দুরবস্থা সহ্য করতে পারল না,হঠাৎ একটা ম্যাসিভ ব্রেন স্ট্রোকে পক্ষাঘাত গ্রস্থ হয়ে গেল। একদিকে আমি আর আমার সন্তান,অন্য দিকে অসুস্থ বাবা,দুজনকে নিয়ে বোন রীতিমত খাবি খেতে শুরু করল। কোনো রোজগার নেই,অথচ চারটে পেট,আর তার উপর বাবার রোগের খরচ। কিছু দিনের মধ্যেই সঞ্চয় শেষ;আমাদের তখন না খেতে পাওয়া দশা । উফফ কি সব দিন গেছে তখন!
অনুসূয়া থামল,পাশ থেকে পিকদানিটা টেনে নিয়ে পিক ফেলল।তারপর বলল,আর কিছুদিন অমন চললে কি হত কে জানে,ভাগ্যিস তখন নমিতা রেলে চাকরিটা পায়।
-আমাদের জন্যেই কি তাহলে মাসি…
-আর কি। হতাশ গলায় বলল নমিতা।
মানি কেন বিয়ে করে নি,এই নিয়ে স্বাভাবিক কৌতূহল থাকলেও বাবাই কখনো মাকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করে নি,কারণ তার সেটা শোভনীয় হবে বলে মনে হয় নি,কিন্তু আজ এই চব্বিশ বছর বয়সে এসে সে যখন জানতে পারল,মানির স্বার্থত্যাগের কথা,তখন সে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য সে থম মেরে বসে রইল।
-কি রে কি হল?
-কিছু না। বাবাই উঠে পড়েছে।
-কোথায় চললি?কোন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবি বললি না ?
-না,এই রোগের চিকিৎসা ডাক্তার করতে পারবে না।
-তাহলে?
-জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ বেবি। বাবাই মায়ের গালটা টিপে দিয়ে রহস্যজনক ভাবে হাসতে হাসতে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
অনুসূয়া ছেলের আত্ম প্রত্যয় দেখে মুগ্ধ হল ।তাঁর মনে হল,পারলে ওই পারবে,নমিতার দুঃখ মোচন করতে। তিনি হাত জোর করে ইষ্ট দেবতাকে স্মরণ করে বললেন,মা ওকে আশীর্বাদ করো,ও যেন নিজের কর্মে সফল হয়।
ঠিক সেই সময়ই কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়ে পাড়ার কালী মন্দিরে সন্ধ্যারতি শুরু হল। অনুসূয়া স্পষ্ট অনুভব করলেন,ঈশ্বর যেন তাকে ইতিবাচক সংকেত পাঠালেন।
-কি বলছো কি তুমি?আমার কি এতো টুকু ক্ষমতা নেই নাকি দায়িত্ব বোধ নেই,তোমার বাড়ির লোকেরা কি আমার কেউ হয় না?তোমাকে গ্রহণ করবো,অথচ ওদেরকে পরিত্যাগ করবো,এ তুমি ভাবলে কি করে?
-হয়তো আমি ভুল,তুমি তেমন নয়। কিন্তু,তবু এতো গুলো মানুষকে নিয়ে আমি তোমার ঘাড়ে চাপতে পারি না।
-ঘাড়ে চাপবে?কী…কী বলছো কী তুমি নমিতা? তোমার মাথার ঠিক আছে তো? ।
-একদম ঠিক আছে,সুদীপ,আমি সজ্ঞানেই আছি,আর তাই বলছি আবেগের বশে তুমি আজ যে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছো,তার জন্য তোমায় ভবিষ্যতে হয়তো পস্তাতে হতে পারে । তাই…
-আমাকে পস্তাতে হবে তোমাকে বিয়ে করার জন্য?ওহ কাম অন নমিতা,কী যা তা বলছো তুমি! কী হয়েছে তোমার আজকে,কেন এমন উল্টো-পাল্টা কথা বলছ।
-না,আমি ঠিকই বলছি সুদীপ,তুমি এ বিয়েতে খুশি হবে না,তাই …
-তাই কি?
-তোমার এই বিয়ে না করাই উচিত।
-বিয়ে না করা উচিত? এবার একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না। দয়া করে আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না।
-আমি কারো কোনো পরীক্ষা নিতে চাইছি না,এ বিয়ে আমি করতে পারবো না।
– মানে?
-আমি তো না বোঝার মতো কিছু বলি নি,সহজ সরল ভাবে গোদা বাংলায় বলেছি।
-কেন জানতে পারি কি?
-আমার যা বলার তো আমি এতক্ষন ধরে বললামই। নতুন করে আর কী বলবো?
-সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই ফেলেছো,তখন আর জোর করবো না,কিন্তু তবু একবার শেষ বারের মতো বলতে চাই,আমি তোমার যে কোনো শর্তে বিয়ে করতে রাজি আছি,আরো এক বার পারলে ভেবে দেখো।
– না,আমার আর কিছু ভাবার দরকার নেই,আমাকে আর টেলিফোন করো না,চিঠি দিও না। ভালো থেকো।
-কিন্তু নমিতা,নমিতা,নমিতা দাঁড়াও প্লিজ …
-রাস্তায় সিন্ ক্রিয়েট করো না প্লিজ,আমার যা বলার আমি বলে দিয়েছি,নাও প্লিজ লিভ মি অ্যালোন।
-না,শোনো,প্লিজ একবারটি শোনো,তুমি এই ভাবে চলে যেতে পারো না,নমিতা আমার জীবনটা শেষ হয়ে যাবে,নমিতা তোমাকে ছাড়া…
‘কিরে খেতে যাবি তো?’ সুজাতার ডাকে সম্বিৎ ফিরল নমিতার।
বহুকাল বাদে পাইক পাড়ায় এসেছে কলিগের মেয়ের বিয়ে খেতে;বিয়ে বাড়ি অর্থাৎ মুখার্জি ভিলার বারান্দা থেকে টালা ঝিল পার্কটা পরিষ্কার দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে নমিতা অজান্তেই স্মৃতির সরণি বেয়ে প্রায় পঁচিশ বছর আগের সেই অপয়া বিকেলে ফিরে গেছিল।
সেদিন সুদীপের করুণ চিৎকার অগ্রাহ্য করে কাঁদতে কাঁদতে সে ওই পার্কটা থেকে বেরিয়ে একটা চলন্ত দু’নম্বর বাস দাঁড় করিয়ে উঠে পড়েছিল। জানলার ধারে একটা সিটে বসে সারা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছিল,আর তারপর সে মামাকে জীবনের সবচেয়ে বড় মিথ্যা কথাটা বলেছিল । যা ঘটেছিল বলেছিল ঠিক উল্টোটা । সুদীপই অন্য মেয়েতে আসক্ত। এতো বড় একটা মিথ্যে অপবাদ দিতে তার একবারও গলা কেঁপে যায় নি ।কোনো অপরাধ বোধ তার পথ আগলে দাঁড়ায় নি ।তাঁর একবারও মনে হয় নি,সে একটা পাপ করছে,মহা পাপ !
কারণ,তাঁর কাছে তখন তাঁর পরিবার বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মাত্র আট বছর বয়সে বাবা-মা’র সড়ক দুর্ঘটনায় একসাথে মৃত্যুর পর যে মানুষ গুলো তাকে এত বছর আগলে রেখেছে,সযত্নে লালন-পালন করেছে,স্নেহ-ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়েছে,কোনো পরিস্থিতিতেই সেই মানুষ গুলোকে এই কঠিন পরিস্থিতিতে ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্ন ছিল না ।
তার জন্যে সে যে পদক্ষেপ নিয়েছিল,তা অনৈতিক হলেও তাঁর আর কোনো উপায় ছিল না ।কারণ সে
মিথ্যার আশ্রয় না নিলে তাঁর পক্ষে নিজের পরিবারটাকে রক্ষা করা সম্ভব হত না ।
তার দিদি শত কষ্টেও তাকে আটকাতো না,পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী মামাও তাকে থেকে যেতে বলতো না ,সবাই তার বিপক্ষে চলে যেত । তাই মিথ্যাভাষণ ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না ।
না,তার জন্য বিন্দুমাত্র আফসোস হয় নি তার কোনো দিন । আজও হয় না,নমিতা আনমনে ঘাড় নাড়ল ।আসলে অনুতাপ অন্য জায়গায়,সুদীপের সঙ্গে সেই শেষ মুহূর্তের দুর্ব্যবহারের কি কোনো প্রয়োজন ছিল? শান্তিপূর্ণ ভাবে কি সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা যেত না? একটু বুঝিয়ে বলা যেত না?
হয়তো যেত,হয়তো যেত না…কে জানে?আসলে ওই হয় না,অতীতে মানুষ যেটা পরিস্থিতির চাপে করে ফেলে,যেটা তার সেই সময়ের বেস্ট অপশন বলে মনে হয়,পরিস্থিতি উন্নত হলে তখন সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের মনেই অবিরত প্রশ্ন উঠতে থাকে।
তখন বারবার মনে হয়,আর কি কোনো পথ খোলা ছিল না? কোনো উপায় কি ছিল না?অন্য কোন ভাবে কি সমস্যার মোকাবিলা করা যেত না?
প্রথম বারেই এই দ্বিধাকে সমূলে বিনাশ না করলে,ক্রমে ক্রমে বেড়ে এই সংশয় দগদগে অনুতাপে পরিণত হয়,যার দায়ভার বহন করে যেতে হয় গোটা জীবন ।
নমিতা আজ সেই ফেজের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। একদিন যে সিদ্ধান্তকে একশো শতাংশ সঠিক মনে হয়েছিল,আজ তাই মনের মধ্যে দ্বন্ধের সৃষ্টি করেছে। সেই সংশয় আকারে বেড়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত,জট পাকাচ্ছে নিজের মতো করে ।
যার ফলে সেদিন সুদীপকে ওই ভাবে প্রতারিত করার জন্য কোথাও গিয়ে যেন একটা খারাপ লাগার বোধ ধীরে ধীরে জাঁকিয়ে বসছে তার মনে,নিজেকে যেন কেমন একটা ঘৃণ্য জন্তু মনে হচ্ছে,একটা প্রতারক,একটা বিশ্বাসঘাতক…
‘কি রে চল,জায়গা রেখে এলাম,তো? বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে,তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে । ’ সুজাতা একবার নাড়িয়ে দিয়ে কোথায় হাওয়া হয়ে গেছিল,আবার ফিরে এসেছে ।
-হুমম,চল।আমি আসছি ।বলে নমিতা ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়াল।
তারপর অন্ধকারাচ্ছন্ন টালা পার্কের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,কিছু ভুল শুধরানো যায় না ।‘ মেনে নিয়েই বাঁচতে হয় ।‘ গতস্য শোচনা নাস্তি ।‘
‘মা ও মা…বাবাই উত্তেজিত হয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে প্রায় দৌড়াতে দৌড়তে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে।
অনুসূয়া ছেলের ডাক শুনে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। মন বলছে,ভালো খবর আছে।
সেদিন সন্ধ্যা বেলায় ছেলেকে সব বলার পরে,বাবাই ডাক্তারের সম্বন্ধে কোনো উচ্চবাচ্য না করে সোজা নিজের ঘর থেকে ল্যাপটপ নিয়ে এসে বসে পড়েছিল অনুসূয়াকে নিয়ে ।
তারপর ধৈর্য্য ধরে ফেসবুকে সুদীপ রায় বর্মণকে খুঁজে গেছিল ।প্রায় এক ঘণ্টা অনুসন্ধানের পর অবশেষে পঁচিশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া মানুষ টাকে ভার্চুয়ালি পাওয়া গেছিল ।
মাথায় একটা মস্ত বড় টাক পড়েছে,চোখে চশমা উঠেছে,গায়ের রং আরো ফর্সা হয়ে গেছে,আর একটু যেন ন্যুব্জ হয়ে গেছে। কিন্তু,মুখের আদলটা আজও একই আছে,এক পলক দেখেই চেনা যায়। অনুসূয়া আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠেছিল,ছেলের হাত ধরে জানিয়ে দিয়েছিল,হ্যাঁ,এই সে। মায়ের থেকে গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে বাবাই মাঠে নেমে পড়েছিল।
তবে অনুসন্ধান পর্বের দ্বিতীয় পর্যায়ে বাবাইকে বিশেষ পরিশ্রম করতে হয় নি কারণ ফেসবুকের মিউচুয়াল ফ্রেন্ড নামক বহুমূল্য অস্ত্রটার সৌজন্যে সে জানতে পেরেছিল যে ,সুদীপ রায় বর্মণ আর ওদের এইচ.ও.ডি সুনন্দা অধিকারীর মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে । কিন্তু কি সেই যোগসূত্র?
সেটা জানতেই আজ বাবাই কলেজে গেছিল ।
-হয়ে গেছে । মা ।হয়ে গেছে । বাবাই মা কে গেটে দেখে উল্লসিত হয়ে বলল ।
-কি হয়ে গেছে?
-সব হয়ে গেছে ।আর কোনো চিন্তা নেই ।
– আরে ওরকম ভাসা ভাসা বললে বুঝবো কি করে? ভালো করে বল,কি হয়েছে ।
বাবাই ঘরে ঢুকে সোজা ফ্রিজের কাছে চলে গেছে ।একটা ঠাণ্ডা জলের বোতল বার করে ঢকঢক করে কিছুটা জল খেয়ে নিল ।তারপর সোফায় বসে শরীর টাকে এলিয়ে দিয়ে বলল, মানির সাথে সুদীপ স্যারের দেখা করার বন্দোবস্ত করে এলাম ।
– সে কি রে? কি করে? বিস্ময় এবং আনন্দ মিশ্রিত কণ্ঠে অনুসূয়া বললেন ।
– আরে কিছুই না ।খুব এজি ভাবে সব হয়ে গেছে ।তুমি তো জানো,আমি সুনন্দা ম্যাডামের প্রিয় ছাত্র ।ওনাকে সুদীপ স্যারের ছবি দেখিয়ে গোটা ব্যাপারটা বলতেই উনি সব ব্যবস্থা করে দিলেন ।
-তাই? কি ব্যবস্থা করলেন?
-সুদীপ স্যার তো ম্যাডামের সহপাঠী ।বেসুতে দুজনে একসাথে পড়তেন । যদিও এখন স্যার বহু বছর
প্রবাসী ।
-প্রবাসী?
-হ্যাঁ ।
-হ্যাঁ ।স্যার ।দীর্ঘদিন কানাডার অধিবাসী,কলকাতায় আসে না বললেই চলে। তাহলে?
-তাহলে কি? তোমার ভগবান ।সব তাঁর লীলা ।
-মানে?
-মানে,ভগবানের আশীর্বাদে কোইন্সিডেন্টাললি,বহু বছর পর এই বছর স্যার একটা বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের আমন্ত্রণে কলকাতায় আসছেন,’এম। বিশ্বেশ্বরায়া স্মারক বক্তৃতা’য় অংশ নিতে। ম্যাডাম বলেছেন,এই সুযোগ নষ্ট করা যাবে না ।যেভাবে হোক তিনি স্যারকে এই বাড়িতে নিয়ে আসবেন ।আসবেন ই ।
-যাক,বাবা বাঁচলাম!টেনশনে আমার দুপুরে খাওয়া পর্যন্ত হয় নি। তা কবে হবে ওই বক্তৃতা ?
-এই তো আসছে সোমবার ।
-ওই দিনই কি বাড়ি আনতে পারবি?
-হ্যাঁ,সেই রকম কথাই তো হয়েছে। দেখা যাক।
-হুমম। আর…
-বাকি কথা খেতে খেতে হবে মা,বাবাই থামিয়ে দিয়েছে,’সকাল থেকে চারটে কচুরি খেয়ে আছি,তুমি শিগগিরি ভাত বাড়ো,আমি চানটা সেরে আসি। বাবাই দ্রুত পায়ে বাথরুমে ঢুকে গেল।
সুদীর্ঘ বিচ্ছেদের পর নমিতা আর সুদীপের যখন দেখা হবে,তখন ওদের প্রথম প্রতিক্রিয়া কেমন হবে,তার কাল্পনিক চিত্র মানস পটে ফুটে উঠতেই অনুসূয়া তৃপ্তির হাসি মুখে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।
নাটকের দল থেকে পিকনিক ।শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে ।সারাদিন হৈ হৈ করার পর ভারী লাঞ্চ করে সবাই এবার একটু জিরিয়ে নিচ্ছে এদিক ওদিক,আর এই অবসরে সুদীপ একটু ফাঁকায় টেনে এনেছে নমিতাকে।
একটা বৃদ্ধ বট বৃক্ষের শয়ে শয়ে ঝুড়ির আড়ালে একান্তে সুদীপ আজ বিপজ্জনক সীমানা পেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়েছে। হঠাৎ জড়িয়ে ধরেছে প্রেমিকাকে।
ঘটনার আকস্মিকতায় নমিতা খানিক অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে । সে লাজে রাঙা হয়ে বলছে,এই কি হচ্ছে কি এসব ।কেউ এসে যাবে,প্লিজ অসভ্যতা করো না।
সুদীপ নাছোড় বান্দা,ঘাড়ে গলায় মুখ ঘষছে।
-কি হচ্ছে কি,ছাড়ো! নমিতা সুদীপকে ঠেলে দিচ্ছে ।
কিন্তু সুদীপ আজ পাগল হয়ে গেছে।জীবনে প্রথম বার এতো কাছে পাওয়া নারী শরীর তাকে উন্মাদ করে তুলেছে,সে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে নমিতাকে।
‘এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে!’ নমিতা সুদীপকে থামানোর চেষ্টা করছে।
কিন্তু সে শোনে কার কথা,কামনায় জর্জরিত সুদীপ কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ থেকে এবার হঠাৎ নমিতার ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দিয়েছে,
আকস্মিক ‘আক্রমণে’ বিহ্বল হয়ে পড়েছে নমিতা,প্রথম চুম্বনের আবেশে তার চোখ বুজে আসছে,
প্রতিরোধের শক্তি হারিয়ে ফেলছে সে,আর সেই সুযোগে সুদীপের হাত নমিতার উন্মুক্ত নাভি বেয়ে ক্রমশ উপরের দিকে উঠছে,উপরে আরো উপরে।।
‘না!’ সম্বিৎ ফিরে পেয়েছে নমিতা,’সুদীপ প্লিজ ছাড়ো,ছাড়ো সুদীপ। ‘
সুদীপের হুঁশ নেই।সে আজ অপ্রতিরোধ্য গতিতে ধীরে ধীরে উন্মোচন করছে আজন্ম-লালিত রহস্য।
‘না সুদীপ স্টপ,আই সে স্টপ!’ নমিতা বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করছে,কিন্তু সুদীপকে আটকাতে পারছে না,সে উন্মত্তের মতো নমিতার বুকে মুখ ঘষছে।
‘না,সুদীপ,ছাড়ো,ছাড়ো বলছি!’ নমিতা শরীরের সর্ব শক্তি একত্রিত করে জোরে ধাক্কা মেরেছে সুদীপকে, ধাক্কা সামলাতে পারেনি সুদীপ,ভারসাম্য হারিয়ে ছিটকে পড়েছে,গভীর খাদে!
‘বাঁচাও…বাঁচাও’, একটা পাহাড়ি জংলী গাছের দুর্বল ডাল ধরে বিপজ্জনক ভাবে ঝুলছে,সুদীপ!
একি করল নমিতা,কি করল সে?
ক্ষণিকের বিহ্বলতা কাটতেই সে বুঝতে পারলো,কত বড় ভুল সে করে ফেলেছে,তাই সে এক ছুটে চলে যেতে চাইল,সুদীপের কাছে,তাকে রক্ষা করতে।
কিন্তু একি,নমিতা একটুও এগোতে পারছে না কেন?কেন তার সারা শরীর ধীরে ধীরে অবশ হয়ে যাচ্ছে?কেন তার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলো এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বিশ্বাসঘাতকতা করছে?বুঝতে পারছে না,কিছুতেই বুঝতে পারছে না,সে।সে চেষ্টা করছে,প্রাণপণে চেষ্টা করছে,নিজেকে অপ্রাকৃত এই ভয়ঙ্কর চক্রবুহ্য থেকে মুক্ত করে তার মরণাপন্ন প্রেমিকের কাছে ছুটে যেতে।কিন্তু সে পারছে না,কিছুতেই পারছে না।
তার পা দুটো মাটিতে গাঁথা যেন একটা মস্ত বড় সিমেন্টের স্ল্যাবের মতো,এক বিশাল পাহাড়ের মতো,এক প্রাচীন বৃক্ষের মতো,যাকে এক চুলও নড়াতে গেলে,উপড়ে ফেলতে হবে।
‘বাঁচাও নমিতা,বাঁচাও!’ সুদীপ পাগলের মতো চিৎকার করছে,সেই আর্তনাদের তীব্রতায় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে,ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে,বাজ পড়ছে।
দূরে কোথাও একটা মহিলা বারবার ঘোষণা করছে,আপ গ্লোব সিনেমা চার নম্বর প্লাটফর্মে আসছে ।একটা দূরপাল্লার বাসের তীব্র হর্ন শোনা যাচ্ছে ।এক দঙ্গল ছেলে মেয়ে দোল খেলতে খেলতে অনেক নিচ দিয়ে চলে যাচ্ছে ।আর ওদের পাশ দিয়ে এক জোড়া ধবধবে সাদা ঘোড়া দৌড়ে যাচ্ছে,যাদের চালকের মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা।
-আমি আর পারছি না,এবার হাত ফসকে যাবে। সুদীপের গলায় জীবনী শক্তি ফুরিয়ে আসার ইঙ্গিত স্পষ্ট ।
-না,লক্ষ্মীটি,আর কিছুক্ষণ। আমি আসছি ।
-না,না নমিতা আর না,আর আমি পারছি না । আমি জানি তুমি আসবে না ।আমি জানি…আমি জানি…
-না,আমি আসছি,আসছি আমি। প্রাণপণে চেষ্টা করছে নমিতা,পারবে।পারতে তাকে আজ হবেই,নইলে সুদীপকে বাঁচানো যাবে না।সুদীপ চলে যাবে।চলে যাবে তাকে ছেড়ে দূরে, বহুদূর।যেখানে গেলে আর ফিরে আসা যায় না।খুঁজে পাওয়া যায় না কোনো দিন।সেখানেই চলে যাবে সুদীপ চিরকালের মত । চিরকালের মত!চিরকালের মত?
হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরল নমিতার ।সজ্ঞানে এলো সে ।আর সাথে সাথে গোটা শরীরের শক্তি একত্রিত করে হ্যাঁচকা টান মেরে নিজেকে অনাদ্যন্ত এক মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত করে,দ্রুত দৌড়ে গেল সুদীপের দিকে।
-বাবা,তুমি তো এখনও বেশ ইয়ং আছো! মেয়েরা কি আগের মতোই কথায় কথায় প্রেমে পড়ে নাকি ?
-হো হো করে হাসছে সুদীপ ।সেই প্রাণখোলা হাসি ।সমুদ্রের জল এসে ধুয়ে দিচ্ছে সময় ।সূর্য ডুবছে দূরে ,আলো ফুটছে কাছে। আকাশের রং গোলাপি হচ্ছে দ্রুত ।আর বহু দূরে কোথাও ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছে জন্মান্তরের সন্তাপ।
-বাবাই,বাবাই শিগগিরই দরজা খোল,তোর মানি কোনো সাড়া দিচ্ছে না । অনুসূয়ার গলা কাঁপছে ।
একটু আগেই ঘুম চোখে একটা ব্যাড নিউজ পেয়েছে বাবাই ।
সুনন্দা ম্যাডাম ফোন করে জানিয়েছে,মিস্টার রায় বর্মণ ঘুমের মধ্যেই গতকাল মধ্য রাতে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন ।
খবরটা শোনার পর থেকে গুম হয়ে ছিল বাবাই,বুঝতে পারছিল না ,কি ভাবে মা’কে খবরটা দেবে ।তার মধ্যেই…
মায়ের গলা পেয়ে সে দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে,দরজা খুলতে খুলতে বলল,কেন কি হল? কি হল?
-জানি না । কোনো সাড়া দিচ্ছে না । অনুসূয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল ।
বাবাই মায়ের অবস্থা দেখে দৌড়ে গেল মানির ঘরের দিকে । কিন্তু তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে ,ছুটে আর লাভ নেই ।এতক্ষনে যা হওয়ার হয়ে গেছে ।
অবশেষে সমস্ত বাধা-বিপত্তি,আপত্তি,দ্বিরুক্তি,নিয়ম-কানুন,সমাজ-সংসার ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে মানির প্রিয়তম,পৃথিবীর সব বন্ধন ছিন্ন করিয়ে তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে রওয়ানা দিয়েছে দূরে, বহুদূরে,কোন এক ‘ড্রিম ডেস্টিনেশনে’।