
যে পথে তুমি একা…
বেবী সাউ
আমাদের মফফসলে আর কিছু হোক বা না হোক, রবীন্দ্রনাথ পুরোপুরি ঘরের লোক ছিলেন। ঘরের লোক মানে যাকে দেখেও, দেখা হয় না। জেনেও না- জানার ভান— ঠিক তেমন! কিন্তু থাকেন। তিনি আছেন যতটা সত্য, তিনি না-থাকলে কিছু যায় আসে না— কিছুতেই এই ভাব আসে না। বরং বুকের ভেতর একটা দলা পাকানো কষ্ট থাকে। ভয় করে। হারানোর ভয়ে সারাদিন আরও একাত্ম হয়ে থাকা যায়। আমাদের বাড়ির দোতলার দীর্ঘ লাল রঙের বারান্দায় লেনিন, মার্ক্স, সুভাষ, গান্ধীজী কিংবা লালা লাজপৎ রায় থেকে জহরলাল নেহেরু পাশাপাশি থাকলেও সেখানে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আমাদের বাড়ির রান্নাঘরে মায়ের ঠুংঠাং খুন্তির শব্দে। পান্তাভাতে। কষ্টের সংসারে। আমার বাবার পড়ার টেবিলের পাশে অনাড়ম্বর ছোট এক তৈলচিত্র হয়ে। কিংবা আমার রামায়ণ-প্রিয় ঠাকুমার বালিশের নীচে। আমার দাদু রবীন্দ্রনাথের বুলি ঝাড়তেন শিক্ষা এবং আমাদের ঘরে প্রচলিত কিছু ধ্যান ধারণাকে পালটে দিতে। যদিও তারমধ্যে রবীন্দ্রনাথ কম থাকতেন। দাদু বেশি। পরে এসব জানা গেলেও তখন দাদুর কথাগুলোকেই রবীন্দ্রনাথ ভাবতাম। ফলে, আমরা আপত্তি না করে মেনে নিতাম। কেন মানতাম জানি না! তার মধ্যে একটা ছিল,” রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,পড়াশোনায় ভালো হতে গেলে রোজ দু’গ্লাস দুধ খেতেই হবে!” কিংবা হয়ত বলা হলো, ” রবীন্দ্রনাথ বলেছেন রোজ স্কুলে যেতে হবে”। এমনও শুনতে হয়েছে, “রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, গরমের দিনে গরম জলেই স্নান করতে হবে”… আর আমরা তখনও রবীন্দ্রনাথ না–পড়া হ্যাবলা ক্যাবলার দল সেইসব বাক্য মেনে নিয়ে দাদুকে কাম রবীন্দ্রনাথকে খুশি করার চেষ্টা করতাম। অবশ্য যখন রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছাই এবং যখন দেখি তিনি তার নিজের দুধের গ্লাস শ্যামাকে ধরিয়ে দিচ্ছেন, স্কুল তাঁর ভালো লাগছে না কিংবা গৃহশিক্ষক না আসার জন্য অদৃশ্য শক্তির কাছে করুণ আবেদন— এতদিনের দুধ খাওয়া সহ বাদবাকি সাধ্য সাধনা বিফল ও ব্যর্থ মনে হয়। পরে রবীন্দ্রনাথের “জীবনস্মৃতি ” যখন পড়ি তখন দাদু পরলোকে। অভিযোগ করার লোক নেই। কিন্তু সেই যে ‘রবীন্দ্রনাথ বলেছেন’ এবং রবীন্দ্রনাথ বলে একজন কেউ আমাদের আছেন এই অভ্রান্ত সত্য নিয়ে আমরা আমাদের চলা শুরু করেছিলাম। কারণ তখনও সত্য যে অভ্রান্ত হয় না, সে বিষয়ে আমার মনে কোনও সংশয়ই তৈরি হয়নি। রবীন্দ্রনাথ যে যুগে যুগে আমরা আবিষ্কার করছি শুধুমাত্র বিশ্বাসে নয়, ভালোবাসায় নয়, রবীন্দ্রনাথ প্রতি মুহূর্তে আমাদের ভাবনার জগতে বিপর্যস্ত করছেন বলে, এই জায়গাটুকু আমাদের মনে তখনও জন্মই নেয়নি। কিছুটা নতুন কোনও পরবের মতোই আমরা রবীন্দ্রনাথকে এক ঠাকুর বলেই মনে করতাম। কেন তিনি ঠাকুর, কী তিনি বলেছেন, কী তিনি লিখেছেন, তা বোঝার বয়স হয়নি। এ এক অদ্ভুত অবস্থা বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের, যে বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে যদি কেউ দেবতা হয়ে যান, তাহলে তাকে আর কোনও প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় না। বাঙালি তখন তাঁকে মনে রাখতে শুরু করে সন্দেহের ঊর্ধে থাকা কোনও ব্যক্তি হিসেবে। আর এখানেই হয়তো সেই আইকন বা ব্যক্তির মৃত্যু হয়। তবু ফিরে আসা যাক অতীতে।
একটু বড় হতে না হতেই আমাকে গান শেখাতে এলেন অতুল স্যার। ঢোলা পাজামা এবং সাদা পাঞ্জাবি— আলখাল্লার মতো কাপড় তাঁর। তিনি আমাকে আ এবং অ্যাঁ — সা থেকে নি -এর উচ্চারণ শেখাতে শেখাতে ঢাউস একটা হারমোনিয়ামের সামনে বসিয়ে প্রায় দু’ঘন্টা রেওয়াজ করাতেন। নিমরাজি আমি বসে বসে “ও ওরে গৃহবাসী… “-র গৃহবাসীকে টেনে যাচ্ছি। কিন্তু কিছুতেই এই টানা ঠিক হচ্ছে না। মনে মনে বিরক্ত হচ্ছি এবং রবীন্দ্রগান শিখব না ঠিক করেছি, তখনই স্কুলে আমার এক বান্ধবী জানালো, রবীন্দ্রনাথ শুনলে তার ঘুম পায়! কেন পায় এটার উত্তর আমি পেয়েছিলাম আমার এক অবাঙালি বন্ধুর কাছ থেকে। সে বলেছিল— রবীন্দ্রনাথ পড়লে দিমাগকে (মস্তিষ্ককে) এত বিস্তৃত করতে হয় এবং ভাবতে হয় যে, জং লাগা মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তে চায়! এই জায়গাটি নিয়ে কি তখন এতটা ভেবেছি? রবীন্দ্রনাথ পড়লে বা রবীন্দ্রনাথ শুনলে দিমাগকে বা মস্তিষ্ককে এতটা ভাবাতে হয়, যে কিছুক্ষণ পরেই ক্লান্ত হয়ে যেতে হয়! কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আসলেই তাই। রবীন্দ্রনাথ আমাদের মস্তিষ্কের ভিতরে ঢুকে আমাদের মননকে আক্রমণ করেন। এই মননকে আক্রমণ করা কখনও মনে হয় শান্তির আবেশ, আবার কখনও বোঝা যায় অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে উঠছে। সমস্যাটি হল, অনেকটাই প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মতো করেই আমরা রবীন্দ্রনাথকে পড়ি বা তাঁর গান গাই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল এক গভীর বিষাদের জায়গা। যে কোনও শিল্পী বা ভাবুক যিনি ভাবনার গভীরে প্রবেশ করেহেন একবার, তাঁর পক্ষে এই আপাত আনন্দকে সরিয়ে প্রকৃত বিষাদের কাছে পৌঁছে যাওয়াটাকে এড়িয়ে থাকা যায় না। ফলে,রবীন্দ্রনাথ পড়তে আমার কখনো ঘুম পায়নি। বরং বিনিদ্র রাতে তাঁর গানকে সঙ্গী করতে করতে কত কত প্রাণের কাছে ফিরে গেছি। কত কত আত্মহত্যা থেকে বেঁচে গেছি। কতবার যে হত্যা থেকেও বাঁচিয়েছি নিজেকে!
একাকীত্ব জীবনে, এই প্রবাসী জীবনে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বলেই হয়ত আমি মেনে নিতে এবং মানিয়ে নিতে পেরেছি। নতুন করে নিজেকে গড়তে গড়তে চলেছি। আমার মনে পড়ে, আমাদের বাড়িতে দুধ–কলা–ফুল–দুর্বো সাজিয়ে কোনো পূজার আসন কখনো পাতা হয় নি। কিন্তু রবীন্দ্রপুজো হত। তাঁর জন্মদিন। কিংবা বাইশে শ্রাবণ। আমার মা স্নান সারতেন। তাঁর ভেজা চুলের ডগায় বিন্দু বিন্দু জলের মুক্তো জমেছে। একটা লাল সিঁদুরের টিপ। হালকা রঙের শাড়ি। পড়ার ঘরের দেওয়াল থেকে রবীন্দ্রনাথকে বের করে আনছেন আমাদের বিরাট উঠোনে। একটা কাঠের চেয়ারকে ইতিমধ্যে সাজানো হয়েছে ধবধবে সাদা ধুতি পেতে। পাশে রাখা এক গোছা রজনীগন্ধা। ধূপের দানি। গন্ধ ছড়াচ্ছে। আর রবীন্দ্রনাথ আমার মায়ের হাতে চন্দনের টিপ পরে জন্মদিন সারছেন।
সেদিন, বাবাকে আমার সত্যি সত্যি রবীন্দ্রনাথ লাগত। সাদা পাঞ্জাবী পরে, শান্ত অথচ উদাত্ত কণ্ঠে ‘আফ্রিকা’ বলে যাচ্ছেন বাবা। আমার মা পায়েসের হাঁড়ি এনে রাখছেন উঠোনে। তারপর চোখ বন্ধ, তাঁর কন্ঠ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বেরোচ্ছেন। ” যে পথে যেতে হবে/ সে পথে তুমি একা/ নয়নে আঁধার রবে/ ধেয়ানে আলোকরেখা “। এই প্রবল গ্রীষ্মে, ফুটিফাটা গরমেও আমার মায়ের দু’চোখ বেয়ে কান্নার স্রোত বইছে। তিনি ধরা গলায় গাইছেন বারবার। রিপিট করছেন। ততক্ষণে দেখি, মা ‘রবীন্দ্রনাথ’ হয়ে গেছেন। আর সেদিন বুঝেছিলাম রবীন্দ্রনাথ গাইতে গেলে, রবীন্দ্রনাথ হতে হলে নিজের কাছে নিজেকে কাঁদতে হয়।
ধীরে ধীরে সময় পালটায়। জীবনে ব্যস্ততা ঢোকে। সংস্কৃতির পরিবর্তন হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ থেকে যান ঠিক তাঁর মতো করে। তাঁর রূপ নিয়ে। কিছুটা পরিবর্তিত কিছুটা অপরিবর্তিত। কিন্তু এখনো কিছু একটা করার আগে আমাদের দেখে নিতে হয় তিনি কী করেছেন! কিছু একটা ভাবতে গেলে সর্বপ্রথম ভাবতে হয় তিনি কীভাবে ভেবেছেন! আমাদের কিছু একটা শুরু হয় তাঁর কিছু একটা দেখেই। সে খুশী হোক কিংবা দুঃখ! আনন্দ হোক কিংবা বেদনা! একবার আমরা বেড়াতে গেছিলাম আরাকু ভ্যালি। বড় মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ। সেখানে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা বেশ কিছু টিলা জাতীয় পাহাড়। আমরা ঠিক করলাম, সেখানে উঠব। হাঁপাচ্ছি। উঠছি। হঠাৎ বোন গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলো, ” আকাশ ভরা সূর্য তারা…” সঙ্গে সঙ্গে হাঁপানি গায়েব। ক্লান্তি শ্রান্তি হতাশার প্রদেশ ভেঙে আমরা আনন্দিত মুক্ত প্রাণ। শুধু এক অবাঙালি পরিবার বলেছিল— কঁহা ডিজে বাজনা চাহিনে… আ গয়া রভীন্দ্রনাথ…
যখন ছোট ছিলাম রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আমাদের ‘দিন আনা দিন খাওয়া’ পরিবারের কাছের জন। শীতের দিনে একটা জামার ওপরে আরেকটি জামা, চপ্পল দু’টিকে ছুঁড়তে ছুঁড়তে চলা কিংবা জানলার ধারে বসে লাল মাটির পথে গরুর পাল নিয়ে হেঁটে যাওয়া রাখালটি যে আমাদের বড় চেনা জানা নরদাদা। তাঁর চপ্পল ছুঁড়ে ছুঁড়ে চলা আমাদেরও তাই। জুতো থাকলে আবার হাঁটা যায় নাকি! তাঁর তেঁতুল বিচি জমিয়ে তোলা আমাদেরও তাই। তাঁর পাহাড় বানানো আমাদের টিলা। তাঁর একা একা তেপান্তরের মাঠ খোঁজা, গ্রীষ্মের দুপুরে আমাদের শুধু মায়ের ঘুমের অপেক্ষা। প্রেমও এলো তাঁর কবিতার হাত ধরে। নিবেদনেও তিনি। ‘সাধারণ মেয়ে’ ভেবে অভিমান করতে শিখলাম আমিও।
রবীন্দ্রনাথ দূরের ব্যাপার হতে আরম্ভ করলেন যখন, আমার নাইন টেন। বাপ রে! কী সব প্রবন্ধ! কী সব আলোচনা! কী সব রক্তকরবী! এত জটিল! এত কঠিন! কী যে বলে লোকটা— যখন প্রথম মাথায় ঢুকল ততদিনে আমাদের রবীন্দ্রনাথ ‘ঠাকুর’ হয়ে গেছেন। দূরের কেউ। যাঁর প্রতি মুগ্ধ হওয়া যায় কিন্তু ছোঁয়া যায় না। তাঁর দিকে ছোটা যায় কিছু পৌঁছানো যায় না। যাঁর গানে কবিতায় নিজের শৈশবকে, কৈশোরকে, একাকীত্বকে, বিবেকের দংশনকে খুঁজে পাওয়া যায় কিন্তু তাঁকে নয়। তাঁর চিন্তা ভাবনায়, জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হওয়া যায় কিন্তু তাঁর দিকে তাকানোর অবসরটুকু আর পাওয়া যায় না। কিংবা তাকালেও চোখ ঝলসে যায়। প্রচন্ড সূর্যের দিকে তাকানোর মতো। দিশাহীন, বিভ্রম লাগে।
আর সেই রবীন্দ্রনাথকে খুঁজতে খুঁজতে
খোঁজ বেড়ে যায় আরও। ওইযে ছোটবেলা থেকে কানে এবং কন্ঠে ঢোকানো হয়ে গেছে, ‘ যে পথে তুমি একা…’ কিংবা ‘একলা চলো রে…’ তাই একা হাঁটার ভয়টুকু গায়েব হয়েছে যেমন তেমনি মনের মধ্যে প্রতিনিয়ত অনুরননের ফলে ‘একা’ হয়ে গেছি সঙ্গী সাথীদের কাছ থেকে। কাউকে সঙ্গে নেওয়ার কথাও কী মন থেকে সরে যায় নি? আর তখনই আরও আরও দীর্ঘ হয়ে ওঠে পথ। আর আমার লোভী জীবন ‘রবীন্দ্রনাথ’ হয়ে ওঠার জন্য পথে পা বাড়ায়… একা… একাই…