
মীরা মুখোপাধ্যায়-এর কবিতাগুচ্ছ
গদ্যকবিতা
কার কাছে রেখে যাবো আমার অন্ধ বোনটিকে !
আমার তেষট্টি আর বাহান্ন অন্ধ বোনের। জানি,
এভাবে কবিতা হয় না। কবিতার ব্যাকরন আছে, লাগে কবিতার শরীর নির্মাণে রঙিন তুলির টান।
কিন্তু জীবন যেখানে প্রশ্ন ছুঁড়েছে ভোঁতা কার্তুজের ঢঙে সেখানে আমার জন্যে কি থাকবে !
অন্ধকার ঘরে লুকিয়ে কান্না নাকি এরকম একটি কবিতা !
অ্যাসিড ভিক্টিম
তার আশপাশ থেকে সমস্ত আয়না লুকিয়ে রাখলেও সে ঠিক একদিন জলের কাছে যাবে।
একচোখ দিয়ে কোঁচকানো মুখ দেখবে, দেখবে চামড়ার দলা বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়া।
তবু সে বাঁচতে চাইবে, ভালোবাসা নাহলেও দয়া
চাইবে। অভিশাপ দিতে দিতে একদিন ক্লান্ত হয়ে শেষে জলের নিকটে যাওয়া বন্ধ করে কিনতে চাইবে রকমারি ওড়না ও মেয়েদের রঙিন সানগ্লাস।
চোর
কবর ও এপিটাফ নিয়ে কমপক্ষে একশো কাহিনী পড়েছি অদ্যাবধি। ওবেলিস্ক কাকে বলে সেও জানি। জন্ম মৃত্যুর সন তারিখ, নাম লিখে রাখে প্রিয়জন, মায় কয়েকটি বিষন্ন পংক্তি যার উপর ফুল রেখে যায় কেউ কেউ
একজন চোর, যে কবরের মার্বেল পাথর চুরি করে, সাবধানে ফেলে দেয় ফুল।
একবার পড়েও দেখে না যার ওবেলিস্ক খুঁড়ছে তার নাম ডোরা না টমাস…
সে কী ভাবে এভাবেই তার কবরেও একদিন হানা
দেবে নুতন তস্কর !
কবিতা ও থ্রিলার
পারতপক্ষে কবিতা পড়ি না আমি , সত্যি বলছি।
কবিতা আমাকে গাঢ়তর হতাশার দিকে নিয়ে যায়,
একা হতে হতে চলে যাই বিলয়বিন্দুর কাছাকাছি।
বরং গোয়েন্দাগল্প পড়ি,টানটান থ্রিলারে কমিক চরিত্র থাকে, ম্যাজিক রিলিফ থাকে। আর
পাহাড়ের ধারে ডাকবাংলোর লনে মাধবীলতার মধুমঞ্জরী বোন ঘাসের স্যান্ডেল পরে হেঁটে যায়,
টিপয়ে গরম কফি, এয়ার বাবলস্ নাকি আর্সেনিক
গুঁড়ো !
কবিতা পড়ি না আমি,সে আমাকে ক্রমাগত দুঃখ দেয় এবং হতাশা
বিবাহপ্রস্তাব
আজ আর লগ্ন নেই, চাঁদ ডুবে গেছে বহুক্ষণ।
বিবাহপ্রস্তাব থেকে লাফ মেরে উঠে আসে পিরানহা
মাছ।
শব্দবন্ধটি মাঝামাঝি ভেঙে যায়। আজ কোন তিথি ছিল মনে নেই, শুধু মনে আছে
শেষভোরে নৌকোর মাঝি সমুদ্রসৈকত থেকে আলুথালু
বিবাহ শব্দটি কুড়িয়ে এনেছে, প্রস্তাব শব্দটি ভেসে গেছে
কতদূরে কেউ তা জানে না
মীরাদি, আপনি এক আশ্চর্য কলম। কেন? আপনার লেখার এক মুগ্ধ পাঠক হিসেবে বলতে পারি এই কবিতা-পঞ্চক এক অনবদ্য একত্রিতকরণ। পাঁচ রকমের ঘরানা, জীবন ছুঁয়ে থাকা অমোঘের দ্যূতিমান বিচ্ছুরণ, কিন্তু কোথাও কবিতাকে গ্লোরিফাই করার সচেতন চেষ্টা নেই। যেন শব্দদের স্বাধীনতা দেওয়া হল পংক্তি বিন্যাসের এবং সেই পংক্তিরা নিজেরাই একেকটি আদল স্পষ্ট করে তুলল। পাঠক্রিয়ার জন্য রেখে গেল বিস্ময়। এমন একেকটি বিষয়, সর্বসমক্ষেই দিব্য বিচরণ করে, কিন্তু তারা যে কবিতার আলো জ্বেলে বিশেষ হয়ে উঠতে পারে, এই অবাক করার অনুভূতি কে দেবে মিডিওক্রেসিকে!
আপনিই তো রইলেন। ‘অ্যাসিড ভিক্টিম’ কবিতাটির মধ্য দিয়ে যে অভূতপূর্ব প্রেক্ষিত ফুটে উঠল, ‘বিবাহপ্রস্তাব’ শব্দবন্ধের ভেঙে যাওয়ার ভেতরেও যে অলৌকিকের হাতছানি, ‘গদ্যকবিতা’র আশ্রয়ে যে বিষাদসৌন্দর্য এবং এভাবে প্রত্যেকটি কবিতার অপরূপে যে অলীক উদ্ভাস, তা কি শুধুই কবিতার? আমাদের তথাকথিত মানবিকতা বিস্মরণের নয়? নার্সিসিজম আক্রান্ত সমকালকে দুদন্ড থমকে দিল এই লেখারা…শ্রদ্ধা জানবেন।🙏
আপনার কবিতা বড় ভালোবাসি। এভাবে এমন স্বাভাবিকতায় যে শব্দ বুনে গূঢ় উচ্চারণ হয় তা আগে জানিনি।