
পর্ণশবরীর কথকতা ১১
প্রাপ্তি চক্রবর্তী
এমন অনেক সময় হয় আমি যেটা লিখব বলে ভাবছি তাকেই হয়তো কিছু অন্যরূপে কেউ লিখে রেখেছেন আগে। একটা কিছু পড়তে গিয়ে বিশেষ ভাবনা ঠোকর দিয়ে উঠে জানান দেয় এই তো! এই তো! ছেলেমানুষি প্রলম্বিত হলে ভাবতেম আমার লেখা, আমার ভাবনা চুরি হয়ে গেছে স্বপ্নের মধ্যে। গোড়া শুদ্ধ তুলে নিয়ে গিয়ে নিজের জমিনে বসিয়েছেন কেউ, এখন তাকে জাগিয়ে তুলতে গেলে বাগান দেখতে আসা মানুষেরা বলবেন ‘ও তো ঐ বাগানের গাছ।’
ছেলেমানুষি গিয়েছে বলে বুঝি আমাদের ভাবনাগুলো এক জায়গায় একই। সব যুগে সব শিশুর প্রথম খেলা, প্রথম হাসি যেমন এক- তেমনই। একটা জিনিস বুঝি এখন, আমরা যাঁরা সত্তর, আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকের শিশু তাঁদের যাপনটা মোটের ওপর একই ঠাটে বাঁধা ছিল। রাগিনী হয়তো তা থেকে নতুন নতুন উঠতো, কিন্তু মূলের কাঠামোটি এক। অল্প-বিস্তর আমাদের সকলের প্রিয় মহম্মদ রফি সাহেব, হেমন্ত কিংবা মান্না দে, গুলজারের ছবি, সৌমিত্র, সাবিত্রী, অপর্ণা কিংবা কিশোরকুমারের বেদনাবিধুর জলদগম্ভীর কণ্ঠের গানগুলি। এবং আরো অন্য অনেক কিছু যা এক ফর্মায় লিখে শেষ করা যাবে না।
আমরা যাঁরা মফস্বলি শিশু আর যাঁদের গ্রামজীবন দেখার একটা সুযোগ হয়েছিল জীবনের অন্তত একটি সময়ে তাঁদের পুকুর কিংবা ছোট নদীটিতে বেলা পার করে ঝাঁপিয়ে এবং দাপিয়ে চলার স্মৃতি সার্বজনীন। এরমধ্যেও রকমফের আছে নিশ্চিত। যে শিশু দুষ্টু-দামাল, হাতে-পায়ে, সে বাইর-বাড়িতে সময় কাটিয়েছে বেশি। কথাটা বাহির বাড়ি বা বাহিরবাটি। খাসবাঙালের পূর্বপুরুষের ভাষায় তা বাইর-বাড়ি হয়েছিল। তো যা বলছিলাম, দামাল শিশু তার পঙ্গপালের মতো বন্ধুবৃত্ত দিয়ে নিজেদের এবং অন্যের বাগানে একইরকম উৎসাহে কুল, বুকে লাল জমিয়ে রাখা মিঠে পেয়ারা কিংবা আম অথবা জাম লুঠের পরিকল্পনা সাকার করে লঙ্কা-মরিচ সহযোগে বনভোজন চালায়। আর যে শিশু কুনো, সে অন্দরমহলের মধ্যে থাকা ঘরোয়া বাগান আর টিউকলের পাশে লতিয়ে ওঠা নীল অপরাজিতার পাতার নাচন দেখে মহাখুশি। আমাদের এককালের বৃহৎ পরিবার যুগে যুগে এই দুই শিশুকেই পেয়েছিল নিবিড় করে। আর সেই যুগ যুগ ধরে চলে আসা উত্তর আর দক্ষিণের বৈপরীত্যে থাকা নানা শিশুর কথা আমাদের স্মৃতিতে ধরা থাকে পুরুষানুক্রমে।
দামালপনা আর কুনোভাব দুইয়ের সামঞ্জস্যে গদ্যের চলন হয় সহজ। কোনো একটি দিক নিয়ে জীবন নয়, কোনো একটি দিক দিয়ে জীবনকে পূর্ণ গোলোকে পাওয়া যায় না। চুপ থেকে ঘরেরটুকু দেখব আবার ঘাটে গড়াগড়ি করা দামাল শিশুর হাত-পায়ের ধুলো দেখব, তাকে স্বীকার করব- তবেই না স্মৃতির ভাঁড়ার পূর্ণ হয়ে গল্প হবে সকলের।