
শ্যামল ভট্টাচার্য-র গল্প
নেকড়ে
সে আবার এসে দাঁড়ালো সেই জায়গাটায় যেখান থেকে বছর পাঁচেকের বাচ্চা মেয়েটা নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলো। পুলিশ ইতিমধ্যে অনেকবার এখানে এসে গেছে। প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাকেও করেছে। সে যদিও ঠিক প্রতিবেশী নয়। একটু দূরে থাকে। পাশের পাড়ায়। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালীন সেখানে তাঁর ঘনিষ্ঠ উপস্থিতি লক্ষ্য করে পুলিশ তার সঙ্গে কথা বলে। যদিও তাকে খুব একটা বিব্রত হতে হয়নি কেননা স্বল্প হলেও, তার একটা লেখক পরিচিতি আছে এবং ওখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান তদন্তকারী পুলিশ কর্মী তার লেখার সঙ্গে পরিচিত তো বটেই, সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে তাকে প্রত্যক্ষ ভাবে চিনতেও পারলেন। মেয়েটি যেখান থেকে নিখোঁজ হয়েছে তা একটা ছোট পার্ক। পাশে পুকুর। পুকুর আর পার্ক রাস্তার ওপারে এবং রাস্তার এপারেই মেয়েটির বাড়ি। এ পাড়ার বাড়িগুলি প্রায় গায়ে গায়ে লাগোয়া। মেয়েটি আর পাঁচ দিনের মতোই পার্কে খেলছিলো। কখনো বন্ধুদের সঙ্গে। কখনো একা একা। কখনো অনেকেই লক্ষ্য করেছে তাকে। কখনো কয়েক মুহূর্তের জন্য হয়েছে অলক্ষিত। এই রকমই এক অলক্ষিত মুহূর্ত থেকেই মেয়েটাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না।
এই পার্কের সামনের রাস্তা দিয়ে সে নিয়মিত যাতায়াত করে। বিকেলে এই পার্কে বাচ্চাদের খেলতেও দেখে। ঠিক কোন্ বাচ্চাটি হঠাৎ করে হারিয়ে গেলো তা নির্দিষ্ট করে চিহ্নিতও করতে পারলো। ওখানে যতো বাচ্চা খেলতো সবাইকেই কেমন খুব আপনজন মনে হতো। কখনো কখনো সে পার্কে গিয়েও বসতো। কখনো এই শিশুটি কিভাবে খেলছে, কখনো ঐ শিশুটি কিভাবে খেলছে, এসব খুব মজা নিয়ে লক্ষ্য করে চলতো।
যে মেয়েটি নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো অথবা অপহৃত অথবা অন্য কিছু, তার বাড়িটা যেহেতু পার্কের ঠিক বিপরীত দিকেই, দিনের অন্য সময় আসা-যাওয়ার পথে তাকে চোখে পড়তো। কখনো বারান্দায়, কখনো নিজের ঘরের জানালার কাছে আপন-মনে খেলে চলেছে। সে কখনো কোনদিন মেয়েটিকে দেখে কিছু বলেনি। কাছে গিয়ে বা কাছে ডেকে আলাপ জমানোর কোনো চেষ্টাও সে করেনি। আসলে এই শিশুটির সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়ে উঠেছিল দ্রষ্টার সম্পর্ক। সাক্ষীর সম্পর্ক। তার হঠাৎ করে এভাবে হারিয়ে যাওয়া তাকে, নিজের অন্তরঙ্গ পৃথিবীর মধ্যে, যেন দৃশ্যশূন্য করে তুলেছিলো। খুব কষ্ট পাচ্ছিলো। যেখান থেকেই হোক, খুঁজে পেতে চাইছে তাই সেই শিশুটিকে।
এইসব ভাবনা নিয়েই সে মেয়েটির বাড়ির বারান্দার কাছে এসে চুপ করে দাঁড়ায়। এই ক’দিনে মেয়েটির বাড়ির লোক বুঝে গেছে তার এখানে আসার কারণ। কিভাবে মেয়েটি এখান থেকে অপহৃত হয়ে গেলো তা সে যে বুঝে নিতে চাইছে সেটা টের পেয়ে, তারা তাকে আর কোনো প্রশ্ন করে বিব্রত করে না। মেয়েটি যে কিভাবে হারিয়ে গেলো সে বিষয়ে কোনো স্পষ্টতা না পেলেও, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে। যখনই সেখানে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে দু-তিনটি বাড়ির পরে আরেকটি বাড়ি থেকে তাকে এক ভদ্রমহিলা লক্ষ্য করে চলেন। যুবতীই। লুকিয়ে নয়। যাতে সে তার এই লক্ষ্য করে চলা বুঝতে পারে সেই ভাবেই সেই যুবতীটি কোনো না কোনো অবস্থানে থাকে। যুবতীটির অবস্থানের এই বিষয়ে তার প্রত্যয় যখন প্রায় প্রতিষ্ঠিত, সে ঠিক করলো, এগিয়ে যাবে। কথা বলবে ওই যুবতীর সাথে।
সেদিনকে সে ওখানে গিয়ে দেখলো, ওই যুবতীটি দাঁড়িয়ে আছে বারান্দাতেই। সে যখন এগিয়ে যাচ্ছে তার দিকে, যুবতীটি এক মুহূর্তের জন্যেও চোখ সরায়নি তার উপর থেকে। যেন তার সঙ্গে কথা বলবার সব রকমের উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরি করবার ব্যপারে সেই যুবতীও যথেষ্ট আগ্রহী।
যখন সে যুবতীটি যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো তার খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, যুবতীটি বলে উঠলো
-আপনি একজন লেখক না?
-হ্যাঁ। একটু-আধটু লিখি বটে।
-আপনার তো ইথোলোজিতে বেশ আগ্রহ আছে। তাই না? পশুদের আচার-ব্যবহার, পশুদের বিভ্রম, পশুদের মিমিক্রি, পশুদের যৌন জীবন এসব বিষয়ে যথেষ্ট অধ্যয়ন করে লেখালেখি করেন না আপনি?
সে এবার একটু অবাক হলো। তার সম্পর্কে অচেনা কেউ, বিশেষত এক অচেনা যুবতী এতটাই জেনে থাকবে, এটা বিস্ময়কর। সে সেই বিস্ময় জড়ানো কণ্ঠেই বললো
-আপনি আমার কি কি বই পড়েছেন?
-পাশবিক আলো পাশবিক অন্ধকার। ঈশ্বরীর আলো ঈশ্বরীর অন্ধকার। এই দুটি বই পড়েছি।
-কোথা দিয়ে কিনলেন, মানে পেলেন কোথা থেকে?
-গতবছর বইমেলাতে।
-আচ্ছা। আমাকে দেখে চিনতে পেরেছেন যে আমিই সেই লেখক?
-আপনার বইতেই তো আপনার ছবি দেওয়া ছিলো। ঠিকানা দেওয়া আছে। আমার স্বামীর ব্যবসার কাজ। ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় আমাদের ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হয়। এই সময়টা আমরা ভাড়ায় থাকি। এখানেও তাই আছি। যখন এদিকে আমার স্বামী বাড়িভাড়ার কথা বললো, তখন আমি আপনার ঠিকানাটা মাথায় রেখেছিলাম। ইচ্ছে ছিলো একদিন যোগাযোগ হবে। কথা হবে। সেটা যে এতো তাড়াতাড়ি ঘটে যাবে তা আমি ভাবতেও পারিনি। প্রথমদিন যখন আপনাকে দেখি একটু জড়তা ছিলো। আজ তিনদিন ধরে আপনাকে একইভাবে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে জড়তা আর নেই।
-বুঝলাম। আপনি জানেন আমি কেন ওই বাড়ির সামনে এই তিনদিন এতোটা সময় ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম?
-জানি। একটি পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়ে নিখোঁজ হয়ে গেছে, তাই তো?
-হ্যাঁ। আপনি কি এই ব্যাপারে সন্দেহজনক কিছু দেখেছেন বা বুঝেছেন? সেসব হয়ে থাকলে আমাকে বলুন বাচ্চাটাকে খুঁজে পেতেই হবে।
-বাচ্চাটাকে আমি চিনতাম। আমারও খুব পছন্দের ছিল মেয়েটা।
-আপনার সঙ্গে আলাপ ছিলো?
-ছিলো তো। ও এর মধ্যেই বেশ কয়েকবার আমার ঘরে এসেছে। কতো গল্প করেছে। খেলেছে।
-তাহলে তো আপনার এই কথা পুলিসকে জানানো উচিত ছিলো। ওরা হয়তো কোনো জরুরি প্রশ্ন উত্তরের মধ্যে দিয়ে কিছু সূত্র পেতে পারতো।
-না। আমাদের মধ্যে তেমন কিছু কথা হয়নি। আর যেটুকু কথা হয়েছে সেসবের মধ্যে কোন সূত্র আছে কিনা তা প্রাথমিকভাবে খুঁজে দেখার জন্য পুলিশকে ডেকে আনা আমার পক্ষে খুব একটা স্বস্তিকর নয়।
-হুম। বুঝতে পারছি। মেয়েটির বাড়ির লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন? বলেছেন এইসব কথা?
-না। বলিনি। তবে আপনি যখন এতোটাই চাইছেন আর যেহেতু লেখক হিসেবে আপনি আমার কাছে শ্রদ্ধার এবং কাঙ্ক্ষিত সেইহেতু আমি একটা প্রস্তাব দিতে পারি।
-কি সেটা?
-আপনি আগামীকাল দুপুরে আমাদের বাড়িতে আসুন। ঘন্টা খানেক সময় একসঙ্গে কাটানো যাবে। আর তখন তার ফাঁকে ফাঁকে আমার চেতনে-অবচেতনে অচেতনে মেয়েটির সঙ্গে যা কিছু কথাবার্তা ঘটেছে, সবই বের হয়ে আসতে পারে। যদি কিছু সূত্র থেকে থাকে,তার ভিতরে, তবে আপনি সেটা বুঝতেও পারবেন আর সেই ভাবে পরের সিদ্ধান্ত নেবেন। যাকে যাকে জানানোর প্রয়োজন হবে, তাকে তাকে সেই ভাবে জানানো হবে তারপর।
সে একটু থামলো। যুবতীটির চোখে মুখে শুধু নয় সারা শরীরে যেন এক উজ্জ্বল আমন্ত্রণ। এরকম আমন্ত্রণ সুলভ নয়। একজন লেখক হিসেবে এরকম আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করা খুব কাজের কথা নয়। যদিও সে যে ভদ্রমহিলার প্রতি কামার্ত অনুভব করছে, তাও নয়। তার মনে হয়েছে এই আমন্ত্রণে সারা দেওয়া তার একটা নৈতিক দায়িত্ব এবং এই নৈতিকতা বিশেষভাবেই একজন লেখকের নৈতিকতা। সে বলে উঠলো
-বেশ। সেটা হতে পারে। তবে আপনার স্বামী উপস্থিত থাকবেন তো? সেটা হলে পুরোটাই স্বাভাবিক হয়।
যুবতীটি হেসে বললো।
-আপনি আসুন না। আপনি এতো কিছু জানেন, আপনার অস্বাভাবিক কিছুই লাগবেনা।
-ঠিক আছে। আগামীকাল দুপুরে আমি এখানে আসছি।
সে বাড়ি ফিরে এসেছিলো। এই আমন্ত্রণ যে দৃশ্যের মধ্যে ঘটে গেল সেটিকে আবার মনে মনে পুনর্নির্মাণ করবার চেষ্টা করলো। টের পেল, যুবতীর সমস্ত কথার ভিতরে, শরীরী ভঙ্গিমার ভিতর কোথাও তার কাছে খুব অচেনা একটা প্রলোভনসঙ্কুল ছন্দ আছে।
পরের দিন ভোররাতে সে একটা স্বপ্ন দেখলো। সে সেই হারিয়ে যাওয়া বাচ্চা মেয়েটিকে খুঁজতে একটা গভীর অরণ্যের ভিতর হেঁটে বেড়াচ্ছে। তার পিঠে ব্যাগ এবং সেই ব্যাগে আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্রও আছে। এক পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা অরণ্যের ভিতর দিয়ে সেও নেমে আসছে উপত্যকার দিকে। দূর থেকে চোখে পড়লো, একটা ফাঁকা জায়গায় একদল নেকড়ে একটা সদ্য শিকার করা কিছুকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। তার বুকের ভিতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো। পিঠের ব্যাগে যেখানে অস্ত্র রাখা সে দিকে হাত বাড়িয়ে অবাক হয়ে গেল কেননা সেখানে তার নিজের হাতে গুছিয়ে রাখা অস্ত্রটি আর নেই। কিন্তু সে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ওই নেকড়ের পালের দিকে যাবেই। গিয়ে বুঝে নেবেই, ওরা সেই বাচ্চা মেয়েটিকে শিকার করেছে কিনা। সে ওই ব্যাগের ভেতরটা আবার ভালো করে হাত ঢুকিয়ে দেখলো। খুঁজে পেলো, কিছু নিজেরই ব্যবহৃত কলম যেগুলির আবার কালি ফুরিয়ে গেছে। সে তারই মধ্যে থেকে একটি ধারালো কলম বেছে নিয়ে দৌড়ে যেতে থাকলো সেই দিকে। কিন্তু পাহাড়ের ঢাল এখনো শেষ হয়নি। নিজের আবেগের বেপরোয়া গতি সামলাতে না পেরে সে সেই ঢাল বরাবর গড়িয়ে পড়লো।
নেকড়েদের দল খুব বেশী দুরে ছিলো না। তারা শব্দ পেয়ে তার দিকে তাকালো। সে মাটিতে পড়ে আছে। ঢাল বেয়ে এখানে গড়িয়ে আসার পথে তার মাথায় হাঁটুতে, হাতের কনুই, কব্জিতে অনেকবার বিভিন্ন গাছে আর পাথরে ধাক্কা লেগেছে। সে এখন রীতিমত আহত। এখনই উঠে দাঁড়ানোর এবং প্রতিক্রিয়া জানানোর কোনো শারীরিক শক্তি তার অবশিষ্ট নেই। নিজেকে সংযত করতে তার একটু সময় লাগবে। তার মধ্যে নেকড়ের দল এগিয়ে আসছে তার দিকে। সতর্কতা তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে। তাদের চোখে যে কোনো মূল্যে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখবার এক ভয়ঙ্কর নৃশংসতা। তাদের ঝকঝকে সাদা দাঁতের আভা নিকটবর্তী হয়ে ঢেকে ফেলছে অন্য সমস্ত দৃশ্য। সে বুঝলো, এখন এই দলবদ্ধ নেকড়ে আক্রমণ থেকে তার বেঁচে ফেরার কোনো উপায় নেই। অথচ তার দশ মিটার দূরে এসেই নেকড়েদের দলটি দাঁড়িয়ে গেলো। তারা তাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছে। তারা যেন বহুদিন ধরেই চেনে তাকে। ওই দশ মিটার দূরত্ব বজায় রেখে প্রায় দশ মিনিট ধরে তাকে বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে ওরা দেখলো। এক শ্বাসরোধী অপেক্ষার ভিতর সে এক অলৌকিক নিস্কৃতির প্রার্থনা নিয়ে শুয়ে রইলো। তারপর দেখলো একটি মাত্র নেকড়ে ছাড়া অবশিষ্ট নেকড়েগুলি ফিরে যাচ্ছে। ওরা পার হয়ে যাচ্ছে ওদের শিকার করে রাখা ওই অর্ধভুক্ত দেহটি।
যে নেকড়েটি রয়ে গেলো সে এখনো তার দিকে তাকিয়ে। সে এই অলৌকিক নিষ্কৃতিকে অনুমান করে নিজের ভেতরের শক্তি একটু একটু করে ফিরে পাচ্ছে। উঠে বসছে। এই নেকড়েটির কাছ থেকেও যে কোনো বিপদ নেই, তা এই নেকড়েটির ভাব এবং ভঙ্গিমার ভিতরে স্পষ্ট। সে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো, এই নেকড়েটি মেয়ে। এবারে এটিও ফিরে যাচ্ছে। তবে খুব মন্থর লয়ে। সে উঠে নেকড়েটিকে অনুসরণ করলো। নেকড়েটি পৌঁছালো ওই অর্ধভুক্ত দেহাবশেষের কাছে। কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে সেও। দেখতে পেয়েছে, এটি সেই হারিয়ে যাওয়া শিশুটির দেহ নয়। বরং এক বাচ্চা নেকড়ের দেহ। সম্ভবত যে নেকড়েটি এবার এই বাচ্চা নেকড়েটির দেহাবশেষ মুখে বহন করে চলেছে, সেই নেকড়েটিই তার মা।
নেকড়েদের দলে এরকম কখনো কখনো ঘটে। পরিস্থিতি প্রতিকুল হলে কখনো কখনো দলের অবাঞ্ছিত নবাগত সদস্যকে তারা খেয়ে ফেলে। এটা নেকড়েদের সমাজে অনুমোদিত। আরো অবশ্য কয়েকটি কারণ আছে যার ফলে এটা ঘটতে পারে, সে নিজেকে এটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই তার ঘুম ভেঙে গেলো। সকাল হয়ে গেছে। উঠে পড়ল সে।
দুপুরে সেই যুবতীর বাড়ি পৌঁছালো। সেই যুবতী ছাড়া বাড়িতে আর কেউ ছিলো না। তার একটা অস্বস্তি লাগা শুরু হলেও সে এখনই ফিরে যাবে না বলে ঠিক করলো। যে অনুসন্ধানে সেখানে এসেছে সেই অনুসন্ধান আগে শেষ হতে হবে। যুবতীটি তার অস্বস্তি বুঝতে পেরেছে। সে বললো
-আসলে আমরা এই ঘর আজকের মধ্যেই ছেড়ে দিচ্ছি। আমার স্বামী সব জিনিসপত্র সরিয়ে নিয়ে গেছেন। শুধু এই খাট আর এই চেয়ার টেবিল আছে। এগুলো এখন যে অবস্থায় এসে পৌঁছেছে সেই অবস্থায় আমরা আর নেব না। এগুলো এখানেই পুরনো নিয়েছিলাম এখানেই ফেলে যাবো।
-আপনারা যখন আজ চলে যাবেন তখন আমাকে এইভাবে আমন্ত্রণ করলেন কেন? এ তো আপনাদের বিব্রত করা। কিন্তু এই বিষয়ে তো আমার কিছু করার নেই। আমি তো জানতাম না। আর আপনার স্বামীই বা কি মনে করছেন?
-তার কাছে এই সবই স্বাভাবিক। আর যে কাজ চলছে তাতে এই মুহূর্তে আমাদের দুজনের একসঙ্গে থাকার দরকার নেই। আমি একটু পরেই সেখানে যাবো। আপনার সঙ্গে কথাবার্তা শেষ হলেই আমি চলে যাব।
-আমি বুঝতে পারছি না, আমি ব্যাকুল ওই বাচ্চাটিকে খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু আপনার সেই ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ নেই বলেই মনে হয়। আপনাকে বেশি আগ্রহী মনে হচ্ছে আমার এখানে উপস্থিত করানোর ব্যাপারে। এর কারণ কি?
-কারণ আছে। আমি চাই আপনি আমাকে নিয়ে লিখুন। অথবা ঠিক আমাকে নিয়ে না হলেও যে সত্য আমি আপনাকে দিয়ে যাব সেটিকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করে কিছু লিখুন। এক লেখকের ব্যাখ্যা ছাড়া অন্য কোনো ব্যাখ্যায় আমার সেই সত্যকে ধরা যাবে না।
তার শরীর-মন সমস্তকিছুই অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত হয়ে এলো কোনো এক সত্যের উন্মোচন হওয়ার এই সম্ভাবনার দিকে। কোন্ সত্যের কথা বলতে চায় এই যুবতী? সে বলে উঠলো
-এই সত্য কি সেই বাচ্চা মেয়েটিকে আমায় খুঁজে দেবে?
-দিতে পারে, তবে দেবে কিনা সে সম্পর্কে যদি এখনই নিশ্চিত আমরা দুজনই হয়ে যাই তাহলে তো সত্যের রহস্যময়তা বলে কিছু থাকে না। কিন্তু সত্য তো রহস্য বর্জিত হয় না কখনো।
-তাহলে কি চান আপনি?
-আমি চাই সেই সত্য পাওয়ার জন্য আপনিও যথাযথ মূল্য দিন।
-কি সেই মূল্য?
-আপনি খুব সন্তর্পনে যে লেখা লিখে চলেছেন এখন সেই সম্পর্কে আমাকে কিছু বলুন।
-শুধু এটুকুই?
-এইটুকু? এটাই তো আপনার একমাত্র রহস্য। আপনার সত্য।
-তা বটে।
-তাহলে কি ঠিক করলেন, বলবেন, কি বলবেন না?
-অবশ্যই বলবো। যদি সেই বাচ্চাটিকে খুঁজে পাওয়ার মতো কোনো কিছু জানতে পারি তাহলে আমি আমার সব রহস্যময়তা, সব সত্যই প্রকাশ করে দিতে পারি।
-তাহলে বলুন।
-আমি ইদানিং নেকড়েদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে একটা কাজ করবার চেষ্টা করছি। নেকড়েরাও তো মানুষের মতো সমাজবদ্ধ জীব। ওদের একটা শৃংখলাবদ্ধ সমাজ আছে, আবার কোনো সামাজিক অবদমন নেই। এইটা আমাকে বেশ আগ্রহী করেছে ওদের ব্যাপারে।
-এমন কিছু কি দেখেছেন যা আপনার কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে ওদের সেই দলবদ্ধ যাপনের ভিতরে?
-হ্যাঁ। দলবদ্ধ জীবনে এতো আন্তরিকতা। অথচ তবু কখনো কখনো কিছু কিছু পরিস্থিতিতে দলের নবীনতম সদস্যটিকে ওরা মাঝে মাঝে খেয়ে ফেলে।
-কিসের জন্য খায় ওরা?
-আনুমানিকভাবে প্রচন্ড খাদ্য সংকটই এর কারণ। অবশ্য অন্য সব কারণও থাকতে পারে। আমার ইথলজি নিয়ে অতোটা বিদ্যে নেই। সবে চর্চা করা শুরু করেছি।
-হ্যাঁ, তীব্র খাদ্য সঙ্কটের কারণেও যেমন হতে পারে তেমন দলের নবীনতম সদস্যকে খেয়ে ফেলার কাজ দলবদ্ধভাবে সবার নাও হতে পারে।
-আপনি এ বিষয়ে জানেন?
-এটা জানি যে এক মেয়ে নেকড়েও তার সদ্যোজাতকে খেয়ে ফেলতে পারে যদি সে প্রবল এক যৌন উদ্দীপনায় তাড়িত হয়। দলের বাদবাকি সদস্যরা কিন্তু তখন সেই দেহাবশেষকে ছুঁয়েও দেখবে না।
-সেকি? এরকমও ঘটে?
যুবতীটি মুখে হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে। সেও নির্বাক হয়ে গেছে। কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র। এরপর সে আরও অবাক হয়ে দেখল, কি অনায়াসে নিজেকে নিরাবরণ করে চলেছে তারই সামনে সেই যুবতীটি। সে কেমন বিবশ হয়ে এলো। কোনো প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা এই মুহূর্তে তার নেই। সে কিছুই বললো না। যেমন চুপ করে বসে ছিলো তেমনই থাকলো। যুবতীটি এখন সম্পূর্ণ নগ্ন। যুবতীটি তার অবস্থা দেখে তাকে বললো
-আপনি কি এখন আর যৌনভাবে সক্ষম নন?
সে কোনো উত্তর দিলো না।
-শেষ কবে আপনার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে?
সে এবারও কোনো উত্তর দিলো না।
-আপনি কি এখন এই অভিজ্ঞতা পেতে চাইছেন না?
সে নিশ্চুপ।
যুবতীটি এসে বসে পড়লো তার কোলের উপরে। তার দুটো হাত তুলে নিজের গলায় রাখলো।
-আপনি এখন গলা টিপে আমায় খুন করতে পারেন। কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই। আমি আপত্তি করবো না। আসলে আমিও ওই মেয়ে নেকড়েগুলোর মতো। যখনই প্রবলতর হয়ে আসে এই তাড়না, আমি এমন অনেক কিছুই করে ফেলি যে আগে থেকে ভাবিনি। নিজেকে সামলাতে পারিনা।
সে এখনো একই রকম বিবশ হয়ে বসে আছে। এসব ক্রিয়ার কোনো প্রতিক্রিয়া, কোনো উত্তর তার শরীরে মনে কোথাও নেই। যুবতীটি তার অবস্থা দেখে একটু হাসল। বললো
-জানেন তো অনেক মাকড়সার প্রজাতি আছে যেখানে প্রতিটি যৌন মিলনের পর মেয়ে মাকড়সাটি পুরুষ মাকড়সাটাকে খেয়ে ফেলে। সেই বিপদ এড়ানোর জন্য কোনো কোনো পুরুষ মাকড়সা যৌনমিলন চলাকালীন অবস্থাতেই ভান করতে থাকে, সে আসলে মারা গেছে। আপনার অবস্থা দেখে আমার সেই কথাই মনে হচ্ছে।
সে টের পেলো এবার যেন ধীরে ধীরে বিবশ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসছে সে। বলে উঠলো
-কিন্তু সেই বাচ্চা মেয়েটা? সে কোথায়?
-মেয়েটিকে প্রথম যেদিন পার্কে দেখি আমার খুব ভালো লেগে গিয়েছিলো। ওর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম, আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল, বাচ্চাটা আমার কাছে আসতেও পছন্দ করতো। আমার সন্তানাদি নেই। হয়নি এখনো। ওই মেয়েটিকে দেখে মনে হতো যেন ও আমারই মেয়ে। যে সময়ে সন্তান চেয়েছিলাম সেই সময়ের জন্ম নিলে কেউ এই বয়সেরই হতো।
-এ তো ভালো কথা।
-না। আমার কাছে এটা ভালো কথা নয়। যতো ওকে কাছে পেতাম ততোই আমার যৌন কামনা বেড়ে যেতো। অথচ স্বামী সঙ্গ দিনের পর দিন শুধু নিষ্ফল। মনে হতো এই মেয়েটি যতোদিন আমার নিজের সন্তানের মতো মনে হবে ততোদিন আমার নিজের গর্ভে কেউ আসবে না। ও যদি চলে যায় তবে কেউ আসতে পারে।
-এ তো এক ভয়ঙ্কর মনে হওয়া।
-তা স্বীকার করি। ওই মেয়ে নেকড়েগুলো যারা এইভাবে খেয়ে ফেলে তাদের নিজের সদ্যোজাত সন্তানকে তাদেরও তো এমনই ভয়ঙ্কর মন তৈরি হয়ে যায়, এড়াতে পারে কী?
সে স্থির হয়ে চেয়ে রইলো যুবতীটি চোখের দিকে। সে এখনো নগ্ন অবস্থাতেই বসে আছে তার কোলের উপরে। সে যুবতীটিকে সরাসরি প্রশ্ন করলো
-আপনি কি বাচ্চাটিকে মেরে ফেলেছেন?
-না। তবে সে আমার কাছেই আছে।
-কোথায়?
-পাশের ঘরেই আছে। ঘুমাচ্ছে। আমি এই চারদিন ওকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে রেখেছি। প্রয়োজনে ইনজেকশন দিয়েছি। মেরে ফেলার কথা ভেবেছিলাম বটে, কিন্তু পারিনি। সম্ভব হয়নি।
-তাহলে আমাকে ঠিক কি কারণে ডাকলেন?
-যাতে আমার এই কথাগুলো আপনি বুঝতে পারেন। যাতে মেয়েটিকে আপনি তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। এসব কথা পুলিশের কাছে বলে কোনো লাভ নেই।
-কিন্তু আমি তো আপনাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারি।
যুবতীটি একইরকম মুখে হাসি রেখে বললো।
-সেই ব্যাপারে আমার কিছু বলবার নেই। এটা আপনার সিদ্ধান্ত। তবে বাচ্চাটার এই চার দিনে আমি সম্পূর্ণ পরিচর্যা করেছি। শুধু অজ্ঞান করে রাখা ছাড়া অন্য কোনো অত্যাচার আমি করিনি। খাইয়েছি আর যা যা করা দরকার সবই করেছি। এবার আপনার সিদ্ধান্ত।
যুবতীটি এবার উঠে দাঁড়ালো। উঠে দাঁড়ালো সেও। মেঝেতে পড়ে থাকা কাপড়গুলি তুলে যুবতীর শরীর ঢেকে দিতে দিতে সে বললো
-আমি পুলিশকে ডাকছি। তবে সময় নিয়ে। আমি এই ঘরেই আরো খানিকক্ষণ বসে থাকবো। নেকড়েদের নিয়ে যে উপন্যাসটা লিখছি সেটার আরও কয়েকটি পৃষ্ঠা লিখবো। সংশোধন করবো। তারপর ধীরে সুস্থে পুলিশের কাছে যাবো। পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে ওই শিশুটিকে তার পরিবারের হাতে তুলে দেবো। আপনার সম্পর্কে যা বলার বলবো, তবে এটুকু সময়ের মধ্যে আপনি যান, আপনার স্বামীর সঙ্গে দেখা করুন। তারপর চলে যান যে দিকে যাওয়ার। আমি এখানেই রইলাম।
যুবতীটি একটা একটা করে ঢেকে নিতে থাকলো প্রকাশ্য হয়ে পড়া নিজের সবটুকু নগ্নতা। সে চোখ সরালো। নিজের হাতের মোবাইল খুললো। গুগল ডক সাদা আমন্ত্রণ হয়ে ভেসে উঠলো মোবাইলের স্ক্রিনে। সে লিখতে থাকলো।।