সোমা দত্ত -র গল্প

সোমা দত্ত -র গল্প

বহ্নিশিখা

‘এক’
স্পষ্ট কোনো শব্দ নয়। একসঙ্গে অনেক শব্দ জট পাকিয়ে কানে এলে যেরকম লাগে সেরকম একটা কিছু। শরীরটা খুব জোরে দুলছে দুপাশে। ওরা বোধহয় আমাকে দোলাচ্ছে। ছুঁড়ে ফেলবে? নাকি আরও কেউ আসবে? গলা দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছে না কেন? চোখেও যেন কিছুই প্রায় দেখতে পাচ্ছি না। আমি কি মারা গেছি তাহলে? আমার হাত পা? নাড়াতে চেষ্টা করব? হাত দুটো উপরের দিকে তুলতেই কে যেন জোরে চেপে নামিয়ে দিল। আমি আরও জোর করে হাত দুটো তুলে শক্ত করে রাখতে চেষ্টা করলাম। কথা বলতে পারছি না কেন? আমি মুখ ফাঁক করে কিছু বলার চেষ্টা করে দেখলাম গলা দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছে না। শুধু মাথাটা দুপাশে নাড়াতে পারছি তাই খুব জোরে জোরে মাথা নাড়াতে চেষ্টা করলাম। আবার কে যেন জোর করে হাত দুটো নামিয়ে দিয়ে কী সব বলল। ওটা কী মা? মা এসেছে? মা আ আ… আমি বলতে পারছি না মা। কিরকম উদ্ভট একটা গোঙানির শব্দ কানে এলো। আরও ঝাপসা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। আমি কি মরতে চলেছি? এখুনি মরে যাব? এরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাকে? মা আ আ আ… একটা আচ্ছন্ন অবস্থা যেন। কতক্ষণ ধরে এমন দুলতে দুলতে ওইরকম জট পাকানো শব্দ শুনতে শুনতে যেন চললাম, চলতেই থাকলাম। আমার আর বিশেষ কিছু করার নেই, বলারও নেই। আমাকে মেরে ফেলেছে ওরা। মৃতরা এভাবেই যায় হয়তো। যেতেই থাকে। কোনোদিন এই যাওয়া শেষ হয় না। হঠাৎ তীব্র আলো এসে পড়ল মুখে। সঙ্গে আরও অনেক পায়ের শব্দ। কারা যেন আমাকে ধরে কোথায় তুলছে। এবার যেন আলোটা স্পষ্ট হল একটু। সেই সঙ্গে টের পেলাম কী প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে আমার তলপেটে। কোমরের নিচ থেকে অংশটা যেন ছিঁড়ে পড়ে যাচ্ছে। মা গো! কয়েকটা মুখ ঝুঁকে দেখছে আমাকে। এরাই কি ওরা? আবার ওইসব করবে? আবার? আর না প্লিজ। প্লিজ আর না। আমার লাগছে, খুব লাগছে। মা আ আ। শব্দগুলো আস্তে আস্তে স্পষ্ট হচ্ছে। কেউ একটা বলল, শান্ত হোন। শান্ত হোন। কষ্ট কমে যাবে একটু পরেই। একটু ধৈর্য ধরুন বোন। খুব মোলায়েম স্বরে কেউ বলল। তাহলে এরা ওরা নয়। এরা কারা আমার মায়ের মতন? আমি চোখটা বড় করে স্পষ্ট দেখার চেষ্টা করলাম। দেখতে পাচ্ছি না। ওরা কি আমার চোখ নষ্ট করে দিয়েছে? হালকা অবয়ব ফুটে উঠছে মহিলা শরীরের। হাসপাতাল, নার্স, লোকজনের ছোটাছুটি বোঝা যাচ্ছে। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে তার মানে। আমি আবার বেঁচে উঠব তাহলে? কিন্তু আমার প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। সহ্য করতে পারছি না। একজন এসে আমার হাতে কী একটা লাগাল। হাতটা কী প্রচণ্ড ভারী আমার। স্যালাইন দিচ্ছে মনে হয়। একটা স্ট্রেচারে শুয়ে আছি আমি এখন সেটা বুঝতে পারলাম। আমার পেটের মধ্যে ঘুলিয়ে উঠছে সবকিছু। কান্না পাচ্ছে। ভয় লাগছে। ওই মুখগুলো মনে পড়ছে। ওরা কি এখানে আছে না পালিয়ে গেছে? আমাকে কি সুস্থ করে আবার ওদের হাতে তুলে দেওয়া হবে? ওরা ওই মুখগুলো কী ভয়ানক, কী বিশ্রী! ওদেরকে কেউ কিছু বলবে না? ওরা পালিয়ে যাবে আমাকে এইভাবে যন্ত্রণা দিয়ে ওরা কী পালিয়ে যাবে। আমাকে কি এখন খবরের কাগজে ছাপিয়ে দিয়েছে? সবাই কি জানে? জানেনা নিশ্চই। জানলে মা থাকত। মা নেই কোথাও এখানে। কিন্তু তখন কে একজন মায়ের মতো আমার দুটো নামিয়ে বুকের উপর রেখে দিয়েছিল। আমার মনে হচ্ছিল আমি মরে গেছি। ওরা আমার দেহটাকে কোথাও নিয়ে চলেছে। আমাকে পুড়িয়ে দেবে। সেটা কে ছিল? হয়তো এখনো আমাকে ওরা নিয়েই যাচ্ছে। আমি হয়তো স্বপ্ন দেখছি শরীরের ভিতরে ঘুমিয়ে। মরে গেলে মানুষ হয়তো এভাবে অনেকক্ষণ বেঁচে থাকে। বাপিও কি বেঁচে ছিল মরে যাওয়ার অনেকক্ষণ পরেও? হয়তো ছিল। হয়তো এরকমভাবেই আমাকে খুঁজছিল, মা কে খুঁজছিল। আমরা জ্বালিয়ে দিলাম বাবাকে। হয়তো ভিতরে বাবা জীবন্ত ছিল। হয়তো জ্বলে যাওয়ার মুহূর্তে বাবার শরীরের ভিতরে আটকে পড়ে বাবা আর্তনাদ করে বলছিল আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে জ্বালিও না। আমাকে মাটির অনেক গভীরে অন্ধকারে শুইয়ে দাও। আমি অন্ধকারের সঙ্গে কথা বলব। আমার মৃত্যুকে এভাবে নিয়মে সাজিও না। আমিও ওইভাবে চেচিয়েছিলাম যখন ওরা আমার জামা কাপড় ছিঁড়ে ফেলছিল। চারজনে মিলে লোফালুফি করছিল আমার শরীর নিয়ে। টেনে হিঁচড়ে আমার বুক ছিঁড়ে ফেলতে চাইছিল। আমার দুটো পা টেনে দুদিকে চিরে দেওয়ার মতো জোরে ধরে রেখেছিল দুজন। মা আ আ… বমি আসছে….ওয়াক… কেউ ব্যস্ত হয়ে আরে আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও বলে আমার মাথাটা তুলে ধরল। একটা বাটির মধ্যে অনেকটা বমি হলো। মুখ দিয়ে কিছুটা গড়িয়ে গলায় চলে গেল। কে একজন গায়ের চাদরটা নিয়ে মুখ আর গলা মুছিয়ে দিল।
— পেশেন্টকে বেডে দিচ্ছে না কেন? কোনো একজন চাপা গলায় অন্যজনকে বলছে শুনতে পেলাম
— আরে পুলিশ কেস তো। বুঝিস না? ঝামেলা আছে। সাত আটজন মিলে করেছে। একেবারে ফালাফালা করে ছেড়েছে।
— কিছু ঢুকায়নি তো? বাঁচবে?
— জানিনা। কিন্তু খুব ব্লিডিং হচ্ছে। ডাক্তার দেখল কই? তবে মনে হয় বাঁচবে। বেঁচে হবে টা কী? এসব কেসে মরলেই ভালো। আর কী আছে ওর বলতো?
— পুলিশ তো সঙ্গেই এলো দেখলাম তখন।
— হ্যাঁ এলো তো কী হয়েছে। পেশেন্টকে তো জিজ্ঞাসা করতে পারছে না। কন্ডিশন খারাপ। সঙ্গের লোকগুলোকে জিজ্ঞেস করছে। হাজার লাফরা এখন। পেশেন্টের বাড়ির লোক এখনো এসে পৌঁছয়নি। বাড়ির লোক তাড়া না দিলে হবে? এখন পুলিশ বাওয়াল করবে পঞ্চাশ রকমের। মরলে একরকম ঝামেলা। বেঁচে থাকলে আরেকরকম।
— তুই আনতাবড়ি বলছিস। পুলিশই তো নিয়ে এলো বডিটা।
— কোথায় পুলিশ নিয়ে এলো। আর বডি বলছিস কেন। শালা বেঁচে আছে দেখছিস না। লোকাল লোকজন নিয়ে এসে কাছের থানায় খবর দিয়েছে দেখে পুলিশ এলো।
মাথার ভিতরে ধোঁয়াটে ভাবটা যত কাটছে তত অসহনীয় একটা ব্যথা টের পাচ্ছি। হঠাৎ মনে হল শ্বাস আটকে যাচ্ছে। মুখটা হাঁ করে বাতাস টেনে নেওয়ার চেষ্টা করতে গেলাম। হলো না। জোরে চেঁচাতে চাইছি কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছে না। আমি শরীরটাকে জোরে জোরে ঝাঁকাতে চেষ্টা করলাম। কয়েকজন তৎপর হয়ে অক্সিজেন লাগবে বলতে শুরু করল। আমার চোখের সামনে আবার সব ঝাপসা হতে শুরু করেছে ততক্ষণে। ট্রেচারটা ঠেলে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে আবার আমাকে। কে যেন একটা তখন বলল, মরে গেলেই ভালো ছিল। তার মানে মরিনি এটা নিশ্চিত। না না মরিনি যখন মরব কেন। বাঁচব, অবশ্যই বাঁচব। বাঁচতেই হবে আমাকে। মাথার ভিতরটা কেমন ফাঁকা হতে লাগল। ব্যথাগুলো কোথায়? তেমন টের পাচ্ছি না। ঘুমিয়ে পড়ছি যেন। শব্দগুলো দূরে চলে যাচ্ছে। অনেকদূরে চলে যাচ্ছে যেন সব। আমি কোথাও একটা তলিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।

মনে হচ্ছে সকাল হয়েছে। চারিদিকে উজ্জ্বল দিনের আলো। হাসপাতালের বেড। চোখ ঘোরাতেই চোখে পড়ল মা চেয়ারের পিছনে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। সারারাত মা কি চেয়ারে বসে ছিল? মায়ের ভার্টিগো আছে। এতক্ষণ এভাবে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে তো। গলায় কী যেন একটা দলা পাকিয়ে আছে। আমি বেঁচে আছি সুস্থভাবে আর এটা সত্যি। নাকি স্বপ্ন? মা আ আ… না স্বপ্ন নয় কারণ মায়ের ঘুম ভাঙল। ধরমর করে উঠে বসল। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মা আমার দিকে। তারপর এগিয়ে এলো আমার কাছে। মাথায় হাত রাখল। মায়ের দু চোখ দিয়ে জল পড়ছে। এবার বোধহয় নিশ্চিত হওয়া যায় বেঁচে থাকা সম্পর্কে। বেঁচে আছি। মা আমার মাগো, তুমি কোথায় ছিলে মা, কোথায় ছিলে তুমি। বলতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না। গলা বসে গেছে একদম। খ্যাসখেসে কিছু শব্দ বেরোল মাত্র। মনে পড়ল আমি খুব চেঁচিয়েছিলাম প্রথমে। ওদের একজন আমার গলায় আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে জিভে ছিঁড়ে নেবে বলছিল। গলার মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে দেওয়ায় আমার বমি আসছিল। আমি ওয়াক তুলতেই ছেলেটা আমার মুখটা এত জোরে চেপে ধরল যে আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। অন্য একজন আমার কুর্তির সামনে দিকটা টেনে ছিঁড়ল। তারপর সেটার একটা টুকরো ছিঁড়ে আমার মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। অন্য একটা টুকরো দিয়ে মুখটা বেঁধে দিল। একজন মাথার দিকে দুটো হাত চেপে ধরল। অন্য দুজন দুটো পা দুদিকে টেনে ধরে রেখেছিল। দৃশ্যটা চোখের সামনে আসতেই কান্না আটকাতে পারলাম না আমি। বিছানায় উঠে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে সেই ছোটবেলার মতো কেঁদে ফেললাম। কাঁদছি আর ভাবছি কেন হল? কেন হল এমন? কেন কেন কেন- রাগ ঘেন্না সবকিছু ঝাঁপিয়ে এলো আমার উপর। আমি রেপড। আমি ঠিক সেই অবস্থার মধ্যে আছি যেই অবস্থাগুলো খবরের কাগজে থাকত। নির্ভয়া, অভয়া আরও সব যারা একটা নাম পায় বা পায় না। আমার কানে সেইসব কথাগুলো যেন আবার আসতে লাগল। সেইসব শব্দ, সেইসব নোংরা ভঙ্গিমা, আঁচড়ানো, খাবলানো, কামড়ানো। ওই আয়াটা যেন কী বলছিল? মরে গেলেই ভালো হত। কী আছে ওর আর? কী থাকে? কী ছিল? কী নেই? আবার বমি উঠে আসতে লাগল। আমি হাত পা ছুঁড়তে শুরু করলাম যদিও জানি না কেন অমন করলাম। আমার হাত পা আপনা আপনি যেন লাফাতে শুরু করল। শরীরের ভিতরে যেন এক তুমুল ভাইব্রেশন হচ্ছে। শরীরটা কাঁপছে আমার। সেই মুখগুলো যেন এগিয়ে আসছে আমার চোখের সামনে। আবার আবার ওরা আমাকে রেপ করবে ওইভাবে। আবার ওরা আমার জামাকাপড় ছিঁড়বে। আবার টেনে ধরবে আমার হাত পা। আমি কিছুই করতে পারব না। কিছুই বলতে পারব না। আমার শরীরের ভিতরে সব যেন কেমন তোলপাড় হতে শুরু করল। মাথার সামনে সব যেন ঘুরছে। কত মুখের ভিড়। মায়ের, ওই ছেলেগুলোর, ডাক্তারের সবার মুখ এভাবে মিশে যাচ্ছে কেন। আমার চোখের সামনে আবার সব কেমন যেন অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল। কারা যেন আমায় চেপে ধরেছে। হাত কী বিঁধিয়ে দিল ওটা। ইনজেকশন কেন? কেন ইনজেকশন। আমাকে ঘুম পারিয়ে ছবি তুলবে বলে? না না প্লিজ এটা কোরো না তোমরা আমার সঙ্গে। প্লিজ কোরো না।

দুই

এক সপ্তাহ ধরে বাড়িতে আটকে আছি। এখন অনেকটা সুস্থ। হাঁটতে গেলে এখনো একটু লাগছে। তবে খুবই সামান্য। ভ্যাজাইনাতে তিনটে সেলাই পড়েছিল। এখন অনেকটাই শুকিয়েছে। মাঝখানে দু একবার পুলিশ অফিসার হিমাংশু রায় এসেছিল আর দু একজন মহিলা সাংবাদিক। বাবা আর কাউকে আমার ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। একতলায় আমাকে নামতে বারণ করেছে। বারান্দাতে দাঁড়ানো বারণ। এই ঘরে শুধু আমার গাদাগুচ্ছের বই রয়েছে আর দুটো মুখোমুখি জানলা। তাতে জাল দেওয়া। বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে। খোলা বারণ। তবে কাচের জানলা তাই বাইরেটা স্পষ্ট দেখা যায়। এখন খুব বৃষ্টি হয়। জানলার কাচ বেয়ে সারাক্ষণ জলের ফোঁটা। আমার একদিকের জানলা দিয়ে পিছনের রাস্তাটা দেখা যায়। পিকুদের বাড়ির ছাদে সবাই ঘুড়ি ওড়াচ্ছে দেখলাম। এপাশে দীপালি কাকিমাদের দোতলার বারান্দাটা দেখা যায়। ওদের বারান্দায় অনেক গাছ। বারান্দার গ্রিল দিয়ে গাছের ডালগুলো বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। প্রচুর বেলিফুল ফুটেছে গাছে। বারান্দার বাইরের দিকের সানসেটের হুকে ঝোলানো টবগুলো থেকে জেড প্ল্যান্টগুলো রোদে চকচক করছে। একটা ঘরে এভাবে এতদিন কবে শেষ থেকেছি মনে পড়ে না। বিএসসির পর থেকে সম্ভবত কখনো না। আমাদের একটা নাটকের রিহার্সাল চলছিল। সেটার কী হলো জানিনা। আমাকে মোবাইল দেওয়া হচ্ছে না কিছুতেই। মা কে জিজ্ঞাসা করলে বলছে আর কয়েকদিন পর। একটু একটু করে রাগ বাড়ছে আমার। বাবা সেই যেদিন হসপিটাল থেকে বাড়ি এসেছিলাম সেদিন ঘরে এসেছিল। তারপরে আর আসেনি। বাবার সঙ্গে চিরকালের দূরত্বটাকে বাবা এখনো বজায় রাখতে চাইছে তার মানে। বাবা বোনকে বেশি ভালোবাসে। বোন বাধ্য। বাবার কথা শুনে চলে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। বাবার কথা অমান্য করে জেনারেল স্ট্রিমে যায়নি। রাজনীতির মধ্যে মাথা গলায়নি। নাটক থিয়েটার করেনি। আমি এগুলো সবক’টাই করেছি। বাবা বলত একদিন এমন বিপদে পড়বি তোর এই বেপরোয়া স্বভাবের জন্য দেখবি। পাঁচজন ছেলে মিলে আমাকে ভয়ানকভাবে রেপ করল বাবার ভবিষ্যতবাণী সত্যি করার জন্য নয় নিশ্চই। বাড়িতে আসার পর প্রথম কয়েকটা দিন খুব রেস্টলেস গেছে। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে থেকেছি বেশিরভাগ সময়। এখন একটু ধাতস্থ হয়েছি। হাসপাতালে আয়াগুলো নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল যে মরে গেলেই ভালো হতো। আমার মনে হয়না যে আমি মরে গেলে ভালো হতো। আমি বাঁচতে চাই। আমার এও মনে হয়না যে আমার রেপের সঙ্গে আমার রাজনৈতিক মতাদর্শের কোনো সম্পর্ক আছে। মনে হয়না কেন বলছি আমি জানি যে সেরকম কোনো যোগাযোগ নেই। আমি শুধু ভাবতে পারিনি এটা আমার সঙ্গে হবে। নির্জন কলকাতা শহরের রাস্তা দিয়ে আগেও ফিরেছি রাত করে। রিহার্সাল শেষ করে ফিরতে দেরি এই প্রথমবার নয়। আমার সঙ্গে সাধারণত সুস্মিত থাকে। ওর বাইকে ফিরি নয়তো নিজের স্কুটিতে। সুস্মিত দিল্লিতে গেছিল আর স্কুটি সার্ভিসিং-এ। অটো বাসে কয়েকটাদিন চালিয়ে নেব ভেবেছিলাম। ছেলেগুলোকে অন্ধকারে ভালো করে দেখতে পাইনি কিন্তু ফের দেখলে চিনে যাব বলেই মনে হয়। ওদের চেনাচেনা লাগছিল। আমাকে ফলো করত সম্ভবত। এর আগে অটোতে অসভ্যতা করার জন্য একজনকে মাঝপথে নামিয়ে দিয়েছিলাম। মনে সেই ছেলেটাও সামিল ছিল। হাসপাতালে আয়াগুলো বারবার বলছিল আটজন মিলে করেছে রে। ওই আটজন শব্দটার উপর ওরা জোর দিচ্ছিল। ওটা কী খারাপ লাগা না ভালো লাগা? নিশ্চয়ই ভালো লাগা নয়! তাহলে নম্বরটার উপরে অত জোর দিচ্ছিল কেন। আটজন। আমার কী সংশোধন করে দেওয়া উচিত ছিল? বলা উচিত ছিল আট নয় পাঁচ। আটজন মিলে রেপ করলে আর পাঁচজন মিলে করলে কী ঘটনার হেরফের হয়? পুলিশ যখন আমার বয়ান নিয়েছিল, আমি ঠিক করে কিছু অবস্থায় ছিলাম না। বাবাই যা বলার বলেছে। মা কিছু বলেছে কিনা খেয়াল পড়ছে না। বাবা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কথা বলছিল পুলিশকে। ভুল বলছিল। কিম্বা ইচ্ছা করে বলছিল। বাবা কি সেটাই বিশ্বাস করে না কি ওই স্টেটমেন্ট উদ্দেশ্য প্রণোদিত? আমাকে ফোন ল্যাপটপ কিছু দেওয়া হচ্ছে না কেন? বাইরের লোককে আসতে দেওয়া হচ্ছে না কেন? আমার বন্ধুরা একদিনও কেউ আসেনি সে হতেই পারে না। নিশ্চয়ই বাবার নির্দেশ এসব। আমি লজ্জিত বোধ করছি না রেপের জন্য। আমার লজ্জা লাগছে না। আমার মনে হচ্ছে শুধু ছেলেগুলোকে খুঁজে বার করব কীভাবে। ওদেরকে শাস্তি দেব কীভাবে। আমি সুযোগ পেলে ঠিক সেই সেই যন্ত্রণাগুলো ওদের দিতাম যেগুলো ওরা আমাকে দিয়েছিল। পুরুষের ধর্ষণ হয়না কেন? মেয়েরা কমজোরি বলে? আমি স্টেট লেভেলে অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। পাঁচজন ছেলের কবল থেকে বাঁচাতে পারলাম না নিজেকে। মা আমার পাশে শুতে চেয়েছিল আমি না করেছি। রেপ হয়েছে বলে আমি ভয় পেয়ে যাইনি। আমি বেচারি নই। আমার ঘুমের পাহারা দরকার নেই। দুঃস্বপ্ন আমার একার। তার মোকাবিলা আমি একাই করব। এখনো আমি ওদের গায়ের গন্ধ পাই। নিজের শরীরটাকেও আমার ঘেন্না লাগে। সুস্মিত আমাকে ফোন করেনি? বাড়িতে আসেনি? দিল্লি থেকে নিশ্চই ফিরে গেছে। কাউকে আসতে দিচ্ছে না কেন আমার কাছে? এত লুকোছাপা কিসের। সারা শহরে রাষ্ট্র হয়ে গেছে যে খবর সে খবর থেকে আমাকে ঘরে বন্ধ করে দূরে রাখবে কীভাবে। হঠাৎ মাথাটা গরম হয়ে গেল। বিছানা থেকে নামলাম। এখনো হাঁটা স্বাভাবিক হয়নি। হাঁটতে গেলে কান্না পাচ্ছে কেন কে জানে। আমাকে ধরে ওরা দোলাচ্ছিল। জন্তুর মতো লাগছিল নিজেকে। আমার শরীর, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সব যেন সবজিবাজারে লাট করা সবজির মতো। দরজায় ধাক্কা দিলাম। প্রথমে আস্তে তারপর খুব জোরে। এলোপাথারি লাথি আর ঘুসি চালাতে লাগলাম। কেমন যেন মনে হল আমার সামনে সেই মুখগুলো যাদের আমি ঠিক এইভাবে লাথি মারতে চাই। গলায় পা দিয়ে জিভ বের করে আনতে চাই। আমার যতই কষ্ট হোক আমি মারব। দরজায় পা চালালাম ফের। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। সবাই ছুটে আসছে। মুহূর্তখানেক পর দরজা খুললো। মা, বোন কাকিমা সবাই উঠে এসেছে উপরে। জিজ্ঞেস করছে কী হয়েছে। আমার খুব হাসি পেল। মনে হল হাহা করে হাসি। হাসতে হাসত ছাদ ফাটিয়ে দিই। তাহলে হয়তো এরা বুঝবে কী হয়েছে। কাকিমণি বোনকে বলছিল নিচে যেতে। আমি বললাম থাকতে। আমি কোনো নিষিদ্ধ বিষয় নই যে কচি মেয়েদের দূরে রাখতে হবে আমার থেকে। বললাম ও কোথাও যাবে না। কেউ কোথাও যাবে না। দরজা খোলা থাকবে। আর আমার ফোন ল্যাপটপ এখনই দিতে হবে আমাকে। এখনই, এই মুহূর্তে। মা বোনকে বলল, নিয়ে আয়। আমি বারণ করলাম। বললাম কোথায় আছে আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসব। তাড়াতাড়ি চলতে গিয়ে পাপোষে হোঁচট খেয়ে পড়লাম। মা হাউমাউ করে উঠল। আমি বললাম আমি পারব। কারো হেল্প লাগবে না। আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসব আমার জিনিসপত্র। আমি জানি বাবার ঘরে সব রাখা আছে। এ বাড়িতে ওই একজন ফ্যাসিস্ট রয়েছে যে সবার জীবনের চাবি নিজের কাছে গচ্ছিত রাখে। আমি জানি। মা ফের কাঁদতে লাগল। মা সারাজীবন কাঁদে। আকাশে মেঘ করলেও কাঁদে, বৃষ্টি হলেও কাঁদে, মানুষ মরলেও কাঁদে আর মেয়ের রেপ হলেও কাঁদে। একমাত্র বাবা জবরদস্তি করলে মা কাঁদে না। তখন শুধু ভয় পায়। কাঁদে না। আমার কাকিমা আরেক বিচিত্র চরিত্র। কাকিমা অবাক হয়। সারা জীবন কাকিমা অবাক হয়ে রইল। ওদের ছেলে মেয়ে নেই কোনো। অসুবিধা আমার কাকারই সে কথা জানে সবাই। তাও শ্বশুরবাড়ির সকলে মিলে নাকি প্রথমজীবনে কাকিমাকে বাঁজা বলত। এই গল্পটা কাকিমার কাছেই শোনা। যতবার বলেছি তুমি বারণ করোনি কেন কাউকে, কাকিমা বলত কী বলব, আমার অবাক লাগত। সবাই সব জেনেও কী করে এমন বলে সেটা ভেবে অবাক লাগত। তো কাকিমা পৃথিবীর সব ঘটনায় শুধুমাত্র অবাক হয়ে কাটিয়ে দিল। আমার রেপ হওয়াতেও নির্ঘাত মহিলা অবাক হয়েছে। বাবার ঘর থেকে ফোন ল্যাপটপ সব নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে নিজের ঘরে এলাম। বললাম এই দরজা ভিতর থেকে বন্ধ হবে শুধু, বাইরে থেকে নয়। ঘরে এসে দুধারের জানলা খুলে দিলাম। উফ কী হাওয়া! বর্ষাবিধৌত। কতদিন পরে যেন খোলা পৃথিবীর বাতাসে নিঃশ্বাস নিলাম। এরপর ইন্টারনেট অন করলাম। সুস্মিতকে ফোন করলাম। রিং হয়ে গেল দুবার, ধরল না। রাহেলাকে ফোন করলাম। আমার বন্ধু রাহেলা। এবার ফোন ধরল। কথা হল। কত কথা ছিল যেন আমাদের। কত কত কথা। কত কত কান্না, কত যন্ত্রণা, কত অন্ধকার, কত রক্ত… সব সব বলতে চাইলাম রাহেলাকে। সুস্মিত রিং ব্যাক করল। আমার মায়ের থেকেও বেশি কাঁদল। অনেকক্ষণ কাঁদল। বিকেলে আসবে। রোজই নাকি এসেছে ওরা সকলে। এসে ফিরে গেছে নিচ থেকে। আমার একটু সুস্থ হওয়ার অপেক্ষা করছিল। অদ্ভুত লাগল এই কথাটা শুনে। কার কাছে যে মানুষ কীভাবে সুস্থ হয় কে জানে। আমার কাছে জানতে চাওয়া উচিত ছিল যে আমি কীভাবে সুস্থ হতে চাই। যে যার মতো করে কেউ দরজা জানলা বন্ধ করে দিল, কেউ ফোন ল্যাপটপ বাজেয়াপ্ত করল। কেউ বন্ধুদের দেখা করা আটকে দিল। অবশ্য আমি জানি এই সবকটা কেউ আসলে একজন। বাকিরা তার নির্দেশ পালন করছিল। ফেসবুক খুললাম। ইউ টিউব খুললাম। দেখলাম কীভাবে আমার রেপ হয়েছিল। কীভাবে উদ্ধার হলো আমার। ক’জন রেপ করেছিল। কী কী তদন্ত হয়েছে, কারা কারা সহানুভূতি জানিয়েছে ইত্যাদি। একেক পাতায় একেক রকম বৃত্তান্ত। খুব চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কেউ ব্যাখ্যা করছে ঘটনা কেউ ভয়ানক ভূতের গল্পের মতো এক্সপ্রেশন সেট করে খবর পরিবেশন করছে। এতদিন অন্যের নিগ্রহের খবর শুনতাম আজ নিজেরটা শুনছি। শুনছি আর সেই মুখগুলো মনে পড়ছে। সেই গন্ধটা- উফফ! চোখ বন্ধ করে ফেললাম। মাথাটা যেন ঘুরে উঠল আরও একবার।

তিন
আরও দশদিন কেটে গেছে। আমি অনেকটা সুস্থ এখন। সুস্থতা মানে শারীরিক যন্ত্রণাগুলো তেমন আর নেই। কিন্তু ওই অবস্থাগুলো যায়নি। অবস্থাগুলো বলতে বোঝাতে চাইছি প্রভাবটা। একজন মনোবিদ আমার কাউন্সেলিং করছে। তাতে কতটা কী হচ্ছে আমি জানিনা তবে হয়তো হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না। পুলিশের সঙ্গে দুবার কথাবার্তা হয়েছে। ওরা একই প্রশ্নের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। যেমন তাদের দেখলে চিনতে পারবে তো? কীভাবে কখন কতক্ষণ ইত্যাদি। পুলিশ বেশ সচেতন ছিল প্রশ্নের ব্যাপারে। আমি একা তো নই। উকিল, বাবা, বন্ধুরা অনেকের উপস্থিতিতে প্রশ্ন করেছে। ফলে বেশ সচেতন। সচেতন এবং স্মার্ট। কিছু ছবি দেখানো হয়েছে। তার মধ্যে দুজনকে আমি চিনতে পেরেছি। জানিয়েছি। কয়েকদিন আগে সেই দুজনকে ধরেছে শুনলাম। দেখা যাক। সবাই এখন খুব সচেতন আমার সম্পর্কে। আমার যাতে কিছুতে খারাপ না লাগে সে সম্পর্কে। এমনকি বাবাও। অসভ্যতা করে চেঁচালেও মেনে নেয়। কেন কে জানে। এত সচেতনতা আমার কৃত্রিম লাগছে। এমনকি মাঝেমধ্যে আমিও নিজেও অতিরিক্ত সচেতন হয়ে পড়ছি নিজের সঙ্গে। হয়তো অন্যদের সঙ্গেও। কে জানে। আসলে কিছু অসুবিধা থাকেই। তোমার রেপ না হলে সেটা তোমাকে আমি বোঝাতে পারব না। যেমন ধরো তুমি স্নান করতে গেলে। জামাকাপড় খোলামাত্র তোমার অস্বস্তি হবে। তুমি নিজের শরীরের সঙ্গে চোখ মেলাতে অস্বস্তিবোধ করবে। না না এ আমার মানসিক অবস্থা নয়। এটাই হয়। ধরো তুমি পেচ্ছাপ করতে কমোডে বসলে। তোমার ভ্যাজাইনাতে চাপ পড়বে, প্রশস্ত হবে। অমনি তোমার ভয়ানক অস্বস্তি শুরু হবে। আমার তো পেচ্ছাপ বন্ধ হয়ে যেত প্রথম দিকে। ওই মুহূর্তগুলো কী ভয়ানক ঘেন্নার কিন্তু ওগুলোই আসবে। বারবার আসবে। তোমার শরীরকে তোমার শ্ত্রু মনে হবে। জামাকাপড় পরিয়ে রাখলে ঠিক আছে। খুললেই তুমি শিউরে উঠবে। তোমার শরীর যেন কোনো ভয়ানক ভয়ের গল্প বা ছবি বা সেইসব আতঙ্কিত অধ্যায় যা ভাবলেই চোখ বন্ধ হয়ে যায়। এগুলো তোমাকে আমি ঠিক বোঝাতে পারব না। আরেকটা খুব বাজে ব্যাপার হল সন্দেহ। আমি সব ছেলেদের আজকাল ভিতরে ভিতরে সন্দেহ করি। সবাইকেই কেমন যেন চেনা লাগে। সব মুখ এক হয়ে যায়। বোনের ফিরতে দেরি হলে আমি ব্যস্ত হয়ে উঠি। ওর সবক’টা বন্ধুকে সন্দেহ করি। কাউকে যেন ঠিক আর বিশ্বাস করা যায় না। সুস্মিতকেও কেমন যেন অন্যরকম লাগে। সাত বছরের সম্পর্ক আমাদের। সুস্মিত আমার সমস্ত যন্ত্রণা ভীষণভাবে ফিল করে। কাঁদে বাচ্চাদের মতো। আমাকে বুকে জড়িয়ে রাখে। কিন্তু ওর মধ্যে থেকে সেই উষ্ণতা যেন কোথায় চলে গেছে। আমাকে ছুঁয়ে দেখার সেই আগ্রহ, সেই আড়াল পেলে চুমু খাওয়ার প্রবণতা চলে গেছে। আমাকে পরম স্নেহে সুস্মিত টেনে নেয় ওর বুকে। কিন্তু ওর আঙুলের স্পর্শ থেকে প্রেম হারিয়ে গেছে। শুধুই যেন যত্ন, শুধুই দুঃখ, শুধুই যেন সচেতন আগলিয়ে চলার প্রচেষ্টা। আমি কেঁদে ফেলি সুস্মিতের কাছে। কিন্তু তার কারণ ও বোঝে না। আমিও বোঝাতে পারিনা। শরীরকে অনুবাদ করা যায়? আসলে রেপ ব্যাপারটাকেই অনুবাদ করা যায় না। শারীরিক প্রক্রিয়াকে ভাষা দিয়ে তখনই বোঝানো সম্ভব যখন একই অনুভবের মধ্যে দিয়ে মানুষ যায়। স্বাদ, গন্ধ এসব যেমন অনুবাদ করা যায় না ঠিক তেমনই। আরেকটু বোঝানোর চেষ্টা করব। তোমার কোনো দায় নেই। তবু আমি তোমাকে বোঝানোর ছলে নিজেকেই আরেকটু বলতে চাই। ধরো খুন। খুন করলে কেমন লাগে বলতে পারবে? পারবে না। আমিও পারব না। নিজের হাতে একটা মানুষের খুন হয়ে গেল ধরো। ভাবো? পারবে? দেখো ভাবনাটা ছিঁড়ে যাবে। কারণ তুমি খুন করোনি যে। তুমি এ বিষয়ে যা বলবে সব তোমার চেষ্টা হবে, অরিজিনাল নয়। বোঝাতে পারলাম কিছু? পারলাম না? যাক গে ছেড়ে দাও। আসলে কোনোকিছুই আর আগের মতো নয়। মা’র কথাই ধরো না। মা কীভাবে যেন বুঝেছে মায়ের কেঁদে ফেলাটা ঠিক নয়। হতে পারে মা’কে কেউ বুঝিয়েছে। হতে পারে ওই কাউন্সেলরের পরামর্শে হয়তো মা নিজেকে বদলে ফেলেছে। মা কখনো ওই ঘটনা নিয়ে আলোচনা করে না আমার সঙ্গে। ইন ফ্যাক্ট বাড়ির কেউই আমার সঙ্গে ওই বিষয় নিয়ে আলোচনা করে না। কিন্তু কেন জানি মনে হয় ওরা সারাক্ষণ ওই বিষয় নিয়েই আলোচনা করছে আর আমায় দেখলে যেন সেই মুহূর্তে বদলে ফেলছে প্রসঙ্গ। আর বাবা? আমিকে বাবাকে পছন্দ করতাম না কখনো। বাবাও বোধহয় পছন্দ করত না। বাবার কাছে অপশন ছিল আর আমি অপশন ছাড়াই। এখন বাবাকে দেখলে আমার খালি মা’র সঙ্গে জবরদস্তি করার শব্দগুলো মনে পড়ে। বিশ্রী শব্দ। শারীরিক শব্দ যে এত বিশ্রী হতে পারে আমি কখনো বুঝিনি। বাবার সঙ্গে আমি কথা বলিনা। ইচ্ছা করে না বলতে। আরেকটা সমস্যা হলো সবকিছুকেই মানসিক সমস্যা ভেবে ফেলা। আমাকে মানসিকভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য আমার পুরো পরিবার সাইকোলজির উপর পিএইচডি করে নিল। এতগুলো বন্ধুর মধ্যে এক রাহেলা। রাহেলা যেন একটু আমার শরীরের কাছাকাছি ছিল। শরীর এবং মন। ওই মেয়েটাই একমাত্র কিছু চেষ্টা করেনি। যেমন ছিল তেমন আছে। কোনো বাড়তি পরিবর্তন নেই ওর মধ্যে। বাড়তি পরিবর্তন অবশ্য ওই কাউন্সেলর ম্যাডামের মধ্যেও নেই। কিন্তু সেটা ওর প্রফেশনালিজম। রাহেলা স্বাভাবিক। রাহেলে কী করে বুঝল এত? ও কী বোঝে রেপ হলে কী কী হয়? ওর সঙ্গে কি কখনো হয়েছে? তুমি বোঝো? রেপড হওয়া মহিলারা কি ঘণ্টাখানেক সঙ্গে ইমন অনুষ্ঠানে বলতে আসে নিজেদের কথা? আসেনা। তুমিও আসলে কিছুই বোঝো না। সিমপ্যাথাইজড হও। ফাক অফ ইয়োর সিম্প্যাথি। আমি চাইনা। ওসব কিছুই আমি আর চাইনা। সুস্মিতকেও বলে দেব আমি চাই না। স্নেহ চাই না আমি। প্রাত্যহিকতা চাই। পুরনো জীবন চাই। পুরনো ইউনিফর্ম চাই। আবার আগের মতো বাগবাজারে নদীর ধারে বসে প্রেম করতে চাই। চুমু খেতে চাই। একটা সিগারেট ভাগ করে টানতে চাই। গিটার বাজাতে চাই। পাঁচটা বছর গেলেই সব বদলে যাবে জানি। কিন্তু আমি এই মুহূর্তে চাই, এখনি। আমার নাটকের দল কিন্তু আমায় খুব সাহায্য করেছে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে। যেন কিছু হয়ইনি। যেন অনেকদিন আমি রিহার্সালে না যাওয়ায় ওদের খুব অসুবিধা হয়ে গেছে। হৈ হৈ করে আমাকে ওয়েলকাম জানিয়েছে। ওদের নিয়ে আমি খুব খুশি। আমি রিহার্সালে পরপর কয়েকদিন গেলাম। মনে হল আমি গতজন্মে ফিরে গেছি। উফ অভিনয় তুমি এত প্রশ্রয় কেন দাও আমাকে! শুধু একদিন প্রতীচী আর অস্মিতাকে ফিসফিস করে আলোচনা করতে শুনলাম,
– পাঁচজন না আটজন?
– কী জানি পাঁচজন মনে হয়। দুজন ধরা পড়েছে
– সুস্মিত কী করবে রে?
শেষটুকু আর শুনতে পাইনি। তাই সুস্মিত কী করবে আমি জানতে পারিনি। আচ্ছা পাঁচজন না আটজন এটা সবাই জানতে চায় কেন এত? সংখ্যা বাড়লে বেশি রেপ হয়, কমলে কম। অনেকদিন আগে রেপ নিয়ে একবার কথা হচ্ছিল আমাদের ইউনিভার্সিটি গ্রুপে। মনে আছে একজন ছেলে বলেছিল তার কোন বন্ধু নাকি তাকে বলেছে যে যদি গ্যাং রেপ না হয় তাহলে নাকি প্রাথমিক ভয় কেটে যাওয়ার পরে ভিকটিম এনজয় করে। বলেছিলাম, বন্ধুটাকে প্লিজ ক্যাম্পাসে নিয়ে আসিস অমিত মুখে একটা লাথি মারব রে! অমিতের সেই বন্ধুটা নিশ্চই আমার কথা জানে। গ্যাং রেপ বলে হয়তো কিছু বলেনি অমিতকে। এখন যদি ওই ছেলেটাকে নিয়ে আসে অমিত আমার আর ওর মুখে লাথি মারতে ইচ্ছা করবে না। ওর কোনো দোষ নেই। ওর রেপ হয়নি তাই ও বুঝবে না। কেউ কেউ নাকি রেপ নিয়ে ফ্যান্টাসি করে। তারাই কি রেপিস্ট? রেপিস্ট কি শুধু পাঁচজনই? যারা জানতে চায় পাঁচজন না আটজন তারা নয়? যারা প্রশ্ন করে কোথায় কীভাবে আঘাত করেছিল শরীরের কোন কোন অংশে তারা নয়? যারা অতি সচেতন থেকে আমাকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দিচ্ছে আমি স্পেশাল ওম্যান এখন তারা নয়। দে আর টু ইনোসেন্ট টু রেপ তাই না?

চার
ছ’মাস কেটে যাওয়ার পর অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে জীবনযাত্রা। কেসটা চলছে। বাইরের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বাবা আমাকে দিল্লিতে পিসীর বাড়ি পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিল। আমাকে বলেছিল সিভিল সার্ভিসের প্রস্তুতি নে। দিল্লিতে গেলে সুবিধাও হবে। নিজের মতো করে বাঁচ। শুধুমাত্র শেষের লাইনটা নিয়েছি বাবার থেকে। বাড়ি ছেড়ে দিয়েছি। পিজি নিয়েছি যাদবপুরের কাছে। কলকাতাতেই থাকব। নিজের মতো করে নিয়েই থাকব। দাগ অসুখ অস্বস্তি সবকিছু নিয়েই। টিউশনি করছি এনতার। খরচ উঠে যায়। নেটের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। সিভিল সার্ভেন্ট হওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। বাড়ি যাই মাঝেমধ্যে। মা আমাকে দেখলেই কাঁদে। কেন আমি বাড়ি ছেড়ে বাইরে পিজিতে রয়েছি ইত্যাদি। মা বুঝলই না কোন সময়ে মা’র আসলে কাঁদা উচিত। বোন দিব্যি আছে। ভালো মেয়ে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে মনে দিয়ে। তারপর এম বি এ পড়বে। তারপর একদম ইউ টার্ন নিয়ে এমন একটা বড় প্যাকেজের চাকরি করবে যাতে না লাগবে ইঞ্জিনিয়ারিং না লাগবে এমবিএ। গুড লাক টু হার। ভাবছ সুস্মিতের কথা কখন বলব? সে এখন নেই। ব্যাঙ্গালোরে। ল পড়ছে। ভালোই হয়েছে। ও অদ্ভুত একটা অস্বস্তিতে ভুগছিল আমার সঙ্গে। আমাকে ভালোবাসে কিন্তু কিসের যেন অসুবিধে। কী যেন একটা হয় ওর ভিতরে। আসলে কিছু হয়না এটাই সমস্যা। ও আমার কাছে এলে বাজারের সবজির ঝুড়ির মতো পড়ে থাকে। এটাও বোঝাতে পারব না। তোমার প্রেমিকা বা স্ত্রীর সঙ্গে এই ধরনের একটা কিছু হলেই একমাত্র বুঝতে পারবে। তো সুস্মিতকে আমি হালকা করে দিয়েছি। নিশ্চয় ওর জীবনে এমন কেউ ফের চলে আসবে যেখানে ওর শরীর সাড়া দেবে। বিশ্বাস করো শারীরিক স্পন্দন ছাড়া নারী পুরুষের ভালোবাসার সহবাস হয়না। ওই বন্ধুত্ব টাইপের একটা ঝাপসা কিছু হয় যার ওপারে তুমি কী ভাবছ আমি দেখতে পাচ্ছি না আর এপারে আমি কী ভাবছি তুমি দেখতে চাইছ না। আর শহরের কথা কী বা বলব? ইতিহাস ঘুরতে থাকে। বলে না, হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ। তাও বলছি। ইতিমধ্যে অভয়া কাণ্ডের দু’বছর পূর্তি হয়েছে। শহরজুড়ে আন্দোলন চলছে। সামনেই ইলেকশন। এবার একটা এসপার ওসপার হয়ে যেতে পারে এই বঙ্গে। দেখা যাক। এই পর্যন্তই। আর কিছু বলব না। অন্যান্য সবকিছুর পাশাপাশি আমি একটা এনজিওতে যোগ দিয়েছি। ওদের সূত্রেই বিভিন্ন ধর্ষিত মেয়েদের সঙ্গে দেখা করার, কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। অনেকে অনেক কথা বলেছে। অনেকে কোনো কথাই বলেনি। কিন্তু যখন শুনেছে আমিও একজন ভিকটিম তখন ওদের দৃষ্টি বদলে গেছে। একে অপরকে যেভাবে বুঝেছি সেকথা লিখে বোঝানো যাবে না। ওই যে বলেছিলাম না শারীরিক সব কথা অনুবাদ করা সম্ভব নয়। এখন আমার রাত বিরেতে চলতেও আর ভয় লাগে না। একবার যার গ্যাং রেপ হয় বোধহয় তার আর রেপের ভয় থাকে না। একটা সেলফ ডিফেন্স ক্লাবেও জয়েন করেছি। কনফিডেন্স বাড়ে। তার মানে এই নয় যে গ্যাং রেপ আটকানো যাবে। তবুও… শুধু ডিফেন্স কেন অ্যাটাকের জন্যও তো সিস্টেম মজবুত রাখতে হয়।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes