
চারটি রাতের স্বপ্নসফর (ওল্গা শার্টসের ইংরাজি অনুবাদে ফিওদর দস্তয়েভস্কির White Nights গল্পটি পড়ে)
রুমেলা দাশগুপ্ত
যে সকল কথা বলি, বলে ফেলি, কখনও সেসব কথায় সাজানো দেহটিকে মর্গে রেখে এলে দেখা যেত, অযুত লক্ষ ছোটো ছোটো পোকার মত শরীর বেরিয়ে আসছে কাটা শিরা-উপশিরার নালি বেয়ে। বিস্ময় জাগে এই ভেবেই, যে, নানারূপ কথা দিয়ে বহু শ্রমে যত্নে সাজানো যে বক্তব্যটি পেশ করার পরই তার মেয়াদ ফুরিয়ে গেল, ঠিক সেখানেই জন্ম নিল অসংখ্য অব্যক্ত যন্ত্রণার চারা। কত কথা বলার ছিল, বলাও হল হয়তো কতখানিই, তবু যেটুকু কোনোদিনই বলে ফুরোবার নয়, অথবা, কোনোদিনই বলার মত নয়, সেইসব কথারা কিন্তু আদতেই সঠিক গন্তব্য পেল না। তাই সারাদিনের ঘাড়-ধাক্কা-দেওয়া হুজ্জুতির সংলাপে বুনে নেওয়া দিনানুগ সময়সারণী পেরিয়ে যাওয়ার পরই রাতের অন্ধকারে জ্বলে ওঠে সারি সারি নির্জন পথ, অলিগলি। শুরু হয় কথা। শুরু হয় স্বপ্ন দেখা, অথবা, স্বপ্নে দেখার বিলাসিতা। সদ্য পড়ে যে গল্পটির ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারিনি, ফিওদর দস্তয়েভস্কির লেখা White Nights.। পড়তে পড়তে এমনই কিছু অননুভূত মুহূর্ত ছুঁয়ে গেলাম অপ্রত্যাশিত ভালো লাগায়।
আশ্চর্য এই মন! নিজস্ব একখানি পৃথিবী গড়ে নেয় সেই জন্মমুহূর্ত থেকেই। বাইরের জগতের সঙ্গে যার সম্পর্ক যে একেবারেই নেই, এমনটি কিন্তু নয়, বরং কিছুটা যেন পরিপূরক। অস্তমিত সূর্যের গায়ে পিঠ দিয়ে বসে প্রিয় মানুষের সাথে আলাপ, তার দিকে চেয়ে থাকা অলক্ষ্যে, চোখের কোণ বেয়ে নেমে আসা দ্বিধাভরা সম্ভাষণ— ঠিক এমনই কিছু অপঠিত ইচ্ছে, যা কোনোভাবেই ধরা দেয়নি, ধরা দেবেও না এই ছাপোষা জীবনবৃত্তে, তা যেন মনের ওই অপরিসীম পরিসরে জ্যান্ত হয়ে ওঠে। তাই অবধারিত উৎসাহে প্রতিরাতেই সেই নিভৃত নির্জন অন্ধকারে ঘটে যায় ম্যাজিক। সম্পূর্ণ গল্পটি এক মাত্রাতিরিক্ত নিঃসঙ্গ মানুষের, যে একই সঙ্গে এই গল্পের কথক। যদিও সে এই নিঃসঙ্গ যাপনের প্রতি নির্মমভাবে দুর্বল— এই যুক্তিতেই নিজেকে ব্যাখ্যা করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে, তবু, বিপরীতে কোথাও মনের গভীরে ঘনীভূত অসীম অন্ধকারে পেতে চায় প্রিয় সঙ্গ। কাছে পেতে চায় সেই মানুষটিকে, যার সাথে কিঞ্চিৎ আলাপ মনে করিয়ে দেয় আলোকবর্ষব্যাপী এক অনন্ত যোগাযোগের আখ্যান। তাই প্রাক্গল্প এই পংক্তি বুঝি তার অপ্রাপ্তির অনতিক্রম্য যন্ত্রণা, দেহ-মন-বিবশ-করা কষ্ট, এবং সর্বোপরি, এক ভাষাতীত আফশোসের বিরল প্রকাশ-
“..Or was he born that he might dwell,
If only for a fleeting hour,
In the reflection of your love?”
শুরুতেই কথকের স্বীকারোক্তি- “… I was prey to a peculiar melancholy”, অথবা, “… I was feeling depressed, and the mood persisted for three days before I understood the cause of it.” যেন অব্যর্থ নিশানায় বিদ্ধ করছে আমাদের মনে মেঘলা আকাশকেও। বুকে দীর্ঘ ফাটল ধরিয়ে অনর্গল ঝরতে শুরু করছে কথা-না-হয়ে ওঠা ব্যথাগুলি, যাদের সঙ্গে হয়তো সেইভাবে পরিচিত হয়ে ওঠার সুযোগও ঘটেনি। বিস্ময় সেখানেও, যন্ত্রণার এমন অফুরান ভাণ্ড তৈরি হলই বা কবে! হতবাক হয়েই কথকের সঙ্গে প্রতিরাতে শুরু হয় মনের গভীরতম সুড়ঙ্গে প্রবেশের আমোদ। এ যেন এক অমোঘ ডাক, অদম্য আকর্ষণ। কথকের হাত ধরে এক নাতিদীর্ঘ সফরে খুব সহজ একটা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তার বিষণ্ন দিনরাতের সঙ্গে, সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের ছোটো বড়, সাদা কালো, রঙ বেরঙের ঘরবাড়ি, অলিগলি, পথচারীর সাথে। “As it is, I am friends with the whole of St. Petersburg and that was why, when all the town suddenly packed up and left for the country, I fancied that everyone was forsaking me.” কিংবা, “I am friends with the houses too. When I walk down the street they all seem to step forward before me, and they almost speak, staring at me with all their windows:”— লাইনগুলি পড়তে পড়তে যখন দেখি, যে, এক অশীতিপর বৃদ্ধের সাথে নিত্যদিন একটি নির্দিষ্ট স্থানে দেখা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা কথককে জীবিত রাখছে, অথবা, একটি অতিপরিচিত, অত্যন্ত প্রিয় বাড়ির দেওয়ালে অপছন্দের রঙ লেপ্টে দেওয়ায় কথক অস্তিত্বহীনতায় ভুগছে, মুহূর্তেই মনে পড়ে যায়, পাশাপাশি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে গড়ে ওঠা আমার ছোটোবেলার ছেড়ে আসা পাড়াঘরগুলির কথা। সন্ধের আধো অন্ধকারে বাড়ি ফেরার পথে যাদের সঙ্গে হয়তো আমারও গড়ে উঠেছিল এমনই অনাবিল সখ্যতা। রক্তিম বিকেলে কতবার যে ফিরে ফিরে দেখেছি কত বাড়ির ছাদ, কার্নিশ, দেওয়ালের রঙ, ঝুলবারান্দা ,জানলার ফ্রেম! আসলেই কেউ একা নয়। এভাবেই তীব্র এক বেঁচে থাকার অনুভূতি দৈনন্দিন একই স্বাদের ভিতরেও নাগাড়ে তাড়িত করে আমাদের। তাই আমরা বাঁচি, বেঁচে থাকাকেই বেছে নিই, জীবনের প্রতি পাহাড় প্রমাণ অভিমান জমা রেখেও। কথকের এই সফরেই আলাপ হয় সেই মেয়েটির সঙ্গে, যার সাথে অতিবাহিত সাদা রাত্রিগুলি স্বপ্নের মতোই নিটোল, অথচ, স্বপ্ন থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে ছিটকে যাবার প্রস্তুতিতেই সাজানো। যার সাথে আলাপের প্রথম রাত্রিতেই কথক নির্দ্বিধায় বলতে পারে, “I am a dreamer. I have so little actual, moments like these come to me so rarely that I cannot help living them over and over again in my dreams. I shall dream of you the whole night through, I shall be dreaming of you for a whole week, a whole year.” অপরদিকে, মেয়েটিও অভিভূত এমন নির্মল হৃদয়ের একটি মানুষের সাক্ষাতে। প্রথামাফিক নায়কোচিত আবির্ভাবে মেয়েটিকে দুর্বৃত্তের হাত থেকে রক্ষা করলেও মেয়েটি বিস্মিত হয় পরবর্তীতে কথকের অপ্রথামাফিক আচরণ এবং ভালো লাগার এমন ব্যতিক্রমী প্রকাশ দেখে- “Surely it was not really sinful of me to feel a brotherly compassion for you?” প্রতি মুহূর্তেই মনে হতে থাকে, আবছা আঁধারে যা দেখছি, যাদের দেখছি, যেটুকু শুনছি, যে মেয়েটি এল, তার গল্প শোনাল, ভালোবাসল অথবা ভালোবাসা পেতে চাইল— এইসব তো গল্প নয়, মেয়েটিও বুঝি গল্পের নায়িকা নয়। রক্ত মাংসে গড়া এই নশ্বর দেহটির থেকেও সত্য সে যাপন, সত্য সে অনুভব। এক জীবনে কতবারই তো প্রেম আসে, প্রেম যায়, দিন আসে, দিন যায়। থাকে না কিছুই। কী তবে এত ব্যথা রেখে যায়, কী তবে এত প্রশ্ন রেখে যায়, যার উত্তর খুঁজে পেতেই কেটে যায় আস্ত একটা জীবন, উপসংহারে পৌঁছানো হয় না কোনোদিনই! যে মুহূর্তে কথকের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয় নাস্টেঙ্কার, গল্পের একমাত্র নায়িকার, সে তখন তার প্রিয়তম পুরুষটির জন্য দীর্ঘ এক বছরের অপেক্ষায় অধীর। ইত্যবসরে অন্য এক পুরুষের সঙ্গে তার দেখা, যার সাথে আলাপের প্রাথমিক শর্তে নাস্টেঙ্কা এই শপথ আদায় করে নেয়, যে, এই অন্য পুরুষটি কোনোদিনই নাস্টেঙ্কার প্রেমে পড়তে পারবে না। তারপরই আরো তিন রাত্রির ‘rendezvous’। দ্বিতীয় রাত্রি পেরিয়ে যায় কথকের নিজস্ব স্বপ্নপরিক্রমার রোমহর্ষক বর্ণনায়। তার পরিবেশিত শব্দে এমনই কিছু ঘোরলাগা অনুভূতি জড়িয়ে রয়েছে এবং এমন মন্ত্র উচ্চারণের মতো আবহ তৈরি হয়েছে, যা আক্ষরিক অর্থেই রোমহর্ষক— “Because when spells come over me, I begin to think that I am incapable of ever starting to live a new, a real life, because it seems to me that I have already lost all touch, all sense of the real and the actual…”। কিন্তু এই রাত্রে নাস্টেঙ্কার সঙ্গে আলাপের পরই কথক যেন তার এ যাবৎ উপলব্ধিজাত যাবতীয় তত্ত্ব, যার উপর ভিত্তি করে তার নিদারুণ একাকী জীবন নিজস্ব ছন্দে বয়ে যাচ্ছিল, স্বতঃসিদ্ধ সিদ্ধান্তেই বদলে ফেলে আমূল। ফলস্বরূপ আমরা দেখি, দ্বিতীয় রাত্রির সাক্ষাতের প্রথম অংশে তার স্বপ্নে বাঁচা মুহূর্তের পক্ষে যুক্তি খাঁড়া করে, যাপিত বাস্তব জীবন সম্পর্কে সে যা বক্তব্য রাখছে— “… you and I are leading such a slow, lazy, and sluggish life, Nastenka ; from his (the dreamer, i.e, the narrator) point of view we are all so dissatisfied with our lot, we are finding life so wearisome…. Look at variety of adventures, look at the never ending flow of his rapturous dreams!”, তা বদলে দিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত ধারার ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করছে তার এই বক্তব্যে— “I now know it better than ever that I have wasted the best years of my life… for Providence has sent you to me, my kind angel, to tell me this and to convince me in this knowledge… what am I to dream of now I can say that I have lived at least two evenings in my life”। এখানেও চমকে উঠেছি এই ভেবেই, যে, প্রকৃত সম্পর্ক বুঝি পরশপাথর, সহজলভ্য নয়। কিন্তু যখন আবির্ভূত হয়, অথবা ধরা দেয়, তখন আমূল পরিবর্তনের ঝড় বয়ে যায় সমস্ত সকাল বিকেল দুপুর রাতের উপর দিয়ে, বারণ তোয়াক্কা সমস্তই ফুৎকারে উড়িয়ে। তবে এই ঝড় ধ্বংসাত্মক নয়, তাণ্ডবলীলা দেখানো এর উদ্দেশ্য নয়। এই ঝড় যেন পুরাতনের ক্লান্তি সরিয়ে, সম্পর্কের কৃত্রিমতার মুখোশকে টেনে খুলে দিয়ে, এক নতুন দ্বিধাহীন, সংশয়হীন, আমিত্বহীন, বাঁধনছাড়া গাঁটছড়ায় বেঁধে ফেলে দুটি মনকে।
নাস্টেঙ্কা যে মুহূর্তে তার নিজের গল্পটি বলতে শুরু করে, পরিচয় পর্বেই ফুটে ওঠে একটি ছবি— বাবা মা-হারা নাস্টেঙ্কা, ঠাকুমার কঠোর শাসনের কাঁটাতারের ভিতর টুকটুকে একটি ফুলের মতো বেড়ে উঠছে। সে যখন কথকের কাছে তার ঠাকুমার সঙ্গে একটি সেফটিপিন দিয়ে আটকে থাকার মতো অদ্ভুতুড়ে কাহিনীটি শোনায়, চোখ বন্ধ করে আমি দেখতে পাই, আব্বাস কিয়ারোস্তামির জনপ্রিয় মুভি “Through the Olive Trees” এর নায়িকা, তাহেরে এবং তার ঠাকুমার একটি ভূমিকম্প বিধ্বস্ত গ্রামে স্বজন হারানো যন্ত্রণার মধ্যে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। দুই ভিন্ন দেশের আবহে দুই ভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত ভাবনা, অথচ, এই দুইয়ের মধ্যে কী নিবিড় যোগ স্থাপিত হল আমার মনের গভীরে— কিছু সময়ের জন্য নাস্টেঙ্কা এবং তাহেরে যেন একই বৃন্তে ফুটে ওঠা দুই ভিন্ন রঙের ফুল মনে হল। যদিও পরবর্তীতে জীবনে প্রেমের বহুরূপী লীলা এই দুই নায়িকাকে একে অপরের থেকে বহু দূরে ঠেলে দেয়। নাস্টেঙ্কার ভয়ানক অনুশাসনে বাঁধা জীবনেও প্রেম আসে দুর্বার গতি সঞ্চার করার প্রলোভন নিয়ে। গতি সঞ্চারিতও হয়। এতদূর আলোড়িত করে তাকে, যে, সে তার সর্বস্ব উজাড় করে দিতে চায় প্রণয় পুরুষের চরণে। কিন্তু নিয়তি হয়তো অন্য কিছু লিখতে শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে। ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত না হলেও সম্পর্কটি সেই মুহূর্তে পূর্ণতা পায় না। একটি বছরের অপেক্ষার শর্ত নিয়ে শূন্য হাতে ফিরে আসে সে। তারপর এভাবেই তার অপেক্ষার একটি বছর অতিক্রান্ত হয়। কিন্তু তখনও সে তার স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকারবদ্ধ মানুষটির দেখা পায় না। আর এমনই এক অপেক্ষার মুহূর্তে তার কাছে নিয়তির অমোঘ ইশারায় গলায় কাঁটার মতো বিঁধে থাকা যন্ত্রণার থেকে মুক্তি দিতে পরিত্রাতা হয়ে আসে কথক। যেন এই দেখা হওয়া নির্দিষ্ট ছিল বহুকাল আগেই, অনন্ত এই আলাপচারিতা যেন কেবল যথার্থ সময়ের অপেক্ষায় ছিল। কথককে তাই বলতে শুনি— “… for I have known you a long time, Nastenka, I have long been searching for someone and that is a sign you are the one I have been searching for and that this meeting of ours has been preordained…”। এবং, অচিরেই সমস্ত হিসেবনিকেশ ভুল প্রমাণ করে, সমস্ত নিয়মের গণ্ডী পেরিয়ে কথক, এই অন্য পুরুষটি নাস্টেঙ্কার কাছে ক্রমান্বয়ে হয়ে ওঠে এক বিশ্বস্ত আয়না, যার সামনে নাস্টেঙ্কা উন্মুক্ত করে দেয় তার প্যান্ডোরার বাক্স। সকল সংকোচ পেরিয়ে, সব সংকল্পকে মিথ্যে প্রমাণ করে, কথকের সামনে সাজিয়ে রাখে তার একান্ত শোক, স্বস্তি, সন্দেহ, বিশ্বাস। মনের অপরিমিত গতিময়তার সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে যখন সে রণক্লান্ত, অপরিমেয় ক্লান্তিতে অবসন্ন মাথা রাখে এই কথকের কাঁধে, বহু প্রতীক্ষার পর ঠিক তখনই সে হঠাৎ দেখতে পায় তার কাঙ্খিত পুরুষটিকে। এবং সেই মুহূর্ত থেকেই তার মনে দানা বাঁধতে শুরু করে অন্য এক দ্বন্দ্ব। নাস্টেঙ্কা কথককে বলে— “D’you know what has occurred to me just now? I was comparing the two of you. Why isn’t he- you? Why is he not like you? You are better than he is, even though I do love him more”। আর ঠিক এইখানেই যেন সফল হয়ে ওঠে লেখকের কলম তার সর্বোচ্চ সম্ভাবনা নিয়ে। সাধারণের অগোচরে বেড়ে ওঠা অসাধারণ কিছু অনুভূতির সমন্বয়। যে দ্বন্দ্ব পুনরাবৃত্তে প্রমাণ করে, এই মন সংজ্ঞাতীত, ব্যাখ্যাতীত। মনের না আছে অতীত , না ভবিষ্যত। আছে শুধু বর্তমানের লেলিহান শিখা, যার অনর্গল তাপে পুড়ছে কিছু মুহূর্ত, পুড়ে ছাই হচ্ছে কিছু অনন্ত ইচ্ছে, পরিপার্শ্ব সাপেক্ষে কিছু অনৈতিক অভিলাষ। আবার সেই ছাই থেকেই দু’ একটি স্ফুলিঙ্গের ছিটকে আসা অব্যাহত থাকছে পরবর্তী মুহূর্ত আসার আগে পর্যন্ত। হ্যাঁ, এটুকুই তো বেঁচে থাকা, বাঁচিয়ে রাখা সম্পর্ক এবং সম্পর্কের নিখাদ নির্যাসটুকু। তাই কথকের কাছ থেকে শপথ করিয়ে নেওয়ার পরও নাস্টেঙ্কার অন্তঃপুরে জেগেছে ভালোবাসা পাওয়ার সুতীব্র ইচ্ছে। নাস্টেঙ্কা কথককে বলছে— “Of course I’ve always known you cared for me, but I kept fancying you loved me differently, not in that way…”। এমনকি কথকের কথা ভেবে বুকের ভিতরে অনুভব করেছে চিনচিনে ব্যথা, সামাজিক আয়নায় যা নিশ্চিতভাবেই কিছুটা অনৈতিক। কিছুটা যেন সেই ভাবনা থেকেই সে কথককে লজ্জিত কন্ঠে বলতে চেয়েছে— “ Now then, please do not think that I am so inconstant and flightly in my affections”। লেখকের কলমের প্রতি মুগ্ধতা রেখে যাই এখানেও। মনোজগতের এমন খুঁটিনাটি দ্বিধা সংশয়গুলিও কী সহজাত কৌশলে ব্যক্ত করেছেন! একইসাথে কথকও নাস্টেঙ্কার অপূর্ণ প্রেমের যন্ত্রণার বিলাপ শুনতে শুনতে এবং ক্রমাগত কথকের সঙ্গে সেই অদেখা পুরুষের তুলনার প্রসঙ্গেই নিজের অনুভূতির প্রবাহে বাঁধ দিতে অসফল হয়, ফলে নাস্টেঙ্কার কাছেই প্রকাশ করে নিজের দুর্বলতার কথা। স্বীকার করে, যে, নাস্টেঙ্কাকে সে ভালোবাসে। যদিও এ অনুভূতিকে সে কোনোদিনই নাস্টেঙ্কার মুখোমুখি আনতে রাজি ছিল না, কারণ সে জানে, নাস্টেঙ্কার দেহ মন জুড়ে অন্য একটি নাম ইতোমধ্যেই বাসা করে ফেলেছে। তবু এক শরীর-মন-নিংড়ে-নেওয়া অসহনীয় কষ্টকে মুক্তি দেওয়ার আশায় খুলে দেয় তার মনের গোপন কুঠুরিটি। আর জানানোর অব্যবহিত পরেই মুষড়ে পড়ে অপরাধবোধের দংশনে। তাই নাস্টেঙ্কাকে বলে, “I’d love you so that you would never feel the burden of my love in any way, even you still cared and went on caring for the other man, whom I do not know…. all you would ever feel would be a heart beating constantly beside you, a grateful, ardent heart…” । এরপর তারা দুজনেই এক আশ্চর্য সময় একসাথে অতিবাহিত করে। দুজনের মধ্যে সম্পর্কের যে অভূতপূর্ব রসায়ন, তা যেন চূড়ান্ত সীমা ছুঁয়ে ফেলে ঠিক এইসময়েই। কথক বলে— “we are like two children”। ঠিক দুটি শিশু যেভাবে ভূত ভবিষ্যত ভুলে কেবল তাদের প্রিয় খেলার সামগ্রী নিয়ে খেলতেই থাকে, কখনও কাঁদে, কখনও হাসে, কখনও কথা বলে, কখনও বা কথা বলতেও ভুলে যায়, সেভাবেই এই দুটি মন কিছু সময়ের জন্য তাদের নিজেদের এই পার্থিব সত্তাকে ভুলে যেন স্বর্গের এক কোণে ঠাঁই পেয়েছিল। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়, জয় গোস্বামীর “পাতার পোশাক” কবিতাটি। স্বর্গের জমিটুকু কবি লিখে দিতে চেয়েছিলেন সম্ভবত এমনই কয়েক জোড়া মনের জন্য, যাদের সম্পর্কের কুসুম এই পৃথিবীর মাটিতে প্রস্ফুটিত হওয়া নিষিদ্ধ। নাস্টেঙ্কার প্রেম পুনরুদ্ধৃত হওয়ায় সে ফিরে যায় তার কাঙ্ক্ষিত পুরুষটির কাছে। ফিরে যাওয়ারই তো কথা। তবু নাস্টেঙ্কা যেন রেখে যায় তদুপেক্ষা অধিকতর মূল্যবান কোনো সম্পদ। তাই অনর্গল পিছনপানে ফিরে চাওয়াকেই সঙ্গী করে সে হেঁটে যায় আগামী জীবন গুছিয়ে নিতে। আর এই সত্য তার মনকে কিছুতেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে পারে না, বরং, তার মন থেকে কেড়ে নেয় স্বস্তি, স্বতঃস্ফূর্ততা, সহজভাব।
চারটি রাত অতিক্রান্ত হওয়ার পর যে ম্যাড়মেড়ে সকাল আসে, কথকের ঘরের ভিতরে, বাইরে বিষণ্ন মেদুর আলো। কথক এবার জেনেছে, এই আলোই তার একমাত্র অবলম্বন, আবহমান কাল ধরে যে আলো এসে পড়ে তার ঘরের ঝুলকালি পড়া দেওয়ালে, চেয়ারে, টেবিলে, তার মনের চোরা কুঠুরিগুলোতেও। সেই মুহূর্তেই তার হাতে আসে নাস্টেঙ্কার চিঠি। চিঠিতে সে যেন দিকহারা, কিছুটা লক্ষ্যভ্রষ্ট, নিয়তির অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে। তার জীবন এখন ঠিক তার মনের মতোই সাজানো, অথচ, জীবনের বাকিটুকুর প্রতি তার যেন আর কোনো আগ্রহই নেই। ঠিক এই ভাবনাকেই প্রায় প্রতিফলিত হতে দেখি পরিচালক অভিনন্দন দত্ত পরিচালিত বাংলা মুভি, ‘অনন্ত (The Eternal)’ এ। সেখানেও দুটি চরিত্র, যাদের একে অপরের সঙ্গে রোজ দেখা হয়, সম্ভবত স্বপ্নেই কিছু কথা হয়। মেয়েটি জানায়, সে থাকে রোরো নদীতে। ছেলেটি জানায় তার বাড়িতে জল নেই, শুকিয়ে চরা পড়ে গেছে। এই সম্পর্কটিও অনন্ত বিরহডোরে বাঁধা পড়েছিল। ঠিক সেভাবেই যেন এই গল্পে কথক এবং নাস্টেঙ্কার চলার দুটি ভিন্ন পথ একটি বিন্দুতে এসে মিলে গিয়েছে, পুনরায় ভিন্ন দুটি মুখে বয়ে যাবে বলেই। এই গল্পে কথকের কোনো নাম নেই। কেবল একটিবার মাত্র নাস্টেঙ্কার মুখে শুনি, ‘Mister Adamant’। এ ছাড়া আর অন্য কোনো নামে কথককে কেউ সম্বোধন করেনি এই গল্পে। কথকের চরিত্রটি ঠিক যেন চরিত্র নয়, প্রতিবিম্ব। গভীর রাতের চরাচরে যে নিঃসঙ্গ মন নিঃসঙ্গতার অনিয়ন্ত্রিত উদযাপন করতে চায়, করেও, কিন্তু আদতে মনের অতল গভীরে যত্নে লালন করে ভালোবাসার নিবিড় সাধ, মনের মতো কাউকে মনের চোরাগলির সন্ধান দেওয়ার সাধ, সেই নিঃসঙ্গ মন আসলে হয়তো আমি, কিংবা তুমিও। ক্রমশ ফুরিয়ে আসা, তবু, সুদীর্ঘ এই সফরে বাস্তবের কড়া শাসনে এবং স্বপ্নের যেমন খুশি সাজিয়ে নেওয়ার অমার্জনীয় অবাধ্যতায় যেটুকু সময় কাটলো নিঃসংশয়ে, পূর্বাপর যাঁতাকলে পিষে না গিয়ে, কেবলমাত্র কয়েকটা মুহূর্তে অদম্য তৃষ্ণা নিবারণে— সেটুকুই হয়তো জীবন, সেটুকুই মূল কাহিনী। তাই গল্পটির শেষে কথকের মুখের শেষ উক্তিটি অলৌকিক ক্ষমতায় প্রতিধ্বনিত হতে থাকে পাঠকের অন্তরে, তার চারপাশেও, এমনকি মহাশূন্যে চিরকালীন স্বর হয়ে, যেন অনন্ত প্রেম কেবল কয়েকটি মুহূর্তের নিরিখেই সার্থক হয়ে উঠেছে— “Good Lord! A whole minute of bliss! Why, isn’t it enough even for a lifetime?”। এবং, বিস্ময়কর হলেও, জীবনের পরম সত্যও কিন্তু এইই, যে, আস্ত একটা জীবন দাঁড়িয়ে থাকে এমনই স্বর্ণচাঁপার সুগন্ধ বিজড়িত লোভনীয় কিছু মুহূর্তের উপর, কখনও ভুলতে না পারা, অথবা, কখনও ভুলতে না চাওয়া কিছু অতি দুর্বল মুহূর্তের উপর!