‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’— মহাকাব্যিক চলনের অ্যান্টি-গাথা অথবা অজিত সিং কৌন হ্যায়? <br />সুদীপ্তা সর্বজ্ঞ

‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’— মহাকাব্যিক চলনের অ্যান্টি-গাথা অথবা অজিত সিং কৌন হ্যায়?
সুদীপ্তা সর্বজ্ঞ

গ্রন্থ- অজিত সিং বনাম অজিত সিং তৃষ্ণা বসাক প্রকাশক- দে'জ পাবলিশিং প্রচ্ছদ - মৃণাল শীল ৪৯৯ টাকা

আমিই অজিত সিং। আমিই দোলন। আমিই ভবানী— নামের পেছনে লুকিয়ে থাকা সব গল্পই আমার গল্প। আমিই এই সমাজ। ‘আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে/ আমরা দুজনে সমান অংশীদার/ অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে,/ আমাদের ‘পরে দেনা শোধবার ভার।’— সমাজে যা হচ্ছে, রোজ যা হচ্ছে, তাকে এড়িয়ে পাশের রাস্তা ধরে হেঁটে চলে যাওয়া যায়। সহজে। রাতে বাড়ি ফিরে যথেষ্ট ঘুমও হয়তো আসে। কিন্তু হঠাৎ— ‘ঘুমোনো ছাড়া এই মুহূর্তে আর কাজ নেই তাঁর। তাঁদের পার্টি সাইনবোর্ড হয়ে গেছে সবাই বলে। তাঁরা নাকি রিপ ভ্যান উইঙ্কলের মতো ঘুমোচ্ছিলেন এতো বছর। পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে, বুঝতেই পারেননি। ঘুম থেকে উঠে তারা দেখলেন পৃথিবীটা পাল্টে গেছে’ — এমন যদি হয়? এই হঠাৎ ঘুমিয়ে পরা আর ঘুম থেকে জেগে ওঠার ভয় কিছু মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট লিখে প্রতিবাদ জানান না, কফি-আড্ডায় হাহাকার করেন না; বরং লিখে ফেলেন একটা গোটা উপন্যাস। শুধুই কি উপন্যাস? তিনদিনে পড়া শেষ করেছি ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’। মন তখন ছিল ‘স্বপ্নে দেখা ঘরদুয়ার’-এ। কিন্তু কী এমন হল, পড়তে পড়তে ঘাড় বেয়ে ঠাণ্ডা এক ব্যথা নামল। দেখলাম রক্ত এল রাগ এল না, বিষাদ এল স্মৃতি এল না, রঙ্গ এল কৌতুক এল না। চরিত্ররা না কেউ আমায় প্রশ্ন করল, না আমি তাদের। শুধু একই বাড়িতে, একই ঘরে, কখনও একই খাবার টেবিলে প্রায় মুখোমুখি বসে খেলা দেখার ভঙ্গিতে এদের সঙ্গে বাহাত্তর ঘণ্টা সময় কাটানোর পর ‘পুকুর, মরাই, সবজি-বাগান, জংলা ডুরে শাড়ি,’-তে আমার আর ফিরে যাওয়া হল না। কী এক ভয়ঙ্কর তাগিদে লিখতে বসলাম এই লেখা।
অজিত সিংকে আমি চিনি। আমরা সবাই চিনি। তাকে অ্যান্টি-হিরোর তকমা দেওয়া যাবে কি না সেটা আমাদের ভাবাবে। দাদাজীর কথা সে কি মনে রেখেছিল? — ‘পয়সা তো কামাতেই হবে জীবনে কিন্তু পয়সার পিছনে বেশি ছুটিস না, কারণ পয়সা থাকে না। নাম থাকে।’— যে অজিত সিং-রা শুধু পয়সার পেছনে ছোটে, নিজেকে একটা ‘ইন্ডাস্ট্রি’ বানাতে চায়, তাদের তো দেখেছি; পাইনি তাদের মনের খোঁজ। না, বাঙালির মনের খোঁজ বলিনি। ‘বাঙালি তো শুধু নেতাজীর নামে মেট্রো স্টেশন বানাতে পারে।’— বাঙালির জন্য কিছু করে যাবে অজিত সিং। কেউ তার কথা মনে রাখবে কি না তা নিয়ে সে ভাবেনি। ‘বাঙালি মেয়েগুলো পুরো মাকখন’, তা-ই দেখে গলে যায় সে। মফসসল থেকে আসা মোহরমালা, ভবানী শাস্ত্রীর শুভেচ্ছায় যে এখন উচ্চপদের চেয়ারে বসে কনুই অবধি গড়িয়ে আসা ক্ষমতার স্বাদ চেটেপুটে খায়, সেই মোহরমালা শনিবারের রাতে দরজা খুলে দিলে একটা গোটা বাঙালিজীবন গিলে নেয় অজিত সিং। লিখতে লিখতে মনে হল ট্র্যাজিক হিরোর সংজ্ঞায় চরিত্রটির মধ্যে থাকবে দোষ ও গুণের এক অদ্ভুত সমন্বয়, যার পতন অবশ্যম্ভাবী শুরু থেকেই, ক্যাথারসিসের লোভে লেখক এবং পাঠক দুজনেই তার পতনের অপেক্ষায়। একটি সার্থক ওয়েবসিরিজের ফর্মে ভাবলে এই গল্প জুড়ে বারবার ফিরে আসবে কিছু গরুর দৃশ্য। ৩৫৫ পাতার এই সিনটা:
‘কালিকাপুর থেকে গাড়ি ব্যাক করতে গিয়ে একদম বোমকে গেল পটা। শুধু গরু আর গরু। এতো গরু এল কোত্থেকে? আবার এত রাতে! চারদিকে গমগমে শহর, তারমধ্যে এত গরু কোথা থেকে এল?’
হোমারের ‘ইলিয়াড’-এ যুদ্ধের শেষ কয়েকদিনের বর্ণনা আছে। উত্থান ও পতনের মাঝে ছেড়া ছেড়া কিছু সুতো দিয়ে নিটোল এক গাথা তৈরি হয়েছে সেখানে। এই উপন্যাসে এক বসন্ত থেকে আরেক বসন্তে যাওয়ার পথে হারিয়ে যায় বিদিশা আর দোলন। সাথে মার্কেজ। সে ‘এসে দাঁড়ায় দোলনের কাছে, দোলন বলে ‘চলো’।’ সর্বজ্ঞ ভবানী শাস্ত্রী সর্বনিয়ন্ত্রক হয়েও হার মানেন পোয়েটিক জাস্টিসের কাছে। ভবানীর জ্যোতিষ। ক্ষমতার খেলায় তিনি শাসক ও শোষক। প্রথিতযশা অভিনেত্রী ছেলের ভবিষ্যৎ জানার জন্য লুকিয়ে আসেন তাঁর কাছে। ‘তাঁকে সবাই শাস্ত্রীজী বলে, ভবানীদা বা ভবানীবাবু বলার সাহস কারো হয় না।’
‘অজিত মাঝেমাঝে চোখ বন্ধ করে ভাবে জীবনের মানে কী তার কাছে। অনেক ভেবে সে দেখেছে জীবন মানে হচ্ছে অ্যাকশন। বেঁচে যদি থাকতে চাও তবে তোমাকে অ্যাকশনে নামতেই হবে।’ আর যদি তা না করো তাহলে ঘুমিয়ে পরতে হবে পদ্মনাভর মতো, আর ঘুম ভেঙে কোটি যোগিনীর গলি ও শতরূপা। আমরা নিজেদের মধ্যে, নিজেদের শরীরে নিজেদের অজান্তেই ধারণ করেছি নিয়তি নির্ধারিত এই তিন চরিত্র— পদ্মনাভ, ভবানী, অজিত সিং। ইলিয়াডে অ্যাকিলিসের মৃত্যুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা নেই, আছে তার গোড়ালির কথা। গোড়ালি তীরবিদ্ধ হওয়ার কথা। উপন্যাসের শেষে অজিত সিং মৃত্যুর ঠিক আগে ছেলেবেলায় হারিয়ে যাওয়া তিতলির খোঁজ পায়। দোলন। দোলন হারিয়ে গিয়ে অজিত সিংকে ফিরিয়ে দেয় ‘নীল আর গোলাপী ফুলফুল ছাপ জামা পরা বুকের কাছে আবার একটা হলুদ প্রজাপতি’র মেয়েটিকে। দোলনের লড়াই, শ্রমজীবী মেয়েদের লড়াই, ফেলে আসা স্টেশনের সিঁড়ি গুনতে না পারার লড়াই, যোগ্যপ্রার্থী হয়েও চাকরি না পাওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই— এক বসন্তের ভোরে রঙিন রোদ হয়ে নেমে আসে আমাদের সকালে। সাঁকোর উপর শান্ত হয়ে এসব দাঁড়িয়ে দেখে আমাদের সমাজ। এত মায়া চারপাশে! অথচ কী অস্থিরতা! অস্থিরতা লেখাজুড়ে। ন্যারেটিভ স্টাইল দু’দণ্ড শান্তি দেবে না পাঠককে। সচেতনভাবে পাঠককে সতর্ক করে রাখার কী আশ্চর্য এক পরিকল্পনা! ‘দ্য হোয়াইট টাইগার’এর মুখ্য চরিত্র বলরাম যেভাবে নিজের গল্প বলা শুরু করে, শুরু করে তার সাদা বাঘ হয়ে ওঠার গল্প বলা, সেখানেই অজিত সিং নিজের গল্প বলা থামিয়ে দেয়। আমাদের কি কোনও দায় থাকে রাজনীতির অলিন্দ থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে মুক্ত করার? ক্ষমতার আরামকেদারায় বসার লোভ থেকে নিজেকে মুক্ত করার? অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের অধিকার থেকে নিয়মিত বঞ্চিত হতে থাকলে তার প্রতিবাদ করার? — না, দায় হয়তো নেই। দায়িত্ব আছে। সেই দায়িত্ব থেকে আমরা যখন সরে আসি, যখন নিশ্চিন্তঘুমে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার মজাই আলাদা ভেবে শীতকালে চিড়িয়াখানা আর গ্রীষ্মে দার্জিলিং, আর মাঝে কিছু সাহিত্যমেলা— তখন ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’ এর মতো উপন্যাস আমাদের অস্বস্তিতে ফেলে। নড়েচড়ে বসতে হয়। চোখে আঙ্গুল দিয়ে কেউ দেখিয়ে দেয় — ‘অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?’ আমরা ভাবি, আহ খুব কি দরকার এই লেখা নিয়ে কথা বলার? সমস্যার শুরু এখানেই। উত্তরটা, হ্যাঁ।
যদি ভাবি মহাকাব্য, তবে মহাকাব্যিক চলনে চরিত্রটি হবে জীবনের অংশ অথচ জীবনের থেকে অনেক বড়ো। অজিত সিং তো আমাদের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা দুঃসাহসের আরেক নাম। শিক্ষাকেন্দ্র থেকে অফিস-রাজনীতি সর্বত্র ‘সিং ইজ কিং’। যদি বলি মহাকাব্য, তবে প্রেক্ষাপট হবে বিস্তৃত – ব্যাপ্তি তার বিশ্বজুড়ে। এই গল্পের ব্যাপ্তি আমাদের চেনা জায়গা। বরানগর থেকে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি হয়ে কখনও তা আশেপাশের জেলা্র সর্ষেক্ষেত ঘুরে আসে। যদি চাই মহাকাব্য, তাহলে কর্মকাণ্ড হবে অত্যাধিক সাহসের নির্ভরে, চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া কিছু। যা আমরা ভাবতেও সাহস পাই না কিন্তু কেউ করছে দেখলে আনন্দে ভেসে যাই। অজিত সিং করে দেখিয়েছে বাঙালি যা ভাবতেও পারেনি। সে ‘একার চেষ্টায় বাংলায় শিল্প ডেভেলপ করে ফেলল, আগে তো সুপারি মানেই বিহার থেকে আসবে। সেই ট্রেন্ড ভেঙে দিল অজিত…।’ যদি আঁকি মহাকাব্য, চরিত্রদের মুখের ভাষা পরিমার্জিত, কথা বর্ণনাবহুল। উপন্যাসের চরিত্রদের কথোপকথনে বারবার উঠে এসেছে সময়ের দাবি, ইতিহাস হতে চাওয়া ঘটনার সাক্ষী কিছু শব্দবন্ধ, প্রাসঙ্গিক যা-কিছু প্রয়োজনীয় উত্থানের চটজলদি হিসেব বুঝে নিতে, তেমন কথা। যদি গাই মহাকাব্য, অলৌকিকতা সেখানে অবশ্যম্ভাবী। এমন উপকরণেরও অভাব নেই এখানে। ভবানী শাস্ত্রী এবং ক্ষমতার গুপ্ত অথচ স্পষ্ট আলোয় ডুবে থাকা চরিত্ররা দেখিয়েছেন কীভাবে যোগ্যতমের উদ্বর্তন থামিয়ে দেওয়া যায় অনায়াসে, আবার অযোগ্যের মাথায় পরিয়ে দেওয়া যায় সম্ভ্রান্ত মুকুট। মৌখিক ট্র্যাডিশন মানলে, মহাকাব্য হয়ে ওঠার আগে সেসব গল্প ছড়িয়ে পড়ে মুখ-মুখে, গলিতে-গলিতে, ঐতিহ্যের পরম্পরায়। এই উপন্যাসের প্রতিটা গল্প আমাদেইর গল্প। শুরুতে তাই বললাম চরিত্রের পেছনে সব গল্পই আমাদের ভীষণ চেনা। দুর্নীতির দৌরাত্ম্যে কে কাকে হারাবে সেই যুদ্ধের পরম্পরা সকাল থেকে রাত আমাদের জাগিয়ে রাখে।
দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত তৃষ্ণা বসাকের ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’, এই দীর্ঘ উপন্যাসটিকে অ্যান্টি-মহাকাব্যের আওতায় আনা গেল কি গেল না জানি না, আনার প্রয়োজন আছে কি না তা-ও জানি না। এটুকু জানি সহযোদ্ধারা এই লেখা পড়ুন, পড়ান। কথা বলুন এই লেখা নিয়ে।


আলোচক একজন লেখক, সম্পাদক ও প্রকাশক

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes