দেবদাস রজক-এর গল্প

দেবদাস রজক-এর গল্প

আগুনের মেয়ে

ক্লাচ ধরে এক্সেলেটারে খুব জোরে চাপ দিল সঞ্জু। করুণ কান্নার রোল যেন। হাঁপাচ্ছে বাইকটা। সাইলেন্সার থেকে গদগদ ক’রে কটু ধোঁয়া এখনো বেরোচ্ছে। মাথা খারাপ হয়েছে ওর। কিলবিল করছে ধোঁয়া। গোখরো সাপের মতো দলা পাকিয়ে মিশে যাচ্ছে হাওয়ায়। ওই বিষ, কালো মিহিবিষ সঞ্জুর চায়-ই, মুহুর্তে মুহুর্তে চায়…, যতদিন বাঁচবে ততদিন চায়। পেট্রোল, পোড়া-মোবিলের গন্ধ সঞ্জুর নেশা। নয়তো রক্ত মজা পায় না, দেহে আবেশ আসে না। রাতে মিশমিশ করে শরীর, হাত-দু’টি। ঘুম ভেঙে যায়।

কুহু ডাকার আগেই ওঠে সঞ্জু। ঝুমু ওঠে না তখনও। এপাশ ওপাশ করে। আঁধার। নির্জন পুকুরপাড়ে ডাহুক, হাঁস, বগারী, ঘুঘু ডাকার পর ঘুম ভাঙে ঝুমু’র। কলতলায় গিয়ে গা ধোয়, রাতের নাইটি জলকাচা করে। শরীর ঠান্ডা হয়। ততক্ষণে সঞ্জু চটচটে মোবিল-মাখা রংচটা জামা আর পুরনো খয়েরী কালারের একটা প্যান্ট পরে তৈরি থাকে। চুল আঁচড়ায়। টেরি কাটে। ভোর সারে পাঁচটায় কলকাতা যাওয়ার এক্সপ্রেস বাস ‘শিবদুর্গা’ ঢোকার আগেই দোকান খুলবে। চাঁদপুরের মোড়ে তখন একটি মাত্র চায়ের দোকান থেকে মিঠি-চায়ের গন্ধ ভেসে আসবে। তরল অন্ধকার। মুখ দেখে চেনার উপায় না থাকলেও দেহের গড়ন, পোশাক, আদব কায়দা চিনিয়ে দেবে সঞ্জয়কে। সঞ্জয় বৈরাগী। সকলের প্রিয় ‘সঞ্জু মিস্ত্রী’। বাইক, স্কুটি, এমএইটটি, এমনকি টোটো, মটরভ্যানও সারাইয়ের কাজ করে। দীর্ঘ বারো বছর। তখন ওর বয়স ছিল সতেরো আঠারো। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা ‘সঞ্জয় মটর ওয়ার্কশপ’ ঠিক ভোর সাড়ে পাঁচটায় ওপেন হয়, বন্ধ হয় সেই অনেক রাতে। এ চত্বরে যখন আসেপাশের সব দোকান বন্ধ হয়ে যায়, একটি মাত্র চায়ের দোকান থেকে মিঠি-চায়ের গন্ধ আর ভেসে আসে না, ঠিক তখন সঞ্জু একা হয়। দোকানের ঝাঁপ বন্ধ ক’রে কোনোদিন ঝুমুকে ফোন করে। তারপর পুরনো, তেজি বাইকটিতে সজোরে লাথি মেরে স্টার্ট দিয়ে রাতের অন্ধকার চিরে বেরিয়ে যায়।। শুধু বহু দূর থেকে তখন ভেসে ওঠে বাইকের আনন্দ-শিহরণ ভট্-ভট্ ভট্-ভট্ ভট্…! তারপর মিলিয়ে যায় সব।
“আজ খেতে আসবা বাড়িতে?”
ঝুমু স্টিলের ডিসের ওপর চায়ের কাপ আর মুড়ির বাটি নিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ায় সঞ্জুর। সঞ্জু বিছানায় পা ঝুলিয়ে ব’সে। ডিসটি হাতে নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দেয়।
“তুমি ভাত খেয়ে নেবা, আমার বাড়ি আসতে দুপুর গড়াবে, তোমার শরীর খারাপ করবে”
“সে করুক গা, তুমি খাবা না, আমি খেতে পারবো না। তুমি আসার পর একসাথেই খেতে বসবো”
সঞ্জু চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাপ, ডিস আর মুড়ির বাটিটি বিছানায় রাখল। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। মুড়ির বাটি থেকে এক খাবলা মুড়ি নিয়ে গালে ফেললো। এক কামরার এই ঘরে একটিই মাত্র বড় জানলা। সরকারি আবাস যোজনায় তৈরি ঘরটি। কাল রাতে ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। জানলা দিয়ে আশ্বিনের ঠান্ডা ভারি বাতাস ঢুকে শরীরে আঁচড় দিচ্ছে। ঝুমু আরও কাছে এল সঞ্জুর। বুকের মধ্যে নিজের বুকটি রেখে দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে মাথা নীচু করে বলল,
“তুমি আমাকে একটুও ভালবাসো না। আদর করো না, কাছে টানো না, ক্যানে বলো?”
“কোথায় তোমাকে আদর করি নাহ্? সারাদিন খুব কাজ, পুজোর আগে তো! তাই একটু রাত হচ্ছে বাড়ি ফিরতে। তুমি ভুল ভাবছো, তুমিই তো আমার সবকিছু ঝুমু!”
“মিছে বকছো! আমি বিশ্বাস করছি না”
“আমি মিছে বলছি না ঝুমু, বিশ্বাস করো”
কথাগুলি বলতে বলতে সঞ্জু ঝুমুর অর্ধ উন্মুক্ত স্তনদুটির মধ্যে মুখ গুঁজে দিল। দু’হাত দিয়ে নরম পশমের মতো শরীর নিজের কক্ষের মধ্যে টেনে নিল। ঝুমু গলে পড়তে লাগলো উত্তপ্ত মোমবাতির মতো। বাইরে তখন ব্যাঙ ডাকছে। পুকুরের পাশে ফুলকপির ভেজা জমি থেকে ঝোড়ো হাওয়া ওদের ঘেমে ওঠা শরীরে আবেশের নিঃশ্বাস ফেলে দিল। মিনিট দশেক পর দু’টি উলঙ্গ নারী পুরুষ উঠে এল বিছানা থেকে।

২.
ভোর সাড়ে পাঁচটার আগেই দোকান খুলেছে সঞ্জু। একটু পর শেষরাতের হৃদয় ছিঁড়ে কলকাতাগামী ‘শিবদুর্গা’ বাস দানবের মতো বেরিয়ে গেল। জাফর রহমান ফজরের নামাজ শেষ করেই দোকান খোলার তোড়জোড় নেয়। আখা ধরায়। ধোঁয়া ওড়ে। চাঁদপুর তে’মাথার মোড়টি তখন ধোঁয়া আর কুয়াশায় ছয়লাপ হয়। আখা গনগন ক’রে এলে এক সসপ্যান জল ফোটায়। অনতিদূরে মোরগ ডাকে। চায়ের গন্ধ ম ম করে উঠলে জাফর চাচা হাঁক ছাড়ে,
“ও সঞ্জু! সঞ্জু বাপ! এসো, চা খাবা”
সঞ্জুকে ছেলের মতোই পেয়ার করে জাফর চাচা। নিজের বলতে এখন আর কেউ নেই। বিবি হামিদা বেগম বছর সাতেক আগেই জান্নাতে গেছে। ছেলেপুলেরা সব আলাদা হয়েছে। এখন নিজে অসমর্থ হাতে চায়ের দোকান চালায়। দু’চার পয়সা ইনকাম ক’রে দিন গুজরান হয়। বয়স ষাট বাষট্টি মতো। মাইল তিনেক দূরে পূর্বদিকে মোহরপুরে ওর ভিটেমাটি। জমিজমা যা ছিল রক্তারক্তি হওয়ার আগেই চার বেয়াদব পুত্রকে সমান ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। ছেলেপুলেদের বলে এসেছে,
“তোরা ভিনু থাক। কেউ কাওকে রা করবি না, তোরা ভাল থাকলেই আমার জান জুড়াবে”
এখন চাঁদপুরের এই চায়ের দোকানেই জাফর চাচার একার সংসার। বছর ছয়েক হল। এটাই তার জগত। মাটি আর কাঠের দেয়াল। সামনে বাঁধানো মাটির উনুন। দরজা বলতে আলকাতরা দেওয়া পটিমারা টিনের ঝাঁপি‌। দোকানের ভেতর বাঁশের কাবারি দিয়ে তৈরি লম্বা দুটি বেঞ্চ, কাঠের নড়বড়ে চেয়ার, একটি প্লাস্টিকের টুল। চা, বিস্কুট, পাউরুটি, কলা, কেক আবশ্যক কিছু খাদ্যদ্রব্য রাখতেই হয়। ভোর সাড়ে পাঁচটার প্রথম বাস ঢোকার আগেই মানুষের জটলা শুরু হয়। জাফর চাচার নিশ্চুপ দোকানে তখন প্রাণ ফেরে। গমগম ক’রে ওঠে সামনেটা। চাঁদপুর মোড় থেকে বারো কিমি দূরে চৌগাছা রেল স্টেশন। ভোররাত্রি থেকেই আনাগোনা শুরু হয় যাত্রীদের। সব্জি-ভ্যান, ফলের গাড়ি, পোল্ট্রি মুরগির খাঁচা দেওয়া মটরভ্যান, টোটো, অটো, প্যাডেল ভ্যানওয়ালা সবই এই চাঁদপুরের মোড় ঘেঁষে বেরিয়ে যায় দূরে। রাতের নিস্তব্ধ অলৌকিক চাঁদপুর-মোড় ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, লৌকিক হয়।

“এই যা-ই, দুয়োরে জলটুকু দিয়ে-ই যাচ্ছি গো চাচা!”
দোকানের সামনে জল ছেটাতে ছেটাতে রাস্তার এপার থেকে সঞ্জু সাড়া দেয়। সঞ্জু জানে জাফর চাচার প্রথম তৈরি চায়ের এককাপ তার জন্য বরাদ্দ। ঝুমুর হাতের চায়ের স্বাদ আর চাচার তৈরি চায়ের স্বাদে অনেক পার্থক্য। তবে একটি জায়গায় ওদের খুব সাদৃশ্য। তা হল দু’জনের তৈরি চায়ে কোথাও কোনও খামতি নেই। প্রাণের ছোঁয়া আছে। দরদ আছে। ঝুমুকে ভালবাসা করে বিয়ে করেছে সঞ্জু। একই পাড়ার মেয়ে। শুধু মাঝে কিছু বিস্তর জমি। তাতে আখ, ফুলকপি, বাঁধাকপির চাষ। বছরখানেক হয়েছে ওদের বিয়ে। ঝুমুর বাপের খুব পছন্দ ছিল জামাই সঞ্জয় বৈরাগীকে। নিজস্ব বাড়ি, চাষের জমি, চাঁদপুরের মোড়ে মটরবাইকের গ্যারেজ। সঞ্জু খাটনেওয়ালা ছেলে। এ তল্লাটে বড় নাম-ডাক ওর। ‘সঞ্জু মিস্ত্রী’কে এক ডাকেই চেনে লোকে। ঝুমুর বাপ হরিনাথের গর্ব হয়। বুক ফুলে ওঠে। বেশি দেরি করেননি আর। জানাজানি হতেই গত অঘ্রাণেই মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে বসায়।

সঞ্জু ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো দিয়ে হাতের তালুতে লাগা তেলতেলে গ্রীচ মুছতে মুছতে বড় রাস্তাটি পেরিয়ে এল। জাফর রহমানের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। চা ভর্তি কাচের গ্লাসটি তুলে নিল হাতে।
“ভিতরে এসে বসো বাপ! সকালের চা একটু আয়েশ করে খেতে হয়”
নিজেও চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জাফর চাচা সঞ্জুকে বলল।
সঞ্জু জানে ভোরের আলাদা একটা গন্ধ আছে। শুধু ভোরের নয়। দুপুর, সন্ধে, রাত্রি প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা গন্ধ আছে। চোখ বন্ধ করেও বলে দিতে পারে কোন্ গন্ধ রাতের, কোন্ গন্ধ গোধূলির। সঞ্জু ভোরের এই টাটকা শিশিরগন্ধ নিতে চাইছিল খোলা আকাশের নীচে। চাচার কথায় দোকানের ভিতরে গিয়ে বসল।
“কালরাতে কখন বাড়ি ফিরে ছিলা বাপ!”
“রাতে সাড়ে দশটা বেজে গিয়েছিল। ঝুমু ঘুমাচ্ছিল, ওকে আর ডাকিনি, ওর শরীর একটু খারাপ”
“হুম! ঝুমু বেটিকে একটু নজর দিও বাপ। কাজ তো করবাই সারাজীবন। লেকিন মেয়ে মানুষ, নতুন শাদি, এখন তো সময় দিতে লাগবেই”
সঞ্জু মাথা দোলালো। গরম চায়ে আলতো করে চুমুক দিয়ে,
“চাচা! তবে মনে হয় আর বেশি দিন কাজ করা যাবে না”
ভ্রূ কুঁচকে জাফর চাচা জবাব দিল,
“ক্যানে বাপ? কী হল?”
“সরকার থেকে রাস্তা বড় করবে, চাঁদপুরের দুইদিকে যত দোকান আছে সব ভাঙবে, তোমার আমার দোকানও ভাঙা পড়বে চাচা”
“হ্যাঁ বাপ, ঠিক বলেছ। কাল দুপুরেই পি-ডাবলু-ডি’র লোক এসেছিল। মাপজোক করছিল। দোকান অনেকটা ভাঙা পড়বে। ওরা বলল তাড়াতাড়ি দোকান তুলে দিতে। এই বয়সে বাপ কোথায় যাব? ভিটে বলে তো আর কিছুই নাই!”
সঞ্জুর মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। দীর্ঘ বারো বছরের দোকান ‘সঞ্জয় মটর ওয়ার্কশপ’ এবার ভাঙা পড়বে হয়তো। এ চত্বরে নাম করা মটরবাইক মিস্ত্রী সে। রাস্তা বড় হবে, আধুনিক ল্যাম্পপোস্ট বসবে, সিগন্যালপোস্ট বসবে। রাস্তার দু’ধারে উঁচু উঁচু মার্কেট হবে। চাঁদপুর মোড় বদলে যাবে আধুনিকতার ছোঁয়ায়। তবে এই দোকান ভাঙলে সে খাবে কী? চলবে কী করে? দিন দু’য়েক আগে এলাকার নামজাদা দাপুটে-নেতা বিল্টু রুজ এসে প্রায় হুমকি দিয়ে গেল। ঝুমুকে সে-কথা বলতে পারেনি সঞ্জু। যে অল্প কিছু জমি আছে তাতে চাষাবাদ করে ক’টাকায় বা সে পাবে? বাড়িতে মা-বাপ আছে। নতুন সংসার। বড় খরচ আছে। মটরবাইক সারাই করে যথেষ্টই হয়। বিশেষ করে ফার্স্ট মর্নিংএ। সব্জির ভ্যান, পোল্ট্রি মুরগির গাড়ি, টোটো অথবা বাইকের টায়ার পাংচার হলেই দ্বিগুণ পয়সা। খুলে ফেলে টায়ার ও টিউব। তারপর ধীরে ধীরে আঠা বুলিয়ে ফুঁ দেয়। আবেশে চোখ বুজে আসে।

৩.
ইঞ্জিনে ফায়ার করছে রীতিমতো। তবুও গোঙাচ্ছে। এ অঞ্চলে যখন সমস্ত মিস্ত্রী অকেজো হয়ে যায় তখনই চাহিদা বাড়ে সঞ্জু মিস্ত্রীর। বাইকের রক্ত, বাইকের হাড়গোড়, হৃদপিন্ড সঞ্জুর কথা শোনে। স্পর্শ বোঝে। কিন্তু আজ দুপুর থেকে অভিমানের পালা শুরু হয়েছে। স্টার্ট নিচ্ছে না নতুন একটি বাইক। হাল মডেলের মোটরসাইকেলটা যেন আঠারো বছরের মেয়ে। শরীর থেকে জৌলুস গড়ে পড়ছে। রাধিকার মতো গোপন আড়ষ্ট ভাব। নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে আপন হৃদয় থেকে। শুধু গদগদ করে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে। সঞ্জুর চোখে ঋতুস্রাবময়ী নারী বুঝি। রক্ত ঝরছে, ধোঁয়া উড়ছে, চারদিকে অমৃত-বিষাক্ত ধোঁয়া ওকে মাতাল করছে। সঞ্জু একেরপর এক ওর সমস্ত অঙ্গ স্পর্শ করল। তবুও কোনও উত্তাপ নেই, ইশারা নেই। খুলে ফেলল দেহের সমস্ত বসন। উলঙ্গ করল ওকে। তারপর গোপন অংশে ধীরে ধীরে প্রবেশ করল। পিস্টন খুলে ফেলল, সিলিন্ডার খুলে ফেলল, আউটলেট ভাল্বগুলি সব খুলে রাখল। কার্বুরেটর থেকে স্ট্রেইনার, মিক্সিং চেম্বার, চেকভাল্ব পার্ট পার্ট করে রাখল পাশে। এখন সে সম্পূর্ণ এক দম্ভহীন, নিরাভরণ, অলঙ্কারবিহীন নারী যেন। হাঁপিয়ে উঠেছে সঞ্জু,
“আশ্চর্য! কী হল আজ? কোথায় সমস্যা হচ্ছে?”
মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এল কথাগুলি। লালরঙের হাতল দেওয়া প্লাস্টিকের চেয়ারে গিয়ে বসল। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। দোকানের মেঝে কালো মোবিলে চর-চর করছে। তেলচিটে। বাঁদিকের দেয়ালে টাঙানো বিভিন্ন ধরণের রেঞ্চ। তার নীচে পড়ে আছে ভাঙা তোবড়ানো গাড়ির পার্টস। হেডলাইট, স্পীড মিটার, ভাঙা আয়না, মারগাট, সীড কভার, কত নিস্তেজ দেহাংশ। অগোছালো ঘর। যত্রতত্র ছড়ানো স্ক্রু, নাট-বোল্ট। তীব্র পোড়া মোবিল আর পেট্রোলের গন্ধ। এই দোকান ঘর, এই কটু গন্ধ সঞ্জুকে পাগলের মতো করে। যতক্ষণ না নতুন বাইকটিকে নিজের কব্জায় আনতে পাচ্ছে ততক্ষণ স্বস্তি নেই সঞ্জুর। হাত আর কপাল ঘেমে উঠছে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হচ্ছে। কত সব গাড়ি আসে, গাড়ি যায়। সঞ্জুর হাতেই নতুন প্রাণ পেয়ে উন্মত্ত ঘোড়ার মতো ছোটে। স্কুটি, টোটো, অটো সঞ্জুর হাতের জাদুতে মোহিত হয়। কিন্তু এই হাল আমলের বাইকটির আজ কী হল? তাকে আদর করে ডাকছে, ভালবেসে ডাকছে, রুদ্রমূর্তিতে ডাকছে। তবুও অভিমানী বয়ঃসন্ধিক্ষণের নারী যেন, গুটিয়ে রেখেছে নিজেকে। আরও বেশি স্পর্শের প্রয়োজন ওর।

আজ দুপুরে বাড়ি যেতে পারেনি সঞ্জু। চাঁদপুর মোড় থেকে দেড় কিমি. দক্ষিণে চিত্তপুর অঞ্চলে সঞ্জয় বৈরাগীর বাস। রোজ দুপুরে বাড়ি যায়, খাওয়াদাওয়ার পর আবার ফিরে আসে দোকানে। তারপর সেই রাত্রে। আজ দুপুরে ঝুমু বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ফোন করে ওকে। অভিমান করে। কষ্ট পায়। একা একা নির্জন দুপুরে ভাত বেড়ে খায়। বিকেল হয়। পাশের পানাপুকুর থেকে তখন কাদের বাড়ির হাঁস গলা উঁচিয়ে ডাকে। আকাশ কালো হয়ে বিকেলের পর বৃষ্টি নামে। দূরের মসজিদে আজান হয়। আবার ফোন করে সঞ্জুকে। ফোন বেজে যায়, রিং হয়ে যায়। উত্তর আসে না।

রাত যখন গভীর হল তখন বাইরের দরজায় একটা শব্দ শোনে ঝুমু। মোবাইল দেখল। এগারোটা দশ। দরজা খুলে দাঁড়াল। সঞ্জু ঘরে প্রবেশ করলে অভিমানে চোখ দু’টি লাল হয়ে আসে ঝুমুর। ছলছল করছে চোখ। নাক টেনে টেনে বলল,
“দুপুরে বাড়ি এলা নাহ্? বারবার ফোন করছিলাম। ফোনটা তো ধোরবা?”
“কাজে কাজে আসতে পারিনি গো। কিন্তু এ্যাতো রাতে তুমি জেগে আছ? ঘুমাওনি ক্যানে? ভাত খেয়েছো?”
“তুমি দুপুর থেকে খেয়েছো কি খাওনি! আর আমি খেয়ে নেব? আমাকে তুমি কী ভাবো বলো তো? আমি কি তোমার ঘরে দু’বেলা খেতেই এসেছি?”
“তুমি এমনি এমনি রাগ করছো ঝুমু। কাজের চাপেই আসতে পারিনি দুপুরে। তোমার শরীর ভালো নাই বলেই বললাম”।
“আমার শরীর ঠিক আছে, তোমার জন্যই তো বসে আসি। অনেক রাত হল। হাত-মুখ ধুয়ে এসো, আমি ভাত বাড়ছি”।

৪.
বাইরে ঝিঁঝিঁ আর কুকুর ডাকার শব্দ। জানলা দিয়ে মিশ-অন্ধকার এসে লুটিয়ে পড়ছে বিছানায়। এই অন্ধকারে শুধু চারটি চোখ উজ্জ্বল হয়ে আছে। জোনাক পোকার মতো অনিশ্চিত শূন্যে আলো নেওয়ার চেষ্টা করলো ঝুমু। একটু এগিয়ে এসে সঞ্জুর পুরু ঠোঁটে একটি আকাঙ্ক্ষার চুমু খেলো। তারপর সমস্ত শরীর উড়ন্ত পাখির মতো উড়িয়ে নিয়ে গেল সঞ্জুর উন্মুক্ত বুকের উপর। নরম দু’টি স্তন ওর দেহের মধ্যে যেন গলে পড়ছে। দু’হাত দিয়ে ঝুমুকে জড়িয়ে ধরল সঞ্জু। এরপর হঠাৎই অদ্ভুতভাবে নিজের হাত-দু’টি শিথিল করে নিল। প্রবল অনিচ্ছাই বাঁ হাতের কনুই দিয়ে ঝুমুকে ছিটকে ফেলে দিল নিঃশব্দ রাতের বিছানায়। ঝুমুর এখন অর্ধনগ্ন আগুনের মেয়ের মতো ডুকরে কাঁপে উঠল। কী হল বুঝতে পারলো না। শুধু কাজল চোখ দু’খানি থেকে ক্রমাগত জল পড়তে থাকে। কিছুক্ষণ এভাবেই কাটলো একটি অতৃপ্ত বিছানায়।
“কী হয়েছে তোমার?”
বিছানায় শুয়ে শুয়েই সঞ্জুর খোলা বুকে হাত রেখে আশ্চর্য-স্বরে প্রশ্ন করল ঝুমু। সঞ্জু চুপ করে থাকে। আবার জিজ্ঞেস করল,
“কী গো? বলো! কী হয়েছে তোমার?”
চোখের দিকে তাকাল ঝুমু,
“তুমি কাঁদছ?”
এবার শান্ত অস্ফুট গলায় সঞ্জু বলে উঠল,
“কাঁদছি না, তবে…”
“তবে কী? চুপ করে ক্যানে? বলো?”
সুদীর্ঘ শস্যখেত সারারাত যেভাবে চুপচাপ থাকে সঞ্জুও থাকল কয়েক সেকেন্ড। তারপর ঝুমুর হাতের তালুতে হাত রেখে বলল,
“ভাল লাগছে না কিছু, খবর ভাল নয় জানো! চাঁদপুরের মোড়ে যত দোকান আছে সব তুলে দেবে সরকার থেকে। রাস্তা বড় হবে। জিপিএস সিগন্যাল বসবে, বড় লাইটপোস্ট বসবে, বিল্ডিং হবে, মার্কেট হবে। আমাদের মতো ছোট দোকান সব ভেঙে দেবে। সরকারি খাসের জায়গা তো, যেকোনও সময় নিয়ে নিতে পারে ওরা”
মাথায় যেন বজ্রপাত হল, অন্ধকারে ছায়ার মতো উন্মুক্ত বুকে সোজা হয়ে বসল ঝুমু,
“কী বলছ এসব? আমাদের দোকান ভেঙে দেবে?”
“হ্যাঁ গো ঝুমু। কী করব বুঝতে পাচ্ছি না। দেখি কী হয়…”
রাতের বিছানায় দুই নারী পুরুষ অনেকক্ষণ পর্যন্ত জেগেছিল। টুপ টুপ ঝরে পড়া কিছু জ্বলজ্বলে তারা দূর বহুদূর থেকে ওদের পর্যবেক্ষণ করছিল। যন্ত্রণায় কাতর একটি ছায়া ঘুমন্ত ঝুমুর লাবণ্যময় মুখে ছড়িয়ে পড়ছে। অনন্ত সময় গড়িয়ে যায়। রক্ত মাংসের দু’টি মানব-মানবী ধীরে ধীরে অতল থেকে অতলে গড়িয়ে যাচ্ছে। ঘুমের মধ্যে সঞ্জু দেখছে বুলডোজার এসে উপড়ে ফেলছে বারো বছরের পুরনো দোকান। চাঁদপুরের মোড়ে আর কোনো লোকজনের জমায়েত নেই। আলো আঁধারি ভোর। বুলডোজার তার দানবের মতো হাতল দিয়ে ভেঙে ফেলছে রাস্তা, ফাটিয়ে দিচ্ছে মাটি। বিকট আওয়াজ হচ্ছে কট্ কট্ কট্…! একটা মৃত্যুগহ্বর তৈরি করছে। সঞ্জু নিজেকে দেখতে পাচ্ছে, সে এক শূন্যের মাঝে ঝুলে আছে। ঝুমুকে দেখছে, সে-ও শূন্যে ভেসে আছে, জাফর-চাচাও শূন্য ভাসছে। আরও কত মানুষ শূন্যে ভাসমান, সঞ্জু ওদের অনেককে চেনে, ছোটবেলার বন্ধু কেউ কেউ। সকলের মুখে অদ্ভুত বিকৃত হাসি‌। নীচে ভয়াবহ ধাতব-যন্ত্র পৃথিবীর ভূমিতল ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। সব কিছু ধ্বংসপ্রায়। আর কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না… শূন্যের ওপরেই সঞ্জু দৌড়াতে শুরু করল, কোথায় যাচ্ছে সে জানে না… শুধু দৌড়াচ্ছে দৌড়াচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে…!

আজ ফজরের নামাজের অনেক আগেই কিসের শব্দে জাফর চাচার ঘুম ভাঙল। রাত অনেক গভীর। অন্ধকার চাঁদপুর-মোড় এই সময় নিস্তব্ধ থাকে। শুধু কোনো কোনোদিন দু’একটি ভবঘুরে, চেনা-কুকুর আর ঝিঝিঁর ডাক শোনে জাফর। এই শব্দগুলি শুনে অভ্যস্ত সে। কিন্তু আজ কালো আকাশের নীচে এ কিসের আওয়াজ? গা শিরশির করে উঠল। দোকানের ভিতর ছোট জানলাটি খুলে জাফর রহমান দেখল রাস্তার ওপারে ‘সঞ্জয় মটর ওয়ার্কশপ’ থেকেই যেন এই শব্দ ভেসে আসছে। শব্দ আরও তীব্র হচ্ছে। কী ব্যাপার! কিসের শব্দ হতে পারে! এত রাতে সঞ্জুর দোকান-ঘরে কে? ঠিক ঠাহর করতে পাচ্ছে না।

ধীরে ধীরে দোকানের ছাঁপ খুলে বেরিয়ে এল জাফর রহমান। খালি পায়ে, পা টোলছে। ঘুমের ঘোর। পা টিপে টিপে অন্ধকার অবয়ব ঠেলে রাস্তার এপারে এলো। কিসের শব্দ এত রাতে? কী হচ্ছে? একটু এগিয়ে এলো। হ্যাঁ, একদম ঠিক, সঞ্জুর বন্ধ দোকান থেকেই এই শব্দ ছিটকে আসছে! এবারে দোকানটির খুব কাছে এসে থামল। কান পেতে শুনল ভিতর কেউ যেন আছে। বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ করে উঠছে। কে এই নিশীথ রাতে? কোনও চোর-টোর কি ঢুকেছে? কে? কিসের আওয়াজ? ভিতর খুব ম্লান আলো জ্বলছে আর টুংটাং লোহার শব্দ! জাফর-চাচা ছোট্ট এক ছিদ্র দিয়ে দোকানের ভিতর নজর দিল। কিন্তু এ কী? এ কী দেখছে জাফর রহমান? নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পাচ্ছে না। এই নিস্তব্ধ-রাতে সঞ্জু! সত্যি! সঞ্জয় বৈরাগী। দোকানের ভিতর কী যেন করছে সে!
“সঞ্জু না-কি?”
“কে? জাফর-চাচা?”
“হ্যাঁ বাপ, কিন্তু তুমি এই নিশিরাতে দোকানে কী করছ?”
“চাচা! আমি অনেক রাতে এসেছি দোকানে, একটি মোটরসাইকেল আমাকে ঘুমোতে দিচ্ছে না, তাই”
“সে কী?”
জাফর-চাচা হতভম্ব হয়ে দেখছে এক মানব এক যন্ত্রের সঙ্গে সম্ভোগ করছে। গভীর রাত। উন্মত্ত। যন্ত্রের বিষাক্ত ধোঁয়ায় ভরে উঠছে সারা পৃথিবী। সঞ্জু হাঁপিয়ে উঠেছে। তবুও এ নেশা তার চাই। বিষ। অমৃত। উপরে অর্ধ উলঙ্গ পুরুষ আর তার নীচে শুয়ে আছে যেন এক আগুনের মেয়ে। চারিদিকে যন্ত্রধ্বনি বেজে উঠছে…

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes