
রবীন্দ্রনাথ যেভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছেন অন্তর্জগত
সোমা দত্ত
“গ্যেটের মতো রবীন্দ্রনাথও একজন নন, এক শ জন মানুষ, আর কাব্যে যিনি ধরা দেন তিনিও একজন নন, অনেক ভিন্ন ভিন্ন কবির সমাহার। কবিতার কাছে যা আমাদের নূ্যনতম প্রত্যাশা শুধু সেটুকু মেটাতে তিনি আপত্তি করেন না; আবার তাঁর কবিতা আমাদের জন্য যা করতে পারে তার বেশি কোনো কবিতারই সাধ্য নেই।”
বুদ্ধদেব বসুর এই কথা হয়ত কিছুটা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমাদের যোগসূত্রের আবেগটাকে স্পষ্ট করে। সুধীর দত্তের বেশ কিছু কবিতায় ‘কায়ব্যূহ’ শব্দটির প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। কায়ব্যূহ অর্থাৎ একই সঙ্গে বহু দেহ রচনা অথবা ধারণ করা বোঝায়। এই প্রসঙ্গে এই শব্দটিকেও রবীন্দ্রনাথ আখ্যা দেওয়া যেতে পারে।
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের গদ্য ও পদ্যের প্রতি দোমনা মনোভাব রাখতেন। সমালোচনা করতেন যতখানি গলা ছেড়ে রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন তারও অনেক বেশি।বলেছিলেন, “উনি এসেই পড়েন, উপায় নেই।” এই এসে পড়াটা ঠিক কীরকম?
কার জীবনে প্রথম তিনি কীভাবে অনুপ্রবেশ করেন তার উপর সম্পর্কের সেই অস্থির আবেগের জায়গাটা তৈরি হয় না। জাগতিক যোগসাজশে কোনো পরিণতি পাওয়ার মতো বিষয় এটা নয়। বরং বলা যেতে পারে, এ এক আশ্চর্য কোনো মহাজাগতিক সন্নিবেশ, যে কারণে রবীন্দ্রনাথ যখন জীবনে প্রবেশ করেন, তখন পার্থিব টানগুলো খুব ছোট হয়ে পড়ে তাঁর উপস্থিতির কাছে। তাহলে কী মনের অপার্থিব বোধোদয়ে তার অবস্থান? ঠিক তাও নয়, কারণ এর কোনো নির্দিষ্ট পরিধি টেনে দেওয়া যাবে না। পার্থিবের মধ্যে দিয়েই অপার্থিব যে পাওয়া তাকে ওভাবে প্রকাশ করা অসম্ভব।
“অল্পবয়সে একটা সময় ছিল যখন ভাবতাম রবীন্দ্রনাথ কেবলই আমার, আর সেইটে ভেবে গর্ব হতো বেশ। আজ জানি রবীন্দ্রনাথ সবারই আপন। গর্ব আজ তাই বেড়ে যায় আরো।”
শঙ্খ ঘোষের অনুভব।
এই যে সবার আপন হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, এই যে রবীন্দ্রনাথের কায়ব্যূহ তাকেই স্পষ্ট করে বোঝার চেষ্টা চলে আজো।
যেমন বাগানের দড়িতে এক বালতি জামাকাপড় রোদে মেলতে মেলতে মা যখন গাইতেন ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা কর প্রভু’ বা হাওয়াই গিটারে সন্ধেবেলা সুর তুলতেন, আমার সোনার হরিণ চাই তখনই অজান্তে রবীন্দ্রনাথ ভিতরঘরে পা রেখেছেন কিন্তু সেই অবস্থান বোধের অতীত।
আবার ছোটবেলার সেই যে একখানি চটি বই ‘জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি’ যেখানে বালক রবির সঙ্গে পরিচয়কালীন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসুলভ যে ব্যক্তি এবং বিস্তৃতির সুবিশাল ক্ষেত্র, তার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ কিন্তু তৈরি হয় না।
জানি যে ওই বইয়ের ছেলেটির বড়বেলা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাকিজীবন কিন্তু সেকারণেই যে তাঁর ছোটবেলাকে পড়ছি, তেমন তো নয়। বরং সেই পাঠে দুইয়ের ছোটবেলার মধ্যে মিল আর অমিল খোঁজার তাগিদ বেশি ছিল। অর্থাৎ এই মিল অমিল খোঁজার বিষয়টা ভালো লাগছে তাই পড়ছি আর কী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটবেলা বলে বিশেষ আগ্রহ নিয়ে পড়ছি তেমন কিন্তু নয়। পড়তে পড়তে তাঁর ছোটবেলার সঙ্গে নিজের মিল পেলে আনন্দ, অমিলে আবিষ্কার।
এছাড়াও যা যা আমাদের উপর ন্যস্ত করা হত, যেমন রবীন্দ্রনাথের কবিতা, পাঠ্যপুস্তক, গান এসব দিয়ে ধীরে ধীরে রবীন্দ্রসাহিত্য অধ্যয়নের দিকে যেভাবে এগোনো হত, সেভাবে কিন্তু কবিগুরুর সঙ্গে কোনো স্বতঃস্ফূর্ত সম্পর্ক তৈরি হত না। কারণ আমাদের চেতনায় রবীন্দ্রনাথের প্রবেশ আকস্মিক ঘটে বলেই আমার ধারণা। অধিকাংশের জীবনেই কোনো না কোনো মুহূর্তে ঘটনাটি ঘটেছে, কিন্তু কেন এবং কোন মুহূর্তে তা দাগিয়ে দেওয়া সহজ নয়। এর কোনো ধারাবাহিকতাও নেই অর্থাৎ প্রতিজনের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ভিন্ন অনুষঙ্গে ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে। এর পিছনে কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা অনুশীলনের হাত নেই। প্রেম আর প্রণামের মধ্যে যে দূরত্ব তা পরিকল্পনা মাফিক অতিক্রম করা যায় না।
প্রথম সম্পর্কটা তৈরি করেছিল ‘পোস্টমাস্টার’। বারো তেরো বছর বয়সে, গল্পগুচ্ছ যারা পড়েছে তারা জানে রতন কীভাবে কাঁদিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তো পাওয়া আর না-পাওয়ার মধ্যে এক প্রবল অভিকর্ষ তৈরি করে, পাঠকের বুকে চিরকালের মতো পাথর চাপিয়ে দিলেন কিন্তু যন্ত্রণার ওই অতল অনুভব যে অসহনীয়। সে সহ্য করা কী এতই সহজ? কতবার যে মনে হয়েছে, ওই সেই ‘বর্ষাবিস্ফারিত নদী ধরণীর উচ্ছলিত অশ্রুরাশির মতো চারি দিকে ছলছল করিতে লাগিল…’ ঠিক ওই জায়গা থেকে নৌকোর গতি ঘুরিয়ে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সেই কোমলপ্রাণ রতনের কাছে ফিরিয়ে দিই পোস্টমাস্টারকে। রতনের মনে জেগে ওঠা ক্ষীণ আশাকে সত্য করে তুলি। এই যে সম্পর্ক বিচ্ছেদের করুণ টান এও তো মৃত্যুসম। এইখানে তবে তৈরি হল কবির সঙ্গে বাদানুবাদের পরিসর। এই সেই সূক্ষ্ম প্রবেশক মুহূর্ত।
এরপরে আসি রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার বিষয়ে যা ছোটবেলা থেকে শোনার মতো শ্রুতি সকলের তৈরি হয়না। বিশেষ করে প্রতি অনুষ্ঠানে যদি ‘মমচিত্তে নিতি নৃত্যে’ আর ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ গানের সঙ্গে হাত ঘুরিয়ে, চোখ ঘুরিয়ে কিছু গতানুগতিক ফর্মে নাচতে হয় আর সন্ধে হলেই বাড়ির মেয়েরা ওই একই গানে, সুরের উপর আরেক অধ্যবসায় এমন সিলেবাসসুলভ সুর চাপিয়ে গলা থেকে সুর ছুড়ে দেয় গোটা পাড়ার গৃহস্থ জীবনের সাঁঝবাতির আলোয়, তবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি টান তৈরি হয়না। আমার অন্তত হয়নি। একটু বড় হওয়ার পরে এই অভাববোধে পূর্ণ জীবনকে বিনবক্সে গোল্লা পাকিয়ে ছুঁড়ে দেওয়ার মতো মনে হতে পারে যদি সঠিক দরজা না খুলে যায়। প্রথমবার দরজাটা খুলেছিল স্কুলের এক বন্ধু। স্কুল ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্তে বিদায়ী বার্তায় গেয়েছিল, ‘যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা। নয়নে আঁধার রবে, ধেয়ানে আলোকরেখা…’ বড় হৃদয়প্রথিত এই শব্দের টান। দ্বিতীয়বার এই আবেদন নিয়ে এসেছিল বিক্রম সিং খাঙ্গুরা।
‘নয়ন তোমারে পায়না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে’। বিক্রম চলে গেছেন কিন্তু এক অমর আবেদন সৃষ্টি করে গেছেন এই গানটিতে। এও এক অপূর্ব সংযোগ। প্রিয়জনের মৃত্যু পরবর্তী সময়ে এই গানের সঙ্গে তৈরি করেছে অবিচ্ছেদ্য সংযোগরেখা। ‘নয়ন তোমারে পায়না দেখিতে’ এ যে কী এক অস্থিরতা, কী অদ্ভুত বেদনাগর্ভ থেকে জেগে ওঠা অনুরণন তা শুধু ওই গানই জানে। এইভাবে রবীন্দ্রনাথ জুড়ে নিয়েছেন এমনভাবে যে পরবর্তীকালে তাঁর ছবির দিকে অপলক তাকিয়ে মনে হয়েছে শতাব্দীর ওপারে বসে তিনি আমার উদ্দেশ্যেই লিখেছেন ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি’। এই যে সম্পর্ক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তৈরি হয়, এ কোনো সচেতন রবীন্দ্র-সাহিত্য চর্চা বা গবেষণা নয়। এই সম্পর্ক আত্মজনের অনুভব।
এবং আমি বলব শুধু একা রবীন্দ্রনাথই নন, তাঁর ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি যারা ধারণ করতে পেরেছেন তাঁরাও এই বন্ধনীর মধ্যে টেনে নিয়েছেন আপামর বাঙালি হৃদয়কে। এক বন্ধু কথা প্রসঙ্গে বলল, কোনো এক আষাঢ় মাসের কিশোরবেলায় তাঁর অন্তরে রবীন্দ্রনাথ এক অদ্ভুত কম্পন তৈরি করেছিল ‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে–আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে।’ গানের মধ্যে দিয়ে। এই কম্পন নাকি প্রতিবার তাকে ঠিক ওই দিনটিতে পৌঁছে দেয়। এবার যদি প্রশ্ন করি, এই গানটিই কেন? অন্য আরো কত গান ছেড়ে এই গানই কেন এত গভীরে পৌঁছল। এই পার্সোনিফিকেশনর কোনো ব্যাখ্যা নেই। এটি সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিনির্দিষ্ট।
রবীন্দ্রনাথের বেঁচে থাকার শৈলীর ধারাক্রম অনুসরণ করে পর্যায়ক্রমে জীবন এবং মৃত্যুর যে ঘনিষ্ঠ আঁতাত তাঁর রূপরেখাকে খুব সহজভাবে স্পষ্ট করেছেন রানি চন্দ ‘গুরুদেব’ বইতে। গুরুদেব আক্ষরিক অর্থেই সহস্র কোটি মানুষকে কাঁদিয়ে চলেছেন বাইশে শ্রাবণে সেই উনিশশো একচল্লিশ সাল থেকে। তাঁর চলে যাওয়া এক অসহনীয় অস্বস্তি। তাঁর মৃত্যুমুহূর্ত চিরকালীন যন্ত্রণা। আরও একবার যদি ফিরে যাই সেই লেখায়, যেখানে কম্পমান কলমে রানি চন্দ লিখছেন,
“গুরুদেবকে সাদা বেনারসী-জোড় পরিয়ে সাজানো হল। কোঁচানো ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি, পাট-করা চাদর গলার নীচ থেকে পা পর্যন্ত ঝোলানো, কপালে চন্দন, গলায় গোড়ে মালা, দু পাশে রাশি রাশি শ্বেতকমল রজনীগন্ধা। বুকের উপরে রাখা হাতের মাঝে একটি পদ্মকোরক ধরিয়ে দিলাম; দেখে মনে হতে লাগল যেন রাজবেশে রাজা ঘুমচ্ছেন রাজশয্যার উপরে।”
কী অদ্ভুত এই মনোবেদনা! জীবনের অজ্ঞাতে জীবনের উপরে যার মৃত্যু এমন ছায়া ফেলে সে কোন রবীন্দ্রনাথ!
প্রথম দশকের লেখক। একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক। এ-পর্যন্ত তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।