ধারাবাহিক উপন্যাস <br /> আশ্চর্য নির্বাসন <br />চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম পর্ব <br /> বিতস্তা ঘোষাল

ধারাবাহিক উপন্যাস
আশ্চর্য নির্বাসন
চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম পর্ব
বিতস্তা ঘোষাল

প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় পর্ব একসঙ্গে — প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় পর্ব

জেট ল্যাগ আর চরম উৎকন্ঠায় কেটে গেল দুদিন। মেয়েটি ঘর মুছে চলে যাবার পর জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো মালশ্রী। সামনে যতদূর চোখ গেল কেউ কোথাও নেই। রাস্তাঘাট শুনসান।একটা বাস, অটোরও দেখা নেই। কটা বাজে এখন কে জানে! মোবাইলটা এখানে এসে থেকে চার্জে দেওয়া হয়নি বলে বন্ধ। যদিও এয়ারপোর্টে জানানো হয়েছিল চার্জার দেওয়া হবে। আদতে এখানে শুধু আলো আর ফ্যানের লাইন করা।ফ্যান লাগানো হয়নি।তবে টিউব লাইট লাগানো।লন্ডনে এখনো বেশ ঠান্ডা। আর এখানে গরমে কাহিল হয়ে যাচ্ছিল সে।কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। অভিযোগ জানাবার মত কেউ এখানে আসে না। একটাই বাঁচোয়া মশার উৎপাত শুরু হয়নি।নতুন বাড়ি বলেই হয়তো। কাঁচা রঙের গন্ধ ঘর জুড়ে।

মালশ্রী আকাশের দিকে তাকালো।এখানে আকাশটা বেশ পরিস্কার। শহরের ধুলো এখনো এর বাতাসকে বিষাক্ত করতে পারেনি তা এই সকালের আকাশের দিকে তাকালেই বোঝা যায়।নীলে নীল আকাশে মেঘের দল কেমন খেলা করছে।

কিন্তু নীল রঙ তার কাছে বিষাদের।আকাশের মধ্যে যে শূন্যতা তা যেন ধরা পড়ে এই রঙে।তারও হঠাৎ শূন্য বোধ হল।বুকটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল।যদিও কাল অবধি টেস্টে নেগেটিভ এসেছে, কিন্তু আজ যদি পজেটিভ আসে!নিজের গায়ে হাত রাখল সে।না, কোনো গরম নেই গা।তবু বলা তো যায় না,গোপনে ঘাঁটি বাঁধছে হয়তো।নিঃশব্দে যখন ছোবল মারবে তখন অবস্থা হাতের বাইরে।আর একবার সারা শরীরে ছড়িয়ে গেলে বাঁচার কোনো আশা নেই।

আলতো পায়ের শব্দ কানে এল। মালশ্রী পিছন ফিরে দেখল সিস্টার দিদি।তারও সর্বাঙ্গ ঢাকা।

সুপ্রভাত সিস্টার। মালশ্রী বলল।

উল্টো দিক থেকে কোনো উত্তর এল না। মালশ্রী দেখল, মহিলা একটি ইনজেকশনের সিরিঞ্জ বের করল।তারপর একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো।

গত দুদিন ধরে এই দৃশ্য, এই দৃষ্টি।কোনো প্রতিক্রিয়াহীণ এমন দৃষ্টি ভিতর থেকে কেমন ভয় জাগায়।মালশ্রী ভয়কে জয় করার জন্য আবারও হাসল তার দিকে চেয়ে। তারপর বেডে ফিরে হাতটা বাড়িয়ে দিল।

ব্লাড টানার মতো উপযুক্ত শিরা তার হাতে পেতে বেশ কষ্ট হয় নতুন কোনো কর্মীর। কারন এত সূক্ষ্ম যে প্রায় সময়ই তার শিরা খুঁজে পাওয়া যায় না।এবারও তার ব্যতিক্রম হল না।

সিস্টার দু’তিনবার খোঁচাখুঁচি করে রক্ত টানতে না পেরে একটা বিরক্তির দৃষ্টি দিয়ে চলে গেলেন।

মালশ্রী নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল যে জায়গাগুলো খুঁচিয়েছে,লাল হয়ে ফুলে গেল নিমেষে।

তার চোখ রাগে জ্বলে উঠল।পরমুহূর্তেই সে ফিরে গেল জানলায়।এদিকটা এতটাই নিস্তব্ধ যে পাখির ডাক খুব ভালোভাবে কানে আসছে।

একটা কোকিল এক ভাবে ডেকে চলছে। খানিকক্ষণ শোনার পর সেও কু…উ…বলে ডেকে উঠল।কিন্তু কাচের জানলা ভেদ করে সেই শব্দ কোকিলের কানে পৌঁছাতে পারবে কিনা বুঝতে পারল না।

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শূন্য দৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে রইল।কোকিলটা ডেকেই যাচ্ছে। বসন্তের মাতাল হাওয়ায় তার বিরহী প্রাণ ডাকছে প্রিয়কে।তার প্রিয় কি শুনতে পাচ্ছে!

সে আবার কু..করে ডেকে উঠল।এবার একটা অন্য পাখির ডাক কানে এল।ক্রমশ অনেকগুলো নানা সুরের ডাক শুনতে পেল।

মালশ্রী অবাক হয়ে সেই সমবেত নানা সুরের জলসা শুনতে লাগল।তার মনে হল চারদিকে এত আতঙ্কের মধ্যে একমাত্র এরাই ভালো আছে।এখন মানুষ নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত। ব্যাধ বা পাখিশিকারির দল ঘরের কোনে।এরা আনন্দে গান করছে।এ যেন মুক্তির গান। তাই এত সুন্দর।

সেই সমবেত সুরের ঝঙ্কারের মধ্যে হঠাৎ তার চোখ জলে ভরে এল।আমি কবে মুক্তি পাব?আদৌ কি আর কোনোদিন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব! মেয়েটার জন্য মন খারাপ করে উঠল।

এখানে আসার দিন বিকেলে সৌমিক এসেছিল। বাইরে থেকে দেখতে পেয়েছে।ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। তখন তার কোনো নিয়ম না মেনে ছুট্টে গিয়ে বরকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছিল।যেমন যখনি বাইরে থেকে সে বা সৌমিক ফেরে প্রথম দেখা হতেই পরস্পরকে জড়িয়ে ধরার অভ্যাস।

কিন্তু এখন এসব ইচ্ছের কোনো মূল্য নেই। দুজন দু’প্রান্তে দাঁড়িয়ে কেবল তাকিয়ে রইল।

মালশ্রীর নিজেকে মনে হল খাঁচায় বন্দী হিংস্র জন্তু।ধরা পড়ে তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। আর দূর থেকে সৌমিক তাকে দেখছে।তার চোখে জল এলেও নিরুপায়। সকলের স্বার্থে এখন দূরত্ব বজায় রাখতেই হবে।

মাত্র মিনিট তিনেক সৌমিককে দাঁড়াতে দিল সিকিউরিটি। কোনো বই পত্র দিতে দেয়নি তাকে।এমনকি মোবাইলের চার্জারটাও। সে ঘর থেকেই দেখছিল সৌমিকের চলে যাওয়া।তারপর ধীরে ধীরে ফিরে এসেছিল বিছানায়।

###

দুজনে বাড়িতে থাকলেই দিনরাত ঝগড়া করিস কেন?ভালো লাগে না বুড়ো বয়সে এত অশান্তি।

মা,তুমি সবসময় ছেলের পক্ষে কথা বলো কেন?আমি তো বলেছি একসঙ্গে একটা সিনেমা দেখতে যাব। তোমার ছেলে দিনরাত মারপিটের সিনেমা দেখে। আমার এত মারপিট ভালো লাগে না।

সৌমিক বলে উঠল,আমারও তোমার ওই ন্যাকা ন্যাকা প্রেমের সিনেমা ভালো লাগে না।

তোরা দয়া করে চুপ কর।এই বুড়ো বয়সে এসব ঝামেলা ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে সব ছেড়ে চলে যাই। শাশুড়ি মা বলে ওঠেন।

বান্ধুলি এসে যোগ দেয়। বাবা তোমরা দিন রাত এক সঙ্গে হলেই ঝগড়া করো কেন বলতো !

বাবান,আমি তোমার মাকে কিছু বলিনি।সেই আরম্ভ করেছে। আর মায়ের দালালি কোরোনা। কি পাও মায়ের থেকে!তাও যদি কাছে পেতে!

বান্ধুলি সৌমিকের চেয়েও জোরে চেঁচিয়ে ওঠে। মাইন্ড ইয়র ল্যাঙ্গুয়েজ। ডোন্ট ফরগেট আমি তোমার মেয়ে। বউ নই।আমার সঙ্গে এই ভাষায় কথা বলার অধিকার কে দিল তোমায়?

সৌমিক আরও কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে যায়।

শাশুড়ি পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে।তখনি বলেছিলাম, এ মেয়ে সংসার করার উপযুক্ত নয়।তখন প্রেম উথলে পড়ছিল।একে না হলে বিয়ে করব না।এতটুকু শান্তি নেই।

মালশ্রী কিছু না বলে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকায় শাশুড়ির দিকে।নিজের মনেই বলে অকৃতজ্ঞ মায়ের এমন সন্তানই হয়।পেট শুদ্ধ না হলে কি ভালো সন্তানের জন্ম দেওয়া যায়!

তখনি সৌমিক উঠে আসে মায়ের কাছে।আমাদের ঝগড়ায় তুমি কেন কথা বলছ?তোমার মন্তব্য করার কি দরকার?তুমি তো দিব্বি আছো।এতগুলো লোক রেখে দিয়েছে তোমার জন্য। তারপরেও তুমি মালশ্রীকে খারাপ বলছ কি করে?

বান্ধুলি বাবার কথা শুনে ঠাম্মার ঘরে আসে।বাবা,ঠাম্মার সঙ্গে এভাবে কথা বলবে না।ভুলে যেও না ঠাম্মার বয়স হয়েছে। তাছাড়া তোমরা ঝগড়া করে মরবে, মরো। তার ফল আমরা কেন ভুগব!যাও এখান থেকে।

সৌমিক চুপ করে যায়।

চন্দ্রাবতী কান্না থামিয়ে চুপ করে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।তারপর নতুন উদ্যমে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,এ আমাকে কোন ছেলের ভরসায় রেখে গেলে?এমন স্ত্রৈণ বাপের জন্মে দেখিনি।বউয়ের জন্য মায়ের মুখে মুখে তর্ক করছে!আমারই কপাল!

মালশ্রীর খুব হাসি পায় এসব দৃশ্য দেখে। সে আপনমনে হাসতে থাকে।বান্ধুলি মায়ের কাছে ফিরে এসে তাকে হাসতে দেখে বলে,কোনো লজ্জা বোধ নেই তোমাদের। এখনি অসভ্য লোকেদের মত ঝগড়া করছিলে,আবার এখনি দেখো দাঁত বের করে হাসছে।সৌমিকও এসে যোগ দেয় হাসিতে।তারপর দুজন মিলে সেজেগুজে বেরিয়ে পড়ে।

বান্ধুলি বলে দেখলে তো ঠাম্মা এদের প্রেম।তুমি আমি বোকার মতো এদের সপক্ষে কথা বলি।

চন্দ্রাবতী বলেন,তুমি কিন্তু বাবার সঙ্গে এভাবে কথা বলে ঠিক করোনি।তোমার জন্মদাতা। তাকে সম্মান জানিয়ে কথা বলা উচিত।আমাদের সময় আমরা বাবার সঙ্গে এভাবে কথা বলা তো দূরের কথা!মুখ উঠিয়ে তাকাবার ক্ষমতাও ছিল না।

ঠাম্মা,তোমার আজ কেন চোখের জল ফেলতে হয় বলোতো!তুমি মায়ের থেকে সব সুযোগ সুবিধা নাও,আর তাকেই ছেলের সামনে ছোটো করো।পালটাও নিজেকে।নইলে শেষ অবধি কেউ দেখবে না। আর শোনো বাবাটাও আমার,মাও আমার।তাদের সঙ্গে কিভাবে কথা বলব সম্পূর্ণ আমার বিষয়।

চন্দ্রাবতী নাতনির সঙ্গে তর্কে জান না।এই নাতনিকে নিয়েই তাঁর বেঁচে থাকা।নিজের ছেলে বা বউমা কেউই আসলে তার নয়,এটা তিনি উপলব্ধি করেন সহসা।তখনি আরো বেশি করে সবেধন নীলমনি নাতনীকে আকঁড়ে ধরেন।

এই মুহূর্তে সবাই কি করছে কে জানে ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মালশ্রী। তারপর চুপ করে শুয়ে পড়ে বিছানায়।

নতুন একজন সিস্টার এলেন। একই রকম পোশাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত আবৃত।এসে বললেন,সুপ্রভাত। কেমন বোধ করছেন?

মালশ্রী হাসল।এই প্রথম একজন এখানে সে কেমন আছে জানতে চাইল।সে মাথা নেড়ে বলল,ম্যাডাম আমার তো কিছু হয়নি।তবু এই নির্বাসন।

কিছু করার নেই ম্যাডাম।এটা সকলের ভালোর জন্যই করা হচ্ছে। বুঝতেই তো পারছেন,চারদিকে কেমন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে রোগটা।এতটুকু প্রিকরসান নিলে অনেকটা আটকানো যায়।

হুম।একটা নিঃশ্বাস নিল মালশ্রী। ম্যাডাম, একটা কথা ছিল।

বলুন?

আমার মোবাইলে চার্জ নেই। বাড়ির লোকেদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।

বুঝতে পারছি। কিন্তু আমরা এখানে ইচ্ছে করেই চার্জার রাখিনি।মোবাইল বন্ধ রাখা হচ্ছে আমাদেরও। তাহলে মনের উপর চাপ কম পড়বে।

কারোর সঙ্গে কথা না বলে সারাদিন এভাবে থাকা যায়?

যায়।ভেবে দেখুন এত বছরে কত কথা বলেছেন,কত কথা শুনেছেন।তাতে সাময়িক আনন্দ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু নিজের সঙ্গে নিজের কথা হয়েছে কি কখনো?একটা রোবটের মত আমরা চব্বিশ ঘন্টা কাজ করে চলি।যখন ঘুমোই তখনো মাথা কাজ করে।কখনো ভেবে দেখেছেন সত্যিকারের কোনো কথা আমরা কখনো বলেছি কিনা!

মালশ্রী সিস্টারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

তিনি আবার বললেন,এ কদিন প্রাণ খুলে নিজের সঙ্গে কথা বলুন।অজস্র কথার ভিড়ে আমাদের নিজেদের কথাটা হারিয়ে গেছে। তাছাড়া চারদিকে প্রকৃতিও কত কথা বলছে।আমরা তো তাদের কথা কখনো শুনতে চাই না,পাইও না।কারণ আমাদের হাতে সময় নেই।তাদের ভাষাও আমরা বুঝতে চাই না।এই তো সুযোগ এদের কথা শোনার।একবার শুনতে পেলে দেখবেন পৃথিবীর সব কথা ম্লান হয়ে গেছে।

কথা বলতে বলতে সিস্টার কখন যে রক্ত নিয়ে নিলেন টেরও পেল না মালশ্রী। সে মুগ্ধ হয়ে সিস্টারের কথা শুনছিল।

এখানে কতজন রয়েছেন?সে জিজ্ঞেস করল।

এখানে?তিনটে ফ্লোরে ৬০জন।প্রতি ফ্লোরে ২০জন করে।সবাই এয়ারপোর্ট থেকেই এসেছেন।

ও।চুপ করে গেল মালশ্রী।

মন খারাপ করবেন না।আপনি যুদ্ধ ক্ষেত্রে নেই, আপনার চোখের সামনে যাকে চেনেন না, কখনো দেখেননি তাকে খুন করছেন না।এখানে শুধু কিছু দিনের জন্য নিজেকে আইসোলেটেড রেখে একটা যুদ্ধ জয় করার চেষ্টা করছি আমরা।সেই যুদ্ধটা এক অদৃশ্য জীবাণুর বিরুদ্ধে। একচুল এদিক ওদিক হলেই পুরো জনবসতি শেষ। সবাই মিলে এটাকে রোধ করতে হবে।

আপনি খুব সুন্দর কথা বলেন সিস্টার।

সিস্টার হাসলেন।এবার আমি চলি।আপনি রেস্ট নিন।

একটা কথা বলব?

দুপা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন সিস্টার।পিছন ফিরে তাকালেন।হ্যাঁ, বলুন।

আপনিও সাবধানে থাকবেন।

ধন্যবাদ।কাল আবার দেখা হবে।

এখন কটা বাজে কে জানে!বাইরের আকাশ দেখে মনে হচ্ছে দুপুর।অবশ্য এই কাচগুলো দিয়ে পরিস্কার আকাশ দেখা যায় না।একটা ধূসরতা ঘিরে থাকে।খানিকটা ধোঁয়া ধোঁয়া।

মালশ্রী খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে কপালে হাত দিয়ে শুয়ে রইল।অন্য সময় বাড়িতে একটা ছুটির দিন পেতে কি ভীষণ ইচ্ছে করে।মনে হয় পরপর কদিন ছুটি পেলে সারাদিন শুয়ে বসে কাটাবে।যদিও তা কখনোই হয়ে ওঠে না।

বান্ধুলি বলে,মা,তুমি জীবনেও ছুটি কথার মানেটাই বুঝতে পারলে না।তোমার কাছে ছুটি মানে ঘুম থেকে উঠে হাতে ঝাড়ু বা ঝুল ঝাড়া। আমি তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নেও দেখি একটা লম্বা ঝুল সিলিং থেকে নিচে নেমে আসছে আর তুমি ঝুল ঝাড়া দিয়ে সেটাকে ধরার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছ।

কি করব!এত ধুলো ঝুল আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না।

শুধু কি তাই,তারপরেই তোমার ধোওয়ার কাজ শুরু হয়ে।ওয়াশিং মেশিন চলতেই থাকে সারাদিন ধরে।

হাতে ধোওয়াগুলো সবসময় ঠিকমতো পরিস্কার হয় নাতো কি করব?মালশ্রী উত্তর দেয়।

দাঁড়াও এই তো সবে শুরু।তারপর রান্নাঘরে যে বাসন জীবনে ব্যবহৃত হয় না তাও তোমার বের করে মাজা দরকার।

ঠিক আছে, এসব কিছু করব না আর।

এখানেই তো শেষ নয় মা।বাথরুম ও তো…

নোংরা বাথরুমে আমার সব আটকে যায়। মালশ্রী বলে।

তাহলে আর তোমার ছুটি কি করে হবে মা?তুমি শুয়ে বসে আরাম করে কাটাতেই পারো না।

আরে মায়েদের এসব করতেই হয়।মালশ্রী হাতের কাজ সারতে সারতে উত্তর দেয়।

বান্ধুলি হেসে ওঠে। আমি বাবা এসব কিছু করব না।ছুটির দিন বিন্দাস কাটাবো।বারোটায় ঘুম থেকে উঠব।কফি আর স্যান্ডউইচ খাব।তারপর চিল করব।দুটোয় স্নানে যাব।খেয়েদেয়ে আবার চিল।

বুঝলাম। কিন্তু এসব চিল করার জন্য তো অনেকগুলো লোক রাখতে হবে।তার জন্য অর্থ চাই। পড়াশোনা যা করছ তাতে কি চাকরি পাবে?

মা ডোন্ট ওয়ারি।আমি সব প্ল্যান করে রেখেছি।গ্রাজুয়েশনটা শেষ করতে দাও।তারপর দেখো।

বেশ।আচ্ছে দিন আয়েগার অপেক্ষায় রইলাম।ততক্ষণ আমার কাজগুলো সেরে ফেলি।বলে আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল মালশ্রী।

কিন্তু এখন তো তার কিচ্ছু করার নেই। সারাদিন খালি শুয়ে থাকা।মোবাইলও অফ।একাকীত্ব যে কী ভীষণ কষ্টের তা যেন সে নতুন করে বুঝতে পারছে।

দরজাটা খোলার শব্দে চোখ খুলল মালশ্রী একজন এ্যাটেনডেন্ট ঘরে ঢুকল।তারও সর্বাঙ্গ ঢাকা। কোনো কথা না বলে পাশে রাখা টেবিলে খাবার দিল।ইশারায় খেয়ে নিতে বলল।

মালশ্রী বিছানা থেকে উঠে বসল।

শুনুন।

এই এ্যটেনডেন্টটি পুরুষ। মালশ্রীর ডাক শুনে দাঁড়িয়ে মুখের দিকে তাকালো।

আমার শরীরে এখনো ভাইরাস পাওয়য় যায়নি।আমি হিংস্র পশুও নই।কোনো রকমে খাবারটা দিয়েই পালিয়ে যান কেন?

লোকটি হঠাৎ এমন কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।খানিকটা সামলে নিয়ে বলল, আমার শুধু এইটুকুই কাজ।অকারণে আপনার সঙ্গে কি কথা বলব?

কারন অকারণ কোনোটাতেই তো আপনি কোনো কথা বলেন না।গত কদিন ধরে এখানে রয়েছি।একটা মানুষের সঙ্গেও কথা বলতে পারছি না।এখানে না আছে টিভি,না মোবাইল এমনকি নিউজ পেপার পর্যন্ত পাচ্ছি না।এভাবে থাকলে তো যেকোনো মানুষ ডিপ্রেশনে চলে যাবে।

কথাটা শুনে লোকটি আরও ঘাবড়ে গেল।সে তাড়াতাড়ি বলল, আমি সিস্টারকে আসতে বলছি।

তারপর অপেক্ষা না করেই দ্রুত পদক্ষেপে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

মালশ্রী তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইল।

বেশ খানিকক্ষণ পর খাবারের দিকে মন দিল।ভাত, ভেন্ডি চচ্চড়ি আর ডাল, সঙ্গে ডিম সেদ্ধ,দই।

মালশ্রীর কান্না পাচ্ছে। গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইছে না। আরও কতদিন থাকতে হবে এখানে!

চন্দ্রাবতী বিছানায় শুয়ে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে।যেন তার সমস্ত ভাবনাগুলো এখন ওখানেই থমকে দাঁড়িয়ে। সময়ের কাঁটা এগিয়ে চললেও তার জীবনের কাঁটাটা ভীষণ আস্তে চলছে। ঘড়ির ব্যাটারি ফুরিয়ে আসার আগে যেমন ধীরে ধীরে সময় পিছোতে থাকে এও তেমন।এমন তো হবার কথা নয়। দিব্যি কাজ কর্ম করছিলেন।হ্যাঁ, আগের মতো দৌড় ঝাপ করতে পারেন না ঠিকই, কিন্তু তদারকি তো করেন। তাছাড়া নাতনী কলেজ থেকে ফিরলে তাকে খেতে দেওয়ার দায়িত্বটুকু এখনো তিনি নিজের হাতেই রেখেছেন।এই কাজটার মধ্যে এক পরম তৃপ্তি খুঁজে পান তিনি।

অথচ এভাবে পড়ে থাকতে হচ্ছে! কি পাপ করেছি কে জানে! নিজের মনেই বিড়বিড় করে চন্দ্রাবতী।

ছেলেটা আর নাতনিটা দুদন্ড বিশ্রাম পাচ্ছে না। লক ডাউন চলছে বলে কাজের মেয়েগুলো একটাও আসতে পারছে না। এমনকি আয়াগুলোও আসছে না। মালশ্রীটাও যদি থাকত ওদের একটু সুবিধা হত। কিন্তু এমন পোড়া কপাল! নিজের ভাগ্যকে তিরস্কার করল চন্দ্রাবতী।

জল তেষ্টা পাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে যে নেবে সেটাও পারছে না নিজে। বন্ধু… বন্ধু… একবার শুনবে? বলে বার দুয়েক ডাকল। কে জানে বান্ধুলির কানে ডাকটা পৌঁছলো কিনা! যা জোরে গান শোনে লাউড স্পিকারে। তাও যদি বাংলা হত! দিন রাত হিন্দি অথবা ইংরেজি। আজকাল আবার একটা গান শুনছে যার কোনও কথা বুঝতে না পারলেও দুটো লাইন কেবল বোঝা যাচ্ছে। বড়লোকের বিটি লো লম্বা লম্বা চুল… বাকি কথা বান্ধুলির ভাষায় ৱ্যাপ। এটাই নাকি এখন হিট।

কিন্তু এতো সেই কবেকার গান। যৌবন কালে এ গান কত শুনেছি। গানের সঙ্গে কোমড় দুলিয়েছি। কালে কালে আরও কত কী যে দেখব! মেয়েটা কী শুনতে পেল? তিনি আবার ডাকলেন।

হ্যাঁ ঠাম্মা।বলো।

একটু জল দাও বন্ধু।

বান্ধুলি জল গ্লাসে ঢেলে ঠাম্মার ঘাড়টা উঁচু করে ধীরে ধীরে খাইয়ে দিল। তারপর ঠোঁটের পাশে লেগে থাকা জলটুকু মুছে দিল হাত দিয়ে।ডায়পারটা একবার চেক করে নিল।হিসু করছ না?

চন্দ্রাবতী চুপ করে রইলেন।

জল এত কম খেলে হিসু হবে কোথা থেকে? ঠাম্মাকে মৃদু ধমক দিল বান্ধুলি।

জল খেতে গেলেও তো তোমাকেই ডাকতে হচ্ছে বন্ধু। কত আর ডাকব? তোমাদের উপরেও তো কত চাপ পড়ে গেছে।

এগুলো কোনো যুক্তি নয় ঠাম্মা। এখন যদি তোমার ইউ টি আই হয়ে যায় তাহলে আরেক সমস্যা। হাসপাতালে ভরতি করা যাবে না।

ইউ টি আই টা কি রোগ বন্ধু? সেটা কি করোনার থেকেও ভয়ঙ্কর?

আরে বাবা ইউরিনারি ট্রাক ইনফেকশন। এটা হলে ধীরে ধীরে সেপ্টিসিমিয়া হয়ে যায়। আর এখন যে রোগ নিয়েই হাসপাতালে ভরতি হও না কেন পুচকার ফাওয়ের মত করোনা ফ্রি। কাজেই দয়া করে তেষ্টা পেলেই ডাকবে।

ডাকার চেষ্টা করি বন্ধু। কিন্তু গলায় জোর পাই না। তাই তোমরা শুনতে পাও না।চন্দ্রাবতী মুখে এ কথা বললেও মনে মনে বলল, এত জোরে গান বাজলে কি আর আমার কথা তোমার কানে পৌঁছাবে?

বান্ধুলি বলল, পাশে রাখা অ্যালার্মটা বাজাতে কি হয়! তাহলে তো একবারেই ডাকটা শোনা যায়। কিছু মনে কোরো না ঠাম্মা, তুমি দিন দিন পাকা বাচ্চা হয়ে যাচ্ছ।বড়দের কথা একেবারেই শোনো না। হাজার বার বলেছিলাম, রাতে বাথরুম পেলে আমাকে ডাকবে। আমার কান খাড়া থাকে। একবার ডাকলেই শুনতে পাই। কিন্তু না, তুমি তো নিজের ইচ্ছেয় চলবে। একাই যেতে হবে তোমাকে। দেখলে তো কি হল! এখন খুব মজা পাচ্ছ!

এই শাসন চন্দ্রাবতীকে একমাত্র বান্ধুলিই করে। ছেলে- বৌমা দুজনেই তাদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। নাতনিকে ঘিরেই তো তার যাবতীয় অস্তিত্ব।

সে বকুনিটা উপভোগ করে। তারপর বলে, মার কোনো খবর পেলে? আর ক’দিন?

এই তো সবে পাঁচদিন হল।

লক ডাউন কবে মিটবে বলছে কিছু? আমি বলি কী পুতুলদের খবর দাও। এসে কাজগুলো করে দিয়ে যাক।

কুল ঠাম্মা। আমরা সামলে নিচ্ছি তো সব। একটু দেরি হচ্ছে খেতে ঠিক, কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে না।

তোমার বাবা বাসন মাঝছে, তুমি রান্না করছ, ঘর মুচছ, কাপড় কাচছো, এসব দেখতে কি আমার ভালো লাগছে?

ভালো না লাগলেও কিচ্ছু করার নেই। তাছাড়া আবাসনে বাইরের লোক ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছে।বলতে বলতে গ্লাসে জল ঢালল বান্ধুলি। ঠাম্মাকে জলটুকু খাইয়ে দিয়ে বলল, যাই বাকি কাজগুলো সেরে নিই। দেখি তোমার ছেলেটা কি করছে!

দরজার কাছ অবধি গিয়ে আবার ফিরে এল সে। চন্দ্রাবতীর মোবাইলটা পাশে রাখা টেবিল থেকে নিয়ে তার হাতে দিল। এ নাও ফেসবুক দেখো। ততক্ষণে আমাদের কাজ হয়ে যাবে। তারপর তোমাকে স্নান করিয়ে দেব আমি আর বাবা মিলে।

তুমিই দিও যা পারবে। তোমার বাবার সামনে লজ্জা করে।চন্দ্রাবতী বলল।

লজ্জার তো কিছু নেই। একদিন বাবা ছোট ছিল, তুমি সব করে দিয়েছ। এখন তুমি ছোটো হয়ে গেছ। তার পালা। এতো জীবনের সহজ হিসেব। বলে ঠাম্মার কপালে একটা চুমু খেল বান্ধুলি। তারপর বেরিয়ে এল সেই ঘর ছেড়ে। এখন তার অনেক কাজ। রান্না অবশ্য প্রায় শেষের মুখে।ডিমের ঝোল আর ভাত।এই লক ডাউনের দিনে এখনো যে ডিম ভাত খাওয়া হচ্ছে তাই তো অনেক। টিভিতে তো দেখাচ্ছে কত লোকের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে হাতে টাকা নেই বলে। কি যে হতে চলেছে আগামিদিনে- ভাবতে ভাবতে সে গানটা আবার অন করে কাজে মন দিল।

###

অরবিন্দের রাজনৈতিক চেতনা কিভাবে ধর্মীয় চেতনায় বদলে গেল জানিস? বাসুদেবের প্রশ্ন শুনে মালশ্রী অবাক হল।

জেলে বন্দী থাকার সময় তিনি সর্বক্ষণ গীতা,বেদ, উপনিষদ পড়তেন।জেলেই একদিন হঠাৎই চিত্তরঞ্জন দাস যখন তার লক-আপের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর মধ্যে কৃষ্ণ দর্শন করলেন।তারপর তো তাঁর পুরো পরিবর্তন হয়ে গেল।রাজনৈতিক নেতা থেকে দার্শনিক ও অধ্যাত্মবাদী ব্যক্তিতে পরিণত হলেন।

বাসুদেব বলে যাচ্ছিলেন। বারো বছর তিনি মৌনব্রতী ছিলেন।কারোর প্রবেশাধিকার ছিল না তার ঘরে।নির্দিষ্ট সময়ে কেউ এসে খাবার দিয়ে যেত। প্রয়োজনীয় কিছু জানাবার থাকলে তিনি একটা কাগজে সেটুকু লিখে দিতেন।পৃথিবীতে এমন আত্ম মগ্ন নির্বাসনের নজির আর নেই।

মালশ্রী এগুলো ইতিহাসে একটু আধটু পড়েছিল স্কুল জীবনে।তারপর আর সেভাবে পড়া হয়নি।আইটি নিয়ে পড়ে তাতেই কাজ।বাবার মুখে কথাগুলো শুনতে তার ভালো লাগছিল।

বাসুদেব বললেন, তিনি বলেছিলেন মানুষ নিজের মধ্যে স্বর্গীয় আনন্দ অনুভব করতে পারে যদি যথার্থ চর্চা করে। পরে এই নিয়ে বইও লেখেন। দ্য লাইফ ডিভাইন, দ্য সিনথেসিস অফ যোগা আর সাবিত্রী।

বাবা এই কথাগুলো আমাকে বলছ কেন? আমি তো সেভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাসী নই।

ঠিক। সেই কারনেই তোকে বলছি।যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে তাদের একটা সুবিধা সব তা ভালো হোক মন্দ হোক তাকেই সাক্ষী মানে,ভালো হলে পুজো দেয়,খারাপ হলে গাল দেয়,কিন্তু শেষ অবধি সবকিছুর জন্য তাকেই দায়ী করে।তুই তো সেটা পারিস না,পারবিও না।তাই তোর জন্য এই যোগ সাধনা খুব দরকার।বাসুদেব বললেন।

কেন?

এই সাধনায় মন নিজেই নিজের থেকে আনন্দ খুঁজে নেয়। তাকে আনন্দ পাওয়ার জন্য অন্য কিছুর উপর নির্ভর করতে হয় না।ধর তুই এমন এক জায়গায় রয়েছিস কেউ তোর পরিচিত নয়,তাদের ভাষা তুই জানিস না,খালি অফিসটুকু কোনোভাবে করতে পারছিস,বাকি সময় একদম একা।তখন কিভাবে ভালো থাকবি?

কেন বাবা, মোবাইল, বই এগুলো তো আছে।মালশ্রী বলল।

ধর এগুলো কিছুই নেই, তখন?

বাসুদেবের প্রশ্নের উত্তরে মালশ্রী বলল, বাবা,আমি এত এখন থেকে ভাবতে পারছি না।যখন এমন কোনো সিচুয়েশনে পড়ব তখন ভাবব।

বেশ,তবে সময় পেলে বইগুলো পড়ে নিস।কিছু না পড়লেও অন্তত গীতা পড়।

সেই তো ধর্মগ্রন্থ বাবা।

না,যারা গীতাকে ধর্মগ্রন্থ ভাবে তারা গীতা পড়েনি।এটা আসলে একটা দর্শন।যা মনকে শক্তি যোগায়।

মালশ্রী আর বাসুদেবের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বাড়ালো না।

বাসুদেব বলল, জাহাজ বন্দরে বন্দরে ঘোরে।এর যেমন প্রয়োজন তেমনি বন্দরে লাইট হাউজেরও দরকার।লাইট হাউজ দূর থেকেও দেখা যায়।তার ভিতর দিয়ে বোঝা যায় বন্দর জেগে আছে।ঠিক তেমনি নিজের মনের লাইট হাউজটাও জ্বালিয়ে রাখতে হয়। তাহলে আর কোন বাধা বিপত্তিতে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে না।

আজ এই নির্জন একা ঘরে তার হঠাৎ করেই বাসুদেবের কথাগুলো মনে পড়ল। কেমন আছে বাবা সেটাও জানতে পারছে না।

মালশ্রী জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। রাস্তাটা এঁকেবেঁকে দিগন্তে মিশে গেছে। নীয়নের আলো পড়ে তাকে হালকা সোনালী শাড়ি পরা রহস্যময়ী নারীর মত লাগছে।যতদূর চোখ গেল,কেউ কোথাও নেই। গা ছমছমে একটা নিঃস্তব্ধতা। এত বড় বাড়িটাতেও কোনো কোলাহল নেই। সব কেমন থম মেরে আছে।

মালশ্রীর মনে হল, প্রকৃতি দারুণ ক্ষেপে আছে।

আচ্ছা এর থেকে কি হাসপাতালে ভরতি হওয়া সুখের! নিজেকেই প্রশ্ন করল। সেখানে তাও অনেক লোকের মুখ দেখা যায়,নির্দিষ্ট সময়ে প্রিয়জনের মুখ দেখা যায়,বাকি সময়ও অন্য পেশেন্ট, ডাক্তার, সিস্টার,নার্সদের সঙ্গে কথা বলা যায়।কিন্তু এখানে… নিজেই নিজেকে উত্তর দিল সে।

তার চোখ ভরে উঠল জলে।তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করল।কিন্তু সে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করল,তার কন্ঠ থেকে নির্গত হল “অন্ধ জনে দেহ আলো মৃতজনে প্রাণ.. “।

সৌমিককে কবিতায় পেয়েছে।সে আলমারি থেকে পুরোনো কবিতার বইগুলো সব বের করে ফেলেছে। একটা সময় ছিল যখন কবিতা ছাড়া সে নিজেকে ভাবতেই পারত না। কত বিখ্যাত কবির সঙ্গে তার পরিচয় গড়ে উঠেছিল তাদের কবিতা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পাঠের জন্য।শঙ্খবাবু, সুনীল, শক্তি, উৎপল কুমার বসু, দিব্যেন্দু পালিত, জয় গোস্বামী … কতবার গেছে এদের কাছে কবিতা পাঠ করার অনুমতি নেবার জন্য। গড়িয়াহাটের মোড় থেকে খানিক এগিয়ে একটা আবাসনে থাকতেন উৎপলবাবু আর দিব্যেন্দু বাবু। একই দিনে দুজনের ফ্ল্যাটেই গিয়ে আড্ডা হয়েছে।

উৎপলবাবু তো প্রতিটি কবিতা নিজে পাঠ করে বোঝাতেন তিনি ঠিক কি বলতে চেয়েছেন সেই কবিতাটায়। যতক্ষণ না পুরো মানেটা পরিস্কার হত ততক্ষণ তিনি বারবার পাঠ করে যেতেন।

বলতেন, এত বার কেন পাঠ করছি বলতো! আসলে নিজেকেও ঝালিয়ে নিচ্ছি।ঠিক কি বলতে চেয়েছিলাম, কিংবা যা বলতে চেয়েছি তা কি আদৌ বলতে পেরেছি!

সৌমিক বলত, আমার তো কবিতাটা পড়ে অন্য রকম একটা ইমেজ মাথায় ঘুরছিল।

বলো, শুনি।

সৌমিক যেমন বুঝেছে তেমনি পাঠ করে শোনাতো।

এখানেই তো মজা। কবি নিজের মতো লেখেন।আর পাঠক তাকে নিজের মতো আবিষ্কার করেন। আর বাচিক শিল্পী আবার সেই একই কবিতাকে অন্য ভাবে ভাবেন।

সৌমিক মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনতো।তার মনে হত, পান্ডিত্যের দিক থেকে এনার তুলনা নেই। যদিও তাঁর কবিতার মধ্যে একটা গোলক ধাঁধা আছে, সেটা আবিষ্কার করা সাধারণ পাঠকের কাছে একটু কঠিন। তাই তাঁর কবিতা আবৃত্তির সময় সে বারবার নিজেকে ঝালিয়ে নিত।

সেদিক থেকে অবশ্য সুনীলের কবিতা অনেক বেশি পাঠযোগ্য। আলাদা করে চিত্রকল্প তৈরি করতে হয় না।সুনীল নিজেই তার লেখায় সেটা নিখুঁতভাবে ন্যারেট করে দেন।

সে সবচেয়ে বেশি গেছে সুনীলের ফ্ল্যাটে।এমনও হয়েছে ফোন না করেই চলে গেছে। সেখানেই দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে আড্ডায় মেতেছে।কত নতুন কবির জন্ম দেখল সে সুনীলের বাড়িতে বসেই।অথচ তার নিজের কখনো কবিতা লিখতে ইচ্ছে করেনি। পাঠেই আনন্দ খুঁজে পেয়েছে।

সুনীলদা বলতেন, তোমার কাজ হচ্ছে আমাদের সৃষ্টিকে সাধারণ মানুষের দরবারে পেশ করা। জানো তো কবি বেঁচে থাকেন পাঠক আর তোমাদের মত বাচিক শিল্পীদের মাধ্যমেই।

সে নিজেও বিশ্বাস করত, একটা কবিতা ভালো করে শ্রোতার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজটায় ফাঁকি দেওয়া চলে না। এমন ভাবে পাঠ করতে হবে যাতে শ্রোতার চোখের সামনে একটা দৃশ্যপট তৈরি হয়। আলো আঁধারই পথের মধ্যে দিয়ে তারা যেন ছবির শেষ দৃশ্যটা ভালোভাবে দেখতে পায়, উপলব্ধি করে। তবেই কবিতা পাঠের স্বার্থকতা।

শঙ্খবাবু আবার চুপ করে কেবল শুনতেন। খুব পরিবর্তন না থাকলে কিছু বলতেন না। তবে বাবরের প্রার্থনা শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন।

সৌমিকের বুকের ভিতরে তখন কি ভীষণ অস্থিরতা,সংশয়, উত্তেজনা কাজ করছে। কি বলবেন তিনি?যদি পছন্দ না হয় তবে আবার ভাবতে হবে নতুন আঙ্গিকে। কিন্তু এটা হাতছাড়া করা চলবে না কিছুতেই। সে আগামী বৈশাখী বৈঠকে দূরদর্শনে এটাই পাঠ করবে বলে ঠিক করে ফেলেছে।সেই অনুযায়ী যন্ত্রানুসংগীতেরও ব্যবস্থা করে ফেলেছে।

অবশেষে তিনি মুখ খুললেন। বাঃ বেশ বললেন।

সৌমিকের মনে হয়েছিল এর থেকে বড় পুরস্কার তার জীবনে আর কিছু হতে পারে না।

“এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম
আজ বসন্তের শূন্য হাত—
ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।
……
একা একাই জোরে জোরে আবৃত্তি করল সৌমিক। তখনি মনে হল এই অশান্ত সময়েও কবিতাটা আশ্চর্যভাবে প্রাসঙ্গিক।

তার হঠাৎ করেই গলার কাছটা ভারি হয়ে উঠল।চোখের পাতা ভিজে উঠল।

আমি বেঁচে ছিলাম নাকি! নিজেকেই প্রশ্ন করল সে।কুড়ি বছরে জীবনের এই পর্যায়টা কিভাবে হারিয়ে গেল একটু একটু করে। চাকরিতে প্রমোশন, দ্রুত মোটা টাকা হাতে আসা, অধিকাংশ সময় বিদেশ, এই নামকরা বিশাল আবাসনে তিন হাজার স্কোয়ার ফিট ফ্ল্যাট… এসবের ফাঁকে কখন যে সে আসলে মনে মনে মরে গেছে তা টেরও পায়নি।

আজ যখন সারা পৃথিবীর মানুষ এই গভীর অসুখে দিশেহারা তখন হঠাৎ করেই সৌমিকের মনে হল সে বুঝি দ্বিতীয়বার জীবন ফিরে পেল। তার জন্য এই লক ডাউন, এই সোস্যাল ডিসট্যান্সটা খুব জরুরী ছিল।

বাবা মানুষ কিসের অনুসন্ধানে এত ব্যস্ত? সবই তো আমরা আবিস্কার করে ফেলেছি।এমনকি আগেকার দিনে মহামারী হলে তাকে ঠেকানো যেত না,তারও ওষুধ এখন আবিষ্কৃত।তাও কেন এত মানুষ অস্থির!

মেয়ের কথা শুনে বাসুদেব হাসল।একটা সিগারেট ধরাল।তারপর খুব তৃপ্তি নিয়ে এক টান দিয়ে বলল, মানুষ খুঁজছে সৃষ্টির উৎসকে।সৃষ্টির কারন নিয়ে তার অসীম কৌতূহল।সৃষ্টি রহস্যের। সে ঈশ্বরের মন বুঝতে চায়। সেটাই তার সিদ্ধির লক্ষ্য। আবার সেটাই তার সংকটও বটে। সে তলিয়ে যেতে চায় মহাশূন্যে। দেখতে চায়, ঈশ্বর ঠিক কতটা নির্জন! কতটা একাকী!

আবার এক টান দিয়ে বাসুদেব ঠোঁটের ওপর ঠোঁট চেপে ধরল।মালশ্রীর মনে হল বাবা উত্তরটা গুছিয়ে নিচ্ছে মনে মনে।সে অপেক্ষা করল শোনার জন্য।

জানিস, প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে ঈশ্বরকে নিয়ে ভাবিনি কখনও, আজও ভাবি না, কিন্তু দার্শনিক দিক থেকে বিষয়টা আমাকে টানে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,‘ব্যক্ত হোক তোমা মাঝে অসীমের চিরবিস্ময়’, কী সেই বিস্ময়?’

এ রকম কথা কি এক দিন মনমোহন মিত্রও বলেননি? গৃহস্থ ঘরে সেই ‘আগন্তুক’ মনমোহন, যিনি ‘অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে দেহ প্রাণ’ এই দু’টি চরণ গেয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, নিজেকেই যেন বা, ‘কে দেবে আলো? কে দেবে প্রাণ?’

মনমোহন কে বাবা?মালশ্রী প্রশ্ন করল।

কিছুই কি মনে রাখতে পারিস না? দিন দিন ব্লান্ড হয়ে যাচ্ছিস।বাসুদেবের কন্ঠে বিরক্তি।’আগন্তুক’ সিনেমার মনমোহনকে মনে নেই? উৎপল দত্ত তার ভাগনী আর ভাগনী জামাইকে বলছেন।

ও। মালশ্রী বাসুদেবের মুখের দিকে তাকিয়ে। এ বাবা তার রোজ দেখা বাবা নয়। অন্য কোনো ব্যক্তিত্ব।সে শুনতে লাগল।

খোলা বারান্দা দিয়ে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বাসুদেব বলল, ঈশ্বরকণা নিয়ে খুব কথাবার্তা হচ্ছে।কে জানে, হয়তো এই ব্রহ্মাণ্ডটার আদিকাণ্ডও জানা যাবে এক দিন! কিন্তু,তারও আগে? আরও কত ব্রহ্মাণ্ড আছে! কী ছিল সেখানে? ‘কসমিক এগ’!’বলতে বলতে তাঁর কণ্ঠ মৃদু হয়ে এল, ‘খেলিছো এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে’….

ঈশ্বর মান না মান কিছু তো একটা আছে,যা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে।কি সেটা?শরীরের সব কিছু আমরা জানি,কিন্তু সব জানা স্বত্বেও হার্ট বিট বন্ধ হয়ে যায় যখন সেটাকে আর চালাতে পারি না কেন?কি সেই রহস্য? জন্মের কারন এক্স ক্রোমোজম ওয়াই ক্রোমজমের মিলন।স্পাম আর ওভা।তাহলে প্রথম প্রাণ কিভাবে কোথা থেকে এল?যত এগুলো নিয়ে ভাবি মন তত অন্ধকারে ডুব দেয়।এই ডুবটা দিতে গেলে নির্জনতা দরকার।অন্ধকার দরকার।কারন অন্ধকারের পরই আলো আসবে।

বাবা তুমি আমার সব গুলিয়ে দাও।এত জটিল বিষয় আমি বুঝি না।আমার কাছে জগত মানে নিজের কাজ,তুমি,শাশুড়ি, বান্ধুলি আর সৌমিক। এর বাইরে ছড়ানো ছিটানো বন্ধুবান্ধব।এত রহস্যের খোঁজ করে কি হবে?

বাসুদেব মেয়ের কথা শুনে হাসলেন।সিগারেটের শেষ প্রান্তটা আসট্রে তে গুঁজে বলল,চাকরি তো অনেক দিন হল।অর্থ, নাম,সম্মান,সংসার সবই পেলি।কিন্তু নিজেকে কখনো প্রশ্ন করেছিস সত্যিই কি কিছু পেলি?নিজেকে কি চিনেছিস কখনো?এই চেনাটা দরকার। নইলে জন্মালি আর মরলি,কিছুই রইল না, কেবল কদিনের আহার বিহার মৈথুন রয়ে গেল।মরে যাবার পর সব ছাই।বান্ধুলি কদিন কাঁদল,সৌমিক কদিন অফিস গেল না,তারপর সব আবার নিয়ম মেনে চলবে।কিন্তু তুই কি নিয়ে গেলি? শূন্য হাতে এলি,গেলিও তাই।যখন সময় আসবে দেখিস এই কথাগুলো তোকে ভাবাবে।

মালশ্রী দীর্ঘশ্বাস নিল। বাবা, তোমার কথাগুলো ভীষণ মনে পড়ছে।কেন তখন তোমার কথা শুনে একটু করে তোমার বলে দেওয়া বইগুলো ওলটালাম না!এখন যে দমবন্ধ হয়ে আসছে একা একা।এখানে তো কিছু পাব না।

নিজের মনেই কথা বলছিল মালশ্রী। হঠাৎই যেন মনে হল বাবার কথা শুনতে পেল।

কে বলেছে কিছু পাবি না! রবীন্দ্রনাথের গানটা মনে নেই তোর? ওই যে, বলতে বলতে গেয়ে উঠল, ‘যেতে যেতে একলা পথে নিভেছে মোর বাতি,ঝড় এসেছে, ওরে, ঝড়কে পেলেম সাথি ….’।তারপর গান থামিয়ে বলল,

মনের মধ্যে যখন ঝড় ওঠে তখন তাকে নেভানোর জন্য কোনো দমকল পাবি না।নিজের মন সাগরে ডুব দে।ঠিক পথ পেয়ে যাবি।

আমার খুব একা লাগছে বাবা।বড্ড কষ্ট হচ্ছে সবাইকে ছেড়ে থাকতে।মালশ্রী বিড়বিড় করল।

কোথায় তুই একা?এই যে তোর ঘর জুড়ে আলো,ওই যে রাস্তার পাশে ফুটে থাকা কৃষ্ণচূড়া,কেমন লাল হয়ে চারদিক রাঙিয়ে রেখেছে,তাদের পাতার সঙ্গে কথোপোকথন,কত পাখির গান, তুই শুনতে পাচ্ছিস না?কান পাত,সব শুনতে পাবি। এতদিন তুই ডানা মেলে ঘুরে বেরিয়েছিস,আজ দেখ মেঘের দল,পাখির দল সব কেমন ডানা মেলে নির্ভাবনায় ঘুরে বেরাচ্ছে।এখন আর ওদের কেউ বিরক্ত করছে না।

মালশ্রী পরিস্কার বাসুদেবের গলার স্বর কানের পাশে শুনতে পাচ্ছে।

ওই যে আকাশটা দেখছিস সেখানে হাজার হাজার তারা,নক্ষত্র, গ্রহ,উপগ্রহ। আরও কত কিছু আছে।

মালশ্রী বলল,খালি চোখে তুমি ওদের দেখতে পাও?

বাসুদেব বলল,ভালো করে তাকা,তুইও পাবি।

মালশ্রী আকাশের দিকে আবার তাকাল।কতগুলো মেঘ,কোনোটা গোল,কোনটা ভালুকের মত,কেউ বা নৌকার আকারে ভেসে যাচ্ছে।

বাসুদেব বলল,কি দেখলি?

সে বলল, আকাশ, মেঘ,

আর?

সে আবার তাকাল, অনেকটা উচুঁতে কটি পাখি নিশ্চিন্তে উড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে সে বলল, এবার পাখি দেখলাম।

আবার দেখ।

মালশ্রী দেখল সহসা একটা প্লেন আকাশ চিরে চলে গেল। বলল, প্লেন দেখলাম।

তাতে তো নতুনত্বের কিছু নেই। আকাশে একমাত্র প্লেনই চলে। আর কি কোনো যানবাহন চলে!

মালশ্রী বুঝতে পারছিল না,এরপর আলোচনা কোন দিকে যাবে! সে তাড়াতাড়ি বলল, আর তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

বাসুদেব হাসল। বলল, সত্যি পাচ্ছিস না?

মালশ্রী কাঁচুমাচু মুখে বলল,নাতো!

তুই মেঘ দেখলি,আকাশ দেখলি, পাখি দেখলি এমনকি প্লেনও দেখলি।কিন্তু আসল জিনিসটা দেখলি না।

আসল জিনিসের সন্ধানে আবার আকাশের দিকে তাকাল মালশ্রী।খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল।তারপর বিজ্ঞের মত বলল, এখন তো দুপুর, রাত হলে তারা,চাঁদ এসব দেখা যেত।আর সূর্য আছে ঠিকই, কিন্তু তার দিকে তো তাকিয়ে থাকা যায় না!দেখব কি করে?

বাসুদেব হাজার ভোল্টের হাসি হেসে বলল, লক্ষ্যভেদের গল্পটা মনে আছে? সবাই গাছ পাতা,পাখি,গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশ সবই দেখছিল,কেবল অর্জুন দেখেছিল পাখির চোখ। ওটাই তাকে বিদ্ধ করতে হত।ঠিক তেমনি তুই সব দেখলি,কিন্তু দেখলি না বা বুঝতে পারলি না প্রতিটা তারা,সূর্য,চন্দ্র, গ্রহ এক আকাশের বুকে থেকেও প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের দূরত্ব কত যোজন দূরের।এই দূরত্বটা বজায় রেখে চলছে বলেই এখনো তারা বজায় আছে,তাদের মধ্যে বিস্ফরণ ঘটেনি।যখনি কেউ কাছে এসে যায় তৎক্ষনাৎ ভয়ংকর বিস্ফরণ ঘটে।সেই তারা টুকটো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।

মালশ্রী তখনো বুঝতে পারছে না দেখে বলল, ঠিক তেমনি আমরা মানুষেরা খুব কাছাকাছি চলে এলেই নানান সমস্যা। দূরত্ব বজায় রেখে মিশলে সম্পর্কগুলো সুন্দর থাকে।এই খুব কাছে অথচ নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব মেনে চলার আর্টটা রপ্ত করা দরকার। একবার অভ্যাস করে ফেললে দেখবি সব মানুষকে ভালো বাসতে পারছিস।কারন তখন ভালো জিনিসগুলো মাথায় ঘুরবে,খারাপগুলো সহজেই মন থেকে মুছে যাবে।

সহসা তার মনে কেউ যেন সরে গেল ঘর থেকে। তার গায়ে একটা শিহরণ জাগল। সে আকুল স্বরে বলল,

তুমি আমার কাছে থাকো বাবা। আমাকে এভাবে একা ফেলে চলে যেও না।সৌমিক, বান্ধুলি কেউ আসছে না।আমি হাঁফিয়ে উঠছি,সারাদিন কেটে যাচ্ছে কারোর মুখ না দেখে। এ্যাটেনডেন্ট কয়েক সেকেন্ডের জন্য আসছেন।একবারও কেউ আমার মনের খোঁজ করছেন না।

বেশ খানিকক্ষণ ঘর জুড়ে কোনো শব্দ নেই। মালশ্রী অস্থির ভাবে বিছানা ছেড়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। কোথাও কোনো জনমানব নেই। এখন কি অনেক রাত?একটা কুকুরও ডাকছে না।তার গা ছমছম করে উঠল অজানা আতংকে।সে অস্ফুট স্বরে ঠোঁট নাড়ল। বাবা তুমি যেও না। আর ঠিক তখনি মনে হল দূর থেকে ভেসে আসছে একটা সুর। মালশ্রী জানলা দিয়ে দেখার চেষ্টা করল কোথাও কোনো এ্যাপার্টমেন্ট আছে কিনা!কিন্তু সে জানে নির্জন একেবারে শহরের শেষ প্রান্তে এই বিল্ডিংয়ের আশপাশে কোনো ঘর বাড়ি কিচ্ছু নেই। অথচ ধীরে ধীরে সে সুরটা বুঝতে পারছিল।সে আবার কান পাতল জানলায়।না,এদিক থেকে নয়,সে বন্ধ দরজার সামনে এগিয়ে গেল।অন্য কোনো নজরদারিতে থাকা মানুষ গাইছে !কে আছেন তার পাশের ঘরে,তার পাশের ঘরে?

কিচ্ছু জানে না সে। কিন্তু গানটা এখন আরো স্পষ্ট। সে অবাক হয়ে শুনতে লাগল-ডুব ডুব ডুব রূপ সাগরে আমার মন, তলাতল পাতাল খুঁজলে পাবি রে প্রেম রত্ন ধন। খুঁজ খুঁজ খুঁজ খুঁজলে পাবি হৃদয় মাঝে বৃন্দাবন, দীপ দীপ দীপ জ্ঞানের বাতি জ্বলবে…।

###

সাতদিন হয়ে গেল এই কোয়ারান্টাইন।মালশ্রী অনুভব করছে যে অস্থিরতা , উদ্বিগ্নতা নিয়ে সে এখানে এসেছিল আস্তে আস্তে তা কমে আসছে। সারাদিন মাত্র দুজনের মুখ সে দেখতে পায়।প্রথমজন টেম্পারেচার নেয়, আরেক জন খাবার দেয়। যে লোকটি মাঝে মধ্যে ঘর পরিস্কার করে তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে মালশ্রী। কিন্তু সে হাঁ জি, না জি এর বাইরে একটারও উত্তর দেয় না। খাবার দিতে আসে যে তাকে দেখে মনে হয় কোনো অস্পৃশ্য কিংবা সমাজের ঘৃণ্যতম জীবের ঘরে তাকে খাবার দিতে আসতে বাধ্য করা হচ্ছে।

সারা মুখ ঢেকে হাতে গ্লাভস দিয়ে সে পারলে ছুড়ে খাবার দিয়ে চলে যায়।প্রথম দিকে মালশ্রীর খুব রাগ হচ্ছিল, এখন বুঝতে পারে লোকটি আদতে ভীতু। নেহাত বাধ্য হয়ে কাজটা করছে।সে এখন লোকটাকে দেখলেই হাসে।বলে,আরে কি করি বলুন তো!এখনো তো রিপোর্টে পজেটিভ এল না।ভাবলাম কজন কে ছড়িয়ে তারপর নিজে মরব।অথচ আপনারা তো কামাল করে দিলেন।এখনো সদর্থক কিছু করতে পারলেন না।

শুনে লোকটা তার সারা মুখ ঢাকা কেবল চোখ দিয়ে তাকায় তার দিকে।

মালশ্রীর মনে হয় চোখ দুটো জ্বলছে। পারলে তাকে চিবিয়ে খেয়ে নিত।নেহাত সরকারি ডিউটি,তাই মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু মালশ্রীর তাকে দিয়ে কথা বলাবার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়।

মালশ্র ঠিক করেছে লোকটা এলেই ভালো ভালো কথা বলবে,তাতে যদি লোকটা তার সঙ্গে একটু কথা বলে!

এখন ঘড়ির কাটা না দেখেও সে বুঝতে পারে সকাল নটার আশপাশে।

বাবার কথা মনে পড়ল।

জানিস, আগেকার দিনে যখন ঘড়ি আবিস্কার হয়নি তখন মানুষ সময় বুঝত আকাশের দিকে চেয়ে।সূর্যের গতিবিধি, চাঁদের, তারাদের অবস্থান দেখে।এখনো অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চল আছে যেখানে সময় দেখা হয় এভাবেই।এই ঘড়ি বা ক্লক,

নামটি এসেছে ৭০০ বছর আগে লাতিন শব্দ ক্লক্কা থেকে।

একটু থেমে বাবা আবার বলত,একদম প্রথমে ছিল সূর্য ঘড়ি। এর জন্য মানুষ একটা লাঠি পুঁতে রাখতো খালি জায়গায়। আর তার পাশে গোল করে এঁকে রাখতো চক্র আর তাতে নানা সংকেত, যা দেখে তারা বুঝতে পারতো সময় কত।এর পর একে একে এল তারা ঘড়ি, জল ঘড়ি, বালু ঘড়ি, মোমঘড়ি।তবে যন্ত্র ঘড়ি প্রথম কে আবিষ্কার করে তা আজও অজানা।

কেন বাবা, আমি তো জানি আর্কিমিডিস প্রথম ঘড়ি আবিষ্কার করেছিলেন।

না, এর কোনো সঠিক প্রমাণ নেই।তবে ফিউজ স্পন্সর প্রথম হাত ঘড়ি তৈরি করেন।এটা নিশ্চিত।

বাসুদেব রাতের বেলা মালশ্রীকে নিয়ে ছাদে উঠে দেখাত চাঁদ তারা নক্ষত্র।ওই দেখ দূরের ওটা ধ্রবতারা।ওটা কালপুরুষ।ওই তারাটাকে দেখছিস? ওর নাম লুব্ধক।

এগুলোর পাশাপাশি মেয়েকে শোনাতো- মহারাজা দক্ষ প্রজাপতির সাতাশটি পরমা সুন্দরী কন্যা ছিল। তাদের নাম ছিল, অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, মৃগশিরা, আদ্রা, পুনর্বসু, পুষ্যা, অশ্লেষা, মঘা, পূর্ব-ফাল্গুনী, উত্তর-ফাল্গুনী, হস্তা, চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা, অনুরাধা, জ্যেষ্ঠা, মুলা, পূর্বাষাঢ়া, উত্তরাষাঢ়া, শ্রবণা, ধনিষ্ঠা, শতভিষা, পূর্ব ভদ্রপদা, উত্তর ভদ্রপদা এবং রেবতী। দক্ষ রাজা মেয়েদের বিয়ের জন্য উপযুক্ত বরের সন্ধান করেও একমাত্র চন্দ্রদেব ছাড়া অন্য কারো সন্ধান পেলেন না। নিরুপায় হয়ে চন্দ্রদেবের সঙ্গেই তাঁর সাতাশ কন্যার বিয়ে দিয়ে দিলেন। চন্দ্রদেব ভীষণ অসুবিধায় পড়লেন। একা তার পক্ষে সাতাশ স্ত্রীকে সামলানো কিছুতেই সম্ভব নয়। তাছাড়া তিনি ভালোবাসেন রোহিনীকে।তখন তাঁর মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল— তিনি স্থির করলেন বারো রাশিচক্রের মধ্যে তিনি তার সাতাশ সুন্দরী স্ত্রীকে এমনভাবে ঘর বেঁধে দেবেন যেন প্রতি মাসে অন্তত একবার করে তাদের প্রত্যককে সাক্ষাৎ দিয়ে আসতে পারেন। সেই ব্যবস্থা অনুযায়ী চাঁদ নাকি আজও রাশিচক্র পাড়ি দিয়ে তাঁর প্রিয়তমা পত্নীদের মাসে অন্তত একবার করে দেখা দিয়ে এসে তিন দিন বিশ্রাম করেন। চাঁদের এই রাশি পরিক্রমণকেই আমরা মাস নামে অভিহিত করি।

একটু থেমে আকাশের দিকে তাকিয়েই বলতেন, বাংলার গ্রামাঞ্চলে একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘মাসে এক বছরে বারো, এর যত কম পারো।’ বয়স্করা নববিবাহিত পুরুষদের কানে কানে এ ধরনের অলিখিত মন্ত্র বলেন বিয়ের রাতে। যার অর্থ দাঁড়ায়, যত কম স্ত্রী সংসর্গ করা যায় ততই স্বাস্থ্যের জন্য মঙ্গলজনক। তাদের মতে, মাসে এক দিনের বেশি স্ত্রীর সাহচর্যে যাওয়া উচিৎ নয়।

অথচ দেখ এই ভারতেই কত ব্রাহ্মণের একশোর কাছাকাছি বউ ছিল।শোনা যায়,এরা নাকি সারা বছর একজন করে স্ত্রীর কাছে যাবার পরিকল্পনা করতেন।মানে কারোর যদি সত্যিই একশোটা স্ত্রী থাকত তাহলে সে শেষ স্ত্রীর কাছে কবে যেতেন!বলেই হো হো করে হাসত বাসুদেব।

মালশ্রী এখন জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ক্যালকুলেট করে কটা বাজতে পারে!

প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মত সে যেমন বুঝতে পারে নটা বাজলেই পেটে টান ধরে।মানে ওই সময় লোকটি আসবে খাবার নিয়ে।

সে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। তার অনুমান সঠিক করে আপাদমস্তক মুড়ে লোকটি এল।

আজ মালশ্রী তাকে উত্তেজিত করে এমন কোনো কথা বলল না।আসা মাত্রই হেসে সুপ্রভাত বলল।

তারপর বলল,এ রকম পোশাক পরে থাকতে বড় কষ্ট হয় বলুন।আপনি নিজে খাওয়া দাওয়া করছেন তো সময় মতো!ঠিক করে খাবেন।জানি,আপনার প্রচুর কাজের চাপ,তবু,নিজের খেয়াল রাখবেন।

মালশ্রী লক্ষ করছিল লোকটি একটু অবাক হচ্ছে তার কথায়।সে খাবারটা রাখতে রাখতে আড়চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে।

মালশ্রী সেটা খেয়াল করেই বলল,কি এক অদ্ভুত রোগ এল! সারা পৃথিবীর মানুষকে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে।

লোকটি যে তার কথা শুনছে মালশ্রী অনুভব করছে। সে আবার বলল,কি ঝামেলা বলুন তো!

লোকটি হঠাৎ করে বলে উঠল, কলিযুগ, ঘোর কলিযুগ। মানুষের পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়ে এসেছে। এবার সে ধ্বংস হবে।

মালশ্রী চাইছে লোকটি আরও খানিকক্ষণ থাকুক। তার সঙ্গে কথা বলুক।সে এবার বলল,আপনি কি শ্রীকৃষ্ণের কথা বলছেন?

না,আমি কিছু বলছি না।কিন্তু শাস্ত্রের কথা সত্যি হবেই।হতেই হবে।বলে লোকটি আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো।

মালশ্রী শেষ বারের মত চেষ্টা করল।শাস্ত্রে বলেছে নাকি মহাভারতে?

লোকটি দরজা টেনে দিতে গিয়ে একবার পিছন ফিরল।বলল,এখান থাকে বেরিয়ে আমাদের শাস্ত্রগুলো পড়বেন।তাতে সব লেখা আছে।

লোকটি চলে গেল।মালশ্রী আবার একা।সিস্টার সেই বিকেলে আসবেন।এই লোকটি অবশ্য দুপুরে আরেকবার আসবে লাঞ্চ দিতে।

মালশ্রী বিছানা থেকে উঠে টেবিলের কাছে গেল।পাউরুটি মাখন দিয়ে, ডিম সেদ্ধ আর একটা কলা।এই সময়টা চা খেতে বড্ড ইচ্ছে করে।কিন্তু চা দু’বারই বরাদ্দ। সেই ভোর বেলা একজন এসে চা আর দুটো বিস্কুট দিয়ে চলে যায়।তার আসা ও যাওয়া এত দ্রুত গতিতে যে মালশ্রী উঠে ভালো করে তার মুখটাও দেখতে পায় না।বিকেলে সিস্টার যখন টেম্পারেচার মাপতে আসে তখন তিনিই চা নিয়ে আসেন।মালশ্রী বুঝতে পারে,এই বিপর্যয়ে অধিক স্টাফের সংকুলান করা অসম্ভব।

তাছাড়া এখন রাজ্য জুড়ে লকডাউন শুরু হয়ে গেছে। রাস্তা ঘাট শূন্য। গাড়ি বন্ধ। ফলে যারা এখানে কাজ করছেন তারা বাড়ি ফিরতেও পারছেন না।

এসব কথা সে শুনেছে সিস্টারের থেকে।একমাত্র এই সিস্টারটি এলেই তার সঙ্গে একটু কথা হয়।

সিস্টারটির নামও সে জেনে গেছে। সাবিনা।প্রথমে নিজের নাম বলতে চাননি।বলেছিলেন কি হবে জেনে!

মালশ্রী বলেছিল,কিছুই হবে না।একটা কৌতূহল মাত্র।

উত্তরে বলেছিলেন, আপনি তো হিন্দু। সারনেম দেখে মনে হয় ব্রাক্ষ্মণ!

মালশ্রী খুব জোরে হেসে উঠেছিল। বলেছিল,আপনি সেদিন যে কথাগুলো শোনালেন আমাকে,তা শুনে আমার মনে হয়েছে আপনি একজন মানুষ, আর মানুষের একটাই জাত,একটাই ধর্ম।তা হল মনুষ্যত্ব।এই যে এই নির্জন জনমানবহীন দ্বীপে আপনি আমাকে আশার আলো দেখাচ্ছেন তাতে আপনি আমার কাছে ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গল।

কি যে বলেন আপনি? কার সঙ্গে কাদের তুলনা?তিনি এক এবং অদ্বিতীয়ম।

মালশ্রী হেসে বলেছিল, আমি তো তাকে দেখিনি,শুধু গল্প শুনেছি। কিন্তু আপনার মতো যারা সেবাকেই জীবনের ব্রত করে নিয়েছেন, এত রকম রুগীর সঙ্গে থেকে যেকোনো মুহূর্তে নিজেদের মধ্যেও রোগ ছড়িয়ে যেতে পারে জেনেও চেষ্টা করছেন আমাদের ভালো রাখতে তারাই আমার কাছে ফ্লোরেন্স।

না, আপনার সঙ্গে কথায় পারব না। হেসেছিল সাবিনা। তারপরে টেম্পারেচর মেপে চলে গেছিলেন।

(ক্রমশ)

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes