
সিনেমা রসিকের দর্শন
সব্যসাচী মজুমদার
সিনেমা এবং সিনেমা: সিদ্ধার্থ সাঁতরা:হাওয়াকল পাবলিশার্স:দাম - ৪০০ টাকা: প্রচ্ছদ - বিতান চক্রবর্তী
সিনেমা এবং সাহিত্যের সম্পর্ক বিষয়ক আলোচনা নতুন কিছু নয়। নতুন নয় আদানপ্রদানের সম্পর্কটিও। আদৌ সাহিত্যকে সিনেমা যথার্থ ভাবে প্রতিফলিত করতে পারে কিনা! কিংবা সিনেমার ভাষা সাহিত্যের সঙ্গে কোন সূক্ষ্মতায় স্বাতন্ত্র দাবি করে – এসব চর্চিত ও অনিঃশেষ তর্কের ভেতরে প্রবেশের বাচালতা প্রকাশ করার ইচ্ছেয় নয়,এক সাহিত্য রসিকের সিনেমা দর্শনের প্রীতিময় ভাষার পাঠই এ আলোচনার সর্বস্ব হতে চলেছে। সিদ্ধার্থ সাঁতরা রচিত ‘ সিনেমা এবং সিনেমা ‘ পাঠের একটি আনন্দ রয়েছ।বইটির বিন্যাসে প্রথমেই যেটি পাঠককে আকর্ষণ করতে পারে বলে মনে হয়,সেটি হল ভাষার আন্তরিকতা। গূঢ় তত্ত্বের শিক্ষকতার ভঙ্গিটি ত্যাগ করে লেখক মূলত চিন্তা ভাগ করে নিতে চেয়েছেন।আর এই ভঙ্গিটি বিশেষ করে এই পাঠকের মতো সিনেমা দেখতে ভালোবাসা মানুষদের খুব সুবিধা হয় বলেই মনে হয়।
খুব সারল্যের বিণ্যাস যে রয়েছে এই গ্রন্থে তা নয়, এবং বিষয়ও যে সাধারণ পাঠকের কাছে খুব সহজ তাও নয়। কিন্তু সিদ্ধার্থ বাবুর গদ্যের আন্তরিকতায় সিনেমার বাইরের মানুষও সিনেমাকে ভালোবাসতে শিখে ফেলে। ভারতীয় সিনেমা থেকে আফ্রিকার সিনেমা,প্রতিবাদের সিনেমা বা মানবাধিকারের সিনেমার মতো ভিন্ন ভিন্ন সিনেমার ভাষার পরিচয় ধরে রেখেছে এই বইটি।একই সঙ্গে সিনেমার এক একজন ব্যক্তিত্ব, আন্তর্জাতিক সিনেমাকে সাবালক করে তুলেছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন যেমন লুই বুনুয়েল, গঁদার, পূর্ণেন্দু পত্রী কিংবা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ফিরে দেখা গেছে এই বইয়ে। এমনকি চলচ্চিত্র রসিক বীতশোক ভট্টাচার্য পর্যন্ত আলোচিত হয়েছেন গ্রন্থে।কেবল এক সিনেমা রসিকের দর্শন হিসেবে বইটিকে চিহ্নিত করলে হবে না, তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশের মানুষ কিভাবে সিনেমাকে গ্রহণ করেছে কিংবা কতটাই বা গ্রহণ করেছে তার একটি ধারণাও বটে বইটি।একই সঙ্গে ভালো লাগে প্রত্যেক ব্যক্তিত্বের সামগ্রিক কাজের একটি নিষ্ঠ নথিও উপস্থাপিত হয়েছে আলোচনাগুলির মধ্যে।তার ফলে একজন প্রাথমিক পাঠক বিশ্ব সিনেমার তথা ভারতীয় সিনেমার রদবদলের,বিবর্তন ও কম্পনের প্রহরগুলিকে চিনতে পারে।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ধরে রেখেছে বইটি,সেটি বলা জরুরি – পরিচালকের বৈশিষ্ট্য যাতে স্পষ্ট ফুটে উঠতে পারে, সেরকম এক একটি ফ্রেম ধরে আলোচনা এগিয়েছে কিছু ক্ষেত্রে।বিষয়টি কিন্তু সিনেমার ছাত্রদের পক্ষে প্রয়োজনীয়, তেমনই আলোচকের সিনেমা দেখার নিগূঢ় ক্ষমতার উদাহরণ হয়ে ওঠে,
“পরের ছবি ‘বেল দ্য জুর'(Belle de Jour ১৯৬৬)। ছবি শুরু স্বপ্ন দৃশ্য দিয়ে। পাতা ছড়ানো এক নির্জন রাস্তায় ঘোড়ার গাড়িতে যাচ্ছে স্বামি-স্ত্রী পিয়ের ও সেভেরিন। সেভেরিনের কেমন এক সন্ত্রস্ত ভাব। পিয়েরের ডাকে স্বাভাবিক ভাবে সে সাড়া দেয় না। পরে পিয়েরের নির্দেশে দু-জন কোচোয়ান সেভেরিনকে চাবুক মারে এমনকী সে অনুমতি দেয় উপভোগ করার। সেভেরিনের মনে হয় সে পিয়েরকে ভালোবাসে কিন্তু সবসময় চায় না। স্বামীর শীতল আচরণে সে আর্ত হয়ে ওঠে। দাম্পত্য জীবনে কামনা মেটে না বলে দুপুর দুটো থেকে বিকাল পাঁচটা তিনঘণ্টার জন্য সে এক বিলাসগৃহে দেহপোজীবনীর কাজ নেয় যেখানে এক মঙ্গোলীয় ব্যক্তি ঘন্টা বাজিয়ে মন্ত্রোচ্চারণের পর যৌন সম্পর্ক করে। ছবিতে ফ্যান্টাসির প্রভাব আছে, আছে পরাবাস্তবতারও প্রভাব। বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় অবক্ষয়ী মনস্তত্ত্বের শিকার সেভেরিনকে কিন্তু বুনুয়েল ক্ষমা করেননি। সমালোচকরা এই ছবিকে বলেছেন দার্ঢ়্য, মনন ও নৈর্ব্যক্তিকতার ছবি।”(পৃঃ:৯৭,লুই বুনুয়েল:অবাধ কল্পনার অধিবাস্তবতাবাদ)
কথা হচ্ছিল লুই বুনুয়েলের সিনেমা সম্পর্কে।সহজ ভাষা আর সম্পৃক্ত দৃষ্টির নিপুণ মেলবন্ধনে পরিচালকের স্বভাব ও স্বাতন্ত্র ফুটে উঠে অত্যন্ত স্পষ্টতায়। নবীন চলচ্চিত্র দর্শকের কাছে একটি সহায়ক হয়ে ওঠে এই ছোট ছোট নির্মেদ আলোচনাগুলি।
আবার,”তাঁর ছবির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল চরিত্রগুলি পরিবারহীন। তাদের মা, বাবা, ভাই বোন ইত্যাদি কোনো আত্মীয়স্বজনকে কোনোদিন দেখা যায়নি কিন্তু ছবিতে ব্যক্তিমানুষের সঙ্গে সবসময় জুড়ে আছে সমাজ, সময়, রাজনীতি, আন্দোলন সংগ্রাম থেকে কমিউনিজম সহ নানা প্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ। তাঁর শেষ দিকের একটি ছবি Film Socialisme (২০১০)-এ গদার তিনটি আন্দোলনকে বিষয় করে নিজস্ব ছন্দে ছবিটি করেছেন। প্রথম আন্দোলনের বিষয়টি একটি জাহাজের ঘটনা (প্রসঙ্গ: সেই সব ঘটনাগুলি) যেখানে নানা ভাষাভাষী যাত্রীদের মধ্যে প্রধান চরিত্র হিসেবে তুলে ধরেছেন এক বৃদ্ধ যুদ্ধপরাধী, এক প্রাক্তন রাষ্ট্রসংঘ আধিকারিক এবং এক রাশিয়ান গোয়েন্দাকে। এখানে যুদ্ধ, পুঁজিবাদ সহ নানা বিষয়কে বিশ্লেষণ করেছেন। দ্বিতীয় ঘটনাটি (প্রসঙ্গ: আমাদের ইউরোপ আন্দোলন) এক গ্যাস স্টেশনে একজোড়া শিশুর যারা দু- ভাইবোন। সেখানে তাদের বাবা-মাকে সমন পাঠিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে স্বাধীনতা, সমানাধিকার ও একাত্মতা বিষয়ে তাদের অবস্থান। শেষ ঘটনাটি (প্রসঙ্গ : আমাদের মানবতা আন্দোলন) ছ-টি বিখ্যাত স্থান ইজিপ্ট, প্যালেস্টাইন, ওডেসা, গ্রীস, নেপলস এবং বার্সেলনা দিখতে যাওয়া। একেবারে অন্যরকম ছবি।” (পৃঃ ১০০;জঁ লুক গদার: গতানুগতিকতার বিরুদ্ধাচার)
গদারের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লিখতে গিয়ে জানাচ্ছেন সিদ্ধার্থ বাবু।গদার প্রেমিক থেকে গদার অনুসন্ধানী সকলের কাছেই এ আলোচনাটি কৌতুহলের হয়ে উঠবে বলেই বিশ্বাস হয়, তেমনই আফ্রিকার সিনেমা সম্পর্কে একটি বিস্তারিত তালিকা তৈরি করে সিদ্ধার্থ বাবু একটি বড় কাজ করেছেন সিনেমা রসিকের জন্য। অপিরিচিত মহাদেশের দৃশ্য কবিতাকে স্পর্শ করার সুযোগ করে দেয় আলোচনাটি।
ছোট ছোট বাক্যের বিশেষণহীন গড়নটিকে মনে ধরে যায় সহজে। লেখক খুব সহজেই তাঁর কথাগুলিকে পাঠকের জন্য রেখে যেতে পারেন। সিনেমা রসিকের জন্য অত্যন্ত তৃপ্তিকর হয়ে দাঁড়ায় কথোপকথনগুলি। বস্তুত পক্ষে একটি ডায়ালগ চলতে থাকে গোটা বই জুড়ে।
বইটিকে সম্ভ্রমাত্মক দূরত্বে না রেখে বরং বইটির সঙ্গে আন্তরিকভাবে আলোচনা করা যায়। মিলিয়ে দেখা যায় নিজের দেখার অভিজ্ঞতার সঙ্গে।বইটি সিনেমা রসিকের পক্ষে একটি আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠতে পারে বলেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।
আলোচক একজন কবি,প্রাবন্ধিক এবং সম্পাদক
ভালো লাগলো। কবি সব্যসাচী মজুমদার আলোচনায় বইয়ের প্রেক্ষিতকে প্রসারিত করেছেন। ধন্যবাদ 🙏🏻