
ধারাবাহিক উপন্যাস
আশ্চর্য নির্বাসন
প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্ব একসঙ্গে
বিতস্তা ঘোষাল
আশ্চর্য নির্বাসন
বিতস্তা ঘোষাল
( সুচনা)
গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান। ভুচং, হানকু এবং হানয়াইং-নিয়ে ‘চীনের থোয়ারফার’। এই শহরের দু’পাশ দিয়ে কুলুকুলু শব্দে বয়ে চলেছে হান আর ইয়ানসিকিয়াং নদী। বেশ কয়েকটি রেলপথ, মহাসড়ক এবং এক্সপ্রেসওয়ে এর মধ্য দিয়ে চলে গেছে। সারাদিন এর ব্যস্ততা তুঙ্গে। অসংখ্য মানুষের কলোরবে মুখর এখানকার বাজারগুলো।চিনের অন্যান্য অঞ্চলে যে সব মাংস পাওয়া যায় এখানে তার থেকেও বেশি নানা প্রকার পশু পাখির মাংস মেলে।তাই বাজারগুলোতে লোকেদের আনাগোনা লেগেই থাকে।
ডিসেম্বর মাসের শেষে সমাগমটা একটু বেশিই। প্রচন্ড হাড় কাঁপানো শীতে নাগরিকরা নিজেদের পছন্দমত মাংসের সম্ভার নিয়ে ইংরেজি নতুন বছরকে বরণ করতে প্রস্তুত হচ্ছে।পিছনে পড়ে থাকবে পুরোনো দিনগুলো।কিন্তু এক ভয়ানক খবরে শুরু হল বছরের শেষদিন।
সারা শহর জেনে গেল মরণ রোগ হানা দিয়েছে এখানে। নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও কোনও সামুদ্রিক জীব থেকেই সম্ভবত এক অজানা ভাইরাস থাবা বসিয়েছে এখানকার বাসিন্দাদের উপর।যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এক শরীর থেকে অন্য শরীরে।এর আগে সার্স ভাইরাসের ক্ষেত্রে প্রথমে বাদুড় এবং পরে গন্ধগোকুল থেকে মানুষের দেহে ঢোকার নজির রয়েছে। আর মার্স ভাইরাস ছড়িয়েছিল উট থেকে। কিন্তু এই ভাইরাসের উৎস কী সঠিক জানার আগেই এই শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে চীনের কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করল।
বছর শেষ হল চূড়ান্ত দুঃশ্চিন্তা নিয়ে।জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের গোড়াতেই সারা পৃথিবী জেনে গেল করোনা নামে এই ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগীর মৃত্যুর কথা।
জানুয়ারি মাস শেষ হবার ঠিক আগের দিন উহান থেকে ৪৪৮৮ কিলোমিটার দূরে ভারতের কেরালায় উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে বাড়িতে ছুটি কাটাতে আসা এক ছাত্রের শরীরে মিলল এই ভাইরাস।
তখনো শীতের অল্প আমেজে মেতে কলকাতা। দুর্গা পূজোর মতই বই পিপাসু মানুষ মেতে রয়েছে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা নিয়ে। এসব আতংক প্রভাবিত করেনি এই শহরকে। পরিস্থিতিটা বদলে গেল মার্চের গোড়াতেই।এই কাহিনীর শুরু সেখান থেকেই।
১
পর্দাটা সরিয়ে দেওয়া মাত্র একমুঠো রোদ ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল।কাচগুলো একটা কাপড় দিয়ে মুছে আপাদমস্তক ঢাকা এ্যাটেনডেন্ড ইশারায় মালশ্রীকে মুখ ধুয়ে নিতে বলে চলে গেল।
ফিনাইলের তীব্র গন্ধ ঘর জুড়ে।মানে মেয়েটি জানলার কাচ ও ঘর এটা দিয়েই মুছল।মালশ্রী জানলাটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
এখান থেকে শুয়ে বাইরেটা দেখা যায় না।কেবল জানলার বাইরের অংশটুকুই চোখে পড়ে। অল্প একটু আকাশ। ঘন নীল মেঘ।নৌকার মত ভেসে ভেসে চলেছে। কোথায় যাচ্ছে, কোথায় যাবে সেটা বোধহয় তারা নিজেরাও জানে না।শুধু ভাসতেই জানে।এক আকাশ থেকে আরেক আকাশ ভাসতে ভাসতে তারা সীমারেখা অতিক্রম করে যায়।
প্রতিটা দেশেরই নির্দিষ্ট সীমারেখা আছে।মেঘ কি জানে সেটা?এসব ভাবতে ভাবতে মালশ্রী একটা বড় করে শ্বাস নিল।তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে বসল।
এবার বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে সিস্টারের অপেক্ষা।
এই ঘরটা ঠিক হাসপাতালের ঘরের মতো নয়।বরং সরকারি অফিসের ঘর যেমন হয় তেমনি। সাদা হোয়াইটওয়াস,তাতে নীলের বর্ডার।রঙের গন্ধে বোঝা যাচ্ছে এখনো এটার ব্যবহার শুরু হয়নি।একটা বড় লম্বা ঘরকে কাচের দরজা ও দেওয়াল দিয়ে ভাগ করা হয়েছে।এসব এমারজেন্সি ব্যবস্থা।
মালশ্রী অন্য মানুষের ছায়া বুঝতে পারছে কাচের ওপারে। কিন্তু কাচগুলো এতই মোটা সেখানে ছেলে না মেয়ে নাকি বয়স্ক এসব কিছুই বোঝার উপায় নেই। সবকিছু কেমন যেন ধূসর।
বাথরুমটাও বায়ো টয়লেট। অর্থাৎ সেটা প্রয়োজন অনুযায়ী সরিয়ে নেওয়া হবে।খুবই ছোটো সেই বাথরুমে একটা কমোড,ছোট্ট এক বেসিন আর একটা কল।তাতে কোনোরকমে স্নান করা যাবে।
এখানে আসার পর থেকে সে অর্থে ভালো করে স্নান করা হয়নি।পোশাক বলতে দু’জোড়া নির্দিষ্ট পাজামা আর ফতুয়ার মত জামা। সেগুলো যে একেবারেই নতুন সেটাও বোঝা যাচ্ছে।
ব্রাস পেস্ট সাবান স্যানিটাইজার চিরুনি আর একটা তোয়ালে বিছানার পাশে ছোট্ট একটা টেবিলে রাখা।
মালশ্রীর হঠাৎ কান্না পেল।অথচ কদিন আগে যখন কলকাতা ফিরছিল তখন মন অদ্ভুত আনন্দে ভরে ছিল।বাড়ি ফিরেই বর,শাশুড়ি আর মেয়েকে দেখতে পাবে সে।গত চারমাস ধরে অফিসের কাজে সে লন্ডনে।
ফেরার টিকিট আগে থেকেই কাটা ছিল।তখনো এমারজেন্সি ডিক্লেয়ার হয়নি।সারা পৃথিবী জুড়ে এমন পরিস্থিতি ছিল না।
জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় যখন প্রথম শুনল চিনের খবর,তখন মন কু ডাকলেও পাত্তা দেয়নি।এমন তো কত কিছু ঘটে।আবার কদিনের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।কাজেই তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে ফেরার দিকেই মন দিয়েছিল সে।
কিন্তু দ্রুত সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল জীবানু।প্রতিদিনই খবর আসছিল ইউরোপের দেশগুলো আক্রান্ত।ইতালি, স্পেন, জার্মান, এমনকি লন্ডনেও ঢুকে গেছে।আস্তে আস্তে লক ডাউন করে দেওয়া হল অঞ্চলগুলোকে। যেটুকু খাবার ছিল সেইটুকু দিয়ে ক’দিন চলার পর সরকারের তরফ থেকে বাড়ি বাড়ি কাঁচা খাবারের প্যাকেট দেওয়া শুরু হল। আর তাদের মত ক’দিনের ভিসা নিয়ে কাজে যাওয়া এমপ্লয়ীদের বলা হল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশ ছাড়তে।ততক্ষণে অবশ্য সে জেনে গেছে ভাইরাসের আক্রমণে চিন শুধু নয়,ইতালিও আক্রান্ত।এবং সেখানে মৃত্যুর হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আমেরিকা,কানাডা,জার্মানি, ইউরোপের অধিকাংশ রাষ্ট্রের পাশাপাশি ভারতেও ঢুকে গেছে। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা একে শতাব্দীর মহামারী ঘোষণা করে দিয়েছে। একাধিক দেশ আন্তর্জাতিক উড়ান বাতিল করে দিয়েছে।
মালশ্রীদের বিমানটাই শেষ আন্তর্জাতিক বিমান।তারপরই বিদেশি ও অন্য দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নাগরিকদেরও দেশে ঢুকতে দেবে না ঘোষণা করেছিল সরকার। মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল সেদিন। আবার সকলের সঙ্গে দেখা হবার সুযোগ পাওয়ার জন্য।
ইতিমধ্যে বান্ধুলি জানিয়েছে- মা আমাদের কলেজ বন্ধ করে দিয়েছে। কতদিন জানায়নি।এতদিন বাড়িতে বসে কি করব মা? আমি তো পাগল হয়ে যাব। তুমিও নেই।
বাবা তো আছে। মালশ্রী বলল।
তা আছে।তার তো এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম। সেটা আরও চাপের।
কেন?
দিন-রাত একটা ঘরে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। টিভিও দেখতে পারছি না।
কেন?
সাউন্ড হলেই বাবা রেগে যাচ্ছে। আর ঠাম্মা ঘুম থেকে উঠেই ফেসবুকে।একটা করে খবর দেখছে আর আমাকে বারবার হাত ডেটল দিয়ে ধোয়া করাচ্ছে।
মাসি আসছে?
সেতো আসছে। কিন্তু কদিন আসবে জানি না।
কেন ওখানে কি লক ডাউন ঘোষণা করেছে?
না, এখনো করেনি। তবে সারা পৃথিবী যখন ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তখন এখানেও নিশ্চয়ই কদিনের মধ্যেই করে দেবে।
হুম। বলে মালশ্রী ফোন রেখে নিজের কাজে ফিরে গেছিল। কিন্তু একটা চিন্তা তাকে গ্রাস করছিল। লক ডাউন শুরু হলে ফ্লাইট বন্ধ করে দেবে নিশ্চয়ই। এখান থেকে ফ্লাইট এখনো পুরোপুরি বন্ধ না হলেও যে হারে ছড়াচ্ছে তাতে আর কদিনের মধ্যেই সব উড়ান বন্ধ হয়ে যাবে।হয়তো তাদের ফ্লাইটই লাস্ট উড়বে।
মালশ্রীর চিন্তা আরও বেড়ে গেল দেশেও সংক্রমণের খবর পেয়ে। কলকাতায় প্রথম আক্রান্তের খবর দিয়ে মেয়ের ফোন এল। তারাও খুব চিন্তিত। কারন প্রথম আক্রান্ত ছেলেটি লন্ডন থেকেই এই ভাইরাস নিয়ে দেশে ফিরেছে।তাকে তিনদিন বাদে হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছে। ফলে লন্ডন থেকে আগত তার মাকে দেশে ফিরতে দেবে কিনা এই নিয়ে তার দুঃশ্চিন্তা শুরু হয়ে গেছিল। মালশ্রীরও যে চিন্তা হচ্ছিল না, তা নয়। কিন্তু একটাই স্বান্তনা তাদের দেশ ছাড়ার নির্দেশ এসে গেছিল।
কোম্পানি অবশ্য এসব শুরু হওয়ার আগেই টিকিট কেটে দিয়েছিল। ফলে টিকিট পেতে ঝঞ্জাট হল না। নির্দিষ্ট হেলথ কেয়্যারের বিশেষ এ্যাম্বুলেন্সে তাদের এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিল প্রশাসনের তরফ থেকে। ততদিনে পুরো দেশ ঘর বন্দী হয়ে গেছে। জনগণ যাতে বেরোতে না পারে সেইজন্য প্রতিটি মোড়ে ক্রোন বসিয়ে মনিটারিং চলছে চব্বিশ ঘন্টা। তাছাড়া বাইরের তাপমাত্রাও দিনের বেলা ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে এমনিতেই বয়স্কদের জন্য বিশেষ নজরদারী।কারন হিসেবে বলা হচ্ছে ষাট ঊর্দ্ধ মানুষেরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।
হিথরো বিমানবন্দরে কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে জ্বর পরীক্ষা, কড়া সিকিউরিটি চেকিং, মেডিক্যাল চেকিং সেরে দুবাইগামী বিমানে ওঠার ছাড়পত্র পেল মালশ্রী।
দুবাই এয়ারপোর্টে বসেই ফেসবুকে তার দেশে এই রোগে প্রথম মৃত্যুর খবর পেল। আর তার ফলে পুরো দেশে লক ডাউন ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী পরের দিন থেকেই।সে আশ্বস্থ হল তার আগেই সে পৌঁছে যাবে।
তবু মনের মধ্যে একটা সংশয় কাজ করছিল।শরীরে যদিও প্রমাণ পাওয়া যায় নি,বলা তো যায় না যদি ভাইরাস ঢুকে থাকে!এ ভাইরাস প্রথমে বোঝা যায় না।একসপ্তাহ বাদে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে শরীরে। আর তখনি দ্রুত অন্যর শরীরেও ছড়িয়ে যায়।
এয়ারপোর্টে বসে এসব ভাবার মাঝেই বান্ধুলির ভিডিও কল এল।
মা, তোমার শরীর কেমন? জ্বর বা গলা ব্যথা বা কাশি নেই তো?
নাতো রে।
তোমার এয়ারপোর্টে মেডিক্যাল চেকিং হয়েছে? রিপোর্ট এসেছে?
তাতে তো নেগেটিভ এসেছে। তাই তো ফ্লাইটে উঠতে দিল।কেন রে?
না মা চিন্তা হচ্ছে বলে জানতে চাইলাম।
ও।কোনো চিন্তা নেই। এখনো পর্যন্ত ঠিকই আছি।কাল ভোরে দেখা হচ্ছে।
মা দুবাইতেও চেক করছে?
হ্যাঁ রে।এখানেও করে নিয়েছে। জানিস বেটা, আমি এতবার এখান হয়ে এসেছি, কিন্তু এত ফাঁকা এয়ারপোর্ট আগে কখনো দেখিনি।মনে হচ্ছে সারা শহরটা জুড়ে কারফিউ চলছে।আর মুহূর্তে মুহূর্তে সব পরিস্কার করা হচ্ছে। প্যাসেঞ্জারদের স্যানিটাইজার দিয়ে গেল।বার বার হাত পরিস্কার করতে বলছে।
হ্যাঁ মা,এখানেও টিভিতে নিউজ পেপারে সর্বত্র একই কথা বলছে।বারবার হাত সাবান দিয়ে ধোওয়া,জল খাওয়া, কারোর সঙ্গে হ্যান্ড সেক না করা, এক হাত দূরত্ব থেকে কথা বলা…মা, আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে।
কিসের বেটা?আমি তো এসে যাচ্ছি কালই।
তাড়াতাড়ি ফেরো মা।আমি শুতে গেলাম।ভোরে এয়ারপোর্টে যাব তোমাকে আনতে।গাড়ি বলে রেখেছি।
না না,আসতে হবে না।আমি ক্যাব বুক করে নেব।এত ভোরে এসে করবে কী!তার থেকে বাড়িতে থেকো।আর কলিং বেল বাজালেই খুলে দিও।বাবা আর ঠাম্মা তো শুনতেও পায় না বেল বাজলেও।এত ঘুমের ওষুধ খায় যে ঘুম ভাঙে না তাদের।
মা,ডোন্ট ওয়ারি।আমি জেগে যাব।মোবাইল অন রইল।এলার্ম দিয়ে রাখছি।
আচ্ছা বেশ। শুয়ে পড়ো এবার।মুউহা…বলে মোবাইল রাখল মালশ্রী।
প্রায় সাড়ে চারমাস কলকাতা ছেড়ে থাকাটা বড় কষ্টের। বিশেষ করে বান্ধুলিকে একা রেখে আসতে মন খারাপ করে।কিন্তু অফিসের কাজের শর্তই এটা ছিল।জয়েন করার সময়ই বলা হয়েছিল বছরে একবার চার থেকে ছমাসের জন্য ইউরোপের যেকোনো শহরে তাদের ব্রাঞ্চ অফিসে কাজ করতে যেতেই হবে।
তখনও বান্ধুলি হয় নি।কাজেই এ শর্ত মেনে নিতে অসুবিধা ছিল না।মেয়ে হবার পরে তাকে নিয়েও এসেছে একবার। সেটা লন্ডন ছিল না।ফ্রান্সে গেছিল।কিন্তু তাকে ঘরে রেখে যাওয়া খুবই অসুবিধার।তবে সেখানে একটা সুবিধা ছিল।ওয়ার্কিং মাদারদের বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্য সরকার একাধিক ক্রেস বানিয়েছে।যদিও তাদের মত অল্পমেয়াদী ভিসা নিয়ে আসা ওয়ার্কিং মায়েদের জন্য তা নয়,তবু তার অফিস তাকে সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
অফিস আসার সময় সে বান্ধুলিকে ক্রেসে রেখে আসত।ফেরার সময় নিয়ে ফিরত।বান্ধুলি প্রথম প্রথম কাঁদলেও পরে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মিশে গেছিল।
মালশ্রী লক্ষ করেছিল, ভাষাটা এই বাচ্চাদের মধ্যে কোনো প্রতিকূলতা সৃষ্টি করেনি।তাদের নিজেদের মধ্যে আদান প্রদানের এক অদ্ভুত ভাষা তারা নিজেরাই আবিষ্কার করে নিয়েছিল।
এমনকি দেশে ফেরার সময় বান্ধুলি এমন কান্না জুড়ে ছিল যে মনেই হচ্ছিল না সে সেই দেশের কেউ নয়।
অনেক কষ্টে তাকে নিয়ে আসা গেছিল।
এরপর অবশ্য আর তাকে নিয়ে আসা হয় নি।স্কুল জীবন শুরু হয়ে গেছিল তার।তাছাড়া অফিস থেকেও জানিয়ে দিয়েছিল এরপর আর সন্তান নিয়ে যাওয়া যাবে না।শাশুড়ি মাও নাতনিকে আর ছাড়তে চাননি।তার যাবতীয় দায়িত্ব তিনিই সামলাতে শুরু করেছিলেন।
বিনিময়ে মালশ্রী কলকাতায় থাকার দিনগুলোতে যত রকম ভাবে সহযোগিতা তাকে করা যায় করে।বান্ধুলিকে দেখার জন্য নির্দিষ্ট সেন্টারের মেয়ে সোমা,রান্নার জন্য কনিকাদি,বাসন মাজা, ঘর মোছার জন্য পুতুল,এমনকি কাপড় কাচার জন্যও শম্পাকে রেখে দিয়েছে।
শাশুড়ি মাঝে মাঝে রেগে যান এত লোক দেখে।
এত লোক রাখার দরকার কি?সারাদিন মাথার রক্ত পায়ে ফেলে যা রোজগার করিস সবই এই লোকেদের পিছনে চলে যাচ্ছে।এখন তো বান্ধুলি বড় হয়ে গেছে। নিজের কাজ সব নিজেই করতে পারে।শুধু শুধু সোমাকে রাখার কি দরকার?তাছাড়া আমিও তো অথর্ব হয়ে যাচ্ছি। গতরে জং ধরে যাচ্ছে কোনো কাজ না করে করে।
মালশ্রী এর উত্তরে মনে মনে বলেছে, রেখেছি বলেই এই কথাগুলো বলছ।নইলে যখন রাখা হয়নি কম কথা শুনিয়েছ নাতনিকে রাখা নিয়ে!মা চলল,বাইরে,অর্থ রোজগার না ছাই!খালি বাইরে ঘোরার জন্য অজুহাত। এত যখন চাকরির শখ তো বিয়ে করা কেন বাপু!আর সন্তান নেওয়াই বা কেন?মায়েদের এত লোভ ভালো না।তাকে অনেক সাক্রিফাইস করতে হয় সন্তানের জন্য, পরিবারের জন্য।আমিও তো পারতাম চাকরি করতে।পেয়েও তো ছিলাম স্কুলে। কিন্তু শাশুড়ি করতে দিল না।সত্যি তো মেয়ে মানুষ বাইরে বেরোলে সংসার চলে কি করে!
এসব পুরনো কথা মালশ্রী আর বলতে চায় না।সে হেসে বলে, জং ধরবে কেন?এতগুলো লোককে চালনা করাটাও একটা কাজ।এই ধরো না আমাদের অফিসে এত স্টাফ। আমাদের উপরে কতগুলো বস বলোতো!একেবারে যে ওপরে তিনি কি ফিল্ডে কাজ করছেন নাকি এ অফিস ও অফিস ঘুরছেন!তিনি এক জায়গায় বসে সবাইয়ের কাজের রিপোর্ট নিচ্ছেন আর নজরদারি করছেন।তুমিও তো আমাদের সংসারের চিফ বস।তোমার কাজটা খুবই ভাইট্যাল।
শাশুড়ি এসব শুনে -যতসব বাড়াবাড়ি, বলে নাতনিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেন।
মালশ্রী এতগুলো বছরে একটা কথা উপলব্ধি করেছে, সংসারের মূল কর্তৃত্ব যদি শাশুড়ির হাতে রেখে দেওয়া যায়,আর তার সুযোগ সুবিধার দিকে নজর রাখা যায় তবে বাইরের কাজ শান্তিতে সামলানো যায়।তাই শাশুড়ি যতই বলুক না কেন একটি লোককেও সে ছাড়ায় না।
তাছাড়া তারও তো বয়স হচ্ছে। এই সুখটুকু তার প্রাপ্ত।সৌমিক এক অদ্ভুত ছেলে।সে বাড়ির কোনো খবরই রাখে না।সে কর্মসূত্রে অধিকাংশ সময়ই আমেরিকায় থাকে।অবশ্য ভাগ্য ভালো গত চার’মাস সে কলকাতাতেই।কাজেই তাকে নিয়ে আশংকার কিছু নেই।
একটা শ্বাস ফেললো মালশ্রী।মোবাইলের দিকে তাকালো।কলকাতাগামী বিমানের ঘোষণা শুরু হয়েছে। সে ধীর পদক্ষেপে এয়্যারবাসের দিকে এগোলো।
পরমুহূর্তেই মনে হল, সৌমিককে কি আদৌ আসতে দেবে তার কাছে?তাহলে তো আইসোলেসন করার দরকার হত না।
এসব ভাবতে ভাবতেই সে সামনে এগোচ্ছিল।
সিঁড়ি দিয়ে ফার্স্ট ফ্লোরে ওঠা মাত্র সে দেখল, চারজন মানুষ পুরো শরীর ওয়াটার প্রুফ জ্যাকেট মানে রেনকোটের মত দেখতে লম্বা পা অবধি ঢাকা পোশাক ,মুখ ঢাকা মাস্কে পরে বসে।খালি চোখগুলো দেখা যাচ্ছে, হাতেও গ্লাভস।চারটে চেয়ার নির্দিষ্ট দূরত্বে।প্রত্যেকের হাতেই একটা করে হলুদ মেশিন।অনেকটা বন্দুকের মত দেখতে সেগুলো। তারা এক এক করে লাইন দিয়ে দাঁড়ালো।
বুকের উপরে আটকানো ব্যাচ দেখে মালশ্রী বুঝতে পারলো তারা মেডিক্যাল স্টুডেন্ট। একজন মালশ্রীর শরীরে সেই যন্ত্রটা ঠেকালেন।তারপর নিজের সামনে রাখা ল্যাপটপে কি যেন লিখলেন।ততক্ষণে আরেকজন অমন পোশাক পরা মানুষ তার সামনে এসে বললেন,আসুন আমার সঙ্গে।
মালশ্রী তার পিছন পিছন হাঁটতে লাগল।দোতলার একটা কাচের ঘরে এসে সেই মানুষটি তাকে বসতে বলল।
মালশ্রী বুঝতে পারলো আজ থেকে এটাই তার ঘর।ঘরেতে একটি মাত্র নার্সিং হোমে পাতা বেডের মত বেড,পাশে সাইট টেবিল।সেখানে বিসলারী বোতল।আর একটা কিট।
সেই মানুষটি চলে যাবার প্রায় পনেরো মিনিট বাদে একজন সিস্টার ঘরে এল।তারও আপাদমস্তক মোড়া।তিনি ড্রেস, এককাপ চা বিস্কিট আর দুটো পাউরুটি দিয়ে জানালেন,আপনি ফ্রেস হয়ে নিন।একটু বাদে এসে ব্লাড আর স্যালাইভা নিয়ে যাব পরীক্ষার জন্য। এই প্যাকেটে খাওয়া হয়ে গেলে থুথু রেখে দেবেন।
মালশ্রী মাথা নেড়ে ঠিক আছে বলল।
সে বুঝতে পারছিল না তার এই বন্দি জীবনটা কেমন হতে চলছে!
সে টয়লেটে ঢুকল।
সৌমিকের মন ভালো নেই।তার আমেরিকা যাবার প্রোগ্রামটা ক্যানসেল হয়ে গেছিল ফেব্রুয়ারিতেই।অবশ্য তখনো কোভিড নাইন্টিন নিয়ে তেমন কোনো মাথা ব্যথা বা আন্তর্জাতিক উড়ান বাতিল হবার কোনো ঘোষণা ছিল না।
সে যেতে পারেনি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে।যাবার ঠিক তিনদিন আগে মা বিছানা থেকে নামতে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। কোমড়ে,পিঠে এমনকি মাথার পিছনেও ভালোই চোট পেয়েছিলেন।
যদিও পাছে ছেলের যাওয়া ক্যানসেল হয়ে যায় তাই তিনি বলছিলেন, তেমন কিছু হয়নি।একটু ব্যথা আছে,আর্নিকা খেলেই সেরে যাবে।
অবশ্য সৌমিক কোনো রিস্ক নেয়নি।বয়স তো ভালোই হয়েছে মায়ের।এই বয়সে হাড়গুলো দূর্বল হয়ে যায়।যদি ভেঙে গিয়ে থাকে তবে আরেক ভোগান্তি।
সে সেদিন বিকেলেই পাড়ার কাছের নার্সিংহোমের অর্থোপেডিক্সের কাছে নিয়ে গেছিল।
ডক্টর ব্যানার্জি ভালো করে চেক করে বললেন,মনে হচ্ছে কোমড়ে একটা ক্রাক হয়েছে।এখনি একটা এক্স রে করিয়ে নিন।আর আমাকে প্লেটটা পাঠিয়ে দিতে বলুন।
ডঃব্যানার্জির আশঙ্কা সত্যি করে দেখা গেল একটা ক্রাক হয়েছে।বয়স ও হার্টের সমস্যা থাকায় কড়া কোনো ওষুধ দেওয়া বা অপারেশন করা যাবে না।তিনি বললেন,এর একমাত্র ওষুধ হল সম্পূর্ণ ভাবে বিছানায় শুয়ে থাকা।প্রয়োজনে বিছানাতেই বাথরুম পায়খানা সব করা।উঠতে গেলে বিপত্তি বাড়বে।
চন্দ্রাবতী প্রথমে এই ব্যবস্থা মেনে নিতে আপত্তি জানালেও শেষ পর্যন্ত মানতে বাধ্য হলেন।তিনি ছেলেকে বোঝালেন আয়া রেখে আমেরিকা চলে যেতে।নইলে টিকিটটা নষ্ট হবে।এতগুলো টাকাও জলে যাবে।
কিন্তু সৌমিক শুধু আয়ার ভরসায় কিভাবে তাকে ফেলে রেখে যায়!তবু একবার ভেবেছিল দশ দিনের তো কাজ।করেই চলে আসবে।কিন্তু বান্ধুলি প্রচন্ড রেগে গেল।
ঠাম্মাকে এভাবে রেখে যাওয়াটা শুধু মুর্খামি তাই নয়,এক ধরনের অবহেলা বাবা।মা থাকলে অসুবিধা ছিল না।
সৌমিক মেয়েকে বোঝাতে গেল,একা কোথায়,তুই তো থাকবি,তাছাড়া দুটো আয়া থাকবে,আর বাকিরাও তো থাকছে।কটা দিন সামলে নিতে পারবি না মা?এই কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ রে।
বাবা,আমি কলেজ চলে যাব।ঠাম্মা সুস্থ থাকলে সবদিক নজরে রাখতে পারে।কিন্তু কোনো এমারজেন্সি হলে আয়া বা আমি কি করব?শোনো, পৃথিবীতে মায়ের থেকে কোনো কিছুই ইম্পরট্যান্ট হতে পারে না।
মনের মধ্যে একটা খুঁতখুঁত ছিলই সৌমিকের।মেয়ের কথায় যেন একটা যুক্তি খুঁজে পেল না যাবার।তাছাড়া মালশ্রী তখনো বাইরে। সে থাকলে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়া যেত।
সে আমেরিকার যে কোম্পানির সঙ্গে কাজ করতে যাচ্ছিল সেখানে মেল করে পরিস্থিতি জানিয়ে দিল।যদিও অনেক ক্ষতি হল,পুরো প্রজেক্টটাই পিছিয়ে গেল তবু কখনো কখনো মেনে নেওয়া ছাড়া কিছু করারও থাকে না, এই ভেবেই নিজেকে স্বান্তনা দিল সে।
কিন্তু এখন সারা বিশ্বের পরিস্থিতি দেখে সে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। ভাগ্যিস মা পড়ে গেছিল,তাই যাওয়া ক্যানসেল হল।নইলে একবার চলে যাবার পর যে কি হত!
আমেরিকায় আক্রান্তের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে তাতে অবাক বললেও কম বলা হয়।প্রথম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ধনী দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা যে এমন হতে পারে তা তার স্বপ্নেরও অতীত ছিল। এখন তো মৃত্যুর মিছিল চলছে।মালশ্রীটাও দেশে ফিরেও এখনো বাড়ি ফিরতে পারল না।তার জন্যেও ভাবনা হচ্ছে।
এসব ভাবতে ভাবতেই তার মনে পড়ল কটি লাইন-
মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব
থেকে যায়; অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে
প্রথমত চেতনার পরিমাপ নিতে আসে।
নিজেই আশ্চর্য হল সৌমিক। এতদিন বাদেও তার লাইনগুলো মনে আছে দেখে। শেষ কবে কবিতার বই ছুঁয়ে ছিল সেটাই তো এখন আর মনে পড়ে না।সংসার কর্মজীবন সবকিছুর মাঝে কবে যে কবিতা হারিয়ে গেল তার জীবন থেকে ধীরে ধীরে সে বুঝেই উঠতে পারল না।
এত বছর বাদে এই লাইনগুলো যেন তাকে বলল-আসলে এতদিন তুমি বেঁচে ছিলে না।তোমার শরীর চলছিল, শ্বাস বইছিল কিন্তু তুমি মরে গেছিলে।এই সময় তুমি বেঁচে ওঠে।
সৌমিক মাকে রাতে ওষুধ দিয়ে ঘর থেকে নিজের ঘরে যাবার আগে মায়ের ঘরের পুরোনো কাঠের আলমারি থেকে জীবনানন্দের কাব্য সমগ্র বইটা বের করে আনল। পাতা ওলটাতে গিয়ে দেখল উৎসর্গ পাতার উপরে বাঁ দিকের কোনায় লেখা- বই মেলার ধূলি মুখরিত প্রাঙ্গণ থেকে সৌমিককে মালশ্রী। তারিখ- ১৯৯৫। ২ রা ফেব্রুয়ারি।
সৌমিক সেই লেখাটার দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে।তার চোখের কোনটা টনটন করে উঠল। কি করছে এখন মালশ্রী!
(ক্রমশ)