
বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় -এর গল্প
সুন্দরীর গোপন কথা
পর্ব ১
সে বালিকা না কিশোরী সে নিজেই জানে না। অট্টালিকার প্রাচুর্য তাকে টানে না। কিন্তু এই হর্ম্যের রহস্য তাকে আকর্ষণ করে।কেন করে সে বোঝেনা।
এই যে পাখিটি বারান্দায় উড়ে এসে জুড়ে বসল তার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হয়… তার গায়ে এত রঙের বাহার।কেন?সে এগিয়ে যায়।তার কৌতুহল আন্তরিক। পাখি তাকে বিশ্বাস করেনা। একটা বিচিত্র শব্দ করে উড়ে যায়। সকালের অপরূপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। উদ্যান পরিপাটি। তার চোখে মুখে মৃদু আনন্দ ও বিস্ময়।সে এখন কী করে? প্রত্যেক নারী কি এই সংশয়ে ভোগে? সদ্য বালিকার সব প্রশ্নের উত্তর হয়না।
সে নিজের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়। তৎক্ষণাৎ ছুটে গিয়ে নিজের কক্ষে দর্পণে নিজেকে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।তার চোখ এতো গভীর আর টানা টানা? তার ভুরু আর চোখের পাতা এতো সুন্দর?এতো দীর্ঘ আর কালো তার চুলের ঐশ্বর্য?সে এখনই ৫ ফুট ৫, আরও লম্বা হবে?,,,তার আঙুল, তার নখ,তার কটিদেশ, তার পায়ের গড়ন এ সব কবে হল? কীভাবে হল?সে রঙ লাগায় না। তবু তার ওষ্ঠ, তার হাত ও পায়ের নখগুলো এতো উজ্জ্বল।সদ্য অঙ্কুরোদগম হয়েছে তার। ব্যথা লাগে কোথাও তবু সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই সামান্য উদ্ভাসিত মুকুলের দিকে।যেন এক মহা সমারোহে প্রকৃতির মতো সেও বেড়ে উঠছে। শুধু সেই অদৃশ্য জায়ফলটিকে সে চেনেনা।
তার একটাই অভাব যে তার কোনো অভাব নেই।
স্নানের ঘর থেকে পরিচ্ছন্ন হয়ে আসার পর সে কিছুক্ষণের জন্য তার একাকীত্ব হারিয়ে ফেলবে। এটাই এ বাড়ির নিয়ম। প্রাতরাশ টেবিলে সাজিয়ে রাখা টাটকা ফল,ফলের রস,দুধ, ডিমের পোচ, ওটস ইত্যাদির মধ্যে সে পছন্দ মতো খাবার বেছে নিতে পারে। সেই স্বাধীনতা সে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে দুবছর আগে।
তার মা একজন গরিষ্ঠ সমাজ কর্মী.. ব্যস্ত মানুষ।
তার বাবা এই উপনগরীর সম্মানীয় আইনজীবী।সে তাদের একমাত্র সন্তান। পৈতৃক সূত্রে অর্জিত এই সুরম্য অট্টালিকা রক্ষা করতে লোকবল ও অর্থ লাগে।যা তাদের আছে।
সে এখানকার সবচেয়ে অভিজাত বালিকা বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে।
গাড়িতে করে ইস্কুলে যাওয়া আসার ফাঁকে সে দেখতে পায় পায়ে হেঁটে, সাইকেল রিক্সায় , ভ্যানে চেপে মেয়েরা ইস্কুলে যায়। তাদের বিনুনির মধ্যে খেলা করে হালকা রোদ্দুর,পাশ থেকে উড়ে আসে পতঙ্গের মৃদু গুঞ্জন।দূর থেকে এসব দেখতে তার ভালোই লাগে।
এই বালিকার কি কোনো নাম নেই? অবশ্যই আছে। নামে কি আসে যায়?
তার ক্লাসে মহিমা নামে একটি বালিকা আছে। তথাকথিত সুন্দরী সে নয়। কিন্তু পড়াশোনায় তুখোড়।সে অবলীলায় প্রথম হয় পরীক্ষায়.. অবহেলায় সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। অঙ্কের জটিল সমীকরণ থেকে বিজ্ঞানের ল্যাবে তার সহজ যাতায়াত।
মহিমার সঙ্গে তার স্বাভাবিক সম্পর্ক। বিত্ত তাদের মধ্যে ব্যবধান হয়ে ওঠেনি।
পর্ব ২
দু বছর আগে এক গ্রীষ্মের দুপুরে সে ঋতুমতী হয়। একেবারে অপ্রস্তুত হয়েছিল তাও নয়। তার একটা মানসিক প্রস্তুতি ছিলই। ক্লাসের কেউ কেউ এই অভিজ্ঞতার কথা তাকে আগে বলেছিল। তার মা তাকে জানিয়েছিলেন কী হয়,কেন হয়,কী কী হতে পারে।
সেই জানা অজানার মধ্যে নারীদের মহাবিশ্বে অনেক ব্যক্তিগত দুর্গ রহস্য থাকে…
যা বই পড়ে জানা যায়না। মহিমা বলেছিল ওকে। কিছু কথা।
রেহানা বলেছিল সম্পূর্ণ অন্য গল্প। নারীবিশ্বে এরকম কত কথা থাকে।
তারপর একদিন কৌশিক আসে এক সন্ধ্যায়।
কৌশিক মিত্র।৫ ফুট ৮! বেশ কালো। মোটা গোঁফ। চোখে বিদঘুটে চশমা। মায়ের অধীনে কাজ করা ছন্দা মাসির একমাত্র ছেলে। এবং ডাক্তার।ওর সেদিন খুব জ্বর। বাবার বন্ধু ডাক্তার কাকু এ তল্লাটে নেই। শহরে গেছেন কি একটা কাজে।
তাই কৌশিকের আগমন।
কৌশিক দেখতে এসেই প্রশ্ন করল, মাসিক হয়?
ওর মা’র ভুরু কুঁচকে গেল।
ও বলল, হাঁ হয়। কেন?
এমনি।
তারপর :বারবার হচ্ছে?
কী হবে?
ইউরিন।
হ্যাঁ হচ্ছে।
জ্বালা করছে?
অল্প।
এরপর ওর উন্মেষের দিকে তাকিয়ে স্টেথোস্কোপ বসালো বুকের উপর দিকে। তারপর নিচে। তারপর পাশে। শেষে পিঠে।শ্বাস নাও। ছাড়ো।
ওর শোনার পদ্ধতি থেকে বোঝা গেল ও জ্বরের কারণ নিয়ে খুব একটা নিশ্চিত নয়।
রক্ত পরীক্ষা লিখেছিল বটে। কিন্তু সেসব করানো হয়নি।চা না খাইয়ে কৌশিককে বিদায় দিয়েছিল তার মা।বোঝাই যাচ্ছিল বেশ বিরক্ত। কৌশিকের ওপর।
ওর কিন্তু মজা লেগেছিল। কৌশিকের সারল্য ও রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থতা দুটোই কিছুটা মজার।রাগ হয়নি।
ওর মামাতো দাদা দিবাকর কিন্তুএকটুও মজাদার নয়। চোখ দেখলেই বোঝা যায় ও গোয়েন্দার মতো কিশোরীদের শরীরের রহস্য ভেদ করতে চায়। এবং নিজের হাত ও আঙুলের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে অঘটন ঘটাই স্বাভাবিক।
ও একদিন সবার সামনে বলল: দিবাকরদা, তুমি আজ আমাকে স্নান করিয়ে দেবে। তুমি নাকি খুব ভালো স্নান করাতে পারো?আজ আমার সময় আছে। এসোনা।
হতভম্ব দিবাকর আমতা আমতা করছে দেখে ও বলল, কেন? আগেরবার তুমি তো আমাকে বললে,করিয়ে দেবে…সেবার আমার সময় ছিল না।তাই।
এরপর দিবাকর বেচারা আর এ বাড়িতে আসে না। আসার মুখ নেই।ও ইচ্ছে করেই এটা করেছিল।
এগুলো খালি একজন রূপসী ধনী বালিকার গল্প নয়। প্রতিবাদী, শিক্ষিত, গরিব, ছোটলোক,হা-ঘরে,লোভী ও নিন্দুক সব মেয়েদের কাহিনি। হয়তো একটু রকমফের আছে। তার বেশি কিছু না।
আসলে ‘সুন্দরী’ এখন একটা বাতিল শব্দ।
মিসোজিনিস্ট এবং বর্জনীয়।
কিন্তু অনেক তথাকথিত সুন্দরী মেয়ে তার অন্তর্গত জায়ফলটিকে প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে সযত্নে লালন করে থাকে। নিজস্ব চৌম্বক ক্ষেত্র সম্পর্কে সে আদৌ অবহিত নয়। ফলত প্রতারিত লোহাখন্ডগুলি বারবার তাদের শক্তিক্ষয় করে। বিস্ফারিত বিস্ময়ে সে দেখতে পায় বহুলিপ্সার পতন ও মূর্ছা।
তারপর একদিন অস্তগামী যৌবনের মায়াবন্দর থেকে শেষ জাহাজ ছেড়ে গেলে অবসাদ ও নিরাপত্তার দোলাচলে দুলতে দুলতে সেই নারী অপস্রিয়মান চৌম্বক ক্ষেত্রের অস্তিত্ব টের পায়। কিন্তু ততদিনে তার চুম্বক এক নির্জীব লোহাখন্ডে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।
সেই রমণীর,সেই গতযৌবনা রূপসীর নিঃশব্দ আর্তনাদ তার সঙ্গী পুরুষটি জানতেও পারেনা। তবে অন্য কেউ তার আর্তনাদকে প্রলাপ ভেবে বসে এবং মুখবই এর দরজায় আলতো কড়া নাড়ে।আর হৃদয়ের সাবমেরিন থেকে উঠে আসা শিকারী যুবক এই সুযোগে কৃতার্থ যমুনার অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা জায়ফলটিকে চুরি করে পালিয়ে যায়। আতঙ্কিত সুন্দরী দর্পণে নিজের মুখ দেখে যৌবনকে অভিশাপ দিয়ে আরও পুরুষ বিদ্বেষী হয়ে ওঠে।আর হেমন্তের সন্ধ্যায় পাতা ঝরার শব্দের মতো ভেসে আসে প্রকৃতির নীরব অট্টহাসি।
বালিকা এতসব বোঝেনা।তার অট্টালিকায় ঘাম নেই, অর্থ আছে। তার অপচয় নেই।
কোনো এক বিকেলে অনুপস্থিতির উদযাপন উপলক্ষে সে মুঠোফোনে মহিমাকে কল দেয়।ফোন বেজে যায়। মহিমা ধরেনা। তখন সে টিউশনে।..নোট নিতে ব্যস্ত।
আকাঙ্খা ও পিপাসা র দোলাচল থেকে বহু দূরে, ঘামে ভিজে, ক্লান্ত ও অসুন্দর মেধাবী মেয়েটি, এই মহিমা, অতি দ্রুত শরীরে কিশোরী এবং মনে ও মননে যুবতী হয়ে ওঠে।