
রবীন্দ্রনাথ
রাহুল দাশগুপ্ত
তিনি জ্বলে আছেন একাগ্রতায়, ধর্মীয় স্থানের পবিত্র অন্ধকারে
মোমের শিখার মতো, আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম দুঃস্বপ্নে,
আর ফ্লোরেন্সের দান্তের মতোই তিনি এসে পৌঁছেছিলেন
মহাজাগতিক রশ্মির মতো দূর কোনও নক্ষত্রমণ্ডলী থেকে…
অন্ধকার তটে হঠাৎ জ্বলে উঠেছিল কোনও রহস্যময় লাইটহাউস
মাঝসমুদ্রে জাহাজের বন্ধ হয়ে যাওয়া কম্পাস হঠাৎ চালু হয়ে গেছিল
যে নদীতে জোয়ার আসত না, সেখানে আসতে শুরু করেছিল অনিঃশেষ জোয়ার
মেধা, দৃষ্টি, বোধ, প্রজ্ঞা মিলেমিশে জন্ম হচ্ছিল এক সচেতন বিবেকের…
আসলে আমার আবেগই অসংযত হয়ে উঠেছে, ভাবতে চেয়েছে
জাহাজ বা লাইটহাউসের মতো অতি-প্রাচীন চিত্রকল্পের কথা
রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের ঋষিদের, হোমার, বাল্মিকী, বেদব্যাস
বা কালিদাসের
দান্তে, গ্যয়তে, দস্তয়েভস্কি বা তলস্তয়ের সমবয়সি, অর্থাৎ সময়হীন,
তাই অতি-প্রাচীন…
উপনিবেশিত, ধ্বস্ত ভারতবর্ষের বুকের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বয়ে গেছিলেন
গঙ্গানদীর মতো
আর হিমালয়ের মতোই মাথা উঁচু করে জন্ম নিয়েছিল এক নতুন সময়
সেই সময়ের ত্বকে শুভ্র বরফের মতো প্রজ্ঞার আলো, আর তাকে উচ্চতা দিয়েছে
প্রগাঢ় চেতনা
রবীন্দ্রনাথ এক সভ্যতার নাম, লোকজীবনের নাম, নৈতিকতার নাম,
যার পুনর্জন্ম হয়েছিল…
আবার রবীন্দ্রনাথ সেই উঁচু বেদী, যেখানে মন্ত্রোচ্চারণের বদলে শুরু হয়েছে
কদর্য উৎসব,
দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠরোধ করে, হত্যা করে যারা হতে চেয়েছিল উত্তরাধিকার
রবি-উৎসবে ছড়িয়ে পড়েছে তাদেরই রক্তবীজ, ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্তাক্ত করে চলেছে
বেদীর পবিত্রতা
মহাভারত, গীতা, দিভাইনা কম্মেদিয়া, মসনবীর মতো পবিত্র অক্ষরগুলি
ঢেকে যাচ্ছে ছাইয়ের স্তূপে…
কখনো মনে হয়, অরবিন্দের উচ্চতা আছে, আর রবীন্দ্রনাথ? উচ্চতায় আছেন,
আবার সমতলেও আছেন
আর সেই সমতলও দিগন্তবিস্তৃত, ওখানে ছোটো ছোটো নিষ্পাপ ছেলেমেয়েরা
ছোঁয়াছুঁই খেলতে আসে
এক মুমূর্ষু পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথ আমাদের আত্মার কাছে শেষ স্যানাটোরিয়াম,
দুঃস্বপ্নের ভেতর চলতে থাকা
শেষ ক্যারাভান, তাঁর সামনে আমরা নতজানু হই, আর্তনাদ করি, স্বীকারোক্তি করি
এবং প্রার্থনাও…