
অনুভব
শ্রাবণী গুপ্ত
যা কিছু সামনে আছে, যা কিছু স্পর্শ করে আছে সেটুকুই বুঝি অনুভূত হয়! এই আকাশ তো কতদূরে তবু কেন ছুঁয়ে থাকে সর্বক্ষণ অনিলে অনলে। এই হাওয়া এই তনুভূত জল কতকাল ধরে স্পর্শ করে আছে! প্রশ্নের পর প্রশ্নে জর্জরিত জীবন, তিরস্কারে পুরস্কারে ঘনীভূত জীবন আজও যেন পরম সত্যের সন্ধানে সুদূর পানে ধায়। নিত্য,অপস্রিয়মাণ। আমি রোজ কার সন্ধানে যাই?
প্রতিটি সকাল এই গুনগুন গুনগুন। কার স্বর, কার সুর, কার দান, কার গান? কে যেন তাঁর সেই অলৌকিক হাত, বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে— “আমার পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই”। কে আমি, কী আমার অস্তিত্ব—এই সব প্রশ্নে দিনমান কাটে, কেটে যায়। “সুধা পান করে মরিগো তিয়াসে”। এ তৃষা যে মিটিবার নয়। জীবন মৃত্যুর এই ছায়াবৃত্তে সর্বক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। ভাবি কর্মব্যস্ত এই জীবন কত সুন্দর। ভাবি অলস সেই জীবন বুঝি আরো সুন্দর! কবিগুরু, তিনি তো নিরলস। তাঁর সাধনায়। তাঁর আরাধনায়। ভাবি। ভাবতে ভাবতে তাঁর সেই শতাব্দী প্রাচীন ঊষর গ্রামটায় পৌঁছে যাই। ভাবি এই তো সেই তালগাছ। এইতো সেই কোপাই কুনুর অজয়। এই সেই রুক্ষভূমি সেই প্রান্তর, কবিগুরুর করস্পর্শে যা ধীরে ধীরে আশ্চর্য হরিৎ ও নরম হয়ে উঠেছিল। এই অনুভূতি অসামান্য। যতবার শান্তিনিকেতনে যাই, মনে হয় এইতো এইতো কবিগুরুর পায়ের ধুলো, এইতো কবিগুরুর করস্পর্শ চিহ্ন। তাঁর ছবির প্রদর্শনী দেখতে গিয়ে সেইবার অনুভব করেছিলাম পা যেন আটকে রেখেছে কেউ। যেন বলছে— এ দেখার কোনো শেষ নেই, কোনো ফিরে যাওয়া নেই কেবল থেকে যাওয়া আছে। কেবল দেখে যাওয়া। তাঁর লেখা গান, তাঁর কবিতা শুনতে শুনতে মনেহয় তাঁর সঙ্গে যাপনের কোনো অস্তিত্ব নেই শুধু অনুভূতি আছে। তিনিই তো পরমতম নাথ, আমার অনুভবের রবীন্দ্রনাথ।
আমার ঘরে দুই ঠাকুর পাশাপাশি থাকেন। ব্রহ্ম এবং ব্রাহ্ম একদম পাশাপাশি। ঠাকুরের সিংহাসনের একেবারে পাশেই কবিগুরুর একখানা মস্ত বড় ছবি, বাঁধানো। জানি এটা শুনে কয়েকজন ঝাঁপিয়ে পড়তেই পারেন। কিন্তু আমার এই-ই। আমার বিশ্বাস আমার এই বিপরীতধর্মীতায় রবীন্দ্রনাথ ক্ষুন্ন হবেন না। আসলে আমাদের বেড়ে ওঠায় রবীন্দ্রনাথ যেভাবে মিশে থাকেন সেভাবেই তো মিশে থাকে আমাদের পারিবারিক রীতিনীতি প্রথা পরম্পরা বিশ্বাস। মায়ের আলতা রাঙা পা যেমন চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায়, সামান্য ছাপটুকুও না রেখে, তেমনভাবেই প্রতিটি আচার প্রতিটি সংস্কার আমাদের ভেতর জারিত হতে থাকে। এইসব সংস্কারলালিত জীবন বড় মনোময়। খুব খুঁটিয়ে দেখলেই বোধহয় বোঝা যাবে সমস্ত সংস্কার আসলে কুসংস্কার নয়। এইসব আচার অন্তরে আলো হয়ে নেমে আসে। আমাদের যৌথবাস, হাসিগান, দালানজোড়া উৎসব, এইসব এইসবের ভেতর যে আলো থাকে তাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা আমার অন্ততঃ নেই।
ছোটবেলার কত স্মৃতি আছে এইসব উৎসব ঘিরে। কত আনন্দ। মামাবাড়ির কালীপুজো, ধেই ধেই করে ভাইবোন মিলে গঙ্গায় স্নান করতে যাওয়া, যাওয়ার পথের ধারে পাটগাছের ক্ষেত, পটপট করে পাটকাঠি ভাঙতে ভাঙতে নদীর দিকে এগিয়ে যাওয়া। তারপর নদীর তীর ভাঙা জলের উপদ্রব দেখে ভয়ে এক ঘটি জল মাথায় ঢেলে ফিরে আসা। ওই পাটক্ষেত ওই গঙ্গাস্নান সেসব কি ভোলার? এই যে কতদিন সেখানে যাইনা, কতদিন ছুঁয়ে দেখিনা মামাবাড়ির ভাঙাচোরা ঘর, তবুও তো অনুভবে আছে। বাতাস তাড়িত হয়ে আমার দীর্ঘশ্বাস হয়তো ছুটে যাচ্ছে সেই পুরনো বাড়িটায়, যেখানে আমার বাল্যকাল, যেখানে আমার শৈশব, শৈশবের নানান স্মৃতি নানান সঞ্চয়।
কড়িকাঠ আজকাল বিশেষ চোখে পড়ে না। চোখে পড়ে না চড়ুই। কিন্তু অনুভবে জীবন্ত সেসব দৃশ্য। যেমন ভাবে রবীন্দ্র গানের সুর আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যায় সেই পদ্মা নদীর বাঁকে বাঁকে। ভালোবাসা আর বিরহের চিরসখা হয়ে ওঠে তাঁর গান। স্মৃতি থেকে বিস্মৃতির দিকে যেতে যেতেও থমকে দাঁড়াতে হয় সেই সমস্ত অনুভূতির কাছে, যা অদৃশ্য অথচ অনস্বীকার্য। শিউলি-ভেজা ভোর কখনো ভোলার নয়, সেই ভোর আর ভোরের আলোর হাত ধরেই বেজে ওঠা সেইসব গান, মননে তার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। সেইসব ভোর হয়তো আজ আর আসে না কিন্তু তার গন্ধ আজও হৃদয়ের অন্তঃস্থল ছুঁয়ে আছে, টের পাই। টের পাই বেঁচে আছি। এই অস্থির সময়েও বেঁচে আছি। এই অবিশ্বাসের সময়েও বেঁচে আছি। চারিদিকে যুদ্ধ যুদ্ধ রব, তবু বেঁচে আছি। চারিদিকে মৃত্যু মিছিল, তবু বেঁচে আছি। বেঁচে আছি কেননা আমার ভেতর বেঁচে আছে সেইসব অনুভূতি যা আমার আজীবনের সঞ্চয়, যা সুন্দর এবং কেবলই সুন্দর। আমার চারপাশের বাতাস হয়তো আজ দূষিত কিন্তু আমার বিশ্বাস দূষিত নয়। আমার চোখ হয়তো আজ স্বপ্ন দেখেনা কিন্তু আমার স্মৃতিগুলো মিথ্যে নয়।
শৈশবের সেইসব কানামাছি, সেইসব কিতকিত দিন মিথ্যে নয়। সেইসব চৌকো চৌকো ঘর, ঘরের ভেতর একটা একটা লাফ মিথ্যে নয়। চোখের বাঁধন মিথ্যে নয়, মিথ্যে নয় চোখের বাঁধন একটু আলগা করে দেখে নেওয়া। হাফ প্যাডেল মিথ্যে নয়, মিথ্যে নয় বটের লাল লাল ফলের হাঁ হয়ে চেয়ে থাকা।
আজ যখন নিজের সন্তানের শৈশব দেখি, দেখি কৈশোর, বড় কষ্ট হয়। কত কী যে পায়নি এরা। হয়তো পেয়েছেও অনেক, ওরা ওদের মতো করে। কিন্তু আমার অনুভবে এইসব বেদনা হয়ে বাজে। নিঃশব্দে। নীরবে।