গাবোর শেষ স্বাক্ষর
স্বর্ণেন্দু ঘোষ
‘বইটা দাঁড়ায়নি। ওটা অবশ্যই নষ্ট করে দিও।’ মৃত্যুর আগে বইটিকে নিয়ে গাবো অর্থাৎ গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের এটাই ছিল ইচ্ছে। তাঁর দুই পুত্র রড্রিগো ও গঞ্জালো গার্সিয়াকে তাঁর এই ইচ্ছের কথা জানিয়ে ছিলেন। বইটির স্প্যানিশ নাম ‘এন অগস্তো নস ভেমস’ যার অর্থ ‘আগস্টে দেখা হবে’। ইংরেজি অনুবাদের নাম ‘আনটিল অগাস্ট’।
পুত্রেরা কিন্তু বইটিকে নষ্ট করলেন না, বরং যত্ন নিয়ে আরম্বরের সাথে তাঁদের পিতার দশম প্রয়াণ বার্ষিকীতে প্রকাশ করলেন। বিশ্বাসঘাতকতা, তাই নয় কি? সেই জন্যেই তো পুত্রদের জন্ম! বইটির ভূমিকায় দুই পুত্র লিখছেন, ‘আমরা বইটিকে নষ্ট করিনি। বইটিকে সরিয়ে রেখেছিলাম এই আশা নিয়ে যে, সময় একদিন এর ভাগ্য নির্ধারণ করবে। তাঁর মৃত্যুর দশ বছর বাদে বারবার পড়তে পড়তে বুঝলাম বইটির মধ্যে অনেক মহৎ কীর্তি ও সাধনা রয়েছে। কিছু তাপ্পি কিছু অসঙ্গতি থাকলেও গাবোর সাহিত্যের অসামান্য দিকগুলো উপভোগ করতে কোনও বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।’ তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি, ভাষার কাব্যিক প্রয়োগ, গল্প বলার ক্ষমতা, তাঁর মানব মনস্তত্ত্ব বোঝার ক্ষমতা আর দুঃসাহসিক প্রকাশ ক্ষমতা বিশেষ করে তিনি যখন প্রেমের কথা লেখেন, সবই রয়েছে বইটিতে। পিতৃদেবকে প্রতারিত করার ব্যাপারে রড্রিগো ও গঞ্জালো গার্সিয়ার অজুহাত খুব স্বচ্ছ। তারা বলছেন, ‘ বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপারে বলতে গেলে আমরা তাঁর পাঠকদের আনন্দকে প্রাধান্য দিয়েছি। যদি পাঠক আনন্দ পান তবে হয়তো গাবো আমাদের ক্ষমা করে দেবেন – আমরা বিশ্বাস করি।’
১৯৯৯ সালে মাদ্রিদে ‘কাসা দে আমেরিকাতে’ গাবো বক্তৃতা দিতে গিয়ে শ্রোতাদের অবাক করলেন। বক্তৃতা না দিয়ে তিনি ‘এন অগস্তো নস ভেমস’ নামে একটি ছোটগল্প পাঠ করলেন। এই গল্পটি ছিল এখনকার মূল উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম খসড়া। তিন দিন পর স্প্যানিশ খবরের কাগজ, ‘এল পাইস’ প্রকাশ করল গল্পটি। একই বছরে এই গল্পটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হবে দ্য নিউ ইয়র্কার পত্রিকায়। পৃথিবী জুড়ে গাবোর ভক্তরা জানলেন, পাঁচটি গল্পের একটা সংকলন আসতে চলেছে যার প্রতিটিতেই মুখ্য চরিত্রে রয়েছন একজন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বিবাহিত মহিলা যার নাম, অ্যানা মাগডেলিনা বাখ। গল্পগ্রন্থ হিসেবেই বইটি প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল। তারপর অনেক স্রোত বয়ে গেছে নদীতে। ২০০৩ সালে উপন্যাসটির আরেকটি অংশ প্রকাশিত হল কলম্বিয়ান পত্রিকা ‘কাম্বিও’তে যার নাম ‘দ্য নাইট অফ দ্য এক্লিপ্স’। এরপর থেকে ২০০৪ সালের শেষ পর্যন্ত গাবো এই উপন্যাসটির ওপর কাজ করলেন এবং পঞ্চম ড্রাফটে গিয়ে থামলেন।
তারপর দীর্ঘ ১৯-২০ বছরের নীরবতা। মার্কেসের সকল পাঠক হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন উপন্যাসটির কথা। ২০২৩ সালে আবার শোনা যেতে থাকল গাবোর পুনরাবিষ্কৃত উপন্যাস প্রকাশিত হতে চলেছে। বিশ্বের সাহিত্য মহল আবার নড়ে চড়ে বসল। অবশেষে এবছরের মার্চ মাসে পাঠকের হাতে এল বহুপ্রতীক্ষিত উপন্যাস। যদিও আয়তনের নিরিখে উপন্যাস বলা চলে না বরং নভেলা বলা যেতে পারে। গাবোর পরিকল্পনা অনুযায়ী এটি প্রায় ৬০০ পাতার একটি উপন্যাস হওয়ার কথা কিন্তু আমরা হাতে পালাম মোটামুটি ১০০ পাতার একটি উপন্যাস। ভূমিকা, সম্পাদকীয় নোট ইত্যাদি নিয়ে বইটির আয়তন আরও কিছুটা বেশি। একবার বসেই বইটি অনায়াসে পড়ে ফেলা যায়। সুতরাং এটুকু স্পষ্ট যে গাবো যা দিতে চেয়েছিলেন তা থেকে পাঠক কতটা বঞ্চিত। আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা বইটির মূলত পঞ্চম খসড়াটি পড়ছি। মার্কেস ছিলেন অত্যন্ত পারফেশনিস্ট। সামান্য ছোটগল্পও তিনি ১২ থেকে ১৪ বার বদল করতেন এবং তারপর তাঁর মনের মত হত। গাবো মৃত্যুর আগের দশটা বছর ডিমেনশিয়া আর ক্যান্সারে ভুগছিলেন। ‘আনটিল অগাস্ট’ নিয়ে তিনি এবং তাঁর সম্পাদক ক্রিস্তবাল পেরা আবার যখন বসলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তার স্মৃতি আর তাঁর সাথ দিচ্ছে না। তিনি কাহিনীর সূত্রগুলো ভুলে ভুলে যাচ্ছেন, মেলাতে পারছেন না। ডিমেনশিয়া ততদিনে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে ফেলেছে তাঁর মনে রাখার ক্ষমতা। মনে রাখতে না পারার জন্য তিনি ভীষণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন শেষের দিকে। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘স্মৃতিশক্তিই আমার লেখার তাৎক্ষনিক রশদ এবং সহায়ক যন্ত্র। এটা নেই মানে কিছুই নেই।’ সত্যিই তো আমারা যদি তাঁর পৃথিবী বিখ্যাত উপন্যাসগুলো দেখি বা তাঁর জীবিত অবস্থায় প্রকাশিত শেষ উপন্যাসিকা ‘মেমরিস অফ মাই মেলানকলি হোরস’-এর দিকে তাকাই তবে বুঝতে পারব ‘আনটিল অগাস্ট’ গাবোর সেসব মহান কীর্তির ধারে কাছে আসে না। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে মিলান কুন্দেরার কথা মনে আসবে; মুখ্য চরিত্রের সাহিত্য পাঠ, বিভিন্ন বইয়ের রেফারেন্স এবং ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল মিউসিকের রেফারেন্স পাঠককে মনে করাবে হারুকি মুরাকামির কথা, কিন্তু পাঠক যেটা পাবেন না তা হল গাবোর ফিনিশিং টাচ।
উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র অ্যানা মাগডেলিনা বাখের জন্ম একটি সঙ্গীতজ্ঞ পরিবারে। বিখ্যাত মিউসিক কম্পোজার ইয়হান সাবেস্টিন বাখের স্ত্রী অ্যানা মাগডেলিনার নামে তার নামকরণ। উপন্যাসটি যখন শুরু হচ্ছে তখন তার বয়স ছেচল্লিশ বছর। সাতাশ বছর আগে অক্ষত কুমারীত্ব নিয়ে বিয়ে করেন এমন একজন পুরুষকে যিনি নিজেও একজন অর্কেস্ট্রা কন্ডাক্টার। দীর্ঘ সাতাশ বছরে এই পরমাসুন্দরী নারী তার নিজের স্বামী ছাড়া দ্বিতীয় কোনও পুরুষকে কখনও কোনও স্থানই দেননি।
অ্যানা মাগডেলিনার মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের ইচ্ছে মত সমাধিস্থ করা হয়েছিল অনিন্দ্য সুন্দর ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপে। ১৬ই আগাস্ট, মায়ের প্রতিটি প্রয়াণ বার্ষিকীতে সমাধিতে একটা পুষ্পস্তবক রেখে আসেন অ্যানা। বিকেলের ফেরিতে তিনি একাই পৌঁছে যান দ্বীপে একই ট্যাক্সিতে উঠে একই হোটেলে ওঠেন, বিকেলে একই ফুলের দোকান থেকে গ্ল্যাডিওলি ফুলের স্তবক কিনে নিয়ে মায়ের সমাধিতে যান। ফিরে এসে রাতটা গরম আর লোডশেডিং-এ কোনও রকমে রাতটা কাটিয়ে সকালের ফেরিতে শহরে ফিরে আসেন। এমনই এক প্রয়াণ বার্ষিকীতে হোটেলে ডিনারের পানাহারের সময় অ্যানার মাথায় দুষ্টুমি খেলে গেল। জীবনে যা তিনি কল্পনাও করেননি তাই করলেন। হোটেলর পানশালা থেকে অপরিচিত এক পুরুষকে নিয়ে এলেন বিছানায়। মদোন্মত্ত অবস্থায় তীব্র সঙ্গমে মেতে উঠলেন। এতটাই মত্ত হয়ে উঠলেন যে নিজের শারীরিক সুখের কথাই শুধু ভেবে গেলেন, পুরুষটির কথা একবারও ভাবলেন না। একটা উন্মত্ত সুখের রাত কাটানোর পর ভোর বেলায় উঠে দেখলেন তার রাতের সঙ্গী চলে গেছে। তার নাম পর্যন্ত জানা হয়নি! তার শরীরে আতঙ্কের স্রোত বয়ে গেল যখন তিনি দেখলেন তার বইয়ের ১১৬ পাতার মাঝখানে একটা ২০ ডলারের নোট রেখে গেছে গত রাতের শয্যাসঙ্গী। ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা যেন একটা মেটাফর এখানে।
একটা ২০ ডলারের নোট তার সমস্ত সুখ এক নিমেষে ধ্বংস করে দিল। এক অদ্ভুত যন্ত্রণা, অপমান, ভয় তাকে তাড়া করে বেড়াতে থাকল। বয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে মার্কেস লিখছেন, ‘যেন সে কলকাতার রাস্তায় হাঁটছে, যেখানে ময়লা পরস্কার করার লোকেরা একটা লাঠি দিয়ে রাস্তায় শুয়ে থাকা মানুষদের আঘাত করে দেখে কে বেঁচে আছে আর কে মৃত।’ এই একটি ঘটনা অ্যানার বৈবাহিক জীবনে বিরাট পরিবর্তন এনে দিল। এত কিছু সত্ত্বেও অ্যানা স্বাধীনতার স্বাদ আর শারীরিক সুখের স্বাদ নেওয়ার জন্য পরের বছরের অগাস্ট মাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন।
তিনি এক বৃত্তের মধ্যে প্রবেশ করলেন – ১৬ই অগাস্ট দ্বীপে যাওয়া, মায়ের সমাধিতে ফুল দিয়ে রাতে নতুন এক প্রেমিক খোঁজা, উন্মত্ত সহবাস, পরের দিন সকালের ফেরিতে শহরে ফিরে আসা এবং তারপর পরের বছরের অগাস্ট মাসের জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা করা। এই বৃত্ত চলতেই থাকে চলতেই থাকে। অবশেষে বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে এলেন কিছু অদ্ভুত ঘটনার মধ্যে দিয়ে।
স্বাধীনতা, স্ববিরোধ, যৌনতা, বিশ্বাসঘাতকতা, অনুশোচনা, প্রেমের রহস্য গভীর ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে অ্যানার চরিত্রে। অপর পক্ষে অ্যানার স্বামী একটা ঝাপসা চরিত্র। মার্কেস আরও সুন্দর ভাবে এমন চরিত্রকে রক্ত মাংস দিয়ে গড়ে তার মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো তুলে ধরতে পারেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে উপন্যাসটি শুধু অ্যানার পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরে একতরফা হয়ে গেছে। মার্কেসের শেষের দিকের কাজগুলোতে আমরা দেখেছি মার্কেস কীভাবে চরিত্রগুলোকে এবং তাদের মানসিক পরিসরকে স্বপ্নের মত ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘আনটিল অগাস্ট’ উপন্যাসে পাঠক সেই রস থেকে বঞ্চিত। ম্যাজিক-রিয়ালিজিম এখানে প্রচ্ছন্ন। এতদসত্ত্বেও এটি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের উপন্যাস। গাবোর শেষ স্বাক্ষর। যদিও নিজেই বলে গেছেন ‘বইটা দাঁড়ায়নি। ওটা অবশ্যই নষ্ট করে দিও।’ প্রকাশ করা উচিত কি নয় সেই দ্বন্দ্বের মধ্যে রড্রিগো ও গঞ্জালো গার্সিয়াকে যেমন দেখেছি তেমন আমরা দেখেছি ভাদিমির নবকভের স্ত্রী ভেরাকে বা কাফকার বন্ধু ম্যাক্সকে। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে যদি কেউ জিতে যায় সে হল সাহিত্য। আমারা ‘দ্য অরিজিনাল অফ লরা’কে জিতে যেতে দেখেছি, দেখেছি ‘দ্য ক্যাসেল’ কিংবা ‘দ্য ট্রায়াল’কে জিতে যেতে। ‘আনটিল অগাস্ট’ও ইতিমধ্যে পৃথিবী জুড়ে বহু পাঠকের অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়েছে। গাবো হয়তো শেষ পর্যন্ত তাঁর দুই বিশ্বাসঘাতক পুত্রকে ক্ষমা করে দেবেন।
—
তথ্য
Until August by Gabriel García Márquez, Penguin Random House
https://en.wikipedia.org/wiki/Gabriel_Garc%C3%ADa_M%C3%A1rquez
https://en.wikipedia.org/wiki/Until_August
https://www.nytimes.com/2024/03/10/books/review/gabriel-garcia-marquez-until-august.html