
উপাসনা দাশগুপ্ত-র গল্প
এক টুকরো চাঁদ
ঢং ঢং ঢং।
‘যাঃ! বারোটা বাজতে মাত্র তিরিশ মিনিট বাকি? এখুনি বেরোতে হয় তাহলে!’
দুম করে দরজা খুলে দৌড়াতে দৌড়াতে সবুজ বেরিয়ে গেল।
দুটি বন পেরিয়ে তারপর আসে জলছবির মাঠ। সেই মাঠের ওই দূরের প্রান্তে যেখানে রোজ চড়ুইরা বসে গান গায়, সেখানে একটা বটগাছ আছে। সেই বটগাছটার পেছনে ঝোপে ঢাকা পাঁচিলটা পেরোলেই রামধনুর পথ। সেই পথ দিয়ে হেঁটে গেলে আসে সোনালি এক ঝরনা। আর ঠিক বারোটার সময় সেই ঝরনার জলে ডুব দিলে পৌঁছে যাওয়া যায় আর এক পৃথিবীতে। সেই পৃথিবীতে চাঁদে পৌঁছোনোর এক লুকোনো সিঁড়ি আছে।
সবুজ রায়গঞ্জের এক ছোট্ট বামন। সারাটা দিন ধরে, ‘ছিঃ, ছিরিখানা দেখ একবার’, এটাই বোধহয় সবচেয়ে বেশি শুনতে হয় তাকে। তার একটাই শখ। সেই লুকোনো সিঁড়িকে খুঁজে বার করা। তারপর সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে চাঁদের এক টুকরো এই পৃথিবীতে নিয়ে আসা। রোজ বারোটায় সে যায় সেই লুকোনো সিঁড়ি খুঁজতে। চারশো আটটা উপায়ে এর আগেও সে চেষ্টা করেছে। আজ চারশো নয় নম্বর দিন। লোকে বলে, ‘বামন হয়ে চাঁদ ধরার স্বপ্ন কি মেটে?’ আর সবুজ ভাবে, সঠিক উপায়টা আজই কী তবে সে খুঁজে পাবে?
কেউ বা বলে, ‘চাঁদ যদি অতই সহজ হত ধরা, তাহলে তা চাঁদ কই থাকত?’ সবুজ তাদের জবাব দেয়, ‘সোনা পরনে থাকলে তা বুঝি আর সোনা থাকে না?’ সে ভাবে, চাঁদ ধরার স্বপ্ন বামুনের থাকতে নেই একথা হৃদয় কী জানে? স্বপ্ন কী একথা ভেবে আসে যে সে বামুনের মনে আসছে? স্বপ্ন এসব বোঝে না বলেই বোধহয় ভয়ও পায় না আসতে। লোকের থেকে আর কিছু শুনতে তো তার বাকি নেই! তাই বোধহয় তার কিছু হারানোর নেই। তার মন অবুঝ।
আগুনের তাপ কত না জানলেই বোধহয় নির্ভয়ে আগুনের কাছে গিয়ে আলোটা নেওয়া যায়। আজ সবুজ ঠিক বারোটার সময় ঝরনার জলে ঝাপ দিয়েই অন্য এক পৃথিবীতে পৌঁছে গেল। সেখানে রয়েছে অচেনা এক পথ। সেই পথেই সে হাঁটা দিল।
এক ঘন্টা হাঁটার পর মনে হল দূরে কী যেন দেখতে পাচ্ছে। কাছে গিয়ে বুঝতে পারল, দূরের জিনিসটা ঠিক কী। মেঘের সিঁড়ি! পেয়ে গেছে। সে সফল হয়েছে। এক পা, দু–পা করে আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বেলা হয়ে গেল। চারপাশে তারাগুলিও জ্বলে উঠল। অন্ধকার না হলে তাদের দেখা যায় না যে! জোনাকির মতো সবুজের চারপাশে এখন কত তারা! চোখের মণির ওপর প্রতিবিম্ব ভেসে উঠছে সেই সব তারার।
সামনে উজ্জ্বল কী যেন চোখে পড়ছে। কী ওটা? ওই তো চাঁদ! বামন হয়ে সে কী তবে চাঁদ পেয়ে গেল? সত্যিই তো! ওই তো চাঁদ! কাছে গিয়ে চাঁদের একটা টুকরো ভেঙে নিল সে। তারপর ধুতির কোঁচড়ে গিঁট বেঁধে সেটাকে রাখল। আজ চারশো নয় নম্বর দিনে সে সফল হয়েছে! চাঁদ নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এল সবুজ।
কথা রটতে সময় লাগে না। ওই যে রাজু তাকে নিয়ে কৌতুক করত, এখন এসে তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। ওই যে রাখাল তাকে দেখে হাসত, আজ সে চাঁদ দেখতে এসেছিল মিষ্টি নিয়ে। লম্বা হয়েও তারা তাকে উঁচু চোখে দেখে। তারা তার সামনে ঝোঁকে। বামন হলেও তাকে তারা বড়ো মনে করে। আসলে যার কাছে চাঁদ আছে, সে বামন হলেও, মানুষের চোখে সে রাজা। মানুষ মানুষকে ছোটো করে আর বামনকে ছোটো করাটা সহজ। কিন্তু মুকুট বোধহয় মানুষের শারীরিক উচ্চতা দেখে মাথায় বসে না। সাফল্য দেখে বসে।
সবুজ এখন বসে বসে ভাবে, যদি চারশো আটটা নিস্ফল উপায় দেখে সে দমে যেত, তাহলে চারশো নয় নম্বর সাফল্যটাও সে পেত না। ঘরে তার বাতি লাগে না আজ। চাঁদের আলোই আঁধার দূর করে। চারশো আটবার চেষ্টা করেও বিফল হয়ে ভারাক্রান্ত হলে সে চাঁদ পেত না। আজ অন্ধকারেই তাকে বসে থাকতে হত!